আরও একবার – অষ্টাদশ পর্ব

by Tamali

দিল্লিতে বৃষ্টি খুব একটা তীব্র হয়না। সারাদিন ধরে বৃষ্টি বা টানা দু তিনদিন বৃষ্টি হয় খুব গভীর নিম্নচাপ হলে। মানি শুনেছে আগে দিল্লিতে বর্ষা বলে কিছু ছিলোনা।শুধু সময়ে সময়ে তপ্ত ধূলিঝড় হত,তাতেই ক্ষনিকের ঠান্ডা হত মেদিনী।এখন তাও বাংলার বর্ষাকালে দিল্লীতেও কখনো সখনো বৃষ্টি নামে,আবার কখনো নামে শিলাবৃষ্টি। আজ ছুটির দিন ওর নতুন ঠিকানা ওর ফ্ল্যাটের ব্যালকনির দরজা দিয়ে সেরকমই শিলাবৃষ্টি দেখছিল ও। এই ব্যালকনির মুহূর্ত গুলো ও সময় পেলেই উপভোগ করে যখন খুশি।এই ফ্ল্যাটটা ওর বড্ড প্রিয় এখন।
আজ থেকে মাস দুই আগে উৎসবের কাছ থেকে মুক্তি পেতে অয়নকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়েছিল মানি বাধ্য হয়ে,উৎসবকে ফাঁকি দিতে।ঘনিষ্ট ভাবে পাবলিক প্লেসে উৎসবের সামনে বসে ভড়ং করেছিল।সেদিন ওর কাছাকাছি বসে নাটক জেনেও অয়ন যে স্বাভাবিক থাকতে পারেনি ইঙ্গিত পেয়েছিল মানিনী।
সৌরভ জব ছেড়ে ফিরে গিয়েছিল নিজের পরিবারের কাছে।কিন্তু অয়নকে দিয়ে গিয়েছিল একটু চাপ,বাড়ি ভাড়া। হঠাৎ একদিন কিছুটা রাত করে মানিনীর ফোনে অয়নের মেসেজ এসেছিল।
“তোমায় কী ভাবে কথাটা বলবো জানিনা।আর তুমি কী ভাবে নেবে তাও আইডিয়া নেই।তাও জিজ্ঞেস করি আমার ফ্ল্যাটমেট হতে তোমার আপত্তি আছে? এখনকার দিনে বিশেষ করে এই শহরে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার,কিন্তু তুমি…মানে… কী ভাববে বুঝতে পারছিলাম না বলে মেসেজ করলাম অনেক ভেবে। তুমি রাজি না থাকলে আমায় এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিতে হবে,একা এটার রেন্ট দেওয়া আমার পক্ষে সত্যি সম্ভব না।আর হ্যাঁ রাজি না থাকলে মেসেজটা ইগনোর কোরো”।
মেসেজটা একবার না দুবার তিনবার করে পড়ে ও বুঝতে চেয়েছিল অয়ন কী বলতে চেয়েছে। ও জানে দিল্লি কেন কলকাতাতেও ফ্ল্যাট শেয়ার করে দুটো ছেলে বা দুটো মেয়ে থাকতেই পারে।কিন্তু একটা ছেলে আর একটা মেয়ে একই ফ্ল্যাটে একসাথে থাকলে ফ্ল্যাটের আশেপাশের মানুষ হয়তো মাথা ঘামাবে না,কিন্তু বন্ধু বান্ধব পরিচিতরা,তারা শুনলে কী বলবে?বেশি করে দিল্লিতে ওর একজন লোকাল গার্জেন আছেন,সেই দীপককাকুরাও কী ব্যাপারটা সহজ ভাবে নেবেন! অয়ন ওর বন্ধু হলেও একটা ছেলে। কিন্তু ও এটা ভাবলো কীকরে? সব মিলিয়ে মানিনীর মাথা গুলিয়ে যেতে থাকে।
কিছুক্ষন ও চুপচাপ বসেছিল,একটাই প্রশ্ন খুঁজছিল অয়ন কী বলতে চাইছে?ও তো মানিনী কে চেনে বেশ কয়েকমাস,আর মানির বিশ্বাস ছিল ও ওকে বোঝেও।তাহলে এরকম অদ্ভুত প্রস্তাব ও কী করে দিলো ওকে।
আধ ঘন্টা এটা সেটা ভেবেও সঠিক উত্তর না পেয়ে ও সেই রাতেই ফোন করেছিল অয়নকে।
অনেক্ষন বাজার পর যখন মানিনী ভাবছে অয়ন ফোনটা ধরবে না,কান থেকে ফোনটা নামাতে যাবে শুনতে পেয়েছিল,”বলো”,অয়নের অস্বস্তি মাখানো ফ্যাসফেসে গলার আওয়াজ।
মানি সেই মুহূর্তে কী বলবে নিজেও বুঝতে না পেরে চুপ করে ছিলো কিছুক্ষন।অয়ন এবার অধৈর্য্য ভরা গলায় বলেছিল,”মানিনী? শুনতে পাচ্ছো?”
-“হ্যাঁ”।
-“বলো।কিছু বলবে?”
-“তুমি এরকম প্রস্তাব দিলে!”
-“হ্যাঁ।সমস্যা কোথায়?আমার ফ্ল্যাট মেট দরকার।আর ফ্ল্যাটমেট চেনার মধ্যে না হলে সম্ভব না তার সাথে এক ছাদের তলায় থাকা। এই মুহূর্তে এই শহরে তোমার সাথেই আমার মানসিকতা,দৃষ্টিভঙ্গি মেলে।তাই বলেছিলাম”। খুব স্বাভাবিক শুনিয়েছিলো অয়নের গলা।থমকেছিলো মানি কয়েক মুহূর্ত।কিন্তু অয়নের প্রস্তাব ওর মনে যে অস্থিরতা তৈরি করেছিল সেটা বেশিক্ষন চুপ থাকতে দেয়নি ওকে।
-“তুমি বুঝতে পারছো কী বলছো? আমার পরিবার,আমার চেনাশোনা মানুষজন এটা এত সহজে মেনে নেবে? তোমার কথাটা বলার আগে মনে হলোনা আমি তোমায় ভুল বুঝতে পারি?”
এবার চুপ করে থাকে অয়ন।আসলে যতই স্মার্ট দেখানোর ভান করুক ওর বুকের মধ্যে হার্টবিট যে রাজধানীর গতিতে ছুটছে সেটার কারণ তো শেষের প্রশ্নটাই।মানিনীকে ভালোলাগা দিয়ে শুরু হওয়াটা যে কবে ভালোবাসায় বদলে গেছে ও নিজেও বোঝেনি।কিন্তু যেদিন ফাঁকা ফ্ল্যাটে মানি ওকে জড়িয়ে ধরেছিল সেই দিনের পর থেকে সারাক্ষন একটা অনিশ্চয়তার ভয় ওকে তাড়া করে।
ও মৌমিতা কে ভালোবেসেছিল ঠিকই,কিন্তু ও যেদিন বিশ্বাসঘাতকতা করে ওর নিজের বেস্টফ্রেণ্ডের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো সেদিন খুব কষ্ট পেলেও সেটাই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছিল।সময় লেগেছিল ওই ঘটনা টা থেকে বের হতে,কিন্তু নিজেকে বুঝিয়েছিলো ওর তুলনায় ওর বন্ধু বেটার, আর সবার অধিকার আছে নিজের জন্যে সেরা বাছার।তাই দেরিতে হলেও ক্ষমা করে দিয়েছিল মৌমিতা কে।
কিন্তু পরিণত বয়সের ভালোবাসায় হয়তো আবেগের থেকেও বেশি থাকে বাস্তবতাবোধ,মানে জেনে বুঝে নিয়ে সম্পর্কে জড়ানো।ফলে নিজের জন্যে কাউকে পারফেক্ট মনে হলে ছেড়ে দেওয়ার কষ্ট অনেক বেশি হয়।আর সম্পর্কের ভিত্তি বন্ধুত্বের হলে মানসিক নির্ভরশীলতা দুর্বল করে অনেক বেশি।তাই মানিনী কে ছাড়া নিজের জীবনটা ভাবা দিনদিন কঠিন হচ্ছিল ওর জন্যে।অপেক্ষা আর সইছিল না,বলতে চাইছিল ও মনের কথা মানিনী কে।তাই অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়ে দেখতে চেয়েছিল মানি কী করে!
“আমি…আমি তোমায় ভালোবাসি আর জীবনটা তোমার সাথেই কাটাতে চাই।আমি জানিনা তুমি কী ভাব আমার সম্বন্ধে কিন্তু জানতে চাই।আর সেই কারণে…”,অয়ন কথাটা ঝোঁকের মাথায় বললেও শেষ করতে পারেনা।
“সেই জন্যে কী অয়ন!” মানি অয়নের ভালোবাসার প্রস্তাব শুনেও কী রিয়াক্ট করবে বুঝতে পারেনা।উল্টে তার সাথে ওর প্রস্তাবের কী যোগ বুঝতে না পেরে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে।
“মানি আজকাল লিভিং খুব কমন ব্যাপার।আমি কিন্তু লিভিং বলতে অন্য কিছু মিন করছি না।এক ছাদের তলায় কিছুদিন একসাথে থেকে আমরা এটুকু তো বুঝতেই পারবো আমরা একে অপরের পারফেক্ট চয়েস কিনা? আবারও বলছি লিভিং মানে ফ্ল্যাট-মেট হিসেবে কিছুদিন একসাথে থাকা।এতে আমরা একে অপরের খারাপটাও জানতে পারবো।তারপর যদি দেখি দুজনের মেন্টালিটি মিলছে তখন না হয়…”,আবারও থেমে যায় অয়ন কথার মাঝে।
মানিনী এতটা অবাক শেষ কবে হয়েছিল মনে নেই ওর।সেই অবাক মেশানো গলায় ও বলে,”আমি তোমায় পছন্দ করি কি না,আমি আদৌ ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবি না জেনেই তুমি দেখছি সব পরিকল্পনা করে ফেলেছ।বাহ দারুন! আর আমি বোকার মত তোমায় একটু অন্যরকম ভেবেছিলাম।বন্ধু ভেবেছিলাম।কিন্তু তুমি তো…”,মানি বাধা পেয়ে থামে।
“প্লিজ আমি তোমার শুধু ফ্রেন্ড হয়ে আর থাকতে পারছিনা।আরে ভাই আমারও তো একটা মন আছে।আর ভালোলাগা,ভালোবাসা হিসেব মেনে হয় না।আমি তোমায় ভালোবাসি,ব্যাস এটাই আমার মনের কথা।আর হ্যাঁ তুমি উৎসবের সাথে সম্পর্কে আছো জেনেও আমি সেই ভালবাসা আটকাতে পারিনি।রাজধানীর ওই জার্নির পর আমি পাগলের মত তোমার কলের অপেক্ষা করেছি।তারপর একদিন মন্ডি হাউস প্লাটফর্মে তোমায় সেম মেট্রো তে উঠতে দেখি,ময়ূর ভিহার এক্সটেনশন স্টেশনে নেমে পাগলের মত খুঁজি তোমায়,জানতাম না তুমি নিজের কাকার বাড়ি না থেকে পিজিতে আছো।তোমার সাথে আবার দেখা হওয়ার আশা যখন ছেড়ে দিয়েছিলাম তোমার ফোন আসে।তুমি জানো না সে রাতে আমার ঘুম হয়নি।তারপর প্রতি মুহূর্তে তোমায় ভালো রাখার চেষ্টা করে গেছি।সেদিন ফ্ল্যাটে তোমার জড়িয়ে ধরা আমায় ঠিক কতটা শান্তি দিয়েছিল তুমি কখনোই বুঝবে না।সেদিনের পর থেকেই মনে হয়েছে তোমায় বলি নিজের কথা।কিন্তু বলতে পারিনি। উৎসবের সামনে তোমার হাত ধরে অভিনয় করেছি তোমার মনে হয়েছে।কিন্তু সেদিন প্রতিটা মুহূর্ত আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হওয়ার অনুভূতিই এনজয় করেছি।মনে মনে ভেবেছি নাটক হলেও আমার কাছে তো সত্যি।তোমার অসহায়তা আমায় কষ্ট দেয়।তোমায় ভাঙতে দেখলে আমি ভেঙে যাই।আর তোমায় যে উৎসব কষ্ট দিয়েছিল একবার মনে হয়েছিল…।
মানি আমি তোমায় প্রথম দেখায় অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম।তোমায় না চিনে,না জেনেও মনে হয়েছিল তুমি আমার জন্যে বেস্ট।আমি তোমার জন্যে কী সত্যি ভাবিনি।আমি জানি এখন তুমি সব দিক দিয়ে বেটার আমার থেকে।তাই তুমি রিফিউজ করতেই পারো।কিন্তু আজকের পর আমার অন্তত এই আক্ষেপ থাকবে না আমি তোমায় নিজের কথা বলতে পারিনি।তাই আজকের পর আর কোনো রাগ থাকবে না নিজের ওপর।কিন্তু তুমিও মুক্ত,তুমি সিদ্ধান্ত নাও নিজের মর্জি মত”,একটানা সবটা বলে থামে অয়ন।
মানি কিছু উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে কিছুক্ষন,কিন্তু বুঝতে পারে ফোনের ওপারের মানুষটা কিছু শোনার অপেক্ষায় চুপ করে আছে।
“পরে কথা হবে,ফোন রাখলাম”,মানিনী কয়েক মুহূর্ত কিছু ভেবে ফোন কেটে দেয়।ও সেদিন বুঝেছিলো ফোন কাটার পর অয়নকে ঘিরে ধরবে একরাশ হতাশা।
একটা মেয়ে হয়ে কিছুই বুঝবে না,এতোটাও অজ্ঞ ও না।কিন্তু রাজধানীর ওই রাতের পর থেকেই অয়ন এভাবে ওকে খুঁজেছে কথাটা ওকে নাড়া দিয়ে গেছিল।
সেই রাতে চুপচাপ নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল ও,ঘুম আসেনি যদিও।
পরেরদিন সকালে উঠে সবার আগে মনে হয়েছিল ওর যেটা সবচেয়ে আগে দরকার,সেটা একটা ফ্ল্যাট।আর এই পিজির একবেডের জীবন ওর আর ভালো লাগছে না।
একটু ফ্রেস হয়ে ও বেরিয়ে পড়েছিল সেই আস্তানার ঠিকানা জোগাড় করতে।
মানিকে নিজের মনের কথা বলার পর ওর ব্যবহার অয়নকে বুঝিয়ে দিয়েছিল মানির না বলতে চাওয়া মতটা।মুখে যাই বলুক,আরও একবার নিজেকে গুছিয়ে নতুন করে ভালোবাসতে গিয়ে সফল হতে না পারার কষ্ট বুকের গভীরে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল।সারারাত কেটেছিল অদ্ভুত এক ঘোরে।ওর জীবনে না পাওয়ার লিস্ট ছোট ছিলোনা,কিন্তু সেখানে মানিনীর নাম যুক্ত করতে চায়নি ও।
যখন চোখের পাতা ভারী হল,তখন পূব আকাশ অন্ধকারের পর্দা সরচ্ছে।
ঘুমের মধ্যেই বেলের আওয়াজে মন বলছিল,’দূর সৌরভ দরজা খুলবে’।কিন্তু বারবার বেলের আওয়াজে এক সময় ঘোর যখন কাটলো মনে পড়লো,’সৌরভ তো আর থাকেনা এখানে।ও তো.. ‘।
অসম্পূর্ণ ঘুমে ক্লান্ত শরীরটা টেনে বিছানা থেকে তুলতে তুলতে ভাবছিল অয়ন, এই সকালে কে আসবে ওর ফ্ল্যাটে? মাসি তো ছুটির দিন বেলায় আসে,কুরিয়ারে কিছু অর্ডার নেই…লকটা ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঘুম ঘোরে যা কে সামনে দেখলো তাকে আশা কেন দুরাশাও করেনি।
“তুমি?” সেদিনের বলা অয়নের তুমি আজও কানে বাজে মানিনীর।এত অবাক কেউ হয়,ভাবেনি ও কখনো।দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকা অয়নকে নিজেই ঠেলে ফ্ল্যাটে ঢুকে এসেছিল সেদিন ও।অনেক বোঝাপড়ার বাকি ছিল,সেটাই ওকে অত সকালে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অয়নের ফ্ল্যাটে।চুপচাপ মানিকে অনুসরণ করে অয়নও এসে বসেছিল ড্রয়িং রুমে সোফাতে।
এক দৃষ্টে তাকিয়েছিল ও মানিনীর মুখের দিকে।ওর ঘুমঘোর চোখ,এলোমেলো চুল মানিনীর বুকে ঝড় তুললেও মুখে প্রকাশ করেনি কিছু।এলোমেলো চুল ,আর ক্লান্ত মুখচোখ বলে দিচ্ছিল সারারাত ঘুমোয়নি ছেলেটা।
নিজেকে কিছুতেই গুছতে পারছিল সেদিন মানি।বারবার একটা অদ্ভুত ইচ্ছে মাথাচাড়া দিচ্ছিল।অয়নকে আগেরদিনের মত জড়িয়ে ওর বুকে মুখ রাখতে ইচ্ছে হচ্ছিল প্রচন্ড ভাবে।কিন্তু ওতো অন্য হিসেব মেটাতে এসেছিল।একটু সময় নিয়ে মানি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো ওর মনের কথা।

ক্রমশ..

You may also like

1 comment

Anonymous July 14, 2024 - 12:21 AM

Daroon lagche

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!