“মানি তুই পুজোয় কবে আসছিস?” বাবার গলাটা ঠিক লাগেনা মানিনীর।পুজোর আর মাস দুই দেরি।
“ইচ্ছা তো আছে মহালয়ার আগে থেকে ছুটি নেওয়ার।এবার ছুটির অ্যাপ্লাই করবো।এই উইকের মধ্যে তোমায় ফাইনাল জানিয়ে দেব”,মানিনী গলাটা স্বাভাবিক রেখে বলে।
মাস দেড়েক হলো অয়নের ফ্ল্যাটে থাকছে ও।পিজির রুম ছাড়েনি,ওখানে সপ্তাহে দুদিন অন্তত থাকে।ওখানে আর অফিসে সবাই জানে ওর এক বান্ধবীর ফ্ল্যাটে আজকাল মাঝে মধ্যে থাকে ও।সমস্যা যে একদম হচ্ছে না তা তো না,কিন্তু অজানা কোনো কারণে সবটাই সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে ও।
ওই সচেতনভাবে চেষ্টা করার জন্যই দীপক কাকুর ফ্ল্যাটেও এক শনিবার ঘুরে এসেছে।কিন্তু তাও কেন কে জানে বাবার কথা শুনে মনেহয় বাবা ওর মিথ্যেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনা।
“হ্যাঁ ছুটি নিয়ে জানাস।আর এবারে তুই ফের,কিছু কথা আছে আমার।আমার দোকানটা ভাবছি বিক্রি করে দেব।আর একা একা ভালো লাগেনা।তুই এবার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নে,তোর কাছে গিয়ে মাঝে মধ্যে থাকবো”,এই সুরে নিজের বাবাকে বিশেষ কথা বলতে শোনেনি মানিনী,অবাক হয়।
যে বাবাকে আগে কতবার এই কথাগুলো বলেও রাজি করাতে পারেনি,আজ সে নিজে এগুলো বলছে বিশ্বাস হয়না ওর।
“বেশ তো।তাহলে তো খুবই ভালো হয়।পুজোর তো এখনো প্রায় দুমাস বাকি,তুমি বললে আমি তার আগেই ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারি।দোকান আপাতত বন্ধ রেখে এসো না আমার কাছে”,মানি মন থেকেই বলে কথাগুলো।
“না।আগে তুই বাড়ি আয়।তারপর বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।তুই আজকাল কথা তো বিশেষ বলার সময় পাস না।আর ফোনে সব কিছু বুঝিয়ে বলাও যায়না।সামনাসামনি বলবো”,এড়িয়ে যায় যেন মানির বাবা।মানি ইচ্ছা করে আর ঘাঁটায় না।টুকটাক কিছু কথা বলে ফোন রেখে দেয়।
ফোন রাখার পরও ওর মনে অসংখ্য প্রশ্ন আনাগোনা করতে থাকে।বাবা কি কিছু আন্দাজ করেছে? কিন্তু সেটাই বা কীকরে সম্ভব? অয়নের সাথে মানির কোনো সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে এটা যদিও বাবা আন্দাজ করতে পারে,কিন্তু একসাথে লিভিং করার ঘটনা কল্পনাতেও আসবে না।
ওর ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় ও।শরীরটা অসুস্থ আজ প্রায় পাঁচদিন হলো।সেই ঝড়ের রাত থেকে জ্বর,এখনো শরীরটা খুবই ক্লান্ত।
প্রথমদিকে মানি একটা বিবেকের তাড়নায় ভুগতো।বাবাকে লুকিয়ে এত বড় কাজ করছে।কখনো কিছু লুকোয়নি তো ওই মানুষটাকে।একটা মনঃকষ্ট সব সময় মনে পিন ফোটাতো।
অয়ন কিছুটা বুঝতো,ওকে ওর মত ছেড়ে দিত। একে অপরের খুব ভালো বন্ধু হয়েও এইসব কারণে মাঝের অদৃশ্য দেয়াল ভাঙতে পারছিলনা কেউই।ভালো বন্ধু,রেস্পন্সিবল ফ্ল্যাট মেট এভাবেই চলছিল।কিন্তু পাঁচিলটা ভেঙে সব কিছু বদলে দিলো ঝড় বৃষ্টির ওই রাত।আর এই কদিনে ওর অসুস্থতা ওর বাবার মনে তৈরি করেছে সন্দেহ,এটা মানি বোঝে।
সেই রাতের স্মৃতি আজ পাঁচদিন পরও মানিনীর মনে অবিশ্বাসের ভয় দূর করতে পারেনি।দিল্লির ক্যাব ড্রাইভারদের সম্বন্ধে এতদিন খারাপ শুনে এসেছে, সেদিন ভালো মন্দ দুটো রূপই দেখেছিল ও।
ফোনের অ্যাপ দিয়ে যে ক্যাব বুক করেছিল সেটা ভালোই আসছিল।জ্যামের জন্যে সময় লাগলেও খুব রাত হবেনা বুঝতে পারছিল মানিনী।কিন্তু গন্ডগোল হল যখন নয়ডা ঢোকার মুখে গাড়ি গেল বন্ধ হয়ে।পাঞ্জাবি ড্রাইভার নিজের জ্ঞান ফলিয়ে বেশ খানিক্ষণ চেষ্টা করে বললো গাড়ি চলবে না।সেই ড্রাইভার ই অন্য গাড়ি দেখে ওকে তুলে দিল সেই গাড়িতে।আর সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল।
গাড়ি কিছুক্ষন চলার পর রাস্তাঘাট দেখে কেমন একটা সন্দেহ হয় ওর।নিজের লোকেশন নিজের ফোনে ট্রাক করে বুঝতে পারলো কিছু একটা ভুলভাল হতে চলেছে ওর সাথে।ড্রাইভারকে বুঝতে না দিয়ে প্রথমে অয়নকেই ফোন করে,কিন্তু অয়নের ফোনের নেটওয়ার্ক পায়না।
কিছুক্ষন পর নিজের ফোন থেকে ভুয়ো কল করে ওর ভুয়ো আঙ্কেলকে,ওর কথা বার্তায় ও বোঝায় সেই আঙ্কেল পুলিশের বড় কর্তা আর ও যেন এখন সেখানেই যাচ্ছে।
কিছুটা হলেও চাপ তৈরি করে সেই ড্রাইভারের মনে।ভুলভাল কারণ দেখিয়ে সেই বদমাশ ছেলে ওকে দিল্লির অচেনা রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যায়।তখন রাত আটটা কুড়ি।মানিনী তখনও চেষ্টা করে অয়নের ফোন পায়না।এরপর লোককে জিজ্ঞেস করে হেঁটে,অটো করে ফ্ল্যাটে ফেরে ও।এর মধ্যে নিজের ফোনের সাইলেন্ট মোড অফ করতে ভুলে যায়।
যতই মনের সাহস দেখিয়ে সবটা করুক অয়নকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি ও।
একটা ভয়,ক্লান্তি সব মিলিয়ে সেদিন রাতে ভালোই জ্বর আসে ওর।আর ওই ঘন্টাখানেকের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ট্রমার আকারে মনে ভয় তৈরি করে দেয় অসুস্থ শরীরে।
এটুকু মনে আছে ওর প্রায় রাত দুটোর সময় ও টলতে টলতে গিয়ে অয়নের রুমের দরজা ঠেলেছিলো।তারপর আর কিছু মনে নেই।
অয়ন চারদিন পর আজ অফিস গেছে।
মানি জানেনা অয়ন না থাকলে কী হত! পিজির রুমে এরকম শরীর অসুস্থ হলেই বা কী করতো! হয়তো সেখানেও সামলে উঠতো ও,কিন্তু অয়নের এই রূপটা হয়তো জানতেও পারতো না।
সেই রাত থেকে মানিকে প্রায় একাই ছাড়েনি ও এই কদিন।বুঝতে পেরেছিল সেই প্রথমদিনের নির্ভর করতে চাওয়া ভীতু মেয়েটাই আবার ফিরে এসেছে।হয়তো কিছু হয়নি,কিন্তু যদি কোনো ক্ষতি হত সেই ভয়েই বারবার শিউরে উঠছিল ও।আর প্রতিবার একটা হাত কখনো ওর হাতে চাপ দিয়ে,কখনো বুকে আগলে রেখে,কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বারবার।
অয়নের মধ্যে একজন বাবা সুলভ মানুষ আছে।হয়তো নিজের বাবার কাছে অনেক কিছু না পেয়ে অবচেতনে তৈরি হয়েছে একটা আকাঙ্ক্ষা, সেই থেকেই আপনা থেকেই গড়ে উঠেছে চরিত্র বৈশিষ্ট্য।
মানিকে ঠান্ডা জল খাওয়া থেকে যেদিন আটকেছিলো সেদিনই ও নিজের বাবার সাথে মিল পেয়েছিল অয়নের।আর এই কদিন বারবার অনুভব করেছে ও যেন নিজের বাড়িতেই আছে।
হঠাৎ মানিনীর ফোন বাজতে শুরু করে।হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সায়নী।এই পুরো সপ্তাহটাই ছুটি নিয়ে নিয়েছে ও,ফলে অফিসের খবর নিজে ঠিক জানেনা।সায়নীর কলটা রিসিভ করে ফোনটা লাউড স্পিকারে দেয় ও,কানে দিতে একদম ইচ্ছা করছে না।
-“বল কী খবর?”
-“তুই বল তোর কী খবর?”
-“এই শরীরটা খুব দুর্বল তাই চুপচাপ শুয়ে আছি।”
-“অয়ন আছে,না অফিস গেছে?” সায়নীকেই ভরসা করে সব বলেছে ও।
-“না আজ চারদিন পর অফিস গেছে।তুই কোথায় অফিসে?”
-“না আজ আমিও অফ নিয়েছি।আচ্ছা মানি তুই উৎসব বলে কাউকে চিনিস?”
চমকে উঠে মানি সায়নীর কথা শুনে।উৎসব তো এখন অতীত ওর জীবনে,তাহলে আজ একমাস পরে সায়নীর মুখে ওর নাম কেন!!
-“হ্যাঁ চিনি।কেন বলতো?”
-“দুদিন আগে আমায় ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল,একসেপ্ট করিনি।কাল হঠাৎ আউটবক্সে দেখি মেসেজ রিকোয়েস্ট,উৎসব নামের ছেলেটা মেসেজ করেছে,আর পরিচয় দিয়েছে তোর খুব ক্লোজ বলে।আমি তো অয়ন ছাড়া তোর মুখে কারোর কথা শুনিনি,তাই একটু অবাক হয়েছি”।
একটা দীর্ঘশ্বাস যেন মানির বুক চিরে আপনা হতেই বেরিয়ে আসে।এই ছেলেটা কি ওকে ছেড়েও ছাড়বে না?কী চায় ও।কয়েকমাস অন্তর অন্তর ওর জীবনে উদয় হয়ে কেন ওকে মানসিক নির্যাতন করে?কিছুই ভেবে পায়না।
-“উৎসব আমার অতীত সায়নী।যদিও ও নিজেই সম্পর্ক ভেঙেছিল আমি চাকরি পাওয়ার পর।কারণ ও চায়নি স্কুল বা ব্যাঙ্ক ছাড়া আর অন্য কোথাও আমি চাকরি করি।কিন্তু পরে ওর মনেহয় ওর ভুল ছিল,বারবার ফিরে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছে।কিন্তু ওর ব্যবহার আমার মনে ওর জন্যে একটা ভয় তৈরি করেছে বলতে পারিস।যখন সম্পর্কে ছিলাম ওকে ছাড়া বাঁচবো না ভাবতাম,কিন্তু ও যেদিন জোর করে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ওর কথা না শোনার জন্য অনেক চেষ্টা করে বেরিয়ে এসেছিলাম ওর অভ্যেস থেকে,তারপর ওই সম্পর্ক মনে একটা ভয় তৈরি করলো।এখন দম বন্ধ লাগে ওই দিন গুলোর কথা মনে পড়লে”,এক নিঃশ্বাসে বলে থামে মানি।
“হুম বুঝলাম।উৎসব কাল আমায় একই কথা বলেছে।অনেকটাই বলে আমায় সাহায্য করতে বলেছে।ওর ধারণা অয়ন তোর কলিগ,তুই ওকে জ্বালাতে অয়নকে নিজের বয়ফ্রেন্ড হিসেবে শো করেছিস।ও তোর এই বোকা নাটকে ভোলেনি”,কেটে কেটে কথাগুলো বলে সায়নী মানিনীর উত্তরের অপেক্ষা করে।
“হাহা।তাহলে উৎসব সেনের ঘটে বুদ্ধি আছে।কিন্তু না ওকে জ্বালানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই।তবু মুক্তি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই ছিল।জানিস সায়নী আমি এতদিন নিজেকে ভালো চিনতাম না।ভাবতাম খুব দুর্বল আর নরম মনের মেয়ে আমি।কিন্তু এই উৎসব আমায় নিজেকে চিন্তে বাধ্য করেছে।ও যত জেদ করবে আমার জেদ তত বাড়বে।বাদদে।তুই এক কাজ কর সিম্পলি ব্লক করে দে।যদি লাইফ হেল করতে না চাস আর কখনো এন্টারটেইন করিসনা একে”,মানিনীর এই গলার স্বর সায়নী আগে কখনো শুনেছে বলে মনে করতে পারেনা।
আরও মিনিট পাঁচেক কথা বলার পর যখন সায়নী ফোন রাখে মানিনীর চোয়াল ততক্ষনে কঠিন হয়ে গেছে।মাথায় একটা রাগের রামধনু ছড়িয়ে যেতে চাইছে যেন,কিন্তু আপাত শান্ত মানি প্রানপনে সেটা আটকে রেখেছে।
ওর মনের এই ধোঁয়াশা ওর মাথা আরো ঠান্ডা হওয়ার সাথে সাথে একটা অবয়ব তৈরি করছে,খুব অপেক্ষা করছে ও অবয়বটা সম্পূর্ণ হওয়ার।কিন্তু বড্ড কাঁপছে সেটা,কিছুতেই স্থির হচ্ছেনা। উৎসব সরে গেছে,কিন্তু ওকে পুরোপুরি জীবন থেকে কাটার জন্যে ওই অবয়বটা স্থির হওয়া বড্ড বেশি দরকার।
মানিনীর অস্থির মাথা কিছুতেই মনটা পড়তে পারছে না।তাই অবয়বটা ধরা দিচ্ছেনা কিছুতেই,চোখ বুজে ফেলে মানি।আর ঠিক সেই মুহূর্তে ধোঁয়াশাটা তৈরি করে মানির মনের প্রতিচ্ছবি।দুর্বল শরীর এলিয়ে পরে বিছানায়।
চলবে..
1 comment
khoob bhalo lagche