“দিল্লি তে তো রেড এলার্ট চালু হয়ে গেছে ভাই।তোদের বিয়েটা ঠিক সময়ে হয়ে গেল,এমনিও বৈশাখে বিয়ে মানে বিশাল কষ্ট।এটাই সব দিক দিয়ে ভালো হলো।কে জানে কী দিনকাল আসছে আবার!” অয়নের বিয়ের আগে বেরোনোর সময় ওকে তৈরি হতে সাহায্য করতে করতে বললো সৌরভ।
“আরে অফিসেও তো রেস্ট্রিকশন চালু করেছে।এই মাস থেকে সপ্তাহে দুদিন অফিস যেতে হয়েছে,তাও নিয়ম মেনে,মাস্ক পরতে হয়েছে।এখানে তো কিছু বুঝতেই পারছিস না তোরা।মানিনীর অফিসেও কড়াকড়ি শুরু হয়েছে।আমাদের তো তাও আইটি,ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলেই যায়।কিন্তু মানির সরকারি চাকরিতে যতই যা হোক অফিস যেতেই হয়।ছাড়।একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে কিন্তু মনেহয় সামলে নেবে”,অয়ন মনের উৎকণ্ঠা পাত্তা না দিয়ে বলে।
“হমম চীন পুরো দেশ জুড়ে লকডাউন করে দিয়েছিল,এখন অন্য দেশেও একই অবস্থা।আশা করি আমাদের দেশে সেসব হবে না।আর আমাদের দেশে এসব করার ক্ষমতাও নেই।তাহলে লোকে রোগে না মরে, না খেয়ে মরবে”,সৌরভ একটু বেশিই টেনশন করছে বুঝতে পারে অয়ন।
ওর আজকের দিনে,বিশেষ করে এই মুহূর্তে কোনো নেগেটিভ কথা ভালো লাগছে না বলে চুপ করে যায়।
সৌরভও নিজের চিন্তায় ডুবে থাকলেও কথা আর বাড়ায় না এই নিয়ে।অবস্থা যে খারাপের দিকে যাচ্ছে সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে।ওর আর কী! ওর পেশা তো ঘরে বসেই কাজ হয়ে যায়।কিন্তু ওর নরম মন দেশের মানুষের চিন্তা ছাড়তে পারেনা।
অয়ন মানিনীর বাড়ি পৌঁছতেই হুল্লোর শুরু হয়ে যায়।প্রথমবার এরকম অবস্থায় পড়ে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল ও,আগে নিজের খুব কাছের কোনো আত্মীয়র বিয়ে দেখার সৌভাগ্য ওর বিশেষ হয়নি।কারণ ওর বাবার কারণে বাবার দিকের আত্মীয়রা ওদের ত্যাগ করেছিল,আর একই কারণে মাও নিজের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখতো না।বন্ধুদের বিয়ে যখন হয় ও প্রবাসে নিজের কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ত ছিল।ফলে বর ঢুকলে বিয়েবাড়ি যে ভাবে গমগমিয়ে ওঠে ওর সেই অভিজ্ঞতা প্রায় ছিলোনা।
যদিও মানিদের আত্মীয়ও খুব বেশি নেই,তারওপর সারা বিশ্ব জুড়ে একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ চলছে,তাই নিমন্ত্রিত ছিল সীমিত।
সব গন্ডি পেরিয়ে যখন ও বর আসনের কাছে গিয়ে পৌঁছল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।ওদের বাড়িতে বাইরের লোক বলতে সকাল থেকে শুধু এই সৌরভ,বাকি পাড়া প্রতিবেশী।
বরযাত্রীও হাতে গুনে পনেরো জন এসেছে।বিয়ের লগ্ন একটু রাতের দিকেই ছিল।নিজের চেয়ারে বসতে না বসতেই সরকারী বিয়ের সই নিতে হাজির হয়ে গেল ম্যারেজ রেজিস্ট্রার।সব কিছু মিটতে নিজের চেয়ারে বসে ফোন হাতে নিলো অয়ন।ফোনটা আনলক করে দেখল মানিনীর মেসেজ।মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল,নিজের মুখটা একহাতে ঢেকে সেলফি তুলে ওকে পাঠিয়েছে।দুস্টুমি ওর একদম যে নেই তা মোটেই না।সেই পাঁচদিন আগে একসাথে ফিরেছে,তারপর কিছুতেই আর দেখা করেনি।ওরা একসাথে আছে আজ প্রায় আট মাস, একটা অদ্ভুত আবেগে জড়িয়ে পড়েছে অয়ন ওর সাথে।মানিনী এখনো ঘর আলাদাই রেখেছে,যদিও অয়ন এখন অনায়াসে ঢুকে যায় ওর ঘরে।আর সেই আবেগ তৈরি করেছে একটা টান,শুনতে বাড়াবাড়ি মনে হলেও ছেড়ে থাকতে একটু সমস্যা হয় ওর।জানেনা মানিনী কী ভাবে,ওর আদৌ এতটা মন খারাপ হয় কি না?
আজকাল মানি বেশিরভাগ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়,সেটা ঘরের ফার্নিচার হোক কী বাইরে খেতে যাওয়া।অয়ন মেনে নেয়।এমনিও ও কোনো বিষয়েই বিশেষ কথা কাটাকাটি পছন্দ করেনা,আর মানির এই ওর বিষয়ে আত্মবিশ্বাস এটাই তো দেখতে চেয়েছিল ও।অয়ন চেয়েছিল মানিনী ওকে শাসন ভালোবাসা আদর আবদার দিয়ে আপন করে নিক।এখন ওদের সম্পর্ক অনেকটাই সেই দিকেই গেছে।তবে টুকটাক ঝগড়া যে হয়না তা নয়,তবে মিটেও যায়।
নিজেদের পুরোনো সম্পর্কের স্মৃতিচারণা করতে করতে কখন যে নতুন সামাজিক বন্ধনের রীতি নীতি পালন করে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে যায় একটা ঘোরে থাকা অয়ন সেটা যেন বুঝতেই পারেনা।একটা ভালোলাগার নেশার মধ্যে দিয়ে বিয়েটা হয়ে যায়,মানিনীর পানপাতা ঢাকা মুখটা আড়াল থেকে যখন বেরিয়ে আসে ঠিক মুগ্ধ করে অয়নকে যতটা,ততটাই অনুভব করায় ওকে,’এই মেয়েটা তো ঠিক আমার মানি না।নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে যে মুখটা আদর করি সেটা বেশ সাদামাটা,অনেক বেশি আপন’।তবে এই কৃত্রিম সাজে আগে কখনো বিশেষ ওকে দেখেনি বলে মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায় মনকে।
“বাবা আমার মেয়েটা বড্ড অভিমানী।বড্ড মনচাপা।ওকে তুমি সামলে রেখো।আমি জানি তুমি পারবে”,চোখটা জলে ভরিয়ে যখন মানির বাবা অয়নকে কথাগুলো বলে ওর বুকটাও তোলপাড় করে ওঠে।বৃদ্ধ বাবার কান্না ভেজা কথা গুলো অয়নকে ছুঁয়ে যায়,মুখে কিছু বলতে পারেনা ও।উল্টে ওর বাবার হাতের মুঠো নিজের দুটো হাতের মধ্যে রেখে চাপ দেয়,মুখ টিপে ঘাড় নাড়ে।তারপর জড়িয়ে ধরে মানিনীর বাবাকে।
শেষ বিদায় নিয়ে মানিনী যখন বরের গাড়িতে করে অয়নের বাড়ির দিকে যাচ্ছে মানির চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসে ছোটবেলার স্মৃতিতে।আগেও তো বাড়ি ছেড়ে গেছে,কখনো পড়াশোনার জন্যে কখনো চাকরি করতে,তখনও মন খারাপ হয়েছে।কিন্তু আজকের কষ্ট যেন একদম অন্য রকম।এই কষ্ট এক অদ্ভুত কষ্ট,যার প্রতিটা বিন্দু এক বদলে যাওয়ার পিন ফোটাচ্ছে।যতদূর ই গেছে বাড়ি বলতে বাবার বাড়িটাই মনে থেকেছে।আজ যেন অধিকার ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট বুকের মধ্যেটা তোলপাড় করে দিচ্ছে।জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠার আশ্রয়ের ঠিকানা আজকের পর থেকে শুধু ‘বাড়ি’ রইলো না,বাবার বাড়ি হয়ে গেল।ও জানে সবাই যতই বলুক দিনকাল বদলেছে,কিন্তু সমাজ কোনোভাবেই এখনো এই চিন্তাধারা থেকে সরেনি।তাই কষ্টটা বড্ড বেশি জাঁকিয়ে বসতে চাইছে মন জুড়ে।আজ মনেহচ্ছে ‘বাবা আমার বড্ড একা হয়ে যাবে’,দূরে চাকরি করতে গিয়েও যা এতদিন মনে হয়নি।
অয়নের ওপর বিশ্বাস ভরসা সব আছে মানির।ও জানে আজ থেকে দায়িত্ব বাড়লেও,দায়িত্ব ভাগ করার মানুষও বেড়েছে।অয়নের মা’কে ও আপন করে নিতে পারবে বলেই ওর ধারণা।আর ওর বাবার দায়িত্ব অয়ন অনেক আগেই নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে।তাও কষ্টটা কমছে না।
হঠাৎ ওর কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে মানিনী।না তাকিয়েই বুঝে যায় ওই শক্ত হাতটা অয়নের।ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা নামিয়ে দেয় অয়নের কাঁধে।কোনো চিন্তা না,আবেগ না,ছোটবেলার ছেঁড়া ছেঁড়া ঘটনাই চোখ বুজে ভাবতে থাকে অয়নের কাঁধে মাথা রেখে।
“বাবু ঘরে আছিস?” আজকাল ছেলের ঘরে সোজাসুজি ঢুকতে একটু অস্বস্তিই হয় অয়নের মায়ের।আগের মত অবাধ যাতায়াত হয়তো কোন মা বাবার পক্ষেই সম্ভব হয়না ছেলের বিয়ের পর।বিশেষ করে প্রতিমা দেবীর যেরকম স্বভাব গুন,এটা ওর চরিত্র উপযোগী কাজও।
“হ্যাঁ মা এসোনা”,অয়ন মানিনীকে ট্রলি গুছতে সাহায্য করছিল।
ধীরে ধীরে ছেলের ঘরে এসে ঢোকে অয়নের মা।
“টিভিতে কী সব দেখাচ্ছে রে।রোগটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে।বলছে অন্য দেশ গুলোর মত আমাদেরও দেশজুড়ে লকডাউন করে দেবে।হ্যাঁ রে কী করবি, দুদিন দেখে যাবি নাকি?” এতক্ষণ টিভি দেখছিল প্রতিমা।ছেলের দুশ্চিন্তায় পায়ে পায়ে উঠে এসেছে।
মায়ের কথায় মুখ তুলে তাকায় অয়ন,সাথে মানিনীও।
“মা আমার যে ছুটি আর বাড়াবে না।অয়নের তাও ওয়ার্ক ফ্রম হোম হয়ে যাবে”,মানিনী অসহায় গলায় বলে।
“কবে শেষ তোমার ছুটি?সেই কদিন দেখো যদি অপেক্ষা করতে পারো।কাল তোমরা তোমার বাড়ি যাবে আর পরশু সকালে ফিরে বেরিয়ে যাবে।কিন্তু লকডাউন হয়ে গেলে কী তোমার অফিস খোলা থাকবে?” চিন্তা করে বলে অয়নের মা।
“মা পরশু ফিরে তার একদিনের মধ্যে সিমলা যাবো তুমি তো জানো।কী করে থেকে যাবো বলো? আর তো বেরোবার সময় পাবোনা।আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা।কিন্তু…”,অয়ন শেষ করতে পারেনা।
“তোরা মনেহয় অবস্থাটা ঠিক অনুভব করতে পারছিস না।লকডাউন মানে বেড়াতে গেলেও আটকে পড়বি।ফিরতে পারবি না।তাই সব দিক ভেবে সিদ্ধান্ত নে”,যথেষ্ট কুণ্ঠিত ভাবেই বলে প্রতিমা।
অয়ন আর মানিনী কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে।দুজনের ছুটি নেওয়া আছে পঁচিশে মার্চ অবধি।আঠারো সিমলা গিয়ে বাইশে ফিরে তিনদিন একটু সংসারটা গুছোবে এটাই ওরা ভেবে রেখেছে। অয়ন কখনো মায়ের কথার বিরোধিতা করেনা।কারণ ও জানে ওর মা যথেষ্ট ভেবে সময় নিয়ে কথা বলে।কিন্তু এই বাড়িতে সদ্য আসা মানিনীর মনে একটু ক্ষোভ জমতে থাকে।ওর মনেহয় অয়নের মা কি চায়না ওরা দুজনে ঘুরতে যাক? ওর সরকারি অফিস,যে পরিস্থিতি আসুক ওকে তো অফিস যেতেই হবে।হ্যাঁ আসার আগে থেকে ওদের মাস্ক ব্যবহার করতে হচ্ছে অফিসে।কিন্তু তার মানে এই না ওদের অফিস বন্ধ হয়ে যাবে করোনা বাড়লে,বা বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি দেবে। অয়ন কী ভাবছে বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে ও।মনে মনে ভাবে অয়ন যদি থাকতে চায় থেকে যাবে,ওকে ফিরতেই হবে।আর এই থাকা না থাকার সিদ্ধান্ত আজ রাতেই নিতে হবে।অয়ন ওর মায়ের কথা শুনে টিকিট যদি পোস্টপন্ড করে তাহলে মানিনী ওর বাবার কাছে দুদিন থেকে আসবে।এখন ও কিছু বলেনা,অপেক্ষায় থাকে রাতের।
ক্রমশ..