প্রথম ভালোবাসা

by Tamali

“মৃত্তিকা, হলো তোমার ?

অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি যে শেষ হতে চললো। বৌমা নীচ থেকে বারবার ফোন করছে।চলো এবার”,

সত্তরের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো সমীরণ  নিজের ষাটোর্ধ্ব প্রিয়তমা স্ত্রী মৃত্তিকাকে তাড়া দিতে নিজেদের বেডরুমে গিয়ে ঢোকে,”বাহ এখনো কী সুন্দর করে সাজো তুমি”।

এই বয়সেও ভালোলাগাটা উপভোগ করে মাথায় হালকা করে ঘোমটা টেনে মৃত্তিকা বলে,”আর ছোটাছুটি করতে পারিনা। এবার এইসব উপোস-তাপস,অঞ্জলি থেকে ছুটি নেব ভাবছি”।

আজও মৃত্তিকা সাজলে অপলকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে সমীরণ,কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারে না। মৃত্তিকাও বোঝে ওই চোখের ভাষা,বুঝতে পারে বয়স বাড়লে ভালোবাসা সবসময় কমে যায় না।

“চলো আমি রেডি। এই বয়সে আর ওভাবে হাঁ করে তাকিয়ে থেকোনা। এক্ষুনি মাম বুড়ি দেখলেই রসিকতা করবে”,নাতনির কথা মনে করিয়ে হাসতে হাসতে মৃত্তিকা তাড়া লাগায়।

ছোট সোসাইটির থ্রি বেডরুমের ফ্ল্যাটে ছেলে বৌমা নাতনি আর এই চির প্রেমিক স্বামীকে নিয়ে মৃত্তিকার সংসার যাপন।

“হুঁ তুমি যদি সব মনে করে নিতে তাহলে তো আমার দায়িত্বই কমে যেত।লাঠিটা কে নেবে শুনি! আমি চলে গেলে কী করে যে তুমি…”,মৃত্তিকার চিৎকারে মাঝপথেই থামতে হয় সমীরণকে।

“আবার এই অষ্টমীর দিন যত অলুক্ষনে কথা! কতবার বারণ করেছি…চলো এরপর গেলে আর অঞ্জলি দেওয়া হবে না”,কথা ঘুরিয়ে বলে মৃত্তিকা।

আর প্রত্যুত্তর না করে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে বৃদ্ধা ভার্যার ডান হাতে লাঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বাঁ হাতটা নিজের মুঠোয় নেয় সমীরণ। গুটি গুটি পায়ে দুজনে এগিয়ে যায় ফ্ল্যাটের দরজার দিকে।

 

 

“আসুন আসুন মাসিমা,এই চেয়ারটায় বসুন”,পুজোর দায়িত্বে থাকা পুলক একটা চেয়ার এগিয়ে দেয় মৃত্তিকার দিকে। বছর তিন আগের ওই অ্যাকসিডেন্টের পর থেকেই ডানপায়ে বেশিক্ষন দাঁড়ানোর জোর পায়না ও।

 

“তুমি এখানে বোস,আমি অষ্টমী পুজোটা ঠাকুর মশাইকে দিয়ে আসছি”,সমীরণ মৃত্তিকাকে চেয়ারে বসিয়ে বলে। ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ পড়ে সোসাইটিতে নতুন আসা আকাশ সেনগুপ্তের দিকে।

“আ-কা-শ…”,একটু জোরে চেঁচিয়ে হাত টা তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় সমীরণ,তারপর মৃত্তিকাকে ছেড়ে এগিয়ে যায় ঠাকুর মশাইয়ের দিকে। কিন্তু নামটা হঠাৎ করে মৃত্তিকার কানের মধ্যে দিয়ে বুকে একটা ধাক্কা মারে যেন,অনেক বছর পর যেন খুব পরিচিত একটা নাম বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানি ধরিয়ে দেয়। সমীরণের ডাকের সাথে সাথেই মৃত্তিকার মাথা ওই নির্দিষ্ট দিকে ঘুরে যায়,আর অস্থির চোখ খুঁজতে থাকে নামের মালিককে। ভিড়ের মধ্যে বসে চোখ চালিয়েও খুঁজে পায়না সমীরণের আকাশকে,আর সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়,’আজ ও তো সেই অষ্টমী,দুর্গাপুজোর অষ্টমী’।

 

যখন ফ্ল্যাটে ফিরে আসে সমীরণ মৃত্তিকাকে নিয়ে তখন মৃত্তিকা যেন কোনো অজানা কারণে ঝিমিয়ে গেছে । সমীরণ খেয়াল করেছিল আকাশকে দেখেই মৃত্তিকা কেমন যেন গুটিয়ে গেল।

আকাশ বয়সে সমীরণের থেকে কয়েক বছরের ছোট। একা পরিবারহীন আকাশ সপ্তাহ খানেক হলো ওদের সোসাইটিতে ফ্ল্যাট কিনে এসেছে। সোসাইটির সেক্রেটারি সমীরণের সাথে দরকারে আলাপ শুরু হলেও,মিশুকে সমীরণ এখন ওকে যথেষ্টই পছন্দ করে।

“একটু ভালো লাগছে শরীরটা মৃত্তিকা?” সমীরণের উদ্বিগ্ন স্বরে মাথা নাড়ে ওর স্ত্রী।

“কী হলো বলতো তোমার? ঠিকই তো ছিলে সকাল থেকে। এরকম তো তোমার কোনো কারণে উত্তেজিত হলে হয়,কিন্তু পূজামণ্ডপে উত্তেজনার তো কিছুই ঘটেনি।তাহলে…!” সমীরণ মৃত্তিকাকে চেয়ারে বসিয়ে বিছানা টানটান করতে করতে বলে।

 

মৃত্তিকা তখন চোখ বুজে নিজের জীবনের পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনাগুলো মনের আয়নায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল। এতবছর পর অনেক ঘটনা স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেও স্পষ্ট মনেছিলো সেই বছর দুর্গা অষ্টমীর দিনটা।

পাড়ার মণ্ডপে অঞ্জলি দিয়ে এসে নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে মৃত্তিকা সেদিন রেডি হচ্ছিল আকাশের সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্যে। এই সময় কানে এলো একটা বাচ্ছার কান্না, তাও পাশের বাড়ি থেকে। একটু কৌতুহল নিয়েই নিজের ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরেছিল ও সমীরণদার বারান্দার দিকে,প্রায় চার বছর পর। যেদিন থেকে সমীরণদার পছন্দের মেয়ের সাথে ওর বাড়িতে বিয়ের কথা শুরু হয়েছিল,সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া মৃত্তিকা জোর করে নিজের মনের দরজায় চাবি দিয়ে সমীরণের বারান্দার দিকের জানলাও প্রায় পার্মানেন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। এই কিছুদিন হলো মহালয়ার পর থেকে জানলা খোলা রাখছে আবার,যদিও ওদের বাড়ির সাথে সম্পর্কটা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গেছে সমীরণের বিয়ের পর থেকেই।

 

জানলা দিয়ে যখন উঁকি দিয়ে চেষ্টা করছিলো মৃত্তিকা কে কাঁদছে দেখার সেই সময় বারান্দায় বাচ্ছাটাকে কোলে করে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল ওর থেকে প্রায় বছর আটেকের বড় সমীরণ। সেই ক্লাস এইট থেকে যার সব কিছু মৃত্তিকাকে মুগ্ধ করতো,সেদিন ওই সমীরণের মধ্যে পুরোনো ওর প্রথম ভালোবাসা সমীরণদাকে কোনোভাবেই খুঁজে পায়নি মৃত্তিকা। চোখে মুখে একরাশ কালি,উস্কোখুস্কো চুলের ছেলেটা এত বছর পরও অন্যের স্বামী জেনেও উদাস করে দিয়েছিল মৃত্তিকাকে। সারাজীবন হাসিখুশি দেখে আসা ছেলেটাকে বড্ড দুঃখী আর হতাশ লাগছিলো। আর অজানা কারণে মৃত্তিকার বুকে একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছিল। বেশিক্ষন দাঁড়ায়নি ও জানলার সামনে, তাড়াতাড়ি নিজের সাইড ব্যাগটা কাঁধে তুলে ও বেরিয়ে গিয়েছিল নিজের ঘর ছেড়ে ।

 

“সত্যি বলছিস আকাশ সেদিন কলেজের ক্যাম্পাসিং-এ তুই চাকরিটা পেয়ে গেছিস?আমায় জানাসনি কেন তাহলে?” যদিও ও জানতো মেকানিক্যালের টপার আকাশ ঠিক একটা চাকরি গেঁথে নেবে,তাও নিজেদের স্বপ্নের দিকে এক পা এগিয়েছে মৃত্তিকার বিশ্বাস হচ্ছিল না।

“হ্যাঁ রে মাটি। ফ্রেশার্স হিসেবে স্যালারিও মন্দ না। ট্রেনিং এর জন্যে প্রথম ছ’মাস মুম্বাই যেতে হবে।…”,মৃত্তিকাকে প্রথম থেকেই মজা করে মাটি বলতো আকাশ।আকাশ কথা বলে গেলেও সেদিন কোনো কারণে মৃত্তিকা পুরো মন আকাশের কথায় দিতে পারছিল না।ওদের দুবছরের সম্পর্কে এই প্রথম আকাশ সামনে বসে থাকলেও ও ভাবছিল অন্য কারোর কথা।

সেদিন আকাশের দেওয়া ট্রিটও ভালো করে উপভোগ করতে পারেনি মৃত্তিকা,বাড়ি ফেরার যেন একটা তাড়া ছিল। আকাশও হয়তো বুঝতে পেরেছিল ওর অন্যমনস্কতা,তাই বেশিক্ষন আটকে রাখেনি ওকে।

 

বাড়ি ফেরার রাস্তায় আবার দেখতে পেয়েছিল সমীরণকে,ছেলে কোলে করে,সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা মনে এসেছিল,’সমীরণদার স্ত্রী কোথায়?”

 

“জানিস মিঠি ও বাড়ির সমীরণ চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছে,ছেলে হতে গিয়ে ওর বউটা বাঁচেনি রে। এত খারাপ লাগছে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ওইটুকু বাচ্ছা কে কখনো বাবা একা সামলাতে পারে! সারাদিন কাঁদছে বাচ্ছা টা” ,বাড়ি ঢোকার কিছু পরেই নিজের মায়ের বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো মৃত্তিকার কানে পৌঁছলেও মাথা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড বেশি সময় নিয়ে নেয়।

কিন্তু বোঝার পরও বিশ্বাস করতে পারেনা,”কার কথা বলছো? সমীরণদার? ওর স্ত্রীর কী হয়েছে?”

 

“আরে বউটা বাঁচেনি রে ছেলের জন্ম দিতে গিয়ে। প্রেম ভালোবাসার বিয়ে, সমীরণের বাবা মা নাকি মন থেকে মানেনি,তাই ছেলে এতদিন বাড়ি আসেনি। যখন এলো,তখন সব শেষ। মনটা খুব খারাপ সকালে শুনে থেকে। তোর বাবা বাজারে গিয়ে সমীরণের বাবার কাছে সব শুনে এসে যখন বলছিল আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারিনি”,মৃত্তিকার ইচ্ছে করছিল এক্ষুনি ছুটে ও সমীরণদার ঘরে চলে যায়। ওই বাড়ির প্রতিটা খাঁজ ওর চেনা। ছোটবেলায় পড়তে গিয়ে যে বাড়িতে ও প্রথম ঢুকেছিলো,সেখানে শেষ বার গেছিল সমীরণের বিয়ের পর একবারই। তারপর অজুহাত দিতে দিতে একদিন না যাওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে এত বছরে।

 

ওর ইচ্ছেটা ও পরেরদিন আর আটকাতে পারেনি, ছুটে গিয়েছিল সমীরণদের বাড়িতে বাচ্ছাটার কান্নার আওয়াজ শুনে।

ওকে দেখে সমীরণ যে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সেখানে কোনো প্রাণ আছে বলে মনে হয়নি মৃত্তিকার। গলা ঠেলা বেরিয়ে আসতে চাওয়া কান্নাটা আটকে ও পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল বাচ্ছাটার ছোট খাটের দিকে। অবাক হয়ে দেখেছিল সমীরণ, মৃত্তিকার মনের ভালোবাসার ছোঁয়ায় পুরোপুরি কান্না না বন্ধ হলেও অনেকটা কমে গিয়েছিল কান্নার বেগ।

 

এরপর পুরো পুজোর বেশিরভাগ টাই আর তার পরের দুমাস ওর কেটেছিল সমীরণের সদ্যজাত শিশু অয়নের সাথে। এই ঘটনায় সমীরণের বাড়ির লোক খুশি হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও মৃত্তিকার মা কিছুতেই ভালোভাবে ব্যাপারটা নিতে পারেনি। সেদিন মৃত্তিকা বুঝেছিল অসহায় শিশুর ভাগ্যের কথা ভেবে আক্ষেপ করা,আর নিজের মেয়েকে সেই অন্যের শিশুর দায়িত্ব নিতে দেখে স্বস্তি পাওয়া আসলে এক জিনিস না। তাও ও কোনো ভাবেই অয়নের ওপর ওর নিজের টানকে উপেক্ষা করতে পারেনি,হয়তো অয়ন সমীরণের ছেলে বলেও।

 

সেদিন রাতটাও স্পষ্ট মনে আছে মৃত্তিকার। পুজোর পর কেটে গেছে প্রায় দুমাস। সমীরণ তখন অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে,নিজের বাড়িতে থেকে ডিস্ট্রিবিউটরশিপের ব্যবসা শুরু করেছে।আকাশ তৈরি হচ্ছে ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করে মুম্বাই যাওয়ার জন্যে।

ফোনকলটা এসেছিল অনেক রাতে। আকাশের কল ভেবে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল মৃত্তিকার। এই নামটা সারাজীবন শুধুই ওর হার্টবিট বাড়িয়ে যাবে,এটাই ভেবেছিল সেদিন।

 

“বলো সমীরণদা”,গলা স্বাভাবিক রেখেই ফোন ধরে কথা বলেছিল ও।

“মৃত্তিকা অয়নের খুব জ্বর রে। মনেহয় সিজন চেঞ্জের ঠান্ডা লেগেছে। কিছুতেই জ্বরটা নামছে না। ডাক্তারের দেওয়া প্যারাসিটামল খাইয়েছি,মা ও বাড়িতে নেই। বড্ড ভয় করছে রে আমার…”,এত অসহায় সমীরণের গলা কখনো শোনেনি মৃত্তিকা। কিছু না ভেবেই ও বলে,”আগে জানাওনি কেন? দাঁড়াও আসছি”।

 

ফোনটা কেটে বাবা মা কে না জানিয়ে চুপচাপ মেইন গেট খুলে যখন ও বেরিয়ে গিয়েছিল, রাত তখন প্রায় একটা।

অদ্ভুত ভাবে সেদিন মৃত্তিকার বুকের মধ্যের ওমে থেকে অয়নের জ্বরের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছিল,ভোর রাতে জ্বর কমে গিয়েছিল।

ফেরার সময় সমীরণ হয়তো কৃতজ্ঞতা বশেই ওর হাতটা ধরেছিল সেদিন। এক অসহায় বাবা কিছু বলতে পারেনি যদিও মুখে,কিন্তু চোখগুলো জলে ভরে ছিল সমীরণের।

 

অঘটন ঘটেছিল তার পরে,নিজের ঘরে ঢোকার সময়।ও আশা করেনি ভোর পাঁচটায় ওর মা ডাইনিং রুমে বসে থাকবে ওর অপেক্ষায়।

বন্ধ হয়েছিল মৃত্তিকার সমীরণদের বাড়ি যাওয়া। কিন্তু সমীরণের প্রতি টান উপেক্ষা করতে পারলেও অয়নের স্নেহের আকর্ষণ বেশিদিন উপেক্ষা করে থাকতে পারেনি মৃত্তিকা। মাস খানেক পর অসুস্থ অয়নের টানে সব বাধা কেটে ফের ও ছুটে গিয়েছিল সমীরণদের বাড়িতে।

 

 

“মৃত্তিকা এই নাও কিছু খেয়ে নাও। বৌমা লুচি আলুরদম বানিয়েছে”,সমীরণের কথার আওয়াজে হঠাৎ বাস্তবে এসে পড়ে মৃত্তিকা। কখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ওর জন্যে খাবার নিয়ে এসেছে।

-“তুমি খেয়েছো?”

-“না তুমি খাও।আমি খাবো।”

-“কেন এত খেয়াল রাখো তুমি আমার? কী দিতে পেরেছি আমি তোমায় এতদিনে?”

 

মৃত্তিকা এধরণের কথা কখনো বলেনা,তাই সাময়িক থমকায় সমীরণ। তারপর একগাল হেসে বলে,”সমস্ত দায় দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছো তুমি আমায়। আমার ভেঙে যাওয়া সংসারটা এত সুন্দর করে এত বছর ধরে গুছিয়েছ,আর সর্বোপরি আমায় গুছিয়েছ,নতুন করে বাঁচতে ভালোবাসতে শিখিয়েছ। অয়ন কোনোদিন অনুভবই করেনি মায়ের অভাব কী! অয়নের মা হয়ে আমার জীবনে এসে কবে কীভাবে আমার জীবনের সবকিছু হয়ে গেছ আমি নিজেই জানিনা। তোমায় ভালবেসে আমি শান্তি পেয়েছি,আশ্রয় দিয়েছিলে তুমি আমায়। জানিনা কেন সেদিন…”,চুপ করে যায় সমীরণ। মৃত্তিকার চোখের প্রশ্ন উপেক্ষা করে বলে,”চলো অনেক কথা বলেছো,এবার খেয়ে নাও”।

আর কথা বাড়ায় না মৃত্তিকা। নিজের থালা থেকে লুচি দিয়ে তরকারি মুড়ে খাইয়ে দেয় সমীরণ কে।

 

 

“তুই কী বলছিস মাটি? তুই কি পাগল হলি? আমাদের দুবছরের সম্পর্ক,দুজনে একসাথে দেখা স্বপ্ন সব কিছু মিথ্যে করে দিতে চাইছিস? বল না কী দোষ আমার? কোন ভুলের শাস্তি দিতে চাইছিস তুই?” সেদিন আকাশের গলা বলে দিচ্ছিল ও ভেঙে পড়েছে।

 

“প্লিজ আকাশ আমি কিছু বলতে পারবো না। শুধু এইটুকু জেনে নে এছাড়া আর কোনো উপায় নেই”,মৃত্তিকা কঠিন গলায় উত্তর দিয়েছিল।

 

“কিসের উপায় মাটি? যে আকাশের রেখায় মিশে যাওয়ার জন্যে মাটি এত উৎসুক ছিল সে হঠাৎ সবটা শেষ করে দিতে চায় কী জন্যে সেটা আমায় জানতেই হবে।…”,আকাশ নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠে।

 

“আমি কিছুতেই তোর জন্যে অপেক্ষা করতে পারবো না,এটাই যথেষ্ট কারণ। এর বেশি কিছু আমি বলবো না। তুই যা মন চায় ভাবতে পারিস। আরো অনেক ভালো মেয়ে পাবি তুই,শুভেচ্ছা রইলো”। আকাশ শুধু বলেছিল,”আমি অপেক্ষা করবো মাটি,দরকারে সারাজীবন অপেক্ষা করবো”। কথাটা গুরুত্ব না দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছিল মৃত্তিকা।

তখনকার ল্যান্ডফোনের যুগে না ছিল মেসেজ,না ছিল ফোন নম্বর  ব্লক করার উপায়। কিন্তু আকাশ হারিয়ে গিয়েছিল মৃত্তিকার জীবন থেকে।

 

সমীরণ একটা কথা খুব বলে,”এই পৃথিবীর হিসেব নিকেশ এখানেই মিটিয়ে যেতে হয়। তোর ভালোবাসা তার প্রমান”।

তাহলে আকাশের ভালোবাসাও কি সেটার প্রমান দিতেই আকাশকে আবার ওর সামনা সামনি এনে ফেলেছে!!

এত বছর আগের মনের লড়াই আবার শুরু হয় নতুন করে।

 

 

দশমীর সকাল,ঘড়িতে বেলা এগারোটা বাজে। রান্নার মাসি ভাত মাংসের কারী বানিয়ে দিয়ে চলে গেছে।

শেষ দুদিনের মনের অস্থিরতা আকাশের মধ্যে এখনো কাটেনি। সেই অষ্টমীর দিন মাটিকে দেখে চিনতে একটুও অসুবিধে হয়নি ওর,একই রকম আছে মুখটা। দেখলেই বোঝা যায় খুব যত্নে থাকে।

এই দুদিন আবার পুরোনো স্মৃতি গুলো বারবার ফিরে আসছে। বারবার সেই একই প্রশ্ন কড়া নাড়ছে মনের দরজায়।

এক কাপ কফি নিয়ে নিজের চিন্তায় বুঁদ হয়েছিল আকাশ।কলিং বেলের আওয়াজে ঘোর কেটে গেল। হাতের কাপটা সিঙ্কে নামিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে একটু হলেও চমকে যায় আকাশ!

 

 

“এসো ভেতরে এসো। তুমি সেদিন আমায় চিনতে পেরেছিলে?” সময়ের স্রোতে ‘তুই’ আপনা আপনি ‘তুমি’ হয়ে যায়।

“আমায় তুই বললে কথা বলতে সুবিধে হবে”,সিঙ্গল সোফায় বসে একটু অস্বস্তি নিয়েই বলে মৃত্তিকা।

 

-“আচ্ছা ঠিক আছে। কী নিবি বল? চা,কফি না সফট ড্রিংকস?”

 

-“কিছু না। আমি তোর কাছে কিছু জবাবদিহি করতে এসেছি, বলতে পারিস। হয়তো সেদিনের তোর প্রশ্নের উত্তর দিইনি বলেই ভগবান আবার আমাদের মুখোমুখি এনে ফেললো। আজ হয়তো আমার জন্যে তোর জীবনটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল…”,শেষ করতে পারেনা মৃত্তিকা কথাগুলো। উত্তেজনায় তাড়াতাড়ি হাঁফিয়ে যায়।

 

-“মাটি প্লিজ রিল্যাক্স। আমি তোর কাছে কোনো জবাবদিহি চাইনা। হ্যাঁ কৌতুহল যে একদম নেই বলবো না। কারণ তুই বেইমানী করেছিস এটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সেদিনও সম্ভব ছিলোনা,আজ ও না। কিন্তু জানতে ইচ্ছে তো করে কেন অত সহজে আমার থেকে চলে গেলি আর সমীরণদা ই বা তোর জীবনে কবে এলো? অবশ্য তুই যদি বলতে চাস। বিশ্বাস কর এই বয়সে এসে কোনো অভিযোগ নেই আর,শুধুই কৌতুহল”,আকাশ একটানা বলে থামে।

 

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মুখ খোলে মৃত্তিকা,”সমীরণ আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা ছিল,যাকে আমি পাইনি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এমনই যখন তোর সাথে সেটল হওয়ার চেষ্টা করছি,ও ফিরে এলো আবার,সঙ্গে সদ্যজাত অয়ন,ওর ছেলে। আমাদের পাশের বাড়ি ওর পৈতৃক বাড়ি। হয়তো সমীরণ কে উপেক্ষা করে সেদিন তোকেই গ্রহণ করতাম যদিনা অয়ন থাকতো। আমার গায়ের গন্ধে ও হয়তো নিজের মা’কে খুঁজে পেয়েছিল। নিজের বাবা মার অমতে যেদিন সমীরণ কে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করি তখনও আমার ভালোবাসা এক তরফের ছিল। ও আমায় শুধুই বিয়ে করেছিল অয়নের জন্যে। তারপর কবে যে ও আমায় আমার থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেললো আমি জানিনা। অয়নের মায়ের সাথে আমি সমীরণেরও স্ত্রী হয়ে গেলাম। এখন আমায় ও মাটির পুতুলের মত আগলে রাখে। তিনবছর আগে একটা অ্যাকসিডেন্টে আমার বাঁ পা’টা কমজোরী হয়ে যাওয়ার পর ও আরো আগলে রেখেছে আমায়। বিশ্বাস কর আকাশ আমি তোকেও ভালোবেসেছিলাম,কিন্তু হয়তো প্রথম ভালোবাসার তীব্রতা বেশি ছিল। সেদিন ওই অসহায় বাবা ছেলে কে আমি ফেলতে পারিনি। কিন্তু ভাবিনি তোকে ফিরিয়ে দিলে তুই নিজের জীবন এভাবে ছন্নছাড়া করে ফেলবি। তোকে দেখার পর থেকে এক অদ্ভুত বিবেক দংশন কুরে কুরে খাচ্ছে আমায়। আমার সুখের সংসার হঠাৎ যেন টাল খেয়ে গেছে…”,অনেক বছর পর গলা ধরে আসে মৃত্তিকার।

“প্লিজ মাটি এভাবে বলিস না। বাবা মা মারা যাওয়ার শরিকি বাড়ি প্রমোটর কে দিলেও আমার ওখানে থাকতে ইচ্ছে করেনি। তাই অনেক খুঁজে এই সোসাইটি তে ফ্ল্যাট কিনি। সমীরণদার সাথে প্রথম দিন থেকেই আলাপ…প্লিজ তুই এসব ভাবিস না। কেউ কখনো জানবে না আমরা পূর্ব পরিচিত”,আকাশ চেষ্টা করে মৃত্তিকা কে শান্ত করতে।

“না আকাশ আমি সেসব ভাবছি না। শুধু মনে হচ্ছে সেইদিন সব কিছু তোকে বলে দেওয়া উচিত ছিল। সেদিন বলতে পারিনি অনুশোচনায়। মনে হয়েছিল তোর সাথে বেইমানী করলাম। কিন্তু সেদিন তোর সাথে সম্পর্ক কন্টিনিউ করলে আরো বেশি বেইমানী করতাম,কারণ তোর প্রতি ভালবাসায় খাত থেকে যেত…”,মৃত্তিকা নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করতে থাকে।

কিছুক্ষন পর যখন ও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নিজেকে অনেকটা হালকা লাগে। মনেহয় হয়তো আকাশের জীবন ও বদলাতে পারবে না। কিন্তু ওর মনটা পরিষ্কার ভাবে প্রকাশ করতে পেরে মনের ভার অনেকটা কম লাগে।

“ভালো থাকিস মাটি। আমি এখনো তোর বন্ধু আছি,তাই অহেতুক এত ভাবিস না…”,ফ্ল্যাটের দরজা খুলে সরে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলতে বলতে দেখে মৃত্তিকার নজর বাইরের দিকে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখতে পায় সমীরণ কে।

এতক্ষন সমীরণ বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তার মৃত্তিকার জন্যে। সব জেনে সব বুঝে ওই নিয়ে এসেছিল মৃত্তিকা কে আকাশের ফ্ল্যাটে।

এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা যেমন ভরে যায়,অন্যদিকে তাতে ছুঁয়ে থাকে অল্প বিষাদ।

মৃত্তিকা আস্তে আস্তে লাঠি তে ভর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে যায় সমীরণের দিকে। ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় সমীরণ,কিন্তু আকাশের চোখে চোখ রেখে। আকাশ হয়তো বুঝতে পারেনা,কিন্তু সেখানে স্পষ্ট ফুটে ওঠে কৃতজ্ঞতা। আকাশের মাটিকে সমীরণের জন্যে ছেড়ে দেওয়ার কৃতজ্ঞতা।

আকাশ তাকিয়ে দেখে ওর প্রথম ভালোবাসা তার নিজের প্রথম ভালোবাসার হাত ধরে চলে যাচ্ছে। কুড়ি বছর পর নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় ও। এই বয়সে আর অভিযোগ আসেনা,বদলে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। আস্তে আস্তে নিজের ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দেয় ও।

সমাপ্ত।

You may also like

6 comments

শুচি স্মিতা December 17, 2022 - 10:18 AM

অসাধারণ। সম্পর্ক ব্যাপারটা সত্যিই বড্ড বিশাল । আরো লেখা পাওয়ার আশায় রইলাম ❤️❤️

Reply
Anonymous December 17, 2022 - 11:57 AM

বৃদ্ধ বয়সের জুটিটা এতো সুন্দর আপনার গল্প না পড়লে হয়তো অনুভব করতাম না!! অনেক সুন্দর হয়েছে আপু। আপনি যেমন ছোটগল্প লিখে শান্তি পাচ্ছেন না আমিও এদের আরো পড়তে না পেরে শান্তি পাচ্ছি না!

Reply
Rina Sarkar December 17, 2022 - 12:21 PM

Apurbo.Aro lekha porar ashay roilam.

Reply
Dr. Anindita Saha December 17, 2022 - 7:14 PM

অসাধারণ। অনেকদিন পরে আপনার লেখা পেলাম। ভীষণ ভাবে মন ছুঁয়ে গেলো। 😘😘😘😘

Reply
Sreya Ganguly December 18, 2022 - 12:53 PM

Khub valo laglo abar tomar lekha pore ❤️

Reply
Chameli Chandra. December 18, 2022 - 3:58 PM

খুব ভালো লাগলো।একটা অন্য অনুভূতি। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতো।

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!