ভালোবাসা মন্দবাসা-অষ্টম পর্ব

by Tamali

“সৃজিত আপনি সার্জারির পরও হাঁটতে পারবেন কিনা শিওর না,তবে এখনকার অবস্থার থেকে বেটার ফিল করবেন।তবে সার্জারির পর কিন্তু কিছুদিন সাবধানে থাকতে হবে। তারপর ফিজিওথেরাপি,এক্সারসাইজ সমস্ত নিয়ম মেনে করলে হাঁটতে পারার চান্স আছে। আর সবার আগে দরকার মনের জোর।ওকে?” ডাক্তারের কথায় ঘাড় নাড়ে সৃজিত।
“ডক্টর পুরোপুরি রিকভার করতে কতদিন সময় লাগবে?” সৃজিত নিজেই জিজ্ঞেস করে।

“দেখুন ম্যাক্সিমাম ছমাস ধরে রাখুন”,ডাক্তারের জবাবে ঢোঁক গেলে অমৃতা। ওর পরীক্ষা আর একমাস পরে আর তার মাস দেড়েক পর ওর রেজাল্ট বেরিয়ে যাবে। তারপর যেখানে জয়েনিং দেবে যেতে হবে।

ডাক্তারবাবু দিন পনেরো পর একটা ডেট দেন অপারেশনের। অমৃতা বুঝতে পারে পরীক্ষার আগে ওর কাজের চাপ অনেকটা বেশি থাকবে।ঠিক আছে সামলে নেবে ও,মনে মনে ভেবে নেয়।
যখন হসপিটাল থেকে বাড়ি আসে বেলা অনেকটাই হয়েছে। সৃজিতকে প্রথমে ফ্রেস করে দেওয়ার তোড়জোড় করতে থাকে।
“তোমার পরীক্ষা তো এসে গেল। সব মিলিয়ে মনেহয় না তোমার হাতে ছমাস সময় আছে?” সারা রাস্তা ধরে গাড়িতে এটাই ভাবতে ভাবতে এসেছে সৃজিত। ও নিজেও জানেনা ওর সুস্থ হওয়ার চান্স কতটা! কিন্তু শারীরিক মানসিক ভাবে যে ও অমৃতার ওপর বড্ড নির্ভরশীল হয়ে গেছে। ও চলে গেলে ওর কী হবে সৃজিত নিজেও জানেনা।একান্তই জেদের বশে যে সম্পর্কটার জন্ম দিয়েছিল ও,সুস্থ হলে যার ভবিষ্যৎ ওর কাছে অনিশ্চিত,এই মুহূর্তে নিজের স্বার্থে সেই সম্পর্কটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওর কাছে।
আজকাল ওর বিবেক মাঝে মাঝে ওকে বড্ড ডিস্টার্ব করে। অমৃতা কে বিয়ের জন্য বাধ্য করার কারণে প্রায়ই বিবেক দংশনে ভোগে ও। কিন্তু শেষ একমাস ওই ঘরে অমৃতা শোয়ে বলে নিশ্চিন্তে যে কত গভীর ঘুম হয় ওই জানে। কতদিন যেন ও এতো ভালো করে ঘুমোয়নি। নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা সৃজিতের মনে তাই বিবেক যন্ত্রণা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়না।
“অত চিন্তা তোমায় এখন থেকে করতে হবেনা। অপারেশনের পর তুমি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। অতদিন সময় লাগবে না”,অমৃতা ওর গা স্পাঞ্জ করতে করতে বলে।
“আমি সুস্থ না হলেও তোমায় মুক্ত করে দেব,ভয় নেই। আমি এমনিও সারাজীবন বোঝা হয়ে জীবন কাটাতে পারবো না। তোমার অনেকটা ক্ষতি আমি করে দিয়েছি,জানিনা এ ক্ষতিপূরণ হবে কী না?কিন্তু আর না”,সৃজিত প্রথমবার এরকম কথা বলে। কাজ থামিয়ে ওর মুখের দিকে তাকায় অমৃতা।
“আমি জানিনা ক্ষতি কিছু হয়েছে কী না,কিন্তু কারণটা জানতে খুব ইচ্ছে করে। কেন এরকম জোর করে একটা সম্পর্ক তৈরি করলে যাতে কোনো প্রাণ নেই”,অমৃতা আস্তে আস্তে বলে।
কিছুক্ষন থেমে সৃজিত মুখ খোলে।কিছুটা সত্যি আর কিছুটা মিথ্যে দিয়ে জবাব দেয়,”আমি সারাজীবন একা বাঁচতে অভ্যস্ত ছিলাম। অনেক ছোট থেকে একা শুই। কলেজে পড়া অবধি আমার মাল্টিপ্লেয়ার গেমের নেশা ছিল,সারারাত জেগে গেম খেলতাম।ঘুমোতে যেতাম ভোররাতে। ব্যবসায় আসার পর যেদিন বন্ধুদের সাথে পার্টি করতাম না রাত জেগে ব্যবসার কাজ করতাম বা ওয়েব সিরিজ দেখে রাত কাটিয়ে ভোরে ঘুমতাম।কিন্তু ওটা ছিল আমার চয়েস।এখন অপারেশনের পর আমি একাকীত্ব কী বুঝি। মনে হত সারাদিন তুমি কাছে থাকো,রাতেও। কিন্তু তুমি যতই নার্স হও,তুমি আমার আত্মীয়া ও। তোমাকে চাইলেই সারারাত আমি আমার ঘরে আটকে রাখতে পারতাম না। তুমি জানো শেষ একমাস আমি যেরকম ঘুমিয়েছি,সারাজীবন কোনোরাত এত ভালো ঘুমোয়নি। আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করে তাদের কাছেও একজন স্ত্রী একজনের নার্সের থেকে অনেক বেশি সম্মানীয়। এটাই আমাদের সমাজ”।
অবাক হয়ে যায় অমৃতা সৃজিতের কথা শুনে। ও কখনো ভাবিনি একটা মিথ্যে বিয়ের আড়ালে একটা এত বড় সত্যি আছে। ভুল তো কিছু বলেনি সৃজিত। নার্সিং হোমের মত প্রতিষ্ঠান থেকে নাইট শিফট করে কাকার বাড়ি ফিরলে কাকিমাও তো কত কটু ইঙ্গিত করেছে।এমনকি পার্থও…।
আর কথা বাড়ায় না অমৃতা। ও এখনো কোনো প্রাণ অনুভব করে না ওদের এই সম্পর্কে। আসলে ভালোবাসা কথাটার প্রতিই ওর বিশ্বাস হারিয়ে গেছে। ও জানে দরকার ফুরোলে সৃজিতও ওকে মুছে দেবে জীবন থেকে। কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ এর কোনো আইনগত অস্তিত্ব নেই জেনেও ওরা চুক্তিপত্র বানিয়েছে হয়তো সেই কারণেই।
আর ও বুঝতে পারে সৃজিত হয়তো ওকে পছন্দ করে,কিন্তু সেই অর্থে ভালোবাসে না। ভালোবাসা আসলে অনুভব করা যায়,সেটা লুকিয়ে রাখা যায়না। ওদের সম্পর্কটা আসলে পারস্পরিক দরকারে তৈরি। অমৃতার দরকার আশ্রয় আর টাকা,অন্যদিকে সৃজিতের দরকার নির্ভরশীল মানুষের। ওর জীবনে মানুষেরই বড্ড অভাব।রজতদার সাথে সম্পর্ক কিছুটা কাছের হয়েছিল একসিডেন্ট এর পর,এখন আবার বিয়ের পর দূরত্ব বেড়ে গেছে। এই একমাস রজতদা ফোন করেছে হাতে গুনে দুবার,দেখতে আসেনি একবারও। আসলে ওদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই,ওদের রাগ হওয়া স্বাভাবিক।
“অমৃতা আজ একটু খাইয়ে দেবে?” এখন নিজেই খেতে পারে যদিও তাও আবদারের সুরে বলে সৃজিত।
অমৃতা এমনিও কথা বেশি বলেনা কোনদিন,এখনও চুপচাপ এগিয়ে আসে।
“তোমার পরীক্ষা আর রেজাল্ট মিলিয়ে হাতে কদিন সময় আছে?” সৃজিত যে ভাবনা টা মন থেকে বের করতে পারছে না বুঝতে পারে অমৃতা।
“মাস তিনেক”,ওর সংক্ষিপ্ত জবাব বেশি অস্থির করে সৃজিত কে।
“আচ্ছা তুমি সত্যি তারপর চলে যাবে?” সৃজিত কী শুনতে চাইছে বুঝতে পারেনা অমৃতা। ওদের চুক্তিতেই তো আছে,অমৃতা তার পর চাইলে চলে যেতে পারে। উত্তর দেয়না তাই ও।
-“কী হলো বলো?”
-“খেয়ে নাও সৃজিত,আমারও খুব খিদে পেয়েছে।”
-“ওহ সরি সরি! আমার খেয়াল ছিল না।আমার খাওয়া হয়ে গেছে,তুমি খেয়ে নাও।”
-“না তুমি আগে শেষ করো। এখনো তোমার খাওয়া হয়নি।”
হঠাৎ অমৃতার হাতটা চেপে ধরে সৃজিত,”তুমি চলে গেলে আমার কী হবে? প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না”।
“সৃজিত ওসব এখন অনেক দেরি। এখন থেকে ওসব নিয়ে ভেবোনা।অপারেশন টা ভালো ভাবে হয়ে যাক আগে”,মুখে এসব বললেও বড্ড অসহায় অনুভব করে অমৃতা নিজেকে।
সৃজিত চুপচাপ খাওয়া শেষ করে হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায়।শরীর একদম ভেঙে গেছে ওর এই ছমাসে। ভালোবাসা জন্মেছে কি বুঝতে পারেনা অমৃতা,তবে একটা অদ্ভুত মায়া হয়। ঠিক রাজপুত্রের মত দেখতে ছিল ওর দিদির দেওরকে বিয়ের সময়। ওরা নিজেদের মধ্যে মজাও করেছে কত ওকে নিয়ে। আর এখন চোখের নিচে কালি পরে,শরীর ভেঙে সেই ছেলে দেখতে বা স্বভাবে রাজপুত্র আর নেই।

সার্জারির দিনও রজত বা প্রিয়া কেউ আসেনা। প্রিয়ার রাগটা অমৃতা বুঝতে পারে,কিন্তু রজত কেন এরকম করছে কিছুতেই মাথায় ঢোকেনা অমৃতার।ওটি তে ঢোকার সময় বড্ড শুকনো লাগে সৃজিতের মুখটা।
সৃজিতের হাতে হাত রেখে ‘আমি আছি’ সেই মুহূর্তে বলাটা দরকার হলেও অমৃতা নিজেও জানেনা ও কদিন থাকতে পারবে? রজত আসলে ও ভেবেছিল আসল কথাটা ও খুলে বলবে ওকে,কিন্তু সব হিসেব গোলমাল হয়ে যায় ওর।ওটির সামনে বসে সৃজিতের সাথে সাথে নিজের জন্যেও ভাবনা ওকে কুরতে থাকে। পরীক্ষার আর পনেরোদিন বাকি,বুঝতে পারেনা কী ভাবে সামলাবে সবটা।কোথা দিয়ে সময় কেটে যায়,শেষ হয় অপারেশন।
“মিসেস রায় অপারেশন সাকসেসফুল। কিন্তু আপনি নিজেও জানেন সুস্থ হতে এখনো মিনিমাম মাস পাঁচেক সময় লাগবে।এই সময়টা খুব কঠিন,তাই আপনাকে কিন্তু ট্যাক্টফুলি সামলাতে হবে।কোনোভাবে হতাশ হতে দিলে হবে না।আমার বিশ্বাস মিস্টার রায় কয়েকমাসের মধ্যেই হাঁটতে পারবেন। লেটস হোপ ফর বেটার”,সৃজিতের ডাক্তার অমৃতাকে হাসিমুখে কথাগুলো বলে পিঠে আলতো চাপর দিয়ে চলে যায়। বয়স্ক ডাক্টরবাবুর কথাগুলো মনে অনেকটা ভরসা দেয়।
অনেক্ষন পর নিজের মনে স্বস্তির হাসি হেসে করিডোরের চেয়ারে বসে নিঃশ্বাস ছাড়ে অমৃতা। যেন এতক্ষন দমবন্ধ হয়েছিল, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয় ও। সৃজিত সুস্থ হলে তবেই ও মুক্তি পাবে, নিজের রাস্তায় এক পা হলেও এগোয় ও।
সৃজিত সুস্থ হওয়া মানে ওর দায়িত্ব কমবে।আবার ও বাঁচতে পারবে নিজের মত।শুধু পরীক্ষাটা ভালো করে দিতে হবে,তারপর বাকিটা ভগবান যা করার করবে। ও চাকরি পেলে চুক্তি মতে মুক্তিও পাবে,তখন নাহয় সৃজিতের জন্যে একজন বিশ্বাসী নার্স কিছু মাসের জন্য ওই দেখে দেবে।
চোখ বুঝে কপালে হাত ঠেকায় ও ভগবান কে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু ভগবানের মুখে মনেহয় না হাসি ফোটে। ভবিষ্যৎ হয়তো এতোটাও হাসার মত হবেনা ওর জন্যে,ভগবান এটা বুঝতে পারে। সরল সাধাসিধে মেয়েটা জীবনে পাওয়ার ঘর কতটা পূরণ হবে ভাগ্যদেবী নিজেও সংশয়ে থাকে।

ক্রমশ…

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!