“রাজীবদা ভেবেছিলাম কোনোদিনও তোমার মুখোমুখি হবোনা।কিন্তু ভাগ্যের এমনি পরিহাস আমাকে তোমার বাড়িতেই এনে ফেললো।তারপরও চেয়েছিলাম তোমাকে উপেক্ষা করতে যাতে নতুন করে তোমার মনে আমার জন্যে কোনো অনুভূতি আর না জাগে।…কিন্তু..কিন্তু…”,আটকে যায় অহনার কথা।এ’কদিনের লুকিয়ে রাখা আবেগ কান্নার দলা হয়ে গলা বুজিয়ে দেয়।কিন্তু ওর দিকে পিছন ঘুরে নিজের পড়ার টেবিলে হাত রেখে চেয়ারে বসে থাকা রাজীবের কোনো ভাবান্তরই অহনা বুঝতে পারেনা।বাধ্য হয়ে অহনাই আবার মুখ খোলে,”তোমার মা বাবা কেন দেশের বাড়ি চলে গেলেন রাজীবদা?…তুমি কি জানতে চাইবেনা একবারও কেন আমি সেদিন তোমার কথা রাখতে পারিনি ..আসিনি তোমার বলে দেওয়া জায়গায়?..প্লিজ কিছু বলো।”অহনার গলায় ধৈর্য্যের অভাব স্পষ্ট বোঝা যায়।কিছুটা নীরবতার পর খুব আস্তে করে জবাব আসে,”না আজ আর কিছু জানতে চাইনা,কারণ চাইলেও আজ আর ওই সময়টা ফিরে আসবেনা।শুধু সময় নয়,পরিস্থিতিও আর থেমে নেই।”
“কেন?কেন জানতে চাওনা তুমি?আর তাহলে আজও কেন বিয়ে করোনি আর ভবিষ্যতে করবেও না বলেছ?”অহনা কিছুক্ষন আগে রুক্মিণীর কাছে কথা গুলো শুনে থেকে নিজেকে যেন সামলাতে পারছেনা।রাজীব একই ভাবে চুপ করে থাকে।কিন্তু বুঝতে পারে উত্তর কিছু একটা দিতেই হবে।কি দেবে ভাবতে ভাবতে অহনা বলে,”তোমরা দুই ভাই বোন বিয়ে করবে না বলেই কাকু কাকিমা দেশের বাড়ি চলে গেছেন।তাদের প্রতি কি তোমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই?এই শেষ বয়সে এসে তাদের কষ্ট দেওয়া কি ঠিক?”
“অহনা আমার বিয়ে না করা নিয়ে আমি কারোর সাথে আলোচনা করিনা।আর তোমার সাথে তো একদমই না,কারণ যার জন্য আমি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা তুমি নও।সে আমার একান্ত আপন একজন।ছাড়ো।তুমি এসব নিয়ে ভেবোনা।”রাজীব দায়সারা উত্তর দেয় দেখে অহনা বিছানা ছেড়ে উঠে রাজীবের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায় আর চমকে ওঠে ওর চোখে জল দেখে।অহনা এভাবে হঠাৎ উঠে আসবে রাজীব ভাবেনি,হঠাৎ নিজের চোখের জল অহনা দেখে ফেলায় ও চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের জানলায় চলে যায়।দৃঢ়চেতা রাজীব নিজের মনের কথা কাউকে বলতেই অভ্যস্ত নয়।কলেজের ওই কটা মাস শুধু অহনার সাথে যখন বন্ধুর মতো মিশতো ওকে সব সব সবটা বলতো নিজের কথা,নিজের মনের কথা।কিন্তু আজ তা হয়না।আজ অহনা গাঙ্গুলী নয়,মিসেস অহনা মুখার্জি ওর সামনে দাঁড়িয়ে যাকে কিছু বলতে গেলেই,যার মুখের দিকে তাকালেই সবার আগে চোখ আটকে যায় তার জ্বলজ্বলে লাল সিঁথিতে।অহনা আর পারলোনা রাজীবের ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো।ওর একটা সিদ্ধান্ত দুটো জীবনই নষ্ট করে দিলো।কিন্তু ও কি করতো সেদিন?ওর ব্রাহ্মণ দাদা কোনো ভাবেই অন্য জাতের কাউকে নিজের বোনের স্বামী হিসেবে মানতে রাজি ছিলোনা।আর দাদা কে ছাড়ার কথা অহনা সেদিন কেন আজও ভাবতে পারেনা।ও আর বৌমনি মিলে অনেক বুঝিয়াছিলো,কিন্তু দাদা মানেনি।ও জানতো দাদাভাই গোঁয়ার তাই হয়তো রাজীব কি বলতে ডেকেছে না জেনেই আগেই দাদাভাই এর মত টা জানতে গেছিল।ভেবেছিল যতই জাতের গোয়ার্তুমি থাকুক রাজীবের মত সৎ,ভবিষৎ উজ্জ্বল, ভালো পরিবারের ছেলেকে দাদা জাতের ওপরে রাখবে,কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণ করে ওর দাদা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বোনকে ত্যাগ করার কথাও বলে দেয়।ফলে বাবা মার ভালোবাসা স্নেহ দিয়ে মানুষ করা দাদাকেই গুরুত্ব দিয়ে নিজের প্রথম ভালোবাসার বলি চড়িয়ে দেয় অহনা।ভাবেনি ওই ছেলেটা পুরো জীবনটা ওর নামে লিখে দিয়েছে।যাতে ওকে ভুল বোঝে তাই সেদিন দেখাই করতে যায়নি,ভেবেছিল এতেই ও বেইমানের তকমা পাবে রাজীবের কাছে আর ওর মন থেকে হারিয়ে যাবে।কিন্তু ওর রাজীবদা যে নিজের প্রথম ভালোবাসা নিয়েও এতটা সিরিয়াস অহনা কোনোদিনও ভাবেনি।ঋষির বিয়ে করতে চাওয়া যে দাদাভায়েরও সদিচ্ছা বুঝে ও অমত করেনি।সেদিন বৌমনি শুধু চেয়েছিল অহনা রাজীবকে বেছে নিক,বলেছিল একসাথে অনেক গুলো জীবন নষ্ট হবে,অহনা কানে তোলেনি ওই কথা গুলো।আচ্ছা রাজীবকে ঠকিয়ে ছিল বলেই কি ও নিজেও জীবনে সুখী হতে পারলোনা?ঋষির সাথে ওর সম্পর্কটা আসলে শুধু শরীরেরই থেকে গেল।প্রথম ছমাস তাই ভালোবাসা আর অভ্যাসের পার্থক্য করতে পারেনি অহনা।কিন্তু যেই শরীরের খেলা নিয়মিত হলো অহনাও ঋষির কাছে সাধারণ হয়ে গেল।সেই সময় অহনা বুঝতে পারতো ঝগড়া করে কথা বন্ধ থাকলে ঋষি শরীরের টানে পাগল হয়ে উঠত।অহনা কে ঋষি স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল কিন্তু স্ত্রীর গুরুত্ব দেয়নি।একটা পোষ্য কে নিয়ে রাখলেও তার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়,তাই অহনা কে ঋষি একদম ভালোবাসেনি তা নয়,কিন্তু সে ভালোবাসায় সম্মান ছিলোনা।প্রতি মুহূর্তে ঋষি বোঝাতো অহনার মতো একটা অনাথ মেয়েকে বিয়ে করে ও বিশাল কৃতিত্ব করেছে।অফিসে পার্টি,বা কোনো সোশ্যাল গ্যদারিং-এ ও অহনাকে নিয়ে যেতে অস্বস্তি বোধ করতো।অহনার সৌন্দর্য্য চোখে পড়ার মতো না হলেও,আলগা চটক সবাইকে একবার বাধ্য করত ওর দিকে ঘুরে তাকাতে,আর সেটা ঋষির চোখ কখনো এড়াতো না।কিন্তু শুধুমাত্র দমিয়ে রাখার জন্যে অহনাকে ও উল্টো কথা বলতো…অহনার মধ্যে একটা গাঁইয়া ভাব আছে তাই ঋষির ওকে নিয়ে অফিস পার্টিতে যেতে লজ্জা করে।কিন্তু নিজে ঠিক যেত আর ফিরত আকণ্ঠ পান করে।নিজে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ঋষির জেনারেল লাইনে বাংলা নিয়েই পড়া নিজের বউকে শিক্ষিত বিশেষ লাগতো না।সব মিলিয়ে অহনা নিজের মধ্যে গুমরোলেও নিজেকে বোঝাতো এগুলো ঋষির মনের কথা নয়,ওকে ঋষি খুবই ভালোবাসে।বাইরের চাপে ফ্রাস্ট্রেশনে এসব অহনা কে বলে।অহনা ছাড়া ওর নিজের কেই বা কাছে আছে।আর তাই দিনের পর দিন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অহনা সেসব মেনে নিত।
“অহনা নীচে যাও।রুকু কিছু ভাববে।ও জানে আমার সাথে তোমার পরিচয় আছে?কলেজে তো সেভাবে কেউ….আমি রুকু কেও কোনোদিন….”,রাজীব দোনামনা করে বলেই ফেলে।
“বছর দুয়েক আগে কৌতুহল চাপতে না পেরে রুক্মিণী তোমার ডাইরি পড়ে সবই জেনেছিল।যদিও আমায় বলেনি ডাইরিতে কি এমন ছিল।এরপর ও যেচেই ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।কলেজের ক্লাস মেট আমার এখন প্রিয় বন্ধুদের একজন।এখন চা খেতে খেতে ওর মুখে কিছু কথা শুনে আমার এতদিনের বিশ্বাসে চির ধরায় আমি তোমার কাছে ছুটে এসেছি।আমি কি করবো তুমি বলে দাও।”অসহায়তা ফুটে ওঠে অহনার কণ্ঠে।রাজীব চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে অহনার দিকে তাকায়।তাই হয়তো যখন ও নিজের পরিবারকে বলছিল ওর বিয়ে প্রতি অবিশ্বাসের কথা,বাবা মা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিলেও ছোট বোনটা নিশ্চুপ হয়ে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে ছিল।যে মেয়েটা যে কোনো ব্যাপারে দাদাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে দিত সে সেদিন হঠাৎ বড় হয়ে গেছিল।একা ঘরে যখন রাজীব মা বাবা কে কষ্ট দেওয়ার জন্যে নিজে মনে মনে ভেঙে পড়েছিল,দুবছরের ছোট বোন বড় দিদির মতো এসে ওর পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিল।আর তাই কোনোদিন এই একটা বিষয় নিয়ে ওকে কোনো প্রশ্ন অবধি করেনি।বোনের প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধে রাজীবের মনটা ভরে গেল।”অহনা এসব কথা এখন অর্থহীন।তুমি এখন অন্যের স্ত্রী।আমার ভালোবাসার সাথে তোমার কোনো যোগ নেই।আমার ভালোবাসার কপালে টিপ থাকলেও সিঁথিতে সিঁদুর ছিলোনা,আমার ভালোবাসা হাতে ঘড়ি ছাড়া কিছুই পড়তো না।… আমার ভালোবাসা শুধুই আমার নারী ছিল….যার নারীত্ব…অটুট ছিল।”ইচ্ছা করে চরম অপমান করলো অহনা কে রাজীব যাতে ওর নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত ওর ভালোবাসায় প্রভাবিত না হয়।কিন্তু অবাক রাজীব আরো অবাক হয়ে দেখলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো ভাবান্তর অহনার মধ্যে হলোনা।কিছুক্ষন বসে থেকে ও উঠে পড়ল রাজীবের বিছানা ছেড়ে।দরজার দিকে এগোতে গিয়ে থামল একবার,”আসলে বাইরের পরিবর্তন সবার নজরেই পরে।কিন্তু ভিতরে কতটা বদল হয়েছে কেউ উপলব্ধিও করতে পারেনা।”সামান্য ব্যঙ্গের হাসি ঠোঁটে এনে অহনা আবার বলে,”স্বপ্ন দেখা কল্পনার জাল বোনা আবেগে ভেসে যাওয়া মেয়েটা জীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে বা ভুলে যায় কল্পনা করতে,নিজের ভালোলাগা কে সময় দিয়ে ভালো থাকা মেয়েটা ভালোলাগা কে ছোঁয়ার সময় হয়তো বা পায়না।”আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”জানো রাজীবদা আমি লিখতে ভুলে গেছি।কতদিন হয়ে গেল এক লাইন লিখিনি অবধি”। আর দাঁড়ায়না, রাজীবকে চরম বাস্তবের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায় রাজীবের জীবনের একমাত্র ভালোবাসা।কেউ যদি বলতো অহনা মা হয়েছে তাতে রাজীবের যে কষ্ট হত,এখন সন্তামসম লেখাকে নিজের জীবন থেকে আলাদা করেছে শুনে তার থেকে শত গুন বেশি কষ্টে রাজীবের হৃদয় যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল।যে কবি কবিতা ভুলে যায়,যে গায়ক গান ভুলে যায়,যে চিত্রশিল্পী আঁকতে ভুলে যায় তার জীবনের গভীরে কোথাও খারাপ লাগার মেঘ জমে ,যা তাকে নিজের সৃষ্টি থেকে দূরে করে দেয়।
“হ্যালো।”ঘুম জড়ানো গলায় অচেনা নম্বরটা রিসিভ করে ঋষি।এখন ঘড়িতে সকাল ৯টা।একটু পরেই বিছানা ছেড়ে উঠে এক কাপ দুধ ছাড়া লাল চা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে অফিসে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয় ও।আজকাল দুপুর আর রাতের খাবার অফিসেই খায়।এত সকালে ফোন আসলে একটু বিরক্ত লাগে,কিন্তু ওর ফোনটা আবার অফ করলে এলার্ম বাজেনা।বেশ কিছু বছর হলো ফোনটা।
“ঘুমোচ্ছিলে?আমি অহনা?”এক কথায় ঘুম ছুটে যায় ঋষির।লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে।তারপরই কি খেয়াল হয়,নিরাসক্ত গলায় উত্তর দেয় ,”বল।হঠাৎ এতদিন পরে আমায় মনে পড়লো?”
“কেমন আছো ঋষি?”অহনা এড়িয়ে যায় ঋষির কথাটা।একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে ঋষি বলে,”আমি ভালোই আছি।কারোর জন্যে কোনো রকম অসুবিধা আমার তো তেমন হচ্ছেনা।কিন্তু মনে হচ্ছে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে বাইরের দুনিয়া দেখে তুমি বিশেষ ভালো নেই।তাই হঠাৎ আমায় স্মরণ।”ওপর প্রান্তে চুপ করে যায় অহনা।অবাক হয় ঋষির কথায়।সত্যি কি ওকে একটুও মিস করেনি ও!সত্যি তাহলে অহনার প্রয়োজন কোথাও নেই সংসারে!
“না ঋষি আমি তোমার খবর নিতে ফোন করেছি।যেদিন বেরিয়ে আসি,মাথা কাজ করছিল না,কিছুই সংসারে দেখিয়ে বুঝিয়ে আসিনি তোমায়,ফোনটাও আনা হয়নি…তাই…”।কথা বাধা পায় ঋষির কথায়।”তাই আমি তোমার অভাব বোধ করছি কিনা জানতে দয়া পরবশত ফোন করেছ?!কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে তোমার তেজ কমে এসেছে বাইরের জগৎ দেখে।কোন ইয়ার দোস্ত আছে বলতো সংসারে দিনের পর দিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে।তুমি একদম ঠিক কাজ করেছিলে তোমার মত মেয়েছেলে দের বাইরের জগৎ টা দেখা দরকার।স্বামীর কথায় আঁতে খুব ঘা লাগে,কিন্তু তার বাড়িতে কত সুখে আছো সেটা তো বোঝোনা।বাইরে বেরিয়ে দুদিনেই বুঝে গেছো তো জগৎ সংসার কি জিনিস।তোমার মত মেয়েমানুষ কে কেউ পাত্তাও দেবেনা,অবশ্য যদি না তুমি অন্য ভাবে নিজেকে পরিবেশন কর।”কথার লাগাম আবারও পড়াতে পারেনা ঋষি।মনের জ্বালা মেটাতে নিজের মনের নিচতা ফোনেই প্রকাশ করে ফেলে।অহনার মনে হয় ওর কানে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিল।এতদিন ঋষির সাথে থাকতে থাকতে ওর কথা বলার ধরণের সাথে অভ্যস্ত বলে ওর শেষের কথাটার মানে বুঝতে অহনার অসুবিধা হলোনা।আর কোনো কথা বলার অভিরুচি ওর হলোনা।শুধু দাঁতে দাঁত চিপে বললো,”আজ আমি নিজেও নিশ্চিত হলাম সেদিন আমি ঠিক কাজ করেছিলাম।আমার দুর্বলতা হঠাৎ মাথা চাড়া দেওয়ায় আজ ফোন করাটা ভুলই হয়েছিল,আবার ফোন না করলে তোমার নোংরা মনটা আবার মনে পড়তো না।ভালো থেকো।”বলে ফোনটা কেটে দিলো।ঋষির ফোন কেটে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিলো অহনা।ঋষির কথায় রাগে ওর সারা শরীরটা কাঁপছিল।ও ভেবেছিল কিছুটা হলেও মান অভিমানের কথা অন্তত হবে,ঋষি যে এরকম নোংরা ভাষা বলবে ও কল্পনাও করেনি।ওর নিজের ওপর রাগ হলো,ঋষি আগেও ওর শিক্ষাগত যোগ্যতাকে অপমান করেছে,কিন্তু আজ ওর মনেহল কেন পড়াশোনা শিখেছিল একটা নোংরা মনের মানুষের চিন্তা কে প্রশয় দেবে বলে?ওর দ্বারা কিছু হবেনা এটা ও নিজেও বিশ্বাস করেছে এতদিন,তাই কিছু করার চেষ্টা না করে শুধু হাতা খুন্তি নেড়ে কেন সোনার সময়টা কাটাচ্ছে?এখনো তো সময় আছে ঘুরে দাঁড়ানোর।মাথা ঠান্ডা করে ও নিলয়কে ফোন করে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে।”হ্যালো দাদাভাই।আমি অহনা বলছি।”
“হমম বল।বাড়ি ফিরছিস কবে?যেদিন ফিরবি জানাস আমি যাব,তোকে আর ঋষিকে একসাথে কিছু কথা বলার আছে।”নিলয় অহনাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে নিজের মত আবার চাপিয়ে দেয়।”দাদাভাই আমি ও বাড়ি ফিরবো না।যদি তুমি চাও তোমার কাছে যেতে পারি।”অহনা এক নিঃশ্বাসে বলে অপ্রিয় কথাগুলো।কিন্তু নিলয় কিভাবে রিয়াক্ট করবে ও ভেবেও দেখেনা।”মানে?আমি বুঝতে পারছিনা তুই কি বলছিস?ঋষিকে ফোন করেছিলিস?”বিরক্তি প্রকাশ পায় নিলয়ের গলায়।”হ্যাঁ করেছিলাম,তোমায় করার আগে।আর তারপরই ঠিক করলাম ওর সাথে এক ছাদের তলায় থাকা সম্ভব না।তাই এখন আমার তোমার কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ঠিকানা নেই।এবার তুমি বল।”অহনা আর কিছু লুকোবেনা ঠিক ই করে নেয়।ওপাশে নিলয় নিরুত্তর থাকে।বোনের কথায় ওর মধ্যে পুরুষ সিংহটা জেগে ওঠে।যে কোনো সম্পর্কে বিশ্বাসী নয়,বিশ্বাসী পুরুষের অহংকারে।যে নিজেও ভাবে মেয়েদের কখনো নিজেদের সীমা পেরোনো ঠিক নয়।যে ভাবে স্ত্রী মাত্রই স্বামীর কথা শুনতে বাধ্য।তাই অহনার এই বাড়াবাড়িতে ও প্রথম থেকেই বিরক্ত।তারপর এখন অহনার এরকম কথায় বিরক্তি শুধু চরমে পৌঁছয় না একটা অসহ্য রাগে ব্রম্ভতালু অবধি চিড়বিড়িয়ে ওঠে।”আমি জানতে পারি ঋষি এমন কি করেছিল যার জন্যে এত বড় সিদ্ধান্ত তুই একা নিয়ে নিলি?গায়ে হাত তুলেছিল তোর?মেরে ফেলতে চেয়েছিল?অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছিল?কি এমন হলো যে এরকম কথা তুই এত সহজে বলে দিলি।”
“গায়ে হাত তোলা…শারীরিক নির্যাতনই সব?দিনের পর দিন মানসিক নির্যাতন,অপমান,অবজ্ঞা,অবহেলা এগুলো কোনো ব্যাপার নয়?আমি ওর বিবাহিত স্ত্রী যাকে প্রতিটা মূহর্ত খাওয়ার খোঁটা শুনতে হয়েছে।আমার শিক্ষা আমার পড়াশোনার কোনো মূল্য যার কাছে কোনোদিনও নেই।আমি বাড়ি ছাড়ার পর বেঁচে আছি,না মরে গেছে তার খবর যে নেইনি,কোথায় আছি জেনেও যোগাযোগ করেনি যে তার কাছে আদৌ আমার কোনো মূল্য আছে?আজ অভিমান কমতে ফোন করে যার কাছে অর্থহীন কিছু খারাপ ইঙ্গিত পাই তাকে স্বামী বলে মানতে সত্যি আমার কষ্ট হচ্ছে।এরকম মনের মানুষের সাথে জীবন কাটেনা।আমি ওর সাথে হাঁফিয়ে গেছি দাদাভাই,ও ভাবে আমার মা বাবা নেই বলে আমার কেউ নেই।এতদিন অপমানের ভাত যাহোক করে খেয়েছি।আর নয়।আমি দেখতে চাই আমি নিজেও কি করতে পারি।”একটানা বলে হাঁফাতে থাকে অহনা।”অহনা চোরের মায়ের বড় গলা ভালো না।দোষ টা যে কার আমি ভালোই জানি।আর এও জানি কোন কারণে ঋষিকে আর তোর ভালো লাগছেনা,কিসের নেশায় তুই সংসার ভাঙতে বদ্ধপরিকর হয়েছিস।কিন্তু জেনে রাখ তোর এই নোংরামিতে আমি নেই।তুই যদি…….”,নিলয় থমকে যায়।স্থান কাল ভুলে চিৎকার করে উঠেছে অহনা।”নোংরামি?!!!কোন নোংরামির কথা তুমি বলছো?আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।আমি এই দুবছরে কি সহ্য করেছি আমিই জানি।তোমার কি মনেহয় সারাজীবন শুধু দুবেলা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই জীবন?একটা সংসার বানাতে স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা,শ্রদ্ধা,সম্মান এগুলোর কি কোনো গুরুত্ব নেই।একজন বাইরের লোক হয়তো ভাববে বাবা ঝগড়া হলো বলে ছেড়ে চলে যাওয়ার কি ছিল?কিন্তু তুমি তো জানো দাদাভাই আমি কতটা আত্মসম্মানী?দিনের পর দিন কেউ তোমার শিক্ষা,সংস্কার,ভালোবাসা কে অপমান করবে,তোমার রান্না খাবে অথচ প্রতি মুহূর্তে সেটার বদনাম করবে, সারা বছর নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সংসার চালিয়েও খোঁটা শুনতে হবে….কেন কেন কেন? তুমি জানো, আমি দুবার দুবার ব্যাংকের ফর্ম ভরেছি,পরীক্ষার দিন সকালে তুমুল অশান্তি করে পরীক্ষা দিতে যেতে দেয়নি।আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন ছিল আমার লেখা,একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতার ডাইরি পড়ে তুমুল অশান্তি আমার কোনো অন্য সম্পর্ক আছে বলে…আমার চোখের সামনে সেই ডাইরি জ্বালিয়ে দেয়।”গলা বুজে আসে অহনার কথা বলতে বলতে।নিজের সন্তানসম নিজের সৃষ্টিকে নিজের চোখের সামনে জ্বলতে দেখার দুঃখ যা মনের গভীরে লুকোনো ছিল আজ তা চোখের জল হয়ে ঝরে পরে।নিজেকে সামলে নিয়ে অহনা আবার বলে,”তোমাদের কাছে গেলেও অশান্তি।খোঁটা শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে যেদিন বুঝলাম যে আমার যোগ্যতা কে যাচাই করতেও দেবেনা,অথচ উঠতে বসতে কিছু না করার খোঁটা দেবে ওকে না জানিয়ে পাড়ার এক বান্ধবীর বুটিকে যাওয়া শুরু করেছিলাম।আমার আঁকার হাত তো তোমার অজানা নয়,কাজের ভালো প্রশংসা পাচ্ছিলাম,কাজের কারণে বৌমনির কাছেও যেতাম…সেই সব কিছু নিয়ে চরম অশান্তি।অফিসে চাপ,পরিবারের চাপ সব বুঝে আমি যত মানিয়ে নিতে থাকলাম তত অশান্তি বাড়তে লাগলো।মাঝে মাঝে আমিও প্রতিবাদ করলে অশান্তি চরমে উঠতো।আচ্ছা দাদাভাই শরীরে আঘাত তো দেখানো যায়,মনের আঘাত কিভাবে দেখাবে?আর নোংরামি???কি না নোংরামি করেছি আমি?বল।”ওপাশে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর নিলয় বলে,”তুই এখন কোথায়?রাজীব বোসের বাড়িতে তো?কি আমি ভুল বললাম?”অহনা বুঝতে পারেনা ওর দাদা কি বলতে চাইছে।তাও বলে,”হ্যাঁ আমার কলেজ বন্ধু রুক্মিণীর বাড়িতে,আর রাজীব ওর দাদা।তাতে কি হলো দাদাভাই?”এবার নিলয় পুরো চুপ করে থাকে।কিন্তু কিছুক্ষন পর অহনার অধৈৰ্য্য কণ্ঠস্বর আবার একই প্রশ্ন করে।কিন্তু ও দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি বাবা মার স্নেহ শাসন দিয়ে বড় করা তার নিজের দাদা এরকম অভিযোগ আনবে ওর বিরুদ্ধে।
“রাজীবের জন্যেই সংসার ছাড়লি তো?ওর জন্যেই সংসার ভাঙতে চাইছিস নিজের?সবার সামনে দাদাভাই এর বাধ্য বোন হওয়ার অভিনয় করে পিছনে ওর সাথে সম্পর্ক রেখে দিয়েছিলিস?!!আজ নিজের স্বামীকে ছেড়ে ওর বাড়ি গিয়ে আছিস,তোর লজ্জা করেনা?আজ ঋষি এসে যদি আমায় উল্টে প্রশ্ন করে সব জেনেও কেন আমি ওর জীবন নষ্ট করলাম,কি উত্তর দেব আমি?একটা পুরুষ মানুষ অকারণ অশান্তি করতে পারেনা।সে তোর মধ্যে নিশ্চই কোনো বেচাল দেখেছিল,তারই ফলে মুখে কিছু বলতে না পেরে অশান্তি করতো।আমি তো ঋষিকে ভালো বলবো, ওর জায়গায় আমি থাকলে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে আগেই বের করে দিতাম।…..”,নিলয়ের আর কোনো কথা অহনার কানে ঢোকেনা।হঠাৎ নিলয় আর ঋষির গলা যেন এক হয়ে যায়।সেই স্বর অহনার কান ফাটিয়ে বুকে গিয়ে আঘাত করতে থাকে।যে দাদার জন্যে ও নিজের প্রথম ভালোবাসা কে বিসর্জন দিয়েছিল,আজ তার এই অবিশ্বাস অহনাকে যেন জ্বলন্ত চিতার আগুনে পোড়াতে থাকে।নিজেকে হঠাৎ ভীষণ একা মনে হয়।জীবনে প্রথম বার মা বাবার অভাব বোধ হয় ওর।ও বুঝতে পারে সমস্তটা মেনে নিয়ে মাথা নিচু করে ঋষির সংসারে না ফিরলে ওকে প্রকৃতপক্ষে সবাইকে হারাতে হবে।এমনকি যে রাজীবের নামে এত বড় অপবাদ জুটলো তাকেও হঠাৎ করে এদেরই একজন মনে হয়।তার ভালোবাসার সত্যতা নিয়ে অহনার সন্দেহ হতে থাকে।যে মনের গভীরে পুরোনো প্রেমিকার অবয়ব কে ভালোবেসে জীবন কাটাতে রাজি,সে চোখের সামনে সেই প্রেমিকাকে খারাপ থাকতে দেখেও এত নিরাসক্ত থাকে কিকরে? অহনার মনে ঠিক ভুল সব মিলে মিশে যেতে থাকে।সব সব ছেলের মুখ ঋষির মুখের সাথে গিয়ে মিশে যায়।সবাই যেন ওর দিকেই আঙ্গুল তুলতে থাকে।বলতে থাকে ওর ব্যর্থতার কথা।কখন যে কান থেকে ফোন নামিয়ে দিয়েছে নিজেও অনুভব করতে পারেনা।ওর দাদাভাই ওকে এত বড় বদনাম,না জেনে দেবে,এটা ওর দুঃস্বপ্নের অতীত ছিল।ওর চোখের জলে সব ঝাপসা হয়ে যায়।অন্ধকার হয়ে যায় সামনেটা।মাথা ঘুরে বুথের মধ্যে পড়ে যাওয়ার আগে ও শুনতে পায় কেউ বুথের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।
রুক্মিণী তখন থেকে হানটান করছে,অহনা সেই সকাল আটটা নাগাদ একটু আসছি বলে বেরিয়েছে,আর এখন প্রায় দশটা বাজতে চললো কোনো খবর নেই।ওর কাছে নাকি মোবাইলও নেই যে ফোন করে খোঁজ নেওয়া যাবে।একে প্রেসার লোও,তারওপর নিশ্চই কোনো অশান্তির বোঝা মাথায় নিয়ে এসেছে…তাই চিন্তা রাজীবেরও হচ্ছিল।কাল সন্ধ্যেবেলা ওর ব্যবহার যে অহনা কে কষ্ট দিয়েছে রাজীব বুঝেছিলো,কিন্তু ও কি বলতো অহনা কে?যাকে প্রতি মুহূর্তে চুরি করে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দেখতো তাকে নিজের বাড়িতে দেখেও চোখ তুলে ভালো করে দেখতে পারছেনা,বারবার ওর সিঁদুর মনে করিয়ে দিচ্ছে ও অন্যের স্ত্রী।কি যন্ত্রনায় যে রাজীব রোজ রোজ মরছে ওই জানে।অহনার কষ্ট যেচে জানতে চাইতেও সংকোচ হচ্ছে,আবার ওকে কষ্ট পেতে দেখেও বুক ফেটে যাচ্ছে।অহনা লেখা ছেড়ে দিয়েছে এর থেকে আর কোনো খারাপ খবর রাজীবের কাছে হতে পারেনা।ওর স্বামীর সম্বন্ধে কিছু না জেনেও ভদ্রলোকের ওপরই রাগ হয়েছিল।উনি জানেন না কত বড় দামি জিনিস উনি পেয়েছেন।রূপ তো অনেকের থাকে,অনেক রকম গুনও আয়ত্ত করে অনেক মানুষ।কিন্তু অহনার লেখার হাত ভগবান প্রদত্ত।রাজীব ঠিক করেছে ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে ওর ইচ্ছা ছাড়া যেচে না ঢুকলেও এই বিষয় নিয়ে অহনা শান্তিনিকেতন ছাড়ার আগে অবশ্যই কথা বলবে।কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়?আজ কলেজ অফ তাই বাড়িতেই থাকতে হবে,কিকরে অহনা কে এড়িয়ে সারাদিন থাকবে এতক্ষন এটাই ছিল মুখ্য চিন্তা।কিন্তু রুকুর চিন্তা টা থাবা বসালো রাজীবের মাথায় যখন ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুঁলো।আর বাড়িতে বসে থাকা সমীচীন নয় ভেবে রাজীব বাজারের দিকে খোঁজার অভিপ্রায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।অনেকটা সময় অহনার খোঁজার পিছনে দিয়ে কি ভেবে রুকু কে একবার ফোন করলো অহনা বাড়ি ফিরেছে কিনা জানতে।কিন্তু রুক্মিণীর উৎকণ্ঠিত গলার আওয়াজ বুঝিয়ে দিলো ও এখনো অপেক্ষার প্রহর গুনছে।হতাশ হয়ে যখন রাজীব ভাবছে বাড়ি ফিরে যাবে না কি এবেলাই একবার পুলিশ স্টেশনে যাবে রাস্তার ওপারে একটা পাবলিক টেলিফোন বুথের পাশে চায়ের দোকানে দেখলো বেশ কিছু মানুষ একটা বেঞ্চকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।রাজীব সাধারণত এইসব বিষয় কৌতুহলি কম হয়,কিন্তু আজকে কোনো এক অসীম টানে পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো।ভিড় সরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে গিয়ে ভিড়ের ফাঁক দিয়ে প্রথমেই নজরে এলো খুব পরিচিত মেরুন রঙের শালের একটা অংশ।অহনা যেদিন ওদের বাড়ির গেট খুলে ভিতরে ঢুকেছিলো ওর গায়ে ছিল।তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে ভিড় ঠেলে ঢুকে ওর পা কেঁপে গেল।যা ভয় পাচ্ছিল তাই….সরু বেঞ্চিতে অহনা কে শুইয়ে রাখা হয়েছে।বুথের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিল।ওর শাল মাটিতে লুটচ্ছে, শাড়িও এলোমেলো।বুকের শাড়ি সরে গিয়ে ভাঁজ বেরিয়ে পড়েছে,আর সেখানে উঁকি দিচ্ছে লাল রঙের দগদগে ঘা।