আরও একবার – ত্রয়োদশ পর্ব

by Tamali

“মানিনী একটা মেইল তোকে ফরোয়ার্ড করলাম।একবার দেখিস তো।কিরে শুনলি?” মানির অফিসে ওর সমবয়সী আরেকটা বাঙালী মেয়ে আছে,সায়নী।
সায়নীর কথা মানিনীর কান অবধি পৌঁছলেও অত্যাধিক অন্যমনস্কতার কারণে মাথায় পৌঁছয় না।সপ্তাহান্তের ছুটিতে উৎসবের বারবার ফোন করতে চাওয়া যে ওকে চাপে রেখেছে ওর মুখের ভাব তা বলে দেয়।
“মানি…নী”,সায়নী একটু জোরে ডাকে এবার।
ঘোর কাটিয়ে ফিরে তাকায় এবার ও।
-“কিছু বলছিলি?”
-“কী এত ভাবছিস তুই? একটা মেইল ফরোয়ার্ড করেছি,দেখ।”
-“ওহ খেয়াল করিনি দেখছি দাঁড়া।”
-“কী হয়েছে কী তোর? এসে থেকে দেখছি অন্যমনস্ক। অয়নের সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি?”
-“অয়ন!! অয়নের সাথে ঝগড়া কেন হবে?”
-“কেন আবার? সম্পর্ক থাকলেই ঝগড়া হবে।সেটাই তো স্বাভাবিক।দেখ না আমার বয়ফ্রেন্ড তো রোজ ঝগড়া করে।এদিকে কথা না বলে থাকতে পারবে না,অথচ ঝগড়া করা চাই”।
-“অয়ন আমার খুব ভালো বন্ধু সায়নী।আগেও বলেছি তোকে। তাও কেন যে বারবার একই কথা বলিস…”
-“দেখ মানিনী আমি বোকা হতে পারি,কিন্তু নিজে পাঁচ বছর সম্পর্কে থাকার পর কোনটা শুধুই বন্ধুত্ব আর কোনটা তার থেকে বেশি এটা না বোঝার মত বোকা আমি না।অয়ন তোকে যে লাইক করে এটা আমরা সবাই বুঝি।কোন ছেলে তোর সামান্য দরকার পড়লেই ছুটে আসে রে? সেদিন তোর শরীরটা অসুস্থ হয়েছিল অফিসে এসে। ছুটির সময় বাইক নিয়ে হাজির।শুধু বন্ধু এতটাও কেয়ার করে?”
-“আরে ওইদিন ও এদিকে এসেছিল কী একটা কাজে।বলেওছিলো তো,তোর মনে নেই।”
-“তোর কী মনেহয় ও সত্যি বলেছিল।ওর চোখে মুখে উৎকণ্ঠা চোখে পড়েনি তোর? আর তুই নিজেও তো বলেছিস আজকাল তোর যা কিছু দরকার ওর সাহায্য ছাড়া তুই একা মেটাতে পারিস না।তোর মুখে দিনে কতবার অয়নের নাম শুনি বলতো? তোর কী মনেহয় ও শুধুই তোর ভালো বন্ধু? কী রে বল।”
মানিনী চুপ করে থাকে।একে উৎসবের চিন্তা,অন্যদিকে অয়ন।এটা তো ঠিক উৎসব হয়তো ফিরে আসতে চাইছে,কিন্তু মানি আর সেটা চায়না।যতবার উৎসব ওকে আগের কথা,ওদের কথা মনে করাচ্ছে তত যেন দমবন্ধ লাগছে ওর। উৎসবের ফোন ওর মনে বিরক্তি জাগাচ্ছে।আর ও সেই বিরক্তি উগরে দিচ্ছে অয়নের ওপর।শেষ দুদিন তো এটাই চলছে। অয়ন মায়ের অসুখের জন্যে গিয়েও শান্তি পাচ্ছে কই? অয়ন কাছে নেই,এক শহরে নেই,এই চিন্তায় এই দুদিন মানি ওকে যা বিরক্ত করছে ফোনে,পুরোটাই মানিনীর স্বভাব বিরুদ্ধ।
উৎসব ওর জীবনে শূন্যতা তৈরি করার আগেই অয়ন বন্ধুরূপে এসেছিল ওর জীবনে। কিন্তু মানি অবাক হলো ভেবে উৎসবের ওপর ও কখনোই এভাবে মানসিক নির্ভরশীল ছিলোনা। ছিল ওর ছোটবেলার বন্ধু ঋতুর ওপর,কিন্তু উৎসবের জন্যেই আজ সেই বন্ধুত্ব আর নেই।
হঠাৎ নিজের মনে চিন্তা করার ফাঁকেই চমকে ওঠে মানি। আরে ঋতুর সাথে অয়নের তো অনেক মিল,আর ঋতু যদি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারে তাহলে অয়ন কেন নয়!!
না,সায়নী বা অন্য কেউ যে যা ভাবে ভাবুক ও জানে অয়ন ওর কতটা ভালো বন্ধু।এরা বোঝেনা বন্ধুত্বের ওপরে আর কোনো সম্পর্কই এত সুন্দর হয়না। উৎসব ও তো ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল, কবে ও এতটা কেয়ারিং ছিল ওর প্রতি! নাহ, অয়ন ওর বন্ধু হয়েই থাক সারাজীবন।এত সুন্দর সম্পর্কটা ও কিছুতেই চায়না নষ্ট হোক।আর তাই এটাকে কিছুতেই জটিল হতে দেবে না মানি।অয়নের বন্ধুত্ব ওকে অক্সিজেন দেয়,নির্ভরশীলতা দেয়।উৎসবের দমবন্ধকর ভালোবাসার থেকে যা অনেক আলাদা আর দামী।
সায়নীর কথায় আলাদা করে উত্তর দেয়না ও,মন দেয় কাজে। যে ভাবছে ভাবুক,ও জানে সত্যিটা কী, আর এতেই ও খুশি। ওর মনের কাছে ও পরিষ্কার অয়নকে নিয়ে,আর ও জানে অয়ন ও এরকম ই ভাবে ওর সম্পর্কে।

“বাবু তুই আজই চলে যাবি? আর এক সপ্তাহ দেখনা, যদি বাড়ি থেকে কাজ করতে পারিস?” প্রতিমা দেবী আজকাল একা থাকতে একদম পছন্দ করেন না।ছেলেটা আরো দশদিন সঙ্গে থেকে মানসিক ভাবে যেন দুর্বল করে দিয়েছে।
“না মা,এই উইকেন্ডে না ফিরলে নেক্সট মানডে অফিস যেতে পারবো না…বিশাল চাপ হবে। তুমি তো বোঝ মা প্রাইভেট কোম্পানি গুলো কতটা স্ট্রিক্ট এসব ব্যাপারে? শুধু মায়ের বয়স হয়েছে,হোম টাউনে একা থাকে এটা বলে এ’কদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম পেয়েছি।নাহলে সেটাও…”,ট্রলি গুছতে গুছতে অন্যমনস্ক ভাবে বলে অয়ন।
শুধু অফিস না। মানিনী ও বড্ড মিস করছে ওকে বুঝতে পারছে অয়ন। এদিকে সৌরভও কী সব প্রবলেম করেছে অফিসে।কাল রাতে প্রচন্ড আপসেট ছিল,বলছিল এই কোম্পানি ছেড়ে দেবে। বস এমনি ভালো মানুষ,কিন্তু ওর সাথে একবার কারোর ঝামেলা হলে সে আর ওই কোম্পানিতে টিকতে পারেনা। নিজে তো বাস্তু ঘুঘু হয়ে ওই এক কোম্পানি আঁকড়ে বসে আছে আজ কুড়ি বছর।
সৌরভ বরাবর ঠোঁটকাটা,কে জানে কী বলতে কী বলেছে!
“তোমায় বললাম,কদিন ছুটি নিয়ে আমার সাথে চলো,সে তো শুনলে না। তবে তুমি ভেবোনা,এই তো ক’মাস পরে পুজো,আবার চলে আসবো ছুটি নিয়ে।মা তোমার প্রেসক্রিপশন টা দাও তো,যে ওষুধ গুলো শেষ হয়ে যাবে দুদিনের মধ্যে,কিনে দিয়ে যাই”,ট্রলির চেন টেনে উঠে দাঁড়িয়ে বলে অয়ন। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে,মায়ের ছলছলে চোখ ওর নজর এরায় না।
“এ কী মা তুমি কাঁদছো! এরকম তোমায় কখনো দেখিনি।আমার মনে কতটা চাপ পড়বে বুঝতে পারছো না? একেই তোমায় ছেড়ে দূরে সবসময় টেনশনে থাকি।তারওপর তুমি ভেঙে পড়লে আমি থাকবো কীকরে বলো?”
“বাবু তুই কী বুঝবি মায়ের জ্বালা! এত কষ্ট করে তোকে মানুষ করলাম,চাকরির কারণে বাইরে পরে থাকিস।কী খাস,কী করে দিন কাটাস বুঝিনা নাকি আমি? ত্রিশ হয়ে গেল এবার বিয়ে থা কর। তোকে সংসারী দেখলেও এই মায়ের প্রানটা জুড়োয়। তোর চিন্তাতেই আরো শরীর খারাপ করে আমার”, ছেলের বুকে মাথা রেখেই বলে স্বভাব শান্ত প্রতিমা।
“আচ্ছা মা করবো বিয়ে।আমায় আর কয়েকমাস সময় দাও। পুজোর সময় এসে তুমি যা বলবে আমি শুনবো”,মায়ের সাথে কথা বলার মাঝেই মনে ভেসে ওঠে মানির মুখটা। মেয়েটার মায়া ওকে বড্ড জড়িয়ে ফেলেছে। ভালোবাসা জীবনে বারবার আসে কী না ও জানেনা,কিন্তু মানি যে ওর জীবনে প্রকৃত ভালোবাসা এনেছে এটা ও অনুভব করে।
প্রতিমা দেবী যেন একটু হলেও শান্তি পায় ছেলের কথায়।ছেলের চুল ঘেঁটে একটু আদর করে বলেন,”কথা দিলি কিন্তু। আবার ভুলে যাস না”।
“ভুলবো না মা”,মৃদু হেসে মুখে এই কথাটা বললেও মন বলে আরো কিছু কথা,’…তোমায় একটা ভালো খবর দেব মা তখন।সেটা শুনলেই বুঝতে পারবে এই কথাটা ভোলা সম্ভব না’।

আজ অফিস শেষে মেট্রোর লাইনে দাঁড়িয়ে মনটা বড্ড অস্থির লাগছিলো মানিনীর। অফিসে আজকে একটা কাজে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছিল।ভাগ্যিস হিমাংশু চেক করতে গিয়ে দেখতে পেল,নাহলে কী যে হত…।
আসলে শেষ এক সপ্তাহ যা হচ্ছে…যে উৎসব ওকে একটা ফোনকল করে সব সম্পর্কের ইতি টেনেছিলো,ওকে কোনো কথা নিজের স্বপক্ষে বলার সুযোগ টুকু দেয়নি,সে কেন আবার সম্পর্ক জুড়তে চাইছে,তাও আবার ওর বাবার মাধ্যমে কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না মানিনীর।
রাজীব চক মেট্রো স্টেশনে আজ ভীড় বেশি,কিন্তু মানিনীর মানসিক অস্থিরতার কারণে ও ভিড় ঠেলতে পারছেনা।তাই ফাঁকা মেট্রোর অপেক্ষায় ও স্টেশন এলাকায় একটা বেঞ্চে চুপ করে গিয়ে বসে।
ওর হঠাৎ মনে পরে মাসখানেক আগে অয়নের সাথে বাইকে রাজীব চক (CP) আসার কথা,আর তার সাথে মনে পড়ে যায় সেই রাতে অয়নের মেসেজ গুলোর কথা।
অয়ন ওকে অনেক কিছু না বলেও যেন অনেক কিছু বলেছিল। বলেছিল মানির প্রতি ওর ভালোলাগার কথা। কিন্তু কোনো মেসেজ শালীনতার সীমা ছাড়ায়নি। আর সেই ভালোলাগা বন্ধুত্বের সীমা পেরিয়ে আর এগোয়নি।
মানিনী কে মেসেজ গুলোয় যা বলেছিল তাতে ছিল ওদের প্রথম দেখার পরেরদিন নিউ দিল্লি স্টেশনে দাঁড়িয়ে বলা কথার প্রতিধ্বনি।

হঠাৎ ওর ট্রাউজারের পকেটে স্মার্ট ফোনের ভাইব্রেশনে ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়।আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ভিড় সামান্য হলেও কমেছে।ঘড়িতে একবার নজর দিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ও।ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আবার মনে পড়ে যায় সকালে অফিস বেরোনোর আগে ওর বাবার সাথে হওয়া কথোপকথন।ঘড়ি বলছে এখন সময় প্রায় আটটা, মানে বাবার হিসেবে ও পিজির ঘরে পৌঁছে গেছে,তাই বাবা ফোন করছে এখন।
সকালের উত্তেজিত কথার পর এখন বাবার ফোন না ধরলে বাবা চিন্তা করবে সেই কারণে ফোনটা রিসিভ করে ও শুধু বলে,”আমি এখনো ফিরিনি বাবা।ফিরে ফ্রেস হয়ে ফোন করবো,ন’টা বেজে যাবে”।
বাবার উত্তর শুনে ফোনটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে ভরে ফোনটা,এগিয়ে যায় ওর স্টেশনের দিকে।
এই লাইনের মেট্রো এই সময়ে ফাঁকা পাওয়া সম্ভব না,তাও অপেক্ষাকৃত কম ভিড় আগের গুলোর তুলনায়। লেডিস সিট গুলোর সামনে নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়ে মানিনী আবার ডুবে যায় চিন্তায়।
সকালে যখন অসময়ে ওর বাবার ফোনটা আসে দুশ্চিন্তাই আগে মনে এসেছিল। কিন্তু ফোন ধরে বাবার স্বাভাবিক গলা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিল।
একটা দুটো একথা সেকথা বলার পর যখন মানি অফিসের দেরীর কথা বলে ফোনটা কাটতে যাবে ওর বাবা কিছুটা তাড়াহুড়ো করে বলে ফেলেছিল,”আমায় উৎসব ফোন করেছিল।ওর কাছে নাকি অনেক আগে থেকে আমার ফোন নম্বর ছিল,তাই একা থাকি বলে ভালমন্দের খোঁজ নিতে ফোন করেছিল।”
মানিনী বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে কিছুক্ষন কিছু বলতে পারেনি। ঘোর কাটিয়ে বলেছিল,”আর কী বললো?”
“বললো একদিন দেখা করতে আসবে। আমি বলেছিলাম ‘তুমি আমায় ফোন করছো মানির সাথে তো তোমার সম্পর্ক নেই’,শুনে বললো সব নাকি ঠিক হয়ে গেছে। কই তুই আমায় কিছু বলিস নি তো?” মানির বাবা কে বিস্মিত লাগে।
“কী বলব আবার? দু দিন ফোন করেছিল ব্যাস। কিছু ঠিক হওয়ার নেই এতমাস পরে,আর হবেও না। তুমিও আর ফোন করলে ধরবে না”,মানির গলার ঝাঁঝে কিছু আন্দাজ করে ওর বাবা একটু ইতস্তত করে বলে,”কিন্তু ও যে বলছিল একদিন ওর বাবা মা কে নিয়ে আসবে আমাদের বাড়ি।সেই জন্যেই তো তোকে এত সকালে ফোন করলাম।কাল অনেক রাতে ফোন করেছিল।আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…।”
সেই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় মানির।মনেহয় না চেয়েও আবার নাগপাশে জড়িয়ে যাচ্ছে ও।
“আমি রাতে ফিরে তোমার সাথে কথা বলছি।এখন অফিস বেরোতে দেরি হয়ে যাবে”,আর কথা বাড়াতে দেয়নি মানিনী সকালে। কিন্তু উদ্বেগ রয়েই যায় সারাদিন মনের মধ্যে।

ক্রমশ..

You may also like

2 comments

Anaya Chatterjee July 9, 2024 - 8:58 AM

Awesome🥰

Reply
Anaya Chatterjee July 9, 2024 - 9:00 AM

nice

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!