“মেয়েটা কোথায় গেল?এত রাত হলো,প্রায় দশটা বাজে…না ফিরছে আর না ফোন ধরছে…”,অয়ন বিড়বিড় করতে থাকে নিজের মনে।
বিকেলে ভালো রকম শিলা বৃষ্টি হয়ে মেট্রো চলাচল কিছুক্ষন বন্ধ ছিল।আটটার পর সেই সমস্যা মিটলেও ফোনের নেটওয়ার্ক আজ একটু ডাউন এদিকে।তার মধ্যেই ব্যালকনিতে এসে বারবার অয়ন চেষ্টা করে যাচ্ছে মানিনীকে ফোন করতে।কিন্তু কানেক্ট করা মুশকিল হচ্ছে,আর হলেও ফোন বেজে যাচ্ছে।মানির সাথে শেষ কথা হয়েছিল ওর অফিস ছুটির পর,সাড়ে ছটা নাগাদ।তখন মেট্রোতে সমস্যা চলছে মানিই বলেছিল,আর সেই কারণে ক্যাব নেবে সেটাও জানিয়েছিল।
বৃষ্টি ঘন্টা খানেক আগে পুরোপুরি বন্ধ হতে অয়ন বাইক নিয়ে ফিরতে পেরেছে,যদিও বিদ্যুতের রেখা এখনো আকাশ চিরে যাচ্ছে।কিন্তু ফিরে প্রচন্ড অবাক হয়েছিল ও।ক্যাব নিলেও মানির ওর আগে ফিরে আসার কথা।হাতঘড়িতে তখনই সময় দেখেছিল রাত প্রায় সাড়ে ন’টা।ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে সবার আগে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়েছিল ও,তারপর ই বসে পড়েছিলো ফোন হাতে করে।
ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর পেরোতে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করলো অয়নের,সাথে শুরু হলো অত্যধিক দুশ্চিন্তা।মানিনী মেট্রো রুট চিনলেও রাস্তাঘাট বিশেষ চেনে না।দু একবার অয়নের বাইকে চেপে দিল্লি গেলেও অতটাও পরিচিত নয় নয়ডার রাস্তার সাথে।অয়নের সেটাই বেশি চিন্তার।সবে দিন পনেরো হলো নয়ডা থাকছে ও।
সেদিন সকালে মানি এসে যখন বেল দিচ্ছিল অয়ন ভাবেনি দরজা খুলে ওকে দেখবে,উল্টে আগের রাতের কথাবার্তা অয়নকে যথেষ্ট টেনশনে ফেলেছিল।ও ভেবেছিল বন্ধুত্ব টাও আর বাঁচলো না হয়তো।
দরজা খুলে ওর ঘুম ছুটে গিয়েছিল।ওকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে মানি যখন ঢুকে আসে বিশেষ কিছুই বলতে পারেনি ও,অনুসরণ করা ছাড়া।
“তুমি তো জানতে আমি এনগেজড।তাও কেন আশা করেছিলে আমার?কেন খুঁজেছিল এভাবে?” ডাইনিং রুমের সোফায় বসে প্রথম প্রশ্ন ছিল মানির।
ঘুমের ঘোর কাটলেও ঘুম ঘুম ভাবটা তখনও কাটেনি অয়নের।তাই মানিনীর কথার আক্রমণ ওকে প্রথমেই কাবু করে দেয়।
“চা খাবে? লিকার চা।আমি দুধ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি”,হাই আটকাতে আটকাতে বলে ও। মানিনী যে ওকে ভালো কিছু বলতে এতদূর আসেনি বুঝে যায় ও,তাই আর বেশি চাপ নেয় না।ডান হাত দিয়ে মাথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে উঠে দাঁড়ায় ও।
“হ্যাঁ খাবো।তবে চিনি কম”,মানিও অয়নকে অবাক করে উত্তর দেয়।
একটু ফ্রেস হয়ে অয়ন যখন কিচেনে চা করতে যায় অবাক হয়ে দেখে মানিনী প্রথমবার ড্রয়িং রুমের সোফা ছেড়ে খোলা কিচেনের সামনে ডাইনিং স্পেসে এসে দাঁড়িয়েছে।একটু অস্বস্তি ও বোধ করে,বুঝতে পারে একটা অস্থিরতা কাজ করছে মানির মধ্যে।
-“অয়ন এই ফ্ল্যাটের রেন্ট কত?”
-“মেইটেইনেন্স নিয়ে সতেরো মত পরে।”
-“হমম।তাহলে চাপ তো পড়ছে তোমার।আবার রান্নার মাসির টাকা আলাদা।জানিনা কত স্যালারি তোমার,তাও নিজের দিয়ে ভাবলে চাপ পড়ার ই কথা”।
-“হ্যাঁ।আমার হাতে আসে চল্লিশ মত।সৌরভ থাকতে কিছু জমছিলো।লাস্ট মাসে পুরোটাই খরচের খাতায় চলে গেছে।মাসীকে মাসে তিন হাজার দিলেও দুবার বাইরে খেতে অনেক বেশি পরে যায়।সাথে সারাদিনের টুকটাক খরচ থাকে,মাসীর রান্নার বাজার থাকে,তাই আর কি…”।
-“তুমি ড্রিংক করো?”
উত্তর দেবে কী! এরকম প্রশ্ন যে আসতে পারে ও তো ভাবেইনি।অফিস পার্টিতে এক দু পেগ চলে।আর দিল্লির গরমে ও আর সৌরভ উইকেন্ডে কখনো কখনো বিয়ার পান করে।আর এটা ওর কাছে এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে ওর ব্যাচেলর জীবনে।কিন্তু সত্যি তো একটা মেয়েকে,যাকে ও পছন্দ করে আর যাকে ফ্ল্যাট মেট হওয়ার মতো দুঃসাহসিক প্রস্তাব দিয়েছে,তাকে ঠিক কী উত্তর দেবে ও ভেবে পেলো না কয়েক মুহূর্তে।ওর মুখের অবস্থা দেখে মানি অনুমান করে বললো,”হমম বুঝলাম।তাহলে একটা মেয়ের সাথে থাকবে কী করে? বিশেষ করে আমার মত অর্থোডক্স মেয়ের? যে এখনো এই জীবনের সাথে কোনো ভাবেই অভ্যস্ত না।যাইহোক আমি যে কারণে এসেছি,আমি রাজি তোমার প্রস্তাবে…”,মানির শুধু একটা কথা শুনেই অয়নের মুখ উজ্বল হয়ে ওঠে।কিন্তু ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মানিনী আবার বলে,”…কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে।তুমি রাজি থাকলে…”মানি বাধা পায় এবার।
“আমি রাজি।তোমার সব শর্তে রাজি।ড্রিংক আমি করিনা।অফিস পার্টিতে জাস্ট গলা সবাইকেই ভেজাতে হয়।আর আমি সৌরভ প্রচন্ড গরমে বিয়ার খেয়েছি কিন্তু সেটাও ওই গলা ভেজানোর মতোই।আজ অবধি মাতলামি করার মত ড্রিংক করিনি”,এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অয়ন চায়ের প্যানের দিকে নজর রেখে।
“আমি কিন্তু বলিনি কী শর্ত।শর্ত একটাই তুমি সত্যি বলবে।আমি উৎসবের সাথে সম্পর্কের পর সত্যি বলতে কী ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছি।তুমি কেন আমার সাথে জীবন কাটাতে চাইছো?আদৌ সত্যি এক ছাদের তলায় থেকেও কী সম্পূর্ণ চেনা যায়? তুমি আসলে যা,বা আমি যা আমরা কেউ কি বিয়ের আগে নিজেদের পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারবো?লিভিং,মানে তুমি যেরকম বলছো তাতে কি আদৌ বদনাম কুড়োনো ছাড়া কোনো লাভ হবে?আমি যেরকম ব্যাক গ্রাউন্ড থেকে বিলং করি আমার পক্ষে লিভিং এর কথা ভাবা মানেই পরিবারের লোকের কাছে ত্যাজ্য হওয়া।আমরা তাহলে অন্তত পক্ষে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ কেন করে নিচ্ছিনা?অবশ্য তার আগেও আমার জানার দরকার সত্যি তুমি কতটা আমায় পছন্দ করো, আর সেটা তুমি আমায় বলবে”,মানিনী যা মনে আসে কিছু না ভেবেই বলে দেয়।ওর কথায় বারবার প্রকাশ পায় ওর মনের অগোছালো ভাব।ও যে কোনো ভাবেই স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারছে না,ওর কথা শুনলেই বোঝা যায়।
অয়ন সত্যি সেদিন বুঝতে পারেনি কী বলবে! ওর পছন্দ কবে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে ও নিজেও বুঝতে পারেনি।তবে এই ভালোবাসা ঠিক বুঝিয়ে বলা যায় না।সত্যি বলতে এ ভালোবাসা ‘ছেড়ে গেলে জীবন শেষ হয়ে যাবে’ প্রকৃতির না।হয়তো বলতে না পারলে সারাজীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত এই ধরনের ভালোবাসা এটা।তবে হ্যাঁ পরিণত বয়সের ভালোবাসার নির্ভরশীলতার জন্যে অয়ন মানিনিকে ছাড়া জীবনটা ভাবতে কষ্ট পাচ্ছিল।
“জানিনা।শুধু জানি প্রথমদিন ভাঙা মনে যেদিন তোমায় দেখি মনে হয়েছিলো ভরসা করতে পারি।মনে হয়েছিল অগোছালো ‘আমি’কে আগলে রাখবে তুমি।দিনের শেষে বাড়ি ফিরতে চাইবো তোমার জন্য।এর থেকে বেশি বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।তবে হ্যাঁ ভালোলাগা বা ভালোবাসা দু’তরফে হলে তবেই সম্পর্ক তৈরি হয়।তাই তো শুধু অনুরোধ আমার কথা ভেবে না।নিজের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিও প্লিজ।আর হ্যাঁ ম্যারেজ রেজিস্ট্রি হোক কী সোশ্যাল দুটোই তো সেই বাঁধন কাটার অনেক হ্যাপা।তাই আমি ফ্ল্যাট মেট রাখবো বলে ফোনটা করেছিলেন।শুধু তোমার কেন আমার পরিজনদের কাছেও লিভিং যথেষ্ট কেচ্ছার ব্যাপার,কারণটা কেউ বুঝবেও না।কাউকে তাই না জানালেই হলো।নিজেদের জন্যে এটুকু তো করতেই পারি আমরা”,অয়ন চা ছেঁকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় মানিনীর দিকে,ওর চোখে চোখ রেখে।
মানিনী ও সেই মুহূর্তে কোনো উত্তর দিতে পারেনা,অয়নের চোখে চোখ রেখে ওর হাত থেকে কাপটা নেয়।
ড্রয়িং রুমে এসে চুপচাপ দুজনে বসে চা শেষ করে।তারপর মানি বলে,”ঠিক আছে আমি এই মুহূর্তে পিজি তে ঘরটা ছাড়ছি না।এক সপ্তাহ থাকবো এসে এখানে।সত্যি বলতে পাস্ট রিলেশন থেকে যা এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে বিয়ে করবো কিনা নিজেও জানিনা,তাই বদনামের পরোয়া করিনা।কিন্তু বাবাকে কেউ কিছু বললে,বাবা সেটা মানতে পারবে না।সেই জন্যে…”।
-“কিন্তু তুমি আসবে কেন? আমার ব্যাপারটা তো আমি ক্লিয়ার করলাম,কেন তোমাকেই ফোন করেছিলাম।কিন্তু..”।
-“কারণ আমার এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো বন্ধু তুমি,যে আমার সবটা জানো,যে আমায় এখনও বোঝ।ভবিষ্যতে বুঝবে কতটা সেটা হয়তো একসাথে থাকলে কিছুটা হলেও বুঝতে পারবো।আর আমিও তোমায় পছন্দ করি,ভালোবাসি বলবো না।কারণ ভালোবাসা জিনিসটাই এখন আমার কাছে ক্লিয়ার না।তবে তুমি দিনে একবার ফোন না করলে,সপ্তাহে একবার দেখা না করলে,তোমার সাথে আড্ডা না মারতে পারলে আমারও কিছুই ভালো লাগে না…”।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে অয়নের অতীতের ঘটনার ভাবনার জাল ছিঁড়ে যায়।দরজা খুলতে ছোটে ও।
দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে যায় ও…মানি ভিজে আলুথালু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ওকে দরজায় দেখে হঠাৎ করে হাউহাউ করে কেঁদে ওকে জড়িয়ে ধরে।প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলেও অয়ন ওকে কিছু বুঝতে দেয় না,ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ফ্ল্যাটের মধ্যে নিয়ে আসে।দরজা লক করে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসায়।
অয়ন বুঝতে পারে মানি পুরো ভিজে কাক হয়ে গিয়েছিল,আর অনেকটা হেঁটে এসেছে।ওর বুকের একটা অংশ অয়নের বুকে ঠেকে থাকায় ও অনুভব করতে পারছিল মানিনীর হার্টবিট,প্রচন্ড জোরে ছুটছে।
মিনিট পাঁচেক পর মানিনী একটু শান্ত হতে উঠে গিয়ে অয়ন জল নিয়ে আসে।জল খেয়ে নিজেকে সামলে মানি কিছু বলতে যেতেই বাধা দেয় অয়ন,”শুনবো মানি তোমার কথা।আগে তুমি চেঞ্জ করে এসো।এই ভিজে কাপড়ে অনেক্ষন আছো,এবার জ্বর এসে যাবে”।
কোনো কথা না বলে মানি আস্তে আস্তে উঠে নিজের ঘরে যেতে যায়।হঠাৎ কী মনে করে অয়ন মানির হাত ধরে টেনে ওকে নিজের বুকে নিয়ে আসে আবার।
মানিও কথা না বলে আবার আঁকড়ে ধরে ওকে।ওর হাবভাব বুঝিয়ে দেয় কোনো ঘটনায় প্রচন্ড ভয় পেয়েছে ও।অয়ন নিজে মানিকে ওই অবস্থায় ওর ঘরের দরজায় পৌঁছে দেয়,”যাও ফ্রেস হয়ে এসো।আমি ঘরের বাইরেই আছি।ভয়ের কিছু নেই।তুমি তো ফ্ল্যাটে আমার কাছে এসে গেছো।আমি খাবার গরম করছি।ফ্রেস হয়ে এসো দুজনে খাবো”।
কোনো কথা না বলে মানিনী শুধু চোখ তুলে একবার তাকায়, জল ভরা সেই চোখে অয়ন অদ্ভুত এক চাওনি দেখে।সেই চাওনিতে মিশে আছে ভয়,কষ্ট,অসহায়তার সাথে অনেকটা ভরসা।অয়ন কিছু না বলে আরেকবার আলতো করে নিজের হাতটা বুলিয়ে দেয় মানিনীর উস্কোখুস্কো ভিজে চুলে।
ক্রমশ ..
1 comment
khoob bhalo