“মানি খেতে দাও,খুব খিদে পেয়েছে”,বেলা বারোটায় যখন অয়ন খেতে চাইলো মানিনীর রান্না তখন সম্পূর্ণ হয়নি।
ওরা সাধারণত আজকাল একটু বেলা করে ওঠে,সকালে উঠে করবেই বা কী! অয়নের অনলাইনে অফিস স্টার্ট হয় বেলা দেড়টা নাগাদ,শেষ হয় রাত সাড়ে নটায়। তাই সকালে উঠে চা খেলেও ওরা ব্রেকফাস্ট করে বেলা দশটার পর। আর সেই হিসেবে দুপুরের খাওয়া খায় একটা নাগাদ,তারপর অয়ন অফিসে অন হয়।
“কী খেতে দেব এখন? এই তো দশটার পর ব্রেড খেলাম আমরা।আর অন্য দিন তো একটার আগে খেতে চাওনা! আমার এখনও তরকারি বাকি”,মানি ওপেন কিচেনে নিজের কাজ করতে করতেই জবাব দেয়।
কয়েক সেকেন্ড…অয়ন চুপচাপ নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে একটু গলা তুলেই বলে,”আজ আমার খিদে পেয়েছে। রোজ সেই এক ব্রেড টোস্ট ছাড়া তো কিছুই জোটেনা।আজ আমি ব্রেড খায়নি,আর আমি জানি সেটা তুমি খেয়ালও করোনি।তোমার অত সময় কই?” অয়ন যেন ঝগড়া করবে বলেই তৈরি হয়ে এসেছে।
মানিনী এবার থমকে দাঁড়ায়। ও এতটাই অবাক হয়েছে কী উত্তর দেবে ভাবতে থাকে। এই লকডাউনের বাজারে যেখানে মানুষ দুবেলা খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই ফ্ল্যাট জীবনেও অর্ডার করে রসদ পেতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে,সেখানে অয়নের মত সেনসিটিভ মানুষ এধরণের কথা বলছে!!
মানি জানে অয়ন নিজের মাকে নিয়ে চিন্তিত,অফিসেও সম্ভবত কোনো সমস্যা চলছে,ওর সাথে সম্পর্ক ঘেঁটে আছে…সব মিলিয়ে অনেকটা পাল্টে গেছে। কিন্তু তাই বলে এরকম ব্যবহার…ও বিশ্বাস করতে পারেনা। কোনো উত্তর দিতে পারেনা ও।
“কী হলো যা হয়েছে তাই দিয়েই খেতে দাও”,মানিনীর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আরো অধৈর্য্য হয়ে ওঠে অয়ন।
মানি চুপচাপ একটা ডিম ভাজার জন্যে রেডি করতে থাকে,এবার অয়ন উঠে আসে কিচেনের সামনে।
“কী ব্যাপার কী? আমি কি মানুষ না,যে আমার কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছো না? তখন থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছি।
“ডিম ভাজছি।ডাল আর ডিম ভাজা দিয়ে দিচ্ছি।পাঁচ মিনিট দাও…”,নিজের কথা শেষ করতে পারেনা মানি তার আগেই অয়ন ফেটে পড়ে,”বেলা বারোটা বাজে।এখন অবধি শুধু ভাত,ডাল হয়েছে! এটা সংসার না হোটেল? আদৌ ইচ্ছে আছে তোমার সংসার করার…”,হঠাৎ মানিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় অয়ন। কী ইস্পাত কঠিন সেই দৃষ্টি। এই প্রথম মানিনীর চোখে ঘৃণা দেখতে পায় অয়ন,থমকে যায় ও।
আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। মাথার মধ্যে যেন ওর হাজারটা পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে মনে হয়।এতক্ষন মানিকে কী বলছিল,কেন বলছিল মাথা গুলিয়ে যায়।
আজ একমাস হলো মানিনী আলাদা থাকছে। অয়নের সাথে খাবার টেবিলে ছাড়া সম্পর্ক শূন্য। অয়নের যে আজ পনেরদিনের বেশি হলো প্রজেক্ট নেই,ও কাউকে বলতে অবধি পারছেনা।একটা অসহায়তা,একাকীত্ব,মায়ের কারণে বিবেক দংশন সব মিলিয়ে ও উগ্র হয়ে উঠছে নিজের মধ্যে। মানিনী আজ ওর কাছে সবচেয়ে বড় দোষী ওর এই অবস্থার জন্য। ও চাইছে নিজের সমস্ত রাগ অভিমান ক্ষোভ ওর ওপর উগরে দিয়ে ওর কথা গুলো শুনতে।
কিছুক্ষন পর ভাতের থালাটা অয়নের সামনে পৌঁছে দেয় মানিনী। ও মুখ দেখে অয়ন বুঝতে পারে ওর ভেতরে তোলপাড় চলছে,কিন্তু বুঝেও নিজের দোষটা স্বীকার করে মানিকে মানাতে ওর অসুবিধে হয়। নিজের ইগো কখন যে এতটা বড় হয়ে গেল ও নিজেও জানতে পারেনা।
অয়নকে যাহোক করে ভাত দিয়ে এসে মানিনী নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে। ও কিছুতেই নিজের পরিস্থিতি যেন মানতে পারছে না। আজ উৎসবের থেকেও অয়নকে অনেক বেশি অসহ্য লাগছে ওর। উৎসবের কাছে ফিরে যাওয়ার চিন্তায় ও যেমন পাগল হয়ে যেত,অয়নের থেকে মুক্তির চিন্তায় ও এখন তার থেকেও বেশি উতলা হয়ে পড়েছে।
বাইরের পৃথিবী ওর অসহায়তা যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। চাইলেও ও অন্য কোথাও যেতে পারছে না। হঠাৎ ওর মনে হলো চাইলেই বা ও যাবে কোথায়! এখন তো লিভ ইন এ থাকেনা।এখন ও বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ।
প্রচণ্ড কান্না পেল ওর। কয়েকমাস আগে অবধি যে ছিল ওর সবচেয়ে বড় ভরসা,ওর বন্ধু।আজ সেই যেন ওর উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে। ও জানে অয়ন ওর মা’কে কতটা ভালোবাসে, কিন্তু অহেতুক ওঁকে নিজেদের মাঝখানে আনার কোনো দরকার তো ছিল না। মানিনীর আজকাল কষ্ট হয় অয়নের ব্যবহারে। যে অয়ন ওকে প্রথম দেখায় আপন ভেবে নিয়েছিল,পাগলের মত খুঁজেছিলো, অকারণে ওকে বাইকের পিছনে বসিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াতো, আর কি কোনো দিন তাকে খুঁজে পাবে! বড্ড সেই অয়নের জন্যে মন কেমন করে ওর।বন্ধ দরজার আড়ালে কাঁদতে থাকে মানিনী। বিয়ের পর বদলে যাওয়া জীবনটা ওর মধ্যে যেন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আস্তে আস্তে মেরে ফেলছে। ও বুঝতে পারেনা আদৌ কোনোদিন আর ও ভালো থাকতে পারবে কি না!
ভাতের থালা সামনে নিয়ে কিছুক্ষন বসে থেকে উঠে পড়ে অয়ন। ভাত কেন কোনো খাবারই ওর গলা দিয়ে এই মুহূর্তে নামবে না। ও কেন এরকম করছে মানিনীর সাথে? শুধুমাত্র মা’কে ছেড়ে আসতে হয়েছিল সেই রাগ থেকে! না কি মানিকে পুরোপুরি পেয়ে যাওয়ার পর টান কমে গেছে।
কিন্তু মানি কে তো এখনও ভালোবাসে ও। হঠাৎ ওর মনেহয় সবার কথা ভুলে ওর নিজেকে নিজের সময় দেওয়া দরকার। ওর চিন্তা দরকার,ও কী চায় বোঝা দরকার। ও তো এতটা স্বার্থপর না।পনেরদিন প্রজেক্ট নেই। তাও ও নিজের ঘরে বসে কিছু না হোক মাল্টিপ্লেয়ার গেম খেলেছে,তাও মানিনীকে কোন হেল্প করেনি। দিনদিন ওর ব্যবহার ওকে অসভ্য করে দিচ্ছে। তার কারণ কী শুধু মা?
ও নিজেও হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে। বন্ধ হয়ে যায় ওর দরজা। মুখোমুখি দুটো বন্ধ দরজার আড়ালে থাকা মানুষ দুটো এই প্রথমবার নিজেদের সম্পর্কের কাঁটাছেঁড়া করতে শুরু করে নিজেদের মনে মনে। এককালে যে ভালোবাসা জীবনে সবচেয়ে দামী ছিল,তা হঠাৎ বোঝা হয়ে জীবন কেন তিক্ত করছে এটা নিয়ে ভাবা দরকার হয়ে পড়ে দুজনের ক্ষেত্রেই। আরও একবার দুজনের জীবনেই ভালোবাসার হারানোর ভয় এসে উপস্থিত হয়।
সারা দুপুর নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নেয় মানিনী। বিয়ের তিনমাসের মধ্যে এই দিন আসবে ও ভাবেনি। আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে কিচেনে ঢোকে ও।পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। এই বিকেল শেষে ভাত খেতে ইচ্ছে করেনা। দুপুরের ভাত ডাল ফ্রিজে ভরে নিজের জন্যে নুডলস বানাতে থাকে। কিন্তু এত কাজের মধ্যেও চিন্তারা মাথা ছাড়েনা। পরের সপ্তাহ থেকে অফিস যেতে হবে সপ্তাহে দুদিন সেই দুশ্চিন্তায় যখন ও মগ্ন,সেই পুরোনো সময়ের মত নিঃশব্দে অয়ন এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। প্রচন্ড অভিমানে যখন ও অয়নের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে হঠাৎ মনেহয় কাঁদছে ছেলেটা। মুহূর্তে অভিমান বদলে যায় উদ্বেগে। ততক্ষনে অয়নের বাহুডোর আলগা হয়ে গেছে। মানি ওর দিকে ফিরে দাঁড়াতেই অয়ন ওকে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়।জীবনে প্রথমবার মানিনী কোনো ছেলেকে ফোঁপাতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত আগের রাগের কথা ভুলতে না পারলেও অয়নের হঠাৎ এরকম ব্যবহারে ও জড়িয়ে ধরে ওকে। অবচেতনে ঘুরতে থাকে ওর মায়ের কথা।
ক্রমশ..