অন্তিম পর্ব:-
নিজের ঘরটা গুচ্ছোছিলো অমৃতা। আর কদিন এখানে থাকবে জানেনা।পেয়ে গেছে ও সরকারী চাকরি,অপেক্ষা করছে জয়েনিং লেটারের। যেদিন রেজাল্ট আউট হলো ওর মনে হচ্ছিল ও বোধহয় কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।বাবার স্বপ্ন ছিল এটা,খুব মনে পড়ছিল সেদিন ওদের কথা।
সৃজিতও সেদিন খুব অন্যরকম ব্যবহার করেছিল, যেন প্রচন্ড খুশি। মিষ্টি এনে সবাইকে খাওয়ালো।ঠিক মেলাতে পারেনি অমৃতা।যদিও শেষ দুমাসই ও সৃজিতকে ঠিক মেলাতে পারছে না।
জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণের পরও মনটা কদিন ধরে খুব খারাপ,কারণটা হয়তো ও বুঝতে পারছে কিন্তু গুরুত্ব দেবে না বলেই সেটা নিয়ে ভাবেনি।
ওর পরীক্ষার দিন থেকে ধরলে আজ দুমাস হতে চললো সৃজিতের হাবভাব সমস্ত কিছু ওকে অবাক করে দিয়েছে। সেদিনের পর থেকে নিজের চেষ্টায় সব কিছু একা একা করতে করতে আজ অনেকটাই স্বাবলম্বী ও। এখন নিজের সমস্ত কেয়ার ও নিজেই নেয়।এই দুমাস অমৃতা শুধু ঘর গুছিয়েছে, গল্পের বই পড়েছে,সৃজিতের সাথে বসে ওয়েব সিরিজ দেখেছে,আর কয়েকদিন সৃজিতের আবদার মেনে রান্না করেছে।
এই দুমাস অমৃতা যখনই সৃজিতকে ওর কাজে হেল্প করতে গেছে,ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে সৃজিত নিজে নিজে করার চেষ্টা করেছে নিজের কাজ।
সব মিলিয়ে অমৃতার এখন খুব ভালো দিন কাটছে,কিন্তু তাও কেন যে ও মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে ও জানেনা। আগের সপ্তাহে নিজের হুইল চেয়ার আর রতনকে সঙ্গী করে সৃজিত অফিস গিয়েছিল। অমৃতা প্রায় জেদ করা স্বত্বেও ওকে নিয়ে যায়নি।সেদিন সারাটা দিন যতক্ষন না ওরা ফিরেছে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারেনি অমৃতা। সৃজিত কে বার দুই ফোন করার পরও ও ফোন তোলেনি, তখন সারাদিন ধরে রতনকে যে কতবার ফোন করেছে…
সবচেয়ে বড় কথা সৃজিত উঠে দাঁড়াতে পারছে,ক্রাচ নিয়ে অল্প হাঁটতেও পারছে।ও যেভাবে মনের জোর দেখাচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেও হাঁটতে পারবে ভবিষ্যতে,জানে অমৃতা।
“অমৃতা দিদি তোমার সাথে কেউ একজন দেখা করতে এসেছে। বসার ঘরে বসিয়েছি”,হঠাৎ দরজার বাইরে রতনের গলার আওয়াজে চমকে গেলেও নিজেকে সামলে ও বলে,”আমার সাথে দেখা করতে এসেছে!!কী নাম বলেছে?”
“নাম জানিনা।দাদাবাবু কথা বলছে।তুমি এসো”, রতনের গলায় তাড়ার স্বর।
“ঠিক আছে তুমি যাও,আমি আসছি”,অমৃতা কৌতূহলী হয়ে পড়ে।
“এসো অমৃতা, তোমার কাকা এসেছেন,তোমার জয়েনিং লেটার নিয়ে…তোমরা কথা বলো আমি আসছি”,অমৃতা বসার ঘরে গিয়ে ঢুকতেই সৃজিত বলে ওঠে,পরমুহূর্তেই ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও, নিজের ঘরমুখো হয়। অমৃতা স্বভাব বশত সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে যেতে গেলে ও হাতের ইশারায় ওকে ‘পারবো’ বলে। তারপর নিজেই আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায় বসার ঘর থেকে।
অমৃতা এবার কাকার পাশে এসে বসে,”কী খাবে কাকা? একটু শরবত দিতে বলি?”
“না রে মা,জামাইও বলছিল।কিন্তু এই অবেলায়…তুই বল,কেমন আছিস মা? এই বুড়ো কাকাকে একদম ভুলেই গেলি?” কাকা বরাবরই ভালোবাসতেন ওকে।তাই কাকার কথা শুনে ঘাড়টা দুদিকে নাড়তে নাড়তে কাকার হাতটা ধরে,একটা কান্নার দলা হঠাৎ যেন গলায় পাকিয়ে ওঠে,যা একদমই ওর স্বভাব বিরোধী।হয়তো কয়েকদিনের মন খারাপও এর কারণ।
কাকার বাড়ির এড্রেস দেওয়া ছিল বলে আগেই কাকাকে জানিয়ে রেখেছিল লেটার আসলে ওকে খবর দিতে,গিয়ে নিয়ে আসবে।কিন্তু ওর কাকা নিজেই দিতে চলে এসেছেন সেটা একদিক দিয়ে ওকে শান্তি দিয়েছিল,কাকিমার মুখোমুখি হতে হবে না ভেবে।
কিছুক্ষন কাকার সাথে কথাবার্তার পর ওঠার সময় তিনি বললেন,”জামাই ভালো হয়েছে অমি, শুধু একটাই দুঃখ তুই দাদার অবর্তমানে আমায় কন্যাদানের অধিকারটুকু দিলি না? তুই সুখে থাক এই আশীর্বাদ করি,আর চিন্তা করিসনা জামাই সুস্থ হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি।”
অমৃতা চুপচাপ শুনে কোনো জবাব দেয়না, বদলে উঠে গিয়ে কাকার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।
কাকাকে বাড়ির গেট অবধি ছেড়ে বসার ঘরে এসেই ঢোকে অমৃতা,সোফায় বসে চিঠিটা খোলে। এক সপ্তাহ পর জয়েনিং,দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক হসপিটালে।মানে গিয়ে থাকতে হবে।এক সপ্তাহে অনেকগুলো কাজ মেটাতে হবে ওকে।উঠে পড়ে ও সোফা ছেড়ে।
“আসছি”,অমৃতার আওয়াজে চোখ খুলে তাকায় সৃজিত। নিজের খাটের ওপর বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আধশোয়া হয়ে বসেছিল ও।এখন ঘরের টেবিলে বসেই ব্যবসার কাজ করে অনলাইনে।যখন কষ্ট হয়,এসে একটু রেস্ট নেয়।অমৃতার কথায় একটা উদাস হাসি হেসে বলে,”আজকাল এঘরে আসতে গেলে পারমিশন নিচ্ছ বুঝি?”
-“তুমি রেস্ট নিচ্ছিলে,তাই…”।
-“না আজ একটু ওপর নিচ হয়ে গেছে,তাই অল্প কষ্ট হচ্ছিল বলে শুয়ে ছিলাম”।
-“দেখেছ তো কীরকম অনিয়ম করছো তুমি! তোমায় চেয়ার ইউজ করতে বলেছেন ডক্টর,ক্রাচ শুধুমাত্র বাথরুম যেতে।ওপর নিচও দিনে বড়জোর একবার বলেছেন,কিন্তু তুমি শেষ কদিন বড্ড বাড়াবাড়ি করছো।”
হাসিটা ঠোঁটে ধরে রেখে সৃজিত আবার বলে,”আমার কাজ তো আমাকেই করতে হবে অমৃতা।কয়েকদিন পর থেকে কে আর খেয়াল রাখবে বলো? কোথায় পোস্টিং দিলো তোমায়?”
চুপ করে থাকে অমৃতা।এতক্ষণ ওর প্রিয় জায়গা সৃজিতের খাটের এক কোনে বসে কথা বলছিল মুখ তুলে,এবার মুখ নামিয়ে নেয়।
কিছুক্ষন ওর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে বসে সৃজিত,”এই মেয়ে কাঁদছো কেন? কী হয়েছে? খুব খারাপ হসপিটালে দিয়েছে? বলো না আমায়।”
নিজের আবেগকে কিছুটা সামলে প্রশ্ন করে অমৃতা,”আমি চলে গেলে তোমার সত্যি কোনো অসুবিধে হবে না? একা একা তুমি সব পারবে?”
-“না পারবো না। খুব কষ্ট হবে।কিন্তু চেষ্টা করবো।”
-“সেন্টার থেকে একজন নার্স আরও কিছুমাস নাও সৃজিত”।
-“না অমৃতা আর অন্য কারোর হেল্প নিয়ে বাঁচবো না আমি।সত্যি বলতে কী নার্স কখনো সেই কাজটা পারেনা যে টা নিজের স্ত্রী পারে,তার সাবস্টিটিউট কেউ হয়না। সুতরাং সেটা আশা করাও ঠিক না।…”
-“সৃজিত…!!!”
-“কী হলো যে টা সত্যি সেটা বদলানো অত সহজ না অমৃতা। তুমি ভয় পেওনা।তোমায় আমি আটকাবো না।আর আইন অনুযায়ী আমাদের বিয়ে না হলেও বিয়ের ছবি আর কন্ট্রাক্ট পেপারের সাহায্যে আইনত বিচ্ছেদ সম্ভব। দুদিনের মধ্যে সেই কাগজ এসে যাবে”।
অমৃতা এবার মুখ তুলে সরাসরি তাকায় সৃজিতের দিকে,জল ভরা চোখে। বড্ড সাধারণ দেখতে শ্যামলা মেয়েটাকে সিঁদুর পড়লে বেশ মিষ্টি লাগে। সৃজিতের তখন ইচ্ছে করে ওই মুখটা দুহাতের মধ্যে নিতে। আজকের মডার্ন যুগে হয়তো দেখতে ভালো নয় বলে কোনো সংজ্ঞা ই হয়না। কিন্তু কিছু কিছু মুখে একটা নরম সরলতা থাকে কাঠিন্যের আড়ালে। কাঠিন্য ভেঙে গেলে তবেই সেই সৌন্দর্য্য ভালো করে নজরে আসে। এতদিন ধরে কঠিন মুখোশ পরে থাকা অমৃতার চোখের জলে সেই কাঠিন্য ধুয়ে যেতে সৃজিতের নজরে এলো সেই সহজ সরল সুন্দর মুখটা। আর পারলো না ও। অমৃতার জলে ভরা চোখ দুটো অনেক কিছু বলে দিল এক নিমেষে। দুটো হাত দুদিকে ছড়িয়ে চোখের ইশারায় সৃজিত অমৃতাকে নিজের বুকেতে ডাকলো,আর মুহূর্ত দেরি না করে স্বভাব কঠিন বুঝদার মেয়েটা ছোট বাচ্ছার মত ঝাঁপিয়ে পড়লো সৃজিতের বুকে। নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখে দিল সৃজিত,কিন্তু ওর কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো না। ও জানে অনেক লড়েছে মেয়েটা নিজের বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে,তাদের মৃতুতেও কারোর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারেনি। অনেক কান্না জমা হয়ে আছে ওর বুকে।দুঃখের কান্না,হারানোর কান্না, অসহায়ত্বের কান্না, অভিমানের কান্না,আর সর্বোপরি ভালোবাসার কান্না। তাই একটু কাঁদুক ও,কেঁদে হালকা হোক,তবেই বলতে পারবে নিজের কথা।
কান্নার দমক একটু কমতে অমৃতা ফিসফিস করে বলতে লাগলো,”আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো না।কালো মেয়ে তোমার পছন্দ না।তুমি দয়া করছো।আমি তোমায় ভালোবাসি বুঝতে পেরে মায়া দেখাচ্ছো।কোনোদিন ভালো করে ছুঁতে পারবে না তুমি আমায়।আমার রঙ দেখলে…”,আর ওকে কথা বলতে দেয়না সৃজিত। ওর মুখটা তুলে ওর ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। ও জানে সেদিন ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিমানে এসব বলছে মেয়েটা। কিন্তু সেদিন সৃজিত বুঝতে পেরেছিল অমৃতা ওকে টেস্ট করছে। সেসব আর কিছু বলেনা। শুধু নিজের ভালোবাসার প্রমান দিতে থাকে চুপচাপ।
“কি গো এভাবে বসে যেতে পারবে? বললাম তুমি সামনের সিটে বোস। প্রায় ঘন্টা দুই লাগবে যেতে। কষ্ট হবে তোমার”,অমৃতা পাশে বসা সৃজিত কে সমানে বকতে থাকে।
“একটু মুখটা বন্ধ করবে? আমি একদম ঠিক আছি।আর আমায় একদম তাড়িয়ে বাড়ি পাঠানোর চেষ্টা অবধি করবে না। আমি ওখান থেকেই ব্যবসা সামলাতে পারবো।দুমাসে একবার এলেই হবে। বাবার ব্যবসার মাক্সিমামটাই এখন অনলাইনে হয়,সেই কোভিড কাল থেকে”,রোগটার নাম বলেই চুপ করে যায় সৃজিত,জানে অমৃতা রোগটার নামেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
আজও অন্যমনস্ক হতে দেখে সৃজিত হাত রাখে অমৃতার কাঁধে।অমৃতা ওর দিকে তাকাতে মৃদু হেসে বলে,”আমি তো আছি এখন তোমার সাথে। সবসময় থাকবো,যদিনা তুমি এই অথর্ব বরকে তাড়িয়ে…উফফ!!”,অমৃতার চিমটি খেয়ে চুপ করে হাসতে থাকে।
অমৃতাও হাসতে হাসতে বলে,”সে উপায় আছে! এই কেলে কুৎসিত বউকে পাহারা দিতে উনি চললেন গন্ড গ্রামে।এমন পাগলামো কেউ করে? বললাম আমি সপ্তাহে সপ্তাহে আসবো, বাবুর পছন্দ হলো না।দেখি কতদিন টিকতে পারে!”
সৃজিত হাত রাখে অমৃতার হাতে,”দেখো অমি আমি চাই তোমার সব স্বপ্ন পূরণ হোক,আর আমি সঙ্গে থাকি। আমি জানি তুমি আগে গিয়ে সব ঠিক করে না এলে আমায় এত সহজে নিয়ে যেতে না। যেখানে তুমি আছো, সেখানে আমার কীসের চিন্তা!একঘেয়ে জীবন কোনদিনই আমার পছন্দ না,এটা তো সেক্ষেত্রে বেশ অন্যরকম একটা জীবন দেখা হবে,আমি বাঁচবো তোমার ওপর নির্ভর করে”।
অমৃতা একটা তৃপ্তির হাসি হেসে মাথা ঠেকায় সৃজিতের কাঁধে। ওরা আইনত বিচ্ছেদের বদলে আইনত রেজিস্ট্রি করে এসেছে গতকাল। কন্ট্রাক্টের সময় ফুরোয়নি,বরঞ্চ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিয়ে তো আসলে একটা কন্ট্রাক্ট ই,একে অপরের সাথে থাকার কন্ট্রাক্ট,একে অপরের পাশে থাকার কন্ট্রাক্ট। এই কন্ট্রাক্টের মেয়াদকাল নির্ভর করে ভালোবাসার স্থায়িত্বের ওপর। হয়তো ভালোবাসা ছাড়াও মন্দবাসা নিয়েও অনেক বিয়ে আজীবনকাল টিকে থাকে। কিন্তু সৃজিত আর অমৃতা এখন আর মন্দবাসার কথা ভাবেনা। ভালোবাসার হাত ধরে ওরা হাঁটতে চায় বাকি জীবন একে অপরের ওপর নির্ভর করে। সময় বলবে কেমন হবে ওদের পরবর্তী জীবন,কিন্তু এখন শুধু ওদের মধ্যে ভালোবাসা বেঁচে থাক,শেষ হোক মন্দবাসার কন্ট্রাক্ট।
সমাপ্ত।
3 comments
অসাধারণ সুন্দর গল্প, ভালো বাসা, মন্দ বাসা। মন ভরে গেল। কোভিডের ভয়াবহ যন্ত্রণা। ভালো বাসা ফুরোলে ও পরিবার টিকিয়ে রাখাসব নিয়ে দারুণ
Koto shundor lekhoni tomar!
অপূর্ব ।আপনার প্রতিটি গল্পই মনে গেঁথে যায় ।