“অনেক্ষন অপেক্ষা করছেন?” মানিনী ওর অফিসের সবচেয়ে কাছের মাল্টিকুইজিন রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখে অয়ন অলরেডি পৌঁছে গেছে।
“না এই ঘন্টা খানেক হলো”,বলে মুচকি হাসে অয়ন।যদিও সময়ের প্রায় এক ঘন্টা আগে পৌঁছে ঘন্টা দুয়েকের ওপর অপেক্ষা করছে ও মানিনীর জন্যে।আজ অফিসটা ডুব মেরেই দিয়েছে ও চুপিচুপি।
“সরি সরি।আসলে লাস্ট মোমেন্টে একটা এমন কাজ এসে গেল…চলুন চলুন ভিতরে যাই।অফিস থেকে আসছেন?” নিজেই আগে রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে মানি।
একটু অবাক হয়েই আজ মানিকে দেখছিল অয়ন।সেই তিনমাসের আগের ভীতু চুপচাপ মেয়েটা আজ যেন অনেক সাবলীল।ভেতরের জড়তা অনেকটা কম।আর যেটা চোখে পড়ার মত সেটা এই তিনমাসে ওর আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তন,অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ওর কথাবার্তায়,যেটা আগের দিন ফোনেই অনুভব করেছিল ও।
সেদিন রাতের ফোনটা এতটাই আশাতীত ছিল যে অয়নের মুখের ভাষাই প্রথমে থমকে গিয়েছিল।কিন্তু ওপাশ থেকে মানিনী যখন ওকে মনে করানোর চেষ্টা করলো ওর মনের ভিতর থেকে কে যেন বললো,”আমি তোমাকে ভুলিনি।তাই মনে করাতে হবেনা।”
প্রত্যুত্তরে হেসে উঠেছিল মানি,ওর হাসি বরং অবাক করেছিল অয়নকে।মেয়েটা তো পুরো ট্রেন জার্নিতে একবারও এরকম প্রাণখোলা হাসেনি!!
কিন্তু কৌতুহল দেখায়নি ও।উল্টে সেদিন ও ছিল অনেক চুপচাপ,কথা বলতে দিচ্ছিল মানিনী কে।
“আসলে প্রায় তিনমাস কেটে গেছে,আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো ভুলে গেছেন,মনে করানোর চেষ্টা করছিলাম।আমি আসলে নম্বরটা ফোনে সেভ করার আগেই কাগজটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, পেলাম আজ প্রায় তিনমাস পর।দুপুরে পেয়েই ফোন করেছিলাম কিন্তু…ফোন বেজে বেজে কেটে গেল…”,মানিনীর শেষের লাইনদুটো শুনে অয়নের মনে পড়েছিল অচেনা নম্বর থেকে আসা ফোনটা ও ধরেনি স্প্যাম ভেবে।নিজের ওপরই রাগ হয়েছিল ওর।মানিনীকে থামিয়ে দিয়ে ও বলে উঠেছিল মিথ্যে টা,”হ্যাঁ আসলে ওয়াশরুমে ছিলাম আর ফোন চার্জে ছিল…তাই হয়তো…”।
“আরে ঠিক আছে।আমি এমনিও তখন ভেবেই রেখেছিলাম রাতে আর একবার চেষ্টা করবো।জানেন তো আমি কিন্তু এখন দিল্লিতে”,মানিকে অনেক বেশি সপ্রতিভ লাগছিলো।
‘জানি।দেখেছি তোমায়’,বলতে চেয়েও বলতে পারেনি অয়ন।বলতে পারেনি ওর পাগলের মত খুঁজে বেরানোর কথা।উল্টে উত্তর দিয়েছিল,”ও আচ্ছা।কবে এলে?কোথায় আছো?” শেষ প্রশ্নটার সাথে কৌতুহল মেশানো ছিল,সেই রাতেই ধাঁধাটার উত্তর খুঁজতে চেয়েছিল ও।
“এই তো মাস খানেক হবে জয়েন করেছি।আমি আছি ময়ূর ভিহারে পিজিতে।আমার আঙ্কেলের বাড়ি এক্সটেনশনে বলেছিলাম না।উনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।এই ব্যাগটা ছিল কাকুর বাড়িতে,আমার এখানে জায়গা কম বলে।আজ ওর থেকেই কাগজটা হঠাৎ পেলাম।সেদিন খেয়াল করিনি,আপনার হাতের লেখাটা কিন্তু মুক্তোর মত”,নিজের প্রশংসা,তাও সেই মেয়েটার থেকে, কানটা না চাইতেও গরম হয়েছিল অয়নের।তার সাথে বুঝতে পারে কেন সেদিন ময়ূরভিহার এক্সটেনশন স্টেশনে খুঁজে পায়নি ওকে,ও আগের প্ল্যাটফর্ম ময়ূরভিহারে নেমে গিয়েছিল আগেই।
“বলুন কী খাবেন?এখানে আমি আগে আসিনি,তাই জানিওনা।আমি আমাদের অফিসের উল্টোদিকের সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে দু একবার গেছি ব্যাস,আজ তাই আপনিই বলুন কী খাবেন।আমিও সেটাই অর্ডার করবো”,মেনুকার্ডে চোখ বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলে মানি।
অয়ন যেন আজ শুধু মানিনীর কথা শুনতেই এসেছে।ওর কথায় মুখে হালকা হাসি ধরে রেখে বলে,”এখন তো স্ন্যাক্স টাইম।এদের চিকেন স্যান্ডুইচটা খুব ভালো,আর কফিটাও মন্দ না।আর চিকেন পছন্দ না হলে ব্রেড পাকোড়াও চলে যায়।আর একটু ভারী কিছু খেতে চাইলে কিমা পরোটা।এবার বাকি অর্ডার তুমি করো”।
মানি মেনুকার্ড থেকে চোখ তুলে তাকায় সোজাসুজি এবার অয়নের দিকে,”এখানে আপনি আগে এসেছেন বুঝি?”
“হ্যাঁ।আমার বন্ধু কাম ফ্ল্যাটমেট কাম কলিগ খুব ফুডি।ও অন্তত দুটো উইকেন্ডে বাইরে বের হবেই খেতে।ওই ওর পাল্লায় পরে একবার এসেছিলাম”,অয়ন হাসিমুখে বলে।
মানি আর কথা না বাড়িয়ে অয়নের সাজেশন মত কফি স্যান্ডুইচ অর্ডার করে পুরো মনোযোগ এবার অয়নকে দেয়।
“বলুন এবার হঠাৎ দেখা কেন করতে চাইলেন?”
“এমনি।মনেহল ফোনে তো শুধু কথা হবে,দেখা হলে একটু ঘোরা হবে,খাওয়া হবে।মানে সাদা বাংলায় যাকে বলে আড্ডা হবে।আর দুজনের আপাতত বাসস্থান যখন এনসিআর, তখন আলাপ জমুক ক্ষতি নেই।আপদে বিপদে তো বাঙালীই বাঙালীর কাজে আসবে নাকি?” উত্তর গুলো আসলে ও তৈরি করেই এসেছে,জানতো এই ধরণের প্রশ্ন আসলে আসতেও পারে।
“এই তো এবার চেনা চেনা লাগছে।এসে থেকে এত চুপচাপ ছিলেন যে মনে হচ্ছিল ভুল লোকের সাথে আছি।এবার আস্তে আস্তে পুরোনো অয়নের খোঁজ পাচ্ছি”,মানির হাসি চওড়া হয়।
অয়নও এবার বড় করে হাসে,”এবার সত্যি করে বলো তো এতদিন পর হঠাৎ ফোন করলে,আগে করলে কি কেউ বকতো?নাকি রাগ করতো?” ঘুরিয়ে একটা প্রশ্নে অনেক কিছু জানার চেষ্টা করে ও।
“সত্যি বলছি কাগজের টুকরোটা ব্যাগের এমন কোথায় ঢুকে গেছিল শত খুঁজেও পায়নি।বাড়ি গিয়ে খুঁজেছি,এখানে এসে খুঁজেছি,বিশেষ করে চাকরিটা কনফার্ম হওয়ার পর খুব বেশি মনে পড়ছিল আপনার কথা।একবার জানাতে বলেছিলেন,কিন্তু কোথাও পাচ্ছিলাম না কন্টাক্ট নম্বরটা।আর ফেসবুকেও পাইনি আপনাকে।সব মিলিয়ে…”,বাধা পায় মানি।
“ফেসবুকে খুঁজেছিলে আমায়!” অয়নের স্বরে রীতিমত বিস্ময়,যেন বিশ্বাস হতে চায়না কথাটা।
“আরে হ্যাঁ তো।নামের বানান বাংলা,হিন্দি,ইংরাজি তিন ভাবে লিখেও পাইনি।পাবো কিকরে,আপনার সারনেম গুলিয়ে গেছিল।কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না”,মানি সরল মনে বলে সত্যিটা।
“জানলেও খুঁজে পেতেনা,কারণ ফেসবুকে আমার নাম ‘চারণ কবি’,ওই নামেই বন্ধুমহলে পরিচিত ছিলাম তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই নামটাই নিয়েছিলাম”,ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসিটা আবার উঁকি মারে অয়নের।আজ ওর মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে।
“চারণ কবি? মানে আপনি কবিতা লেখেন?” মানির বিস্ময়ভরা চোখ দেখে এবার জোরেই হেসে ফেলে অয়ন,”আরে না না।স্কুলে পড়ার সময় থেকে আমার একটা হ্যাবিট ছিল।লাইন মিলিয়ে মিলিয়ে কথা বলা।জাস্ট ফান আর কী।কিন্তু ওই থেকেই বন্ধুরা মজা করে নাম দিয়েছিল চারণ কবি।তারপর ওই নামটাই পরিচিতি পেয়ে গেল বন্ধুদের মধ্যে।স্কুলে পড়তে অরকুটে প্রোফাইল বানিয়েছিলাম এই নামে।তাই ফেসবুকেও ওই নামটাই রাখি,পুরোনো বন্ধুরা ঠিক খুঁজে পায়”,অয়নের কথার মাঝে ওদের স্যান্ডুইচ কফি এসে যায়।
খেতে খেতে আরো পরিচিত হতে থাকে অয়ন মানিনী একে অপরের সাথে।তিনমাস আগের ট্রেনের আলাপ ট্রেনেই শেষ হতে পারতো, ভাগ্য আবার মিলিয়ে দিলো দুটো ছেলে মেয়েকে যাদের জীবনের একটা অধ্যায় অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল,সেটা সম্পূর্ণ হবে কি না সময় তার জবাব দিলেও সম্পর্কের শুরু যে একটা হয়েছে বসন্তের আগমনের হাওয়া তার ইঙ্গিত দিতে লাগলো।
ক্রমশ..
1 comment
khoob bhalo lagche