“হ্যাঁ বলো”,একহাতে ফ্ল্যাট লক করতে করতে অন্য হাত দিয়ে মধুজার কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরে বলল অরিজিৎ।
“হমম শোনোনা,তুমি বেরিয়ে পড়েছ?” মধুজা গলাটা নরম করে জিজ্ঞেস করলো।অরিজিৎ বুঝলো ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’,এত মধুর সুরে মধু কথা বলছে মানে নির্ঘাত ফাঁসাবে।কিন্তু জিৎ ও এতদিনে সংসারের প্যাঁচ পয়জার ভালোই শিখে গেছে,তাই মধু কে সুযোগ না দিয়ে বললো,”হ্যাঁ, তোমায় বললাম না আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন আছে…তাই পাঁচ মিনিট আগেই বেরিয়ে পড়লাম।রাস্তার আজকাল যা অবস্থা হয়েছে,ঠিক সময় অফিস পৌঁছনোই বিশাল ব্যাপার।তুমি আর বুঝবে কি করে বল,নাকের ডগায় অফিস,কিছু না পেলে হেঁটেই চলে যেতে পারবে”।মধুজা জিৎ এর ঠেস মারা কথাটা গায়ে মাখলনা,এখন মাথা ঠান্ডা রেখে কার্যোদ্ধার করতে হবে,নাহলে কপালে দুর্ভোগ আছে।এখন জিৎ ই একমাত্র ভরসা।তাই গলার স্বর আরেকটু মোলায়েম করে বললো,”দেখোনা বাবা যে কি করে!কি করে ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছে,সাথে ভীষণ কাশি।আজ বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছেনা।এদিকে মায়ের পায়ের ব্যাথা টাও বেড়েছে।কে যে আজ বুবকা কে নিয়ে আসতে যাবে জানিনা।আমার একে কাজের চাপ,তার ওপর নতুন ম্যানেজার, কাজের সময় কোনো অজুহাতেই বেরোতে দেবেনা।।তোমায় তাই বলছিলাম আর কি…..”।মধুজার কথা মাঝ পথেই থেমে যায় জিতের বিরক্তিপূর্ণ আওয়াজে।”তোমায় তখনই বলেছিলাম একটা আয়া রাখো।তোমার মা বাবা দুজনেরই বয়স হয়েছে।এভাবে বুবকার দায়িত্ব ওঁদের ঘাড়ে চাপিও না।আমায় আজ সময় মতো অফিসে পৌঁছতেই হবে।আজকের মিটিংটা খুবই ইম্পরট্যান্ট,একটা ইমেজের ব্যাপার আছে।লেটে পৌঁছনো আজ কিছুতেই যাবেনা।তুমি অন্য কোনো ব্যবস্থা কর।”জিতের কথা শেষ হতেই মধু ফেটে পড়লো,”আমিই বা কেন রোজ রোজ ভাববো, ব্যবস্থা করবো?বুবকা তো তোমারও ছেলে,তুমি ভাব।ব্যাংকের এত চাপের কাজ…সারাক্ষন মাথা সজাগ রাখা,তার মধ্যে সংসারের চিন্তা।আমি পারবোনা,তুমি যা পারো ব্যবস্থা করো।বুবকা কে মায়ের কাছে যাকে দিয়ে পারো পৌঁছে দাও।আমি ফোন রাখছি।”ফোন রেখে মাথাটা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে মধুজা।ব্যাংকের কেরানিগিরি করে মাথা গরম করলেই সব গন্ডগোল হয়ে যাবে,কিন্তু মাথা ঠান্ডা করবো ভাবলেই কি ঠান্ডা হয়?মাথায় এসে ভিড় জমায় হাজার সমস্যা।ও জানে জিৎ এর আজ ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে,কিন্তু ওই বা কি করবে?? ভোর পাঁচটায় চোখ খুলে থেকে চরকি নাচন নাচে।রান্না,বুবকাকে রেডি করা,ওকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আসা,ফিরে নিজেদের চা করা,কাজের মাসি আসে তাকে কিছুটা সময় দেওয়া,চান খাওয়া,জিৎ এর খাবার গুছিয়ে রেখে বেরোতে বেরোতে ৯টার পর হয়ে যায়।আবার তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নতুন নিয়ম হয়েছে ৯.৩০এর মধ্যে ডেস্ক রেডি করে ফেলতে হবে।ব্যাংকে এসেও তাই পাঁচ মিনিট বসে নিশ্বাস নিতে পারেনা।শুনে মনে হয় এই তো বাড়ির কাছেই কর্মক্ষেত্র কিন্তু হেঁটে বা রিকশায় আসতে আসতে ৯.২০-৯.২৫ হয়েই যায়। এরপর একদিকে নিজের কাজ,অন্যদিকে বুবকা যতক্ষন না মায়ের কাছে পৌঁছছে তার চিন্তা।জিৎ এর ইভিনিং শিফট..বাড়ি থেকে বেরোয় সাড়ে ১২টা নাগাদ…ভীষণ ভুলো মন ওর…ভালো করে ফ্ল্যাট লক করলো কিনা সেই চিন্তাও থাকে।ওর সমস্ত টা গুছিয়ে দিয়ে আসে নাহলে ওকে গ্যাস জ্বালাতে হলে মধুরই চিন্তায় কাজে ভুল হয়ে যায়।আগে একটা রান্নার লোক রেখেছিল,এত জঘন্য রান্না,তারপর না বলে যেদিন খুশি কামাই…সবমিলিয়ে মানসিক চাপ বেড়ে গিয়েছিল।এখন রাতের রুটি তরকারি করার একজন আছে শুধু,সকালে ওর আর জিতের রান্না মধুজাই করে নেয়,বুবকা তো ওর দিদানের কাছে খায়।নিজের সুবিধার জন্য বাপের বাড়ির পাশের পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনেছে।শাশুড়িমা তো বাড়ি থেকে চলে আসার অপরাধে ওর সাথে ভালো করে কথাও বলেনননা।অথচ বুবকার ২বছর বয়স অবধি ওরা ওখানেই ছিল,যদিও একজন আয়া সেই ক’বছর রাখতে হয়েছিল।কিন্তু সেই আয়া বা শাশুরিমা কেউই বুবকা কে সামলাতে পারতোনা।তার ওপর যাতায়াত মিলিয়ে মধুজার প্রায় ১০-১১ঘন্টা বাড়ির বাইরে বুবকা কে ছেড়ে থাকতে হতো।সারাজীবন গৃহবধূ শাশুরিমা বুঝতে চাইতেন না মধুর অসহায়তা।আজকালকার দিনে একটা চাকরি পেতে যেখানে সারাজীবন কেটে যায় সেখানে উনি ঠারে ঠোরে মধুকে ব্যাংকের সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চাপ দিতেন।মধু এখনো মনের মধ্যে ১০বছর আগের সেইসব দিন গুলো যেন স্পষ্ট দেখতে পায়।ব্যাংকের চাকরিটা পাওয়ার পর তখন বছর খানেক হয়েছে।এই ব্রাঞ্চে তখন ছিলোনা ও,বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে।অরিজিৎ ওর বাবার পেনশন এর কাজে এসেছিল,একটা ছোট কারণে ওর সাথে ঝামেলা হয়ে যায় জিতের।তখন নতুন মধুজা,ঠিক করে কাস্টমার সামলাতে জানতোনা।জিৎ রেগে গিয়ে ম্যানেজার কে কমপ্লেইন করে দেয়,জিতের সামনেই ম্যানেজার মধুকে খুব অপমান করে।সারাজীবন পড়াশোনায় ভালো,মিষ্টি স্বভাবের মধু মা ছাড়া কারোর কাছে কোনোদিন বকুনি খায়নি,তাই লজ্জায় অপমানে ম্যানেজারের কেবিনেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে।অপ্রস্তুতে পরে যায় জিৎ।ম্যানেজার বাবুও বুঝতে পারেন বাড়াবাড়ি হয়েছে।তারপর জিৎ আর উনি মিলে মধুকে শান্ত করেন।কিন্তু এসবের মধ্যে জিৎ আর মধুর টক ঝাল মিষ্টি একটা সম্পর্ক শুরু হয়।এরপর প্রতি মাসে পেনশনের জন্যে বাবার বদলে যেচে অরিজিৎ আসতে থাকে।মাস তিনেক পর ভগবানের নাম করে অনেক সাহস সঞ্চয় করে মধুর নম্বরটা চেয়েই ফেলে।তখন অত মোবাইলের চল ছিলোনা,তবে বাড়িতে একটা ল্যান্ড ফোন ছিল,আর অফিসেও একটা নম্বরে দরকারে ফোন করলে ডেকে দিত।সেই সম্পর্কের তিন মাসের মাথায় একদিন অরিজিৎ ফোনে মধুজা কে দেখা করতে বলে।ওরা প্রথমবার দেখা করে ব্যাংকের বাইরে এক কফি শপে।মধুজা ছুটির পর নির্দিষ্ট কফি শপে গিয়ে দেখে অরিজিৎ বসে আছে।ফর্সা মুখটা এসির ঠান্ডাতেও লালচে,মৃদু ঘামের বিন্দু যেন কপালে।মধুজা দূর থেকে দেখে নিজের মনে হেসে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।গাঢ় হলুদ রঙের ঢাকাই জামদানিতে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মধুজাকে দেখে জিৎ এর চোখে কেন কে জানে খুব আরাম হয়েছিল।মনে হয়েছিল দিনের শেষে ক্লান্তি মেখে ঘরে ফিরে এই মুখটা দেখলে যে কোনো পুরুষের মনে শান্তি ফিরে আসবে।যদিও বিয়ের আগে হয়তো সব মেয়েকে দেখে তাদের পুরুষেরই এরকমই ভাবে,এটাই মধুজার এখন মনে হয়।সেদিন দুকাপ কফি আর এক প্লেট পাকোড়া নিয়ে কি করে দু ঘন্টা কেটে গেছিল দুজনেই আজও বুঝতে পারেনা।মধু সেদিন প্রথম জিৎ এর সম্পর্কে জানে।জিৎ মফস্বলের ছেলে,যদিও কলকাতা থেকে ওদের বাড়ি এক ঘন্টাও না।কিন্তু যাতায়াতের ক্লান্তি বাঁচাতে জিৎ পিজি তে থাকে।জিৎ বলেছিল,”আমি একমাত্র ছেলে,কিন্তু মা প্রথম থেকেই একটু রুগ্ন,তাই চাপ না বাড়িয়ে চাকরি পেয়ে কলকাতা শিফট করে গেছিলাম।প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাই যদিও কিন্তু সারা সপ্তাহের ক্লান্তিতে শরীর আর টানেনা।জানেন মধু একটা ছেলে হওয়ার অনেক জ্বালা।এক সপ্তাহ যেতে না পারলেই মা আমার অভিমান করে ফোন করেনা।তবে আর হয়তো সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ি যাওয়া হবেনা”।অরিজিৎ এর কথায় মধুজা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়।জিৎ হেসে বলে,”বেটার অফার পেয়েছি দিল্লি থেকে।পরের মাসে চলে যাচ্ছি।মা বাবা আপত্তি করেছিল,কিন্তু এমন সুযোগ যে বারবার আসেনা”,মধুর মনটা অকারণেই ভার হয়ে ওঠে,জিৎ এর খুশির খবরে কেন যে ও আনন্দ পায়না ও বুঝতে পারেনা।মধু ভাবে সেই কারণেই হয়তো ট্রিট দিতে ওকে ডেকেছে।এই সময় হঠাৎ অরিজিৎ একটু এগিয়ে বসে টেবিলের ওপর রাখা মধুর বাঁ হাতটা নিজের দুহাতের মধ্যে নেয়।প্রথম অচেনা এক পুরুষের স্পর্শে একটু শিহরিত হয়ে ওঠে মধুজা।জিৎ মধুর চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে বলে,”প্রায় ছমাস তুমি আমায় দেখছো মধু।আমি জানিনা কিকরে প্রপোজ করতে হয়,একদমই আনাড়ি আমি,আর হয়তো একটু সেকেলে।কিন্তু বুঝেছি আমার জন্যে তুমি পারফেক্ট।আমি দিল্লিতে সেটল হতে যাচ্ছিনা।বড়জোর দুবছর,তারপর অন্য অফার না পাই সেম কোম্পানিতেই ট্রান্সফার নিয়ে ফেরত আসব,সেরকম কথা বলেই জয়েন করছি।তুমি কি এই দুবছর আমার জন্যে অপেক্ষা করবে?”
হঠাৎ মোবাইলের মৃদু ভাইব্রেশনে বাস্তবে ফিরে আসে মধুজা।কাউন্টারে ভিড় না থাকায় কিছুক্ষনের জন্য অতীতে হারিয়ে গেছিল ও।ফোন টা হাতে নিয়ে দেখে ‘মা’।তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে ও।ও প্রান্তে শুনতে পায় বুবকার গলা,”মাম্মাম আমি দিদুনের কাছে চলে এসেছি।পাপা দিয়ে গেছে।এই নাও দিদুন কথা বলবে।”এক নিশ্বাসে বলেই ফোনটা দিদার হাতে দিয়ে এক ছুটে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড দাদানের কাছে পালায়।মমতা ফোনটা হাতে নিয়ে বলেন,”কি রে অরির সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি?কিরকম গম্ভীর লাগলো ছেলে টাকে?”মায়ের কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে মধু,”হ্যাঁ কাজের জায়গায় তো আমি ঐ করতেই আসি,ফোনে ঝগড়া।আর যার মুখ গোমড়া দেখলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারোনি কারণটা।তা না করে আমার কাজের সময় ফোন করে এসব প্রশ্ন করছো!সব কিছুর দায় আমি নিয়ে বসে আছি?রাখছি আমি ফোন।যদি কোনো দরকার থাকে তবেই একমাত্র এই কাজের সময় ফোন করবে”।বলেই ফোন টা কেটে দেয় মধু।আজকাল ওর ধৈর্য্য বড্ড কমে গেছে,চিরকালের হাসিমুখ মেয়েটা এখন কথায় কথায় বড্ড মাথা গরম করে ফেলে,কিন্তু মাথারই বা কি দোষ…চাপ নিতে নিতে আজ একটুতেই ধৈর্য্য রাখতে পারেনা।জোর করে সব ঝেড়ে ফেলে কাজে মন দেয় ।অনেক চেষ্টা করেও অরিজিৎ কিছুতেই আগে পৌঁছতে পারেনা।মিটিং শুরু হওয়ার মুহূর্তে গিয়ে পৌঁছায়,ফলে প্রেজেন্টেশনটা আর একবার চেক করার সময় পায়না।তারওপর মধুর সাথে ঘটনায় মন খিঁচড়ে যাওয়ায় মনটাও অন্যমনস্ক হয়ে থাকে।সবমিলিয়ে প্রেজেন্টেশন মোটেও মনের মতো হয়না,শেষ মুহূর্তের ঝামেলা কয়েক রাত জাগার পরিশ্রমটাকে মূল্যহীন করে দেয়।দিনের শেষে সব রাগ গিয়ে পড়ে মধুর ওপর।
মমতা বুঝতে পারেন কোনো কারণে মেয়ে চাপে আছে।ছোট থেকেই চাপ থাকলে আর তা সামলাতে না পারলে মধু মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনা।তবে আজকাল মেয়েটা একটু বেশিই খিটখিটে হয়ে গেছে,বুবকা কেও অকারণ বকাবকি করে প্রায়ই।মাত্র সাত বছর বয়স,ও কি বোঝে ভালো মন্দ!তার ওপর মা কেও পুরোপুরি পায়না।যতই ‘আমরা’ থাকি,মা-বাবার অভাব কি কেউ পূরণ করতে পারে?আজ মেয়েটা এলে ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে হবে,যত সমস্যাই থাক,এত মেজাজ ভালোনা।মেয়েদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়,নাহলে সংসার ভেসে যায়।বুবকা সেই তিন বছর বয়স থেকে ওর কাছেই মানুষ বলতে গেলে,কিন্তু ওর প্রকৃতি অন্য রকম।মেরে বকে ওকে দিয়ে কাজ হয়না,কিন্তু ভালোবেসে বললে সব কাজ করে নেয়,এমনকি দুপুরের খাওয়া অবধি লক্ষ্মী ছেলের মতো খায়।কোনো ঝামেলা নেই।বিকেলের দিকে কি মনে হতে জিৎ কে ফোন করে মধু।রিং হয়ে কেটে যায় জিৎ ফোন তোলেনা।মধু বুঝতে পারে ব্যস্ত আছে,পরে সময় মতো ফোন করবে।আর ঘন্টা খানেক,তারপর মধুর ছুটি।ব্যাংক থেকে বেরিয়ে নিজের সংসারের জিনিস,নাহলে মা বাবার ওষুধ,কখনো বাবা বা মায়ের ডক্টর দেখানো কিছু না কিছু কাজ থাকেই।কোনোদিন দেরি হয়ে গেলে ও আর ও বাড়ি যায়না,বাবা বুবকা কে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে যায়,কারণ ৭টা নাগাদ আবার রুটি করার মেয়েটা এসে পড়ে।ফ্ল্যাট লক দেখলে আর সে ঘুরে আসেনা।সারাদিন পর বাড়ি ফিরে আর রান্না করার ক্ষমতা থাকেনা।আজ আর কোনো কাজ নেই দেখে বাবার জন্যে ফল কিনে একটা রিকশা নিয়ে বাপের বাড়ি গেল মধুজা।রুটি করার মেয়েটা কে আগেই ফোন করে একটু দেরি করে আসতে বলে দিয়েছিল।ফল ছাড়াও একটু মিষ্টি আর সিঙ্গারা নিলো,জ্বরের মুখে বাবার ভালো লাগবে ভেবে।বাড়ির গেট দিয়ে যখন ঢুকলো সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে।মমতা শাঁখ বাজিয়ে সন্ধ্যে দিচ্ছেন।পুজো গেছে আগের সপ্তাহে,বাতাসে ইতিমধ্যেই ঠান্ডার আমেজ।মা কে একটু আরাম দিতে আজ মধু নিজে গিয়েই চায়ের জল বসালো।মমতা ঠাকুরঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন,”আবার তুই ঢুকছিস কেন রান্নাঘরে?দাঁড়া হয়ে গেছে,আমি যাচ্ছি।”
“তুমি ধীরে সুস্থে এস,আমি আজ চা করছি।বাবার জন্যে সেই স্পেশাল আদা চা।আগে বাবার জ্বর হলে আমি ঐ চা করে না দিলে বাবা চা’ই খেতোনা।অনেকদিন করিনি,দাঁড়াও আজ জমিয়ে চা সিঙ্গারা খাবো।”মধু মা কে আস্বস্ত করে।মমতা নিজের মনে হেসে ঠাকুর প্রনামে মন দেন।পাগল মেয়ে,মুড টা ভালো আছে মনে হচ্ছে,থাক আজ আর কিছু বলে দরকার নেই।তাছাড়া ওদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার,ও ঠিক মিটে যাবে।”ঠাকুর ওদের ভালো রেখো”।অনেকদিন পর বাবা মার সাথে গল্প করতে করতে কোথা দিয়ে সময় চলে যায় খেয়াল করতেই পারেনা।যখন খেয়াল হয় আটটা বেজে গেছে।অগত্যা রান্নার মেয়েটা কে ফোন করে বারণ করে দেয়।ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের গুমটিটা থেকে রুটি তড়কা কিনে নেবে ঠিক করে।জিৎ এর আসতে সেই ১১টা।তাই বুবকার রুটি মা করে দেয়,ওকে রাতে দুধ রুটি খাইয়ে দেবে ঠিক করে।সাড়ে আটটা নাগাদ যখন বাড়ির সামনে থেকে রিকশায় ওঠে মনটা ভার লাগে,কাছাকাছি এসে যাওয়ার পর সেভাবে মা বাবার কাছে এসে রাত কাটানোই হয়নি।কতদিন রাত জেগে মার সাথে গল্প হয়নি।বুবকা হওয়ার পর এক বছর মার কাছে ছিল,শাশুরিমা সংসার সামলে কচি বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চাননি।আর তখন মধু সেই পুরোনো ব্রাঞ্চেই ছিল।সব মিলিয়ে শেষ অবধি মা ই ভরসা ছিল।তখন কত গল্প করেছে মা র সাথে।আসলে বিয়ের আগে কাছে থাকলেও বিয়ের পর সংসারের স্বাদ পাওয়া মেয়ে হয়তো মায়ের প্রকৃত সখী হয়।বিয়ের আগের কলেজ বন্ধুর গল্পের থেকেও বিয়ের পরের দুই সংসারের সুখ দুঃখের গল্প হয়তো একে অপরেরটা অনেক বেশি অনুভব করতে পারে।তাই রাত জেগেও দুই বন্ধুর মতো গল্প শেষ আর হতে চাইতোনা।সেসব যেন অনেকদিন আগের গল্প।না,এবার এসে দু চারদিন মার কাছে থেকে যেতে হবে।এসব ভাবতে ভাবতে ফ্ল্যাটের দোর গোড়ায় পৌঁছে যায়।রুটি তড়কা কিনে বুবকার হাত ধরে ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে চাবি লাগিয়ে বুঝতে পারে ফ্ল্যাট খোলা।বুকটা কেঁপে ওঠে,তবে কি জিৎ ঠিক করে লক করেনি সকালে।কি ভেবে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে জিৎ টিভি চালিয়ে বসে আছে।ওদের ঢুকতে দেখে একবার তাকিয়ে আবার খবরে মন দেয়।তখনই মধুর মনে পড়ে জিৎ ওকে কল ব্যাক ও করেনি আজ।কিছুটা অবাক হয়ে ও জিৎ কে জিজ্ঞেস করে,”তুমি?কখন ফিরলে?ফোন করোনি কেন?” কিন্তু অরিজিৎ এর হাবভাব দেখে মনেহয় না মধুর কথা ওর কানে গেছে,কোনো উত্তর দেওয়ার ইচ্ছাও দেখায়না।মধুর ভ্রু কুঁচকে যায়,কি হলো আবার!অনেকটাই অচেনা লাগে জিৎ কে।এগিয়ে যায় জিৎ এর দিকে।
চলবে….