আরও একবার-চতুর্দশ পর্ব

by Tamali

নিজের রুমে ঢুকতে ঢুকতেই প্রায় ন’টা বেজে যায় মানির। পেটে ততক্ষনে খিদের আগুন জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। আজ পিজিতে রাজমা চাউল রান্না হয়। একদম খেতে ইচ্ছা করেনা ওর।কিন্তু পেটের টানে ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়াতে যাবে আবার ফোন বাজতে শুরু করে।
পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে অয়ন,নিস্পৃহ মুখে কলটা ধরে ফোনটা কানে দেয়।
“বলো”,মানির গলার আওয়াজ বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগে অয়নের।
-“আমি আজ ফিরেছি মানিনী।কাল শনিবার একবার দেখা করা যাবে?”
-“আমি আধ ঘন্টা পর ফোন করছি তোমায়”,বেশি কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দেয় ও। পেটে খিদের আগুন জ্বললে কথা বের হয়না ওর মুখ থেকে।
খাওয়া সেরে ফ্রেস হয়ে যখন বিছানায় এসে বসে তখন প্রায় সাড়ে ন’টা। বাবা তখনও ফোন করেনি,মানে এখনো না খেয়ে ওর ফোনের অপেক্ষা করছে।দেরি না করে মানি প্রথমে ফোন করে নিজের বাবাকে।
-“হ্যালো”।
-“তুমি এখনও খাওনি বুঝি!”
-“না রে মা,এই তোর সাথে কথা বলে খেতে বসবো বলে অপেক্ষা করছি।তোর কথাই ভাবছিলাম”।
-“কী ভাবছিলে বাবা। এত রাত কোরোনা।শরীর খারাপ করলে কেউ দেখার নেই ওখানে”।
-“না রে মা কিছু হবেনা।তুই খেয়েছিস তো? অনেক রাত হলো।আর ওখানে ওয়েদার কেমন? এখানে বিকেল থেকে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে”।
বাবা যে কথাটা বলতে না খেয়ে বসে আছে,সেটা বলতে পারছেনা বুঝতে পারে মানিনী। তাই ও নিজেই কথাটা বলে,”উৎসব তোমায় কী বলেছে বাবা? ওর বাবা মা কে নিয়ে আসার কথা উঠলো কেন?”
কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় মানিনীর বাবা।
“এমনি সাধারণ কথা দু একটা বলে ফোন কাটার আগের মুহূর্তে হালকা চালেই কথাটা বলে। কোনো ভূমিকা ছিলোনা বলে আমি নিজেও কিছু বলার সুযোগ পায়নি।সে কারণেই তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।একটু অবাকই হয়েছিলাম বলতে পারিস। আর রাতে সেই জন্যে ভালো করে ঘুমোতেও পারিনি।তাই সকালেই তোকে ফোন করে ফেলি”।
“দেখো বাবা আমি জানিনা উৎসব কী চায়! তুমি তো সবই জানো। আমি প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। সেই সময় উৎসব ফোন করলে…জানিনা,হয়তো বা ওর জন্যে চাকরিটাও জয়েন করতাম না। কিন্তু এখন আর তার কোনোটাই সম্ভব না।এমনকি উৎসবকে পিছনে ফেলে আসার পর আমি যতবার ওই দিনগুলো কথা ভেবেছি দম আটকে এসেছে আমার। জানিনা আমার ভবিষ্যৎ কী, কিন্তু এই মুহূর্তে উৎসবকে নতুন করে মানিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এই কমাসে প্রবাসে থেকে আমার আবেগ মাপা হয়ে গেছে,আর অনেক বেশি প্রাক্টিক্যাল হয়েছি আমি। এখন ঠিক-ভুল, ভালো-মন্দ কিছুটা হলেও বুঝি।তাই উৎসব যাই ভাবুক এই সম্পর্ক আবার তৈরি হওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব না”,সোজাসুজি বলে মানিনী।
একটু থমকে চুপ করে যায় মদন ঘোষ। চাকরি পাওয়ার পর মেয়ের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে অনুভব করেছিল বাবা হিসেবে,কিন্তু এই পর্যায়ে মনের জোর দেখাবে ভাবেনি কখনো।অবাক হলেও মনে মনে খুশি হয়। আর হয়তো মেয়ের নরম মন নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা।
বাবাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলে মানি,”তুমি কিছু চিন্তা কোরোনা।আমি দরকারে উৎসবের সাথে কথা বলে নেব।শুধু ও আর ফোন করলে তুমি ফোন ধরো না।যাও রাত হলো,খেয়ে নাও।এখন আমি জানি কী ভাবে সত্যি ভালো থাকা যায়।বিয়ে সংসার তো সব না বাবা। আমি তাড়াতাড়ি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেব,আর তুমি এসে আমার কাছে থাকবে”।
“হ্যাঁ মা,তুই আমার সব।তুই ভালো থাকলে আমার কোনো চিন্তা থাকেনা।তুইও শুয়ে যা। কাল ছুটির দিন কথা হবে”,মানির বাবার গলায়ও নিশ্চিন্ত ভাব প্রকাশ পায়।
বাবার ফোন কেটে কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকে মানি নিজের খাটে।হঠাৎ চোখ যায় ওর রুমমেট মেয়েটার দিকে,অবাক হয়ে দেখছে ওকে।চোখে চোখ পড়তে মানিনীর হুঁশ ফেরে।অল্প হেসে খাট থেকে নেমে পড়ে,ফোন হাতে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় ওদের রুমের সামনের ব্যালকনিতে।
হঠাৎ মনে পড়ায় ফোন আনলক করে অয়নকে ফোন করতে যাবে,অয়নের নাম ভেসে ওঠে ফোনে,আর কানে লাগানো হেডফোনে বেজে ওঠে অয়নের নম্বরে সেভ করে রাখা রিংটোন।হালকা হাসি ফোটে মানির ঠোঁটে।ফোনটা রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে অয়ন বলে,”সরি মনে হলো তোমার মনটা ঠিক নেই,তাই তোমার ফোনের অপেক্ষা না করে আধ ঘন্টা হতে নিজেই ফোন করে ফেললাম”।
অবাক মানিনী গলার স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করেই বলে,”কী করে বুঝলে মন ভালো নেই আমার?”
“তোমার গলার স্বর…এই এখন যেমন অবাক হচ্ছো”,হাসতে হাসতেই বলে অয়ন।
“বাব্বা ফোনে গলার স্বর শুনে মনের ভাব বুঝতে পারো!!বিশাল ব্যাপার তো”,মানিও মুখে মুচকি হাসি টেনে বলে।
“হ্যাঁ মায়ের মন পড়ার চেষ্টা করতে করতে শিখে গেছি।একার জীবনে এই ফোনে কথাই তো সব,মানুষের মুখোমুখি আর দেখা করি কত!!তাই কান শোনে আর মন মুখ কল্পনা করে এক্সপ্রেশন বোঝার চেষ্টা করে।যাইহোক বলো এবার কাল একবার দেখা করা সম্ভব?”অয়ন ব্যাখ্যা শেষে প্রশ্ন করে,মানিনীর মুখটা আর কল্পনা করতে ইচ্ছা করছে না।বড্ড দেখতে ইচ্ছা করছে ওকে।
“হমম কাল ভাবছি দুপুরে বাইরে লাঞ্চ করবো।এই একঘেয়ে রাজমা,ছোলা, পরোটা খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পরে গেল”,মন ভালো না থাকলে ভালো কিছু খেতে ইচ্ছা করে ওর।
“তাহলে এক কাজ করো,যদি তোমার অসুবিধা না থাকে আমাদের ফ্ল্যাটে আসতে পারো।কাল সৌরভ দুপুরের দিকে কোথাও একটা যাবে,কিন্তু ফ্ল্যাটের বাথরুমে কাজ আছে তাই প্লাম্বার আসবে।আমি বিকেলে বেরোতে পারতাম,কিন্তু দুপুরে একটু ফ্ল্যাটে থাকতে হবে।তুমি এলে আমি কাল রান্না করবো, আজকাল চিকেনটা ভালোই বানাচ্ছি আমি”,কথা গুলো স্বাভাবিক স্বরে বললেও বুকটা ধুকপুক করতে থাকে অয়নের।ও একা থাকবে,ফ্ল্যাটে আসার নামে কী ভাবে রিয়াক্ট করবে মেয়েটা কে জানে!!
মানিনীও সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দেয়না।অয়ন ভাবে হয়তো কিছু খারাপ ভাবলো মেয়েটা ওর সম্বন্ধে,তাই সঙ্গে সঙ্গে বলে,”বিকেলে পাঁচটার পর হলে আমি বাইরেও মিট করতে পারবো’।
সৌরভ বেশিরভাগ দায়িত্ব নেয় জেনেও ওই মুহূর্তে ওর ওপর একটু রাগও হয় মনেমনে অয়নের,’শালা বাইরে যাওয়ার আর দিন পেলি না?’
“ঠিক আছে আমি এগারোটা নাগাদ পৌঁছে যাবে তোমাদের ফ্ল্যাটে,অ্যাড্রেস হোয়াটস অ্যাপ করে দিও।একটাই শর্ত আমি পৌঁছলে দুজনে রান্না করবো।যদি রাজি থাকো বলো”,মানিনী কৌতুকের সুরে বলে।
উত্তর দেবে কী উত্তেজনায় অয়নের হার্টবিট তখন ঘোড়া দৌড়োচ্ছে।
তাহলে এই অনুভূতি গুলো শুধু অল্প বয়সে প্রথম প্রেমেই হয় না।বারবার ভালো লাগা থেকে এরকম বুক ধুকপুক করে!
নিজের আবেগ সামলাতে সামলাতে ঘাম বেরিয়ে যায় অয়নের।গলা স্বাভাবিক রেখে চেষ্টা করে মানিনী কে উত্তর দিতে।
কথা চলতে থাকে।সময়ের দিকে খেয়াল থাকে না দুজনেরই।দুজনের পছন্দ অপছন্দ জানতে জানতে আরো ভালো করে পরিচিত হতে থাকে দুজনে।মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে বা আগে কখনো এই আড্ডাটা তৈরি হয়নি দুজনের মধ্যে,হয়তো আগে অন্য কারোর সাথেই মেশেনি ওরা এভাবে মন খুলে।বন্ধুত্ব দৃঢ় হতে থাকে,মন শান্ত হতে থাকে দুজনের।আরও একবার নতুন করে শুরু করার ইঙ্গিতও হয়তো থাকে দু’তরফেই।

ক্রমশ..

You may also like

1 comment

Anonymous July 13, 2024 - 9:56 PM

Daroon lagche

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!