-“কী হলো?বারবার ফোন কাটছি তাও ফোন করছো?একটু ব্যস্ত আছি…”।
-“অয়ন…অয়ন…”,গলা বুজে আসে মানিনীর।
-“কী হয়েছে মানি কাঁদছো কেন তুমি?আঙ্কেল ঠিক আছেন তো?”
-“অয়ন,উৎসব…উৎসব”।
-“কী…কী করেছে ও?কী হলো বলো?মানিনী তুমি ঠিক আছো তো?কী করেছে উৎসব?ও তোমার বাড়ি গেছে?”
-“উৎসব আমাদের বাড়ি এসেছিল…আমায়,বাবাকে জোর করে ঢুকে পড়লো… বললো কথা আছে,শুনতেই হবে…কিছু শুনলো না…”।
-“তারপর?” মানিনীর গলা যত কাঁপে,কান্নায় বুজে আসে অয়নের চোয়াল তত শক্ত হয়।
-“একই কথা…তারপর ব্ল্যাকমেইল,নিজেকে শেষ করে দেওয়ার হুমকি…আমরা বিরক্ত হয়ে চলে যেতে বলতে…চলে যেতে বলতে…হঠাৎ করে নিজের বাঁ হাতের কব্জিতে ছুরি চালিয়ে দেয়”,আতঙ্কে আবার কেঁদে ওঠে মানিনী।আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনা অয়ন,ও বলে ওঠে “বাস্টার্ড! কাপুরুষ একটা।তুমি প্লিজ ভয় পেয়োনা।কোথায় এখন তুমি?”
-“হসপিটালে।আমার চাকরির কী হবে অয়ন?আমাদের বাড়ি এসে এসব করলো,এখন পুলিশ কেস হলে,আমি ফেঁসে যাবো।আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে”,কিছুটা নিজেকে সামলাতে পারলেও মানির গলার আতঙ্ক ওর কথায় প্রকাশ পেতে থাকে।
-“কিছু হবে না,তুমি ভয় পেয়োনা,আমি আসছি ঘন্টা খানেকের মধ্যে।তুমি শুধু হসপিটালের ঠিকানাটা মেসেজ করে দাও।”
-“অয়ন…অয়ন আমার খুব ভয় করছে।ও এরকম কিছু করবে…”,আবার গলা ধরে যায় ওর।
-“কিছু হবেনা,আমি আসছি।ততক্ষণ একটু সামলাও”,মুখে এসব বললেও আপাত শান্ত অয়নের মাথায় আগুন জ্বলতে থাকে।ও নিজে ছেলে হয়ে বুঝতে পারেনা একটা ছেলে কী করে এতটা নীচে নামতে পারে! ব্ল্যাকমেইল করে,মেন্টালি হ্যারাস করে কী করে জোর করতে পারে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্যে?এভাবে কি সম্পর্ক টেকে, না সুন্দর হয়?
ওর মায়ের বান্ধবীদের সাথে এক টেবিলে বসে খাচ্ছিল বলে মানিনী ফোন করতে বারবার কাটছিল।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছিল।কিন্তু মানিনীর সাথে কথা বলে বুঝতে পারলো কেন ও বারবার ফোন করছিল।
দেরি না করে ও ডাইনিং স্পেসে গিয়ে নিজের মা কে ইশারায় ভেতরে ডাকে।
“কী রে কী হলো!খাবার ফেলে উঠে গেলি,এখন আমায় ডাকছিস?” ওর মায়ের গলায় কিছুটা হলেও বিরক্তি প্রকাশ পায়,খাওয়ার টেবিল থেকে খাবার ফেলে উঠে যাওয়া ওঁর একদম পছন্দ না।
“মা মানিনী খুব বিপদে পড়েছে।ওর পরিচিত একজন সুইসাইড অ্যাটেম্প করার চেষ্টা করেছে ওদের বাড়িতে এসে।আমায় এক্ষুনি বেরোতে হবে”,প্রচন্ড চিন্তা প্রকাশ পায় ওর চোখে মুখে।
ওর মা একটু অবাক হওয়ার সাথে সাথে উদ্বিগ্নও হন,ছেলের আবার কোনো বিপদ হবে না তো।তবে উনি সেই সব মায়েদের দলে পড়েননা,যাঁরা অকারণে ছেলেকে যে কোনো বিষয়ে টেনে ধরেন।আর মানিনী যে এখন ছেলের জীবনে বিশেষ একটা জায়গা করে নিয়েছে এই কদিনে সেটা তিনি ভালোই আন্দাজ করেছেন।তাই আর কথা না বাড়িয়ে বলেন,”ঠিক আছে।তুই ওদের ঠিকানা জানিস তো?পৌঁছে ফোন করিস”।
“না ওদের বাড়িতে না সোজা হসপিটালে যাবো।মানি আড্ড্রেস পাঠাবে হোয়াটস অ্যাপ করে।ক্যাব নিয়ে নেব”,অয়ন অন্যমনস্ক ভাবে বলে।
“যা তাহলে চেঞ্জ করে বেরিয়ে পর।খাবি না তো আর?” ওর মা মনে মনে ভাবে লুচি তো খাওয়া হয়ে গেছিল,সিমুই টা নাহয় ফিরে খাবে।
“হ্যাঁ রেডি হয়ে নিচ্ছি।আর হ্যাঁ তোমার কাছে ক্যাশ হবে কিছু? এখানে ক্যাব ড্রাইভার গুলো ক্যাশ ছাড়া যেতে চায়না।আমার কাছে ক্যাশ তোলা নেই।হাজার দুয়েক দাও,এসে ফেরত দিয়ে দেব”,অয়নের এখানে এই সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি হয়।নয়ডা তে একটা চায়ের দোকানদারও অনলাইনে পেইমেন্ট নেয় আর এখানে ক্যাব গুলো অনলাইন পেইমেন্ট দেখলে ট্রিপ ক্যান্সেল করে দেয়।
“ঠিক আছে আমি টাকা আনছি।তুই রেডি হয়ে আয়”,অয়নকে উত্তর দিতে দিতে ওর মা নিজের বান্ধবীদের কাছে খাওয়ার টেবিলের দিকে পা বাড়ায়।
অয়নও ছোটে নিজের ঘরের দিকে।ওর যদিও স্থির বিশ্বাস উৎসব শুধু মাত্র ভয় দেখাতে এই কাজটা করেছে।দেখা যাক কতটা কী ক্ষতি করতে চেয়েছে ও ওর নিজের।
এসব ভাবনা চিন্তার মাঝে মায়ের থেকে টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ও মিনিট পনেরোর মধ্যে।গুগল ম্যাপ বলছে মানিনীর পাঠানো ঠিকানায় পৌঁছতে প্রায় এক ঘন্টা লেগেই যাবে।
“কী বলবো তোমায় অয়ন! আজ তুমি না থাকলে…মানি আর আমি দুজনেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম খুব।তুমি ঠিক সময়ে না এলে…”,মানিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বেরোতে যাবে ওর বাবা কিছুতেই না খেয়ে বেরোতে দিলেন না।সকালের তরকারি,ময়দা মাখা সব ফ্রিজে তুলে রেখেছিলেন,তাই অয়নকে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা।
তার মাঝেই মানিনী যখন বাবাকে বসিয়ে লুচি ভাজতে গেছে মদন ঘোষ ব্যক্ত করে ফেললো মনের কোণে লুকিয়ে থাকা উদ্বেগ।
“না আঙ্কেল আমায় কিছুই করতে হয়নি।উৎসব ছেলেটা সম্ভবত নিজেও জানতো হাতের কোনখানটা ছুরি চালালে রক্তের ফিনকি ছুটলেও মারাত্মক ক্ষতি হবে না।ডাক্তার সেই জন্যেই তো ওকে বিকেলে ছেড়ে দিলো।এই অবস্থায় ওকে কিছু বললে সেটা পরে সমস্যা বাড়াতো।কিন্তু ওর মা’কে যা বলার দরকার ছিল আমি বলেছি।জানিনা এরপরও ওর লজ্জা হবে কী না!” অয়ন হাসিমুখেই কথা গুলো বললেও ওর মনের মধ্যে রাগের আগুন জ্বলতে থাকে।
উৎসবটা একটা কাপুরুষ।ওর মা কে দেখে অয়নেরই খারাপ লাগছিল।তাও যতটা পেরেছে বুঝিয়েছে।উৎসব মানিনীকে ভালোবেসে যদি এই কাজটা করতো তাও মানা যেত,ও করেছে নিতান্তই ব্ল্যাকমেইল করতে।মানির মুখে যতটুকু শুনেছে অয়ন উৎসব কোনো প্ৰায়োর নোটিস ছাড়াই ওদের বাড়ি চলে আসে।তারপর জোর করতে থাকে বিয়ের জন্য।যখন মানিনী মুখের ওপর ওকে ওর দোষগুলো বলে,সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসা কঠিন হলেও বেরিয়ে এসে ও কত ভালো আছে বলতে থাকে উৎসব হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।তখন মানিনীকে ভয় দেখায় যে চাকরীর জন্য ও উৎসবকে আজ ছেড়ে দেওয়ার সাহস দেখাচ্ছে সেই চাকরী ওর অনিশ্চিত করে দেবে ও।
বলতে বলতে নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করে কব্জির উল্টো দিকে চালিয়ে দেয়।রক্ত অনেকটাই বেরিয়েছিল,কিন্তু ডাক্তার বলেছে ওটা চামড়া কাটার রক্ত।আর তাছাড়া হাতের কব্জিতে ছুরি চালিয়ে জীবন শেষ করা অতো সোজা না।
“যাইহোক বয়স হয়েছে তো,আর এত উত্তেজনা সহ্য করত পারিনা।আগে একবার ও আমায় ফোন করেছিল এই একই কথা বোঝাতে,আমি গুরুত্ব দিইনি।আজ তাই বাড়ি বয়ে চলে এসেছিল।জানিনা মানি এই ছেলেকে বিয়ে করলে ওর ভবিষ্যৎ কী হতো,কিন্তু আজকের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি বলবো খুব বেঁচে গেছে আমার মেয়ে।এই ধরণের ছেলেরা সাইকো হয়।এদের সাথে সংসার করা খুব মুশকিল।আর এদের জীবনে কমিটমেন্ট বলেও আসলে কিছু হয়না।…”,মানিনীর বাবা মানিকেও বলেনি উৎসব মাস খানেক আগে এবাড়িতে আরেকবার এসেছিলো।
মানিনীর বাবার বাকি কথা কানে ঢোকেনা অয়নের,মনে পড়ে যায় উৎসবের সাথে বড্ড মিল পায় ও ওর জন্মদাতার ব্যবহারের।ওর মায়ের কাছে শুনেছে ওর বাবাও ওর মাকে সবসময় সুইসাইডের ভয় দেখাতো।বড্ড বেশি ডমিনেট করতো ওর মা’কে।কিন্তু বিয়ের কুড়ি বছর পর অন্য মহিলাতে আসক্ত হয়ে কত সহজে ওদের ছেড়ে চলে যায়।
অয়নের ভাবনার জাল কাটে সেন্টার টেবিলে লুচির থালা নামানোর শব্দে।তাকিয়ে দেখে মানিনী ওর দিকে তাকিয়ে ওকে পড়ার চেষ্টা করেছে।ওদের কয়েকমাসের সম্পর্কে সেই অর্থে শারীরিক সম্পর্ক হয়তো গড়ে ওঠেনি।কিন্তু দুজনে একে অপরের কাছাকাছি এসেছে বেশ কয়েকবারই।মানিকে জড়িয়ে ধরে থাকতে থাকতে ওকে নিজের বুকে চেপে অয়ন এক দুবার নিজের অনিশ্চয়তা বলেও ফেলেছে,যার মূলে আছে ওর নিজের অতীত।ওর বাবার ব্যবহার ওকে ভালোবাসা সম্বন্ধে বিশ্বাসের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল,আর মৌমিতা সেটা প্রকৃত অর্থে ভেঙে দেয়।তারপরও মানিকে দেখে অয়ন যে দুর্বল হয়েছিলো সেটাই অয়নের মনে নিশ্চিত করে মানিনী ওর ভবিষ্যৎ।
মানিনীও ভেবেছে ওর বাবাকে এবারে ওদের সম্পর্কের কথা বলে দেবে।কিন্তু আজকের ঘটনা ওর বাবাকে না বলতেই অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়।
অয়নের সাথে চোখাচুখি হয় মানির,ও মৃদু হাসে।নিজের বাবার চোখকে এড়িয়ে চোখের ইশারায় জানতে চায় অয়নের মুখের এমন অবস্থা কেন? অয়নও ইশারায় বলে কিছু না।
আজ অয়ন বুঝতে পারে সম্পর্কে ভরসা,বিশ্বাস এগুলোর মূল্য কতটা! একটা সম্পর্ক বছরের হিসেবে পরিণত হয়না।পরিণত হয় পারস্পরিক বোঝাপড়া দৃঢ় হওয়ার মধ্যে দিয়ে।কিছু সম্পর্ক প্রথম থেকে শক্তপোক্ত হয়,আর কিছু আজীবন নড়বড়ে থেকে যায়।ঝগড়া ঝাঁটি,রাগারাগি,মন কষাকষি তখনই সম্ভব যখন তাতে প্রাণ থাকে।আর যেখানে এসব কিছুই নেই সেখানে থাকে হয় মেনে নেওয়া নাহয় মানিয়ে নেওয়া।তাই মতের পার্থক্য হয়না সেখানে।
তবে ঝগড়ার পর ভালোবাসাটাও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।যেখানে শুধুই ঝগড়া আছে,কিন্তু তার মিটমাট নেই সেখানে সম্পর্ক মরতে শুরু করে।যেমন ওর আর মৌমিতার হয়েছিল।ওদের সম্পর্কে প্রথমে ঝগড়া হতনা, আর শেষের দিকে ঝগড়া মিটতো না।
ও মানিনীর সাথে যেচে ঝগড়া করে,ঝগড়া মেটার পরের মুহূর্তটার লোভে।
মানিনীর বাবার অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারে তিনি শেষ ক’মাস যা আন্দাজ করেছেন তা ভুল না।অয়ন ছেলেটাকে দেখার ইচ্ছা তার মনে মনেই ছিল।একদিক থেকে ভালো হলো সেই ইচ্ছা পূরণ হলো।মহাঅষ্টমীর দিন মনে মনে তিনি মা কে প্রণাম জানান,তার মা মরা মেয়েটা এতদিনে একটু ভালো আছে ভেবে বাবার মন খুশি হয়।মনে মনে ঠিক করে মদন ঘোষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অয়নের মায়ের সাথে দেখা করবে।
মা দুর্গা হয়তো চাইলেও সমস্ত অপশক্তির বিনাশ সহজে করতে পারেনা,কিছু শক্তির কুপ্রভাব কখনো কখনো সমগ্র মানবজাতিকে অসহায় করে দেয়।সেই বছর মা দুর্গা হয়তো নিজেও বোঝেনি কী আসতে চলেছে আগামী দিনগুলোতে!
মানুষের দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা প্রকৃতির অঙ্গুলি হেলনে যে স্তব্ধ হতে পারে মানিনী অয়নের বাড়ির লোকের সাথে সমগ্র মানব জাতিও নতুন করে পরিচিত হলো।এই দুর্গাপুজো কিছু মানুষের জীবনে শেষ দুর্গাপুজো হয়ে রয়ে গেল।
ক্রমশ…
1 comment
next plz