আরও একবার – ষষ্ঠ পর্ব

by Tamali

“হ্যাঁ বাবা জয়েনিং কমপ্লিট হয়ে গেছে।এবার দেখি ক্যান্টিন খুঁজে কিছু খাবো”, প্রথম দিনের অফিসে জয়েনিং পদ্ধতি শেষ হতেই দুপুর প্রায় একটা বেজে গেল।

“তুই ঠিক আছিস তো মা।আমায় ছেড়ে কখনো একা থাকিসনি তো।বড্ড চিন্তা হচ্ছে।বললাম আর কদিন অপেক্ষা করে দেখ কলকাতার চাকরিটার যদি কোনো খবর পাস…”,মানির বাবার কথা ওর কথার প্রত্যুত্তরে চাপা পড়ে যায়।
“আমি খুব ভালো আছি বাবা।এখানকার লোকজন,অফিসের লোকজন খুব ভালো।তুমি চিন্তা কোরোনা।আমি পিজি ফিরে তোমায় কল করবো।এখন রাখছি,অফিসে প্রথমদিনেই ফোনে এতক্ষন কথা বলা,কে কী ভাববে?” মানিনী ওর বাবাকে কথা গুলো বলে বাবার সম্মতি নিয়ে ফোন কেটে দেয়।
এদিক ওদিক তাকিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে যায় অফিস ক্যান্টিনে।
প্রথমদিনেই ধাক্কা খায় ক্যান্টিনের খাবার দেখে…ভাত খেলে সঙ্গে আছে ছোলা অথবা রাজমা।ননভেজ থালিতে আছে লাল চিকেনের ঝোল আর ভাত।অযথা রিস্ক নেয়না ও। পরোটার কাউন্টারে গিয়ে একটা আলু পিয়াঁজ পরোটা অর্ডার করে।এক সপ্তাহের পিজি জীবন ওকে এটাই শিখিয়েছে এখানে পরোটা খাওয়া অনেক নিরাপদ,কারণ ছোলা বা রাজমা দিয়ে ভাত ও একদমই খেতে পারেনা।আর এখন চিকেন খেতেও ইচ্ছা হলোনা।ইডলি দোসা থাকলেও এখন ওসব খেতে মন করলোনা।ওর জন্যে ক্যান্টিনের চেয়ে ভালো অফিসের বাইরে ওই রেস্তোরাঁ,যেখানে আগে খাবার অভিজ্ঞতা ওর আছে।
পরোটা নিয়মিত পেটে সইবে না ও জানে,কিন্তু এখন পেট বেশ কিছুক্ষণ ভরা রাখা বেশি দরকার।প্রথমদিন বেশিক্ষন ক্যান্টিনে কাটানো মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।এখনকার লোকজন ভালো হলেও,বাঙালী ফাঁকিবাজ এই তকমা কোনোভাবেই ও লাগতে দেবেনা।এমনিও ও খুব সিরিয়াস যে কোনো কাজের ব্যাপারে।আর সবাইকে সেটাই বোঝাবেও ও।
খাওয়া শেষে ওর জন্যে বরাদ্দ সিটে গিয়ে বসতে যাবে,এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ান ওর সামনে।মানিনীর কাজ ওকে বোঝানোর দায়িত্ব আছে ওই ভদ্রলোকের ওপর।
অবাক হয় মানি,কত ফার্স্ট চলে এখানকার সব কিছু,ভদ্রলোককে অনুসরণ করে ও।
ঘড়ি ধরে যেন চলে এখানে সব কিছু,হয়তো কলকাতার সরকারী অফিসেও তাই হয়।ওর অভিজ্ঞতা নেই তাই এখানে সব কিছুতে বিস্ময় জাগছে।
ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে ছ’টায় ছুটি হলো মানিনীর।আজ ওর প্রথম দিন অফিসে,কিন্তু কোনো ছাড় পেলোনা।কাজ করতে হলো বাকী সকলের মতোই,বুঝে নিতে হল নিজের দায়িত্ব।
অফিস থেকে হাঁটা পথে মেট্রো স্টেশনে পৌঁছতে গিয়ে গত এক সপ্তাহের মত আবার টের পেল দিল্লির ঠান্ডা।ওর মেডিকেল টেস্ট হয়েছিলো নভেম্বরের শেষের দিকে দিওয়ালির পরে পরে ,কিন্তু দুমাসের মাথায় জয়েনিং পেয়ে জানুয়ারির শেষে গত সপ্তাহে যখন দিল্লি নামলো হাড় অবধি কেঁপে গিয়েছিল ওর সকাল সাড়ে দশটা তেও।রোদ থাকলেও তার তেজ সেদিন কমই ছিল তাই জ্যাকেটেও ঠান্ডা হার মানছিলো না।মানিনীর পুলিশ ভেরিফিকেশন হওয়ার আগেই এরা জয়েনিং দিয়ে দিয়েছে,ভেরিফিকেশন এরপর হবে।কোনো সমস্যা হওয়ার কথা ওর না,তাও যতক্ষন না হয় টেনশন একটা থেকেই যায়।
এইসব টুকটাক চিন্তার মাঝে পৌঁছে গেল ও স্টেশনে।দিন দুই আগে দীপক কাকুর সাথে পিজি খুঁজতে বেরিয়ে মেট্রো কার্ড একটা কিনে নিয়েছিল,তাই টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়াতে হলোনা ওকে।
কাকু আর কাকিমা ওকে কিছুতেই পিজি তে থাকতে দিতে রাজি হচ্ছিল না।কিন্তু সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়না বলে অনেকরকম অজুহাত খাড়া করে তবে ও রাজি করিয়েছে ওই মধ্যবয়সী সন্তানহীন দম্পতিকে,তবে শর্ত হয়েছে যেসব সপ্তাহান্তে মানির কোনো প্রোগ্রাম থাকবে না,ওদের কাছে গিয়ে থাকতে হবে ওই দুটো দিন।হাসতে হাসতে মানিনী বলেছে,”তাহলে প্রতি উইকেন্ডেই কিন্তু এসে হাজির হবো জ্বালাতে।চিন্তা করে বলো কিন্তু।এই শহরে প্রোগ্রাম বানানোর কেউ নেই আমার”।
“এখন নেই।দুদিন পর হবেনা গ্যারান্টি কোথায় বল?”দীপক কাকুর চোখ মটকে বলা কথাটা মনে করে এই জনবহুল স্টেশনেও নিজের মনে হেসে ফেলে মানি।তারপরই ভারী হয়ে আসে মনটা।না,আর আপাতত ওর কেউ হবেনা প্রোগ্রাম বানানোর, উইকেন্ডে ওকে সঙ্গ দেওয়ার।এমনকী ফোনেও ঘন্টার পর ঘন্টা কাটবে না ওর সময়, দিনে অথবা মাঝ রাতে।
মানিনী পেরিয়ে এসেছে সেই সময়টা।ও পেরোতে পেরেছে সেই দুঃস্বপ্নের মুহূর্ত গুলো।এখন মানি মেনে নিয়েছে সত্যিটা।
খুব কঠিন ছিল মানির কাছে এই কাজটা। ও আছে,অথচ ওর জীবনে উৎসব নেই এটা মানা ওর পক্ষে নেহাতই অসম্ভব ছিল।যাকে ঘিরে ওর ঘড়ির কাঁটা ঘুরতো, যাকে না ভেবে ও জীবনে সিদ্ধান্ত নেয়নি শেষ পাঁচ বছর,কী করে এত সহজে ভুলে যেত তাকে!! না সহজ হয়নি ওর জীবনেও সেটা। সেই দুপুরের পর জীবনটাই যেন উল্টে গিয়েছিল ওর।

মানিনীর জীবনের রুটিনটায় ফাঁকা সময়ের যেন প্রাচুর্য হয়ে গেছিল।কাটতো না দিনগুলো খুব সহজে।তারওপর ছিল কলেজ বন্ধুদের খবরের অত্যাচার।ওর ব্রেকআপের খবর পৌঁছয়নি অনেকের কাছে আজও।ফলে ওর ‘বয়ফ্রেন্ড’ উৎসবের খবর অযাচিত ভাবেই পৌঁছে যেত ওর কানে।ফেসবুক,হোয়াটস অ্যাপের ব্লক পেরিয়েও ওর কানে আসতো প্রায় সব খবর।নিতে পারতো না ওকে ছাড়া উৎসবের ভালো থাকার খবর গুলো,ভাঙতো ও মনে মনে।তাও ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করেছিল একমাস।কিন্তু যখন জানলো উৎসব সবাইকে ফলাও করে জানাচ্ছে ব্রেকআপের খবর আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি ও।
সেদিন রাতের ওর সেই হাহাকার ওর ঘরের দেয়ালগুলোয় সজোরে আঘাত করলেও ও ভাবেনি সেটা পৌঁছে যাবে ওর বাবার ঘরেও।
আজ ওর এই ঘুরে দাঁড়ানো,পুরোটাই ওর সব হারানো বাবার মুখ চেয়ে।ওর হাসি ফিরে এসেছিল পরিস্থিতির চাপেই।ওর চিন্তায় ওর বাবার প্রেসার যেই বাড়তে শুরু করলো নিজেকে পুরোপুরি ভেঙে নতুন করে তৈরি করা শুরু করলো মানিনী।
আজকাল উৎসব আসে মনের মধ্যে খুব মাঝেমধ্যে।কিন্তু ‘মুভ অন’ করে নিজের মনকে বোঝানো মানিনী আর অতো ভাবেনা ওই ছেলেটা কে নিয়ে।স্মৃতি পিছনে ফেলে এগোনোর চেষ্টা করছে ও অনেকদিন।

ক্রমশ…

You may also like

2 comments

Anaya Chatterjee June 24, 2024 - 9:19 AM

choluk

Reply
Anonymous July 10, 2024 - 12:21 AM

khoob bhalo lagche

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!