আরও একবার – একবিংশ পর্ব

by Tamali

-কী ম্যাডাম কেমন কাটছে পুজো?ছুটি তো প্রায় অর্ধেক শেষ।অষ্টমী হয়ে গেল মানেই ফেরার ঘন্টা বাজছে।আমার অবশ্য অন্যবারের মত সেরকম মন খারাপ করছে না এবার”।
-“তাই নাকি! তা কারণটা কী জানতে পারি অয়নবাবু?”
-“উমম… ওই একটা পেত্নীকে অনেকদিন চোখের দেখা দেখিনি,তাই দেখতে পাবো এই আনন্দ বলা যেতে পারে”।
-“বাব্বা এদিকে তো একসাথে থাকলে আজকাল সারাক্ষন ঝগড়া করো।বিয়ে হওয়ার আগেই বরের মত শাসন,তার আবার মন খারাপ?”
-“আরে ওটাই তো সংসার আর ওটাই ভালোবাসা।দুটো মানুষ ভালোবাসবে,একসাথে থাকবে অথচ ঝগড়া করবে না।সে আবার হয় নাকি?”
-“আচ্ছা আচ্ছা।খুব বুঝি অভিজ্ঞতা সংসার নিয়ে।মা কে জিজ্ঞেস করো তো বাবার সাথে কত ঝগড়া করতো?”
-“মা কী তোমার মত ঝগরুটে নাকি? বাবা যা বলতো মা মেনে নিতো, বিশেষ করে খাওয়ার ব্যাপারে।এদিকে হিমোগ্লোবিন কমে গেছে,উনি এটা খাবেন না।ওটা খাবেন না।ঠান্ডা জল খেয়ে গলা ধরাবেন, অসময়ে স্নান করবেন…আর সব কিছু চুপচাপ মেনে নিতে হবে।যখন জ্বর হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকো খুব ভালো লাগে না?”
-“হুঁ! কে আমার দাঠাকুর এলেন রে?…”
-“কী,কী বললে? দাঠাকুর?…হাহাহাহা”,অয়নের হাসি আর থামতেই চায়না।
-“খুব হাসি পাচ্ছে না? তোমার আসলে আরো কুড়ি বছর আগে জন্মানো উচিত ছিল।তোমার হাবভাব ওরকম ই।প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি করলে এরকম এলোমেলো এত অনুভূতিশীল হলে চলে নাকি?”
-“মানে দাবীটা কী?এর সাথে প্রাইভেট সেক্টরে চাকরির কী সম্পর্ক? আমি মানুষটা হয়তো ঘরোয়া কিন্তু চাকরির ব্যাপারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিরিয়াস।তখন আমি পুরোপুরি ওই জগতের মানুষ।দেখবে এবারে কীরকম হাইক পাই আর সাথে প্রমোশন ও পাবো মনে হচ্ছে।”
-“এবারে মানে ডিসেম্বর তো না।সেই জুন নাগাদ।দূর ততদিন ট্রিটের অপেক্ষা পোষায়?”
হাসি মজা করতে করতে ফোনে প্রায় আধ ঘন্টা বকবক করার পর অয়ন বলে,”চলো এবার ফোন রাখি।মা কে বলেছি একটু ঘুমোতে যাচ্ছি বলে ওপরে এসে বকছি।আসলে আজ মায়ের দুই বান্ধবী এসেছেন আমাদের বাড়ি,মা এমনি ব্যস্ত।কিন্তু হঠাৎ ওপরে চলে আসে তাহলে মুশকিল হবে”।
“কেন মুশকিল হবে? বলবে আমার সাথে কথা বলছিলে।নাকি বলনি তোমার মা কে আমার কথা?” মানির গলার স্বর বদলায়। ছেলে গুলো সম্পর্কে আসে লাফাতে লাফাতে তারপর বিয়ে করে মায়ের মত নিয়ে,ওর পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানে ও।
“হমম সেটা তো বলতেই পারি।আর তাতে আমার মা কিছুই মনে করবে না হয়তো,কিন্তু ঘুমানোর নাম করে মাকে হেল্প না করে গল্প করছি বলে একটু দুঃখ পেতে পারে।আসলে আমার হঠাৎ কথা বলতে এত ইচ্ছে করছিল তোমার সাথে।একটু কথা বলতেই মনটা বেশ আরাম হলো।এবার নীচে নেমে মাকে হেল্প করতে পারবো।তাই বলছিলাম”,অয়ন জবাব টা এত সরল ভাবে দেয় মানির হঠাৎই মনটা ভালো হয়ে যায়।
“যাও এবার নিচে গিয়ে মাসিমা কে হেল্প করো।ওঁর বয়স হয়েছে,একা চাপ পড়বে।আর প্লিজ সারাজীবন এরকম ই থেকো,এরকম সহজ সরল সাধাসিধে।আমরা চাইলেও পারবোনা।এটা তোমার বিশেষ গুন।এতে ভুল বোঝাবুঝি হয়তো কোনোদিনও হবে না।লাভ য়্যূ”,নিজের ইমোশন কে আজ অনেকদিন পর বাঁধন ছাড়া করে দেয় মানিনী অন্য একজনের জন্যে,প্রথমবার অয়নের জন্য।
আর অয়ন এই প্রথম সরাসরি ম্যাজিক ওয়ার্ড নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে শুনে একটু হলেও শিহরিত হয়।মনেহয় জড়িয়ে ধরে মানিনীকে।বদলে ও নিজেও শুধু বলতে পারে,”লাভ য়্যূ টু।তুমিও বদলে যেও না।ছেড়ে চলে যেও না কখনো। রাতে আবার ফোন করবো।বাই”,ফোন কেটেও সিলিং এর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন শুয়ে থাকে ও ফোনটা বুকের ওপর নিয়ে।
মা কে মানির কথা ও খুলে কিছু এখনো বলতে পারেনি,তবে ওর মুখে মানিনীর নাম বার কয়েক শোনা হয়ে গেছে ওঁর।
ওর মা খুব চাপা স্বভাবের।অন্য মায়েদের মত যেচে কিছু বলার জন্য জোর করেনা।কিন্তু ও জানে ওর মনের সব খবর ওর মা রাখে।মৌমিতার প্রতি যখন ওর বন্ধুত্বের থেকেও বেশি কিছু অনুভূতি তৈরি হয়েছিল তার কিছুমাসের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিল মা।তখন শুধু বলেছিল,”এখনো কিন্তু অনেক পথ চলতে হবে।তাই সম্পর্ককে পরিণতি দিতে চাইলে সেই মত নিজেকে তৈরি কর”।আবার মৌমিতা চলে যাওয়ার পরও পাশে সেই মা’ই ছিল।
আজও হয়তো মানিনীর বিষয়টা বুঝেছে,কিন্তু যেচে কিছু বলেনি।
এবারের পুজোতে হঠাৎ একদিন একটা পুজো মণ্ডপে মৌমিতা কেও দেখলো ও।একটু যেন রোগা হয়ে গেছে।হাজবেন্ডকে সঙ্গে দেখতে পায়নি।উল্টে ওর মা কে দেখলো,কিন্তু ওর মা’কেও একটু অগোছালো লাগলো।মাসিমা সবসময় বড় টিপ পরে থাকতেন,আর চওড়া করে সিঁদুর।সেসব কিছুই দেখতে পেলোনা।হঠাৎ মনেহল,কিছু অঘটন ঘটে নি তো?
চমকে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছিল অয়ন ,ওর তাতে কী?মৌমিতাকে সামলানোর জন্যে ওর নিজের এখন অনেক লোক আছে।
মানিনী ওর থেকে প্রায় চারবছরের ছোট,কিন্তু আজকাল ওই যেন অয়নের অভিভাবক।অয়ন ওর খেয়াল রাখে,কিন্তু ও অয়নকে রীতিমত শাসন করে।বাইক চালাতে চালাতে ফোন ধরাই বন্ধ হয়ে গেছে শুধু মানিনীর বকুনির ভয়ে।সিগারেট খাওয়া নিয়ে ওর আপত্তি ওই ভাবে নেই,তবে বেশি খেলে তখন বকাবকি করে।দিনে বড়জোর দুটো।
ছুটির আর দিন সাতেক বাকি।কাল সৌরভের বাড়ি যাবে অয়ন।বেশ কিছুটা দূরে,সারাদিন কেটে যাবে।তাও একবার দেখা করে আসতে হবে ছেলেটার সাথে।চাকরি আর করেনি এখানে এসে কী সব ডিজিটাল মার্কেটিং শুরু করেছে।জিনিসটা ঠিক কী অয়নেরও জ্ঞান ভাসা ভাসা।কাল ভালো করে বুঝতে হবে।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে অয়ন।এবার নীচে যাওয়া যাক।মা’র কোনো দরকার না লাগলে একটু বন্ধুদের আড্ডায় ঘুরে আসবে।

“সুবু এই নে”,ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা ছেলের দিকে লুচির থালাটা এগিয়ে দেন উৎসবের মা।
আজকাল ছেলেটা বড্ড চুপচাপ থাকে।কথা খুব একটা বলেনা।কয়েকমাস আগে দিল্লি গিয়েছিল,ফিরে এক বন্ধুকে ধরে কলকাতায় একটা চাকরি জোগাড় করেছে।লেখালিখি আজকাল প্রায় করেই না।ভয়ে নিজের মা ও বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করেনা।কী হবে খুঁচিয়ে! তার চেয়ে বরং কাজকম্ম করছে,জোয়ান ছেলে বাড়িতে বসে নেই এতেই খুশি মা।
“আজ কী কোথাও বের হবি?এত তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচ্ছিস?”জিজ্ঞেস করবে কী করবে না ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করেই ফেলে উৎসবের মা।
“হুঁ একটা বন্ধুর বাড়ি যাবো।ফিরতে সন্ধে হবে”,নিজের মনের সাথে লড়াই করতে পারছে না ও।দিল্লি যাওয়া অনর্থক পয়সা খরচ ছাড়া কিছুই হয়নি।কিন্তু ও খবর রেখেছে মানিনী এখনো সিঙ্গেল ই আছে।যদি এনগেজড হতো,অন্তত ওর বাবা জানতো।মানি ওর বাবাকে কিছুই লুকোয়না।উৎসবকে জানতেই হবে কেন মানিনী ওর একটা ছোট ভুলকে টেনে ধরে বসে আছে।যে উৎসব ছাড়া কিছু বুঝতো না,সে আজ কেন উৎসবকে কিছুতেই ক্ষমা করছে না!
আর কথা বাড়ায় না উৎসবের মা।নিজের কাজে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে।
আর উৎসব খেতে খেতে ভাবতে থাকে পুরোনো সব কথা।প্রথম দিকে মানিকে ফেরানোর উদ্দেশ্য ছিল নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তামুক্ত করা,কিন্তু এখন এটা একটা জেদে পরিণত হয়েছে।ও ভাবেনি ও গিয়ে মানিনীকে ফেরার অপশন দেবে,আর মানি সেটা তাচ্ছিল্য সহকারে উড়িয়ে দেবে।
হেরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে দিল্লি ছুটেছিলো।কিন্তু সেখানেও যখন উপেক্ষিত হলো একটা জেদ চেপে বসলো মনে।সেই জেদ মানিনীর অবর্তমানে ওই বাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মাসখানেক আগে।মন গড়া কিছু গল্প আর মানির খুব কাছের এক বন্ধুর থেকে হিন্টস পাওয়া কিছু গল্প শুনিয়ে এসেছিল ওর বাবাকে।এমনকি ও অনুতপ্ত,বিয়ে করতে ইচ্ছুক মানিকে সেটাও বলে আসতে ভোলেনি।
“কিন্তু মানিনী এখন প্রাপ্তবয়স্ক।ওর সিদ্ধান্ত ও নিজেই নেবে।আমার এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই”,মানির বাবা যখন কথাগুলো বলছিল উৎসবের মনে আবার হতাশা ফিরে আসছিল।
“মেসোমশাই আমাদের এতদিনের সম্পর্ক এত সহজে শেষ হয়ে যেতে পারেনা।মানিনী এখন বুঝতে পারছেনা শুধুমাত্র অভিমানে।আমি জানি আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি,কিন্তু তখন ভেবেছিলাম আমার ওই রাগকে গুরুত্ব দিয়ে ও হয়তো চাকরি টা নেবে না।কিন্তু…”।
“দেখো উৎসব আমার মেয়েকে আমি স্বাধীনতা দিয়ে মানুষ করেছি।নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখিয়েছি।কিন্তু তুমি ওকে অত্যধিক কন্ট্রোল করতে চেয়েছিল সবসময়।আমার মনেহয়না আমার মেয়ে তোমার সাথে কখনো ভালো ছিলো বা ভবিষ্যতে ভালো থাকবে।প্লিজ তুমি আর ওকে ডিস্টার্ব কোরোনা।নাহলে আমি অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য হবো”,মানিনির বাবার এরকম গলা শুনবে উৎসব জীবনে ভাবেনি।মানি বারবার বলতো ওর বাবা খুব নিরীহ,চুপচাপ।একটু চমকেই ছিল ও সেদিন।
আজ ও শেষ চেষ্টা করবে,যতদূর যাওয়ার যাবে।হয় মানিনীকে মানিয়ে বাড়ি আসবে,নাহলে বাড়িই ফিরবে না।ওর এখনকার জীবন ওর কাছে অভিশাপ হয়ে গেছে।ওর লেখালিখি প্রায় বন্ধ।কী হবে লিখে?বর্তমান সময়ে লিখে কেরিয়ার করা সম্ভব না এটা ও বুঝে গেছে।একটা পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করা ওর মত ছেলের ধৈর্য্যে কুলোবে না।শেষ একবছর পেজে গ্রুপে লিখে কত প্রশংসা পেয়েছে,কিন্তু তার গুরুত্ব ওই সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ।যতই বড় বড় বিজ্ঞাপন দেওয়া হোক না কেন,দিনের শেষে পাণ্ডুলিপি সিলেক্ট হওয়ার পরও বলবে ইনভেস্টমেন্ট লাগবে।তাহলে পাণ্ডুলিপি পড়ে অতো গদগদ হলি কেন বা পাণ্ডুলিপি চাওয়ার সময়ই বা টাকার কথা বললি না কেন?
একটা চাকরি করছে ও ছোটখাটো।কিছু ভালো প্রকাশক আছে,কিন্তু হাতে গোনা আর তাঁদের ক্ষমতাও সীমিত।তাই তাঁরা চায় একদম টাটকা গল্প,ওসব সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা গল্প হবেনা।সবচেয়ে বেস্ট নিজের বই নিজে ছাপাও,আর তাই মানিনীকে কিছুতেই হাতছাড়া করলে হবেনা।
সব কিছু সৎ ভাবে হলে কী আর ওকে অসৎ চিন্তা করতে হত? এই দশটা পাঁচটার চাকরির জন্য ও জন্মায়নি।আর ওর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে শুধুমাত্র মানিনী ঘোষ।ওকে তাই শেষ চেষ্টা একটা করতেই হবে।উঠে পড়ে উৎসব ডাইনিং টেবিল ছেড়ে।হাতমুখ ধুয়ে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে ফেলে বেরিয়ে যায় নিজের বাড়ি থেকে।মা কে বলে বেরোনোর কথাও মনে থাকেনা।

ক্রমশ…

You may also like

1 comment

Anonymous July 24, 2024 - 12:23 AM

very nice

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!