অয়নের সাথে কথা বলতে বলতে মানিনী একসময় উৎসবের কথাগুলো ভুলেই গেল।অয়ন নয়ডার এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আছে। ওর পরিবারে ওর মা আছে,বাবা অনেক ছোটবেলায় ওর মা’কে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায় ওদের ছেড়ে।মা স্কুলে চাকরি করে ওকে বড় করেছে।ওদের বাড়ি ওর মামাবাড়ির পাশেই,মামাদের ভরসায় মা কে রেখে আসে ও।আর বছর পাঁচেক চাকরি আছে মায়ের।তারপর নিজের কাছে নিয়ে চলে আসবে,এটাই ওর ইচ্ছে।
“কী অদ্ভুত,আপনার মা নেই।আমার বাবা থেকেও নেই”,অয়নের ছেলেমানুষী কথায় খালি হাসি পাচ্ছে মানিনীর।এতদিন বাইরে আছে যে ছেলে সারল্য কি এখনো তাকে সত্যি ছুঁয়ে আছে,নাকি ওকে দেখাতে অভিনয় করছে!
মানুষকে আজকাল কেন যে সহজে বিশ্বাস করতে পারেনা মানিনী!
দিনকাল যা,বিশ্বাসটা নিজের কাছে রাখাই ভালো।তাতে জীবনে কম ধাক্কা খেতে হয়।হয়তো উৎসবের বদলে যাওয়া চরিত্রও এর জন্যে কিছুটা দায়ী।
যাইহোক ক্ষনিকের এই আলাপ,এই ভালো মুহূর্ত গুলো জীবনে অনেকদিন থেকে যায়।কী লাভ সত্যি মিথ্যের হিসেব করে।সত্যি হলে ভালোই,মিথ্যে হলেও ক্ষতি নেই।বরং উৎসবের দেওয়া মন খারাপের চেয়ে অনেক বেশি ভালো।
অয়নের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে শোয়ার সময় চলে আসে বুঝতেই পারেনা মানিনী।অয়নের কাছে রাজধানীর এখনকার মেনুর বদনাম শুনতে শুনতে যাহোক করে খাওয়া শেষ করে ফেলে ও।সত্যি বড্ড সাধারণ খাওয়া ট্রেনের বাকি সব কিছুর তুলনায়।
যখন কম্বল টেনে চোখ বুজতে যাবে ওপরের বার্থ থেকে মুখ বাড়িয়ে হাসিখুশি ছেলেটা বলে,”গুড নাইট”।
ওকে শুভেচ্ছা ফিরিয়ে দিয়ে চোখ বোজার মুহূর্তে মনে ভেসে ওঠে ছেলেটার মিষ্টি হাসিটা,বড্ড বেশি পবিত্র যেন ওই হাসিটুকু।মনটা ভালো লাগায় ভরে যায়।অবাক হয় মানি নিজে,এই টুকরো ভালোলাগার সময় তো ও কবেই পেরিয়ে এসেছে! এখন তো শুধুই পরিণত বোধ বাঁচে ওদের মধ্যে।বিশেষ করে উৎসবের সাথে সম্পর্কের পর থেকে সেই কিশোরীবেলার মত এই হঠাৎ ভালোলাগার অনুভূতি তো হারিয়ে গেছে।আজ অনেকদিন পর সেই স্কুলে পড়ার বা কলেজে প্রথমদিনের সেই উষ্ণ অনুভূতি গুলো বুকে যেন ধাক্কা দিচ্ছে।সেই ধাক্কায় উৎসবের দেওয়া কষ্টগুলোও যেন মলিন হয়ে যাচ্ছে।
একে অয়নের বলা কথাগুলোর ‘ফ্ল্যাশব্যাক’, তারওপর ওর হাসির বারবার অবচেতনে ফিরে আসা সব মিলিয়ে ঘুম আসতে বেশ দেরি হয়।বাবার ভাবনাও মনে সূক্ষ্ম চিন্তার রেশ ছাড়ে,আগে কোনোদিন বাবাকে একা রেখে এতদুরে একা ও যায়নি।
দেরি করে ঘুমানো সত্ত্বেও হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়।কী হলো সালোয়ারের প্যান্টটা ভিজে ভিজে লাগছে কেন!! যাহ হয়েই গেল শেষ অবধি।পরশু মেডিকেল টেস্ট,কে জানে ওখানে আবার কোনো সমস্যা না হয়।
মাঝরাতে এসির ঠান্ডায় একটু কাঁপুনি ধরলেও নিজের সাইড ব্যাগের চেন খুলে ওর পরিচিত ব্র্যান্ডের স্যানিটারি প্যাড বের করে ওয়াশরুমে যাবে বলে।শেষ রাতের নির্জনতায় চলন্ত ট্রেনে একা ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে একটু যে ভয় করে না তা নয়।মধ্যবিত্ত ঘরের ঘরোয়া মেয়ে,তার ওপর বাবার দুশ্চিন্তার কথা…সবটা ঝেড়ে ফেলে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াতে যাবে ওপরের বার্থ থেকে অয়ন আস্তে করে বলে,”ওয়াশরুম যাবেন নাকি? দাঁড়ান আমিও যাবো”।
মানি লজ্জা পেয়ে,”আরে না না।থাক থাক…”,বলার চেষ্টা করে দেখে ছেলেটা একলাফে নীচে নেমে এসেছে।
“জানি আপনার একটু অস্বস্তি হচ্ছে।রাজধানীতে ভয়ের কিছু নেই।তাও চলুন আমি সঙ্গে যাই”,যেন পরিচিত কাউকে বলছে এভাবে ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলে ও নিজেই আগে এগোয় কুপ থেকে বেরোনোর কাঁচের দরজার দিকে।
চলন্ত ট্রেনে কোনো সমস্যা নেই বুঝেও হঠাৎ নিজেকে খুব নিরাপদ লাগে মানিনীর।এই যত্নগুলো, আগলানোগুলো এক এক সময় মনে সুন্দর অনুভূতি রেখে যায়।অপরিচিত ছেলেটাকেও বড্ড ভরসার মনে হয় হঠাৎ করে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সামনেই অয়নকে দেখতে পায়না মানিনী।ওর একটু বেশিই সময় লাগলো চলন্ত ট্রেনে ব্যালেন্স করে সব কাজ মেটাতে।হাতের কাগজটা নিয়ে কি করবে ভাবছে হঠাৎ একটা গেটের সামনে থেকে অয়নের গলা পায়,”বেসিনের গা ঘেঁষে ওটা ডাস্টবিন”।
ছোট থেকে শেখা আড়ালটা হঠাৎ প্রকাশ্যে আসায় প্রথমে একটু লজ্জা পেয়ে যায় ও,কিন্তু অয়নের হাবভাবে বুঝতে পারে এসব ওর কাছে খুবই সাধারণ ঘটনা।
সকালে ঘুম ভাঙলেও কম্বলের তলা থেকে যেন বেরোতে ইচ্ছা করেনা।চোখটা কষ্ট করে খুলতেই যে মুখটা আর হাসিটা চোখে পরে সেটা অয়নের।ওর কোনাকুনি লোয়ার বার্থের এককোনে বসে চায়ের কাপ হাতে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।যেন ঘুমন্ত মানিনীর ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল এতক্ষন।
“মর্নিং।ওঠো।কাল সারা সময় আপনি বলেছি,আর আমার দ্বারা আপনি হবেনা বয়সে ছোট একটা মেয়েকে।আর আজকাল ‘আপনি’ বড় ব্যাকডেটেড”,সারারাত মানিনীর অবচেতনে ফিরে আসা হাসিটা হেসে বলে ও।
উঠে বসে মানি কম্বলটা গায়ে জড়িয়েই বলে,”গুড মনিং”।
ওর সাধারণ মুখে এলোমেলো চুল,ঘুম জড়ানো চোখ,ফ্যাকাসে ঠোঁট অন্যরকম এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে সেটা ও বুঝতেও পারেনা।কিন্তু হঠাৎ একজনের হাসিটা ম্লান হয়ে চোখে মুখে বিস্ময় ধরা পড়ে।নিজেকে লুকোতে চোখ নামিয়ে নেয় অয়ন।
“চা আর দেবে?” ঘুমঘোর গলায় জিজ্ঞেস করে মানি।
“অ্যা..হ্যাঁ দেবে তো।ওই তো একটা ছেলে আসছে চায়ের ট্রে হাতে”,মানিনীর থেকে চোখ সরাতে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে আসা ছেলেটার দিকে মনসংযোগ করে অয়ন।
মানিনীকে পিছনে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে নিজেকে সামলায় ও। সম্পর্ক ভেঙেছে বলেই আবার নতুন সম্পর্কে জড়াতে হবে এমন কোনো মানে নেই,বরং সেটা হলে নিজের পুরোনো ভালোবাসার ওপরই সন্দেহ হবে ওর নিজের।
আর তিনঘন্টা তারপর কে কোথায় হারিয়ে যাবে কেউ জানেনা,নিজেকে বোঝায় ও।
নিজের ফোনটা হাতড়ে সময় দেখতে গিয়ে ধাক্কা খায় মানি,যাহ চার্জ শেষ।চার্জারটা হাতড়াতে থাকে ব্যাগের মধ্যে,কিন্তু পায়না।টেনশন শুরু হয় এবার ওর,ফোনেই তো সব ডিটেইলস আছে।
“কী হলো ফোনে চার্জ শেষ?চার্জার পাচ্ছোনা না?আরে চিন্তার কিছু নেই।দেখি ফোনের চার্জারের পোর্টটা।” আবারও সেই অয়ন।নিজের বার্থ থেকে হাত বাড়িয়ে পাওয়ার ব্যাঙ্ক পেরে দেয়।
“থ্যাংক্স অয়ন।আপনার ঋণ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে”,মৃদুস্বরে বলে মানি।
হাহা করে হেসে ছেলেটা উত্তর দেয়,”জমুক জমুক।চাকরি পেয়ে একদিন এই বাউন্ডুলে ছেলেটাকে পেট ভরে খাইয়ে দিও,সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে।”
মানিনীর বলতে ইচ্ছা করে,’তখন কোথায় পাবো তোমাকে? তুমি আমার এক রাতের বন্ধু ছিলে।সেই এক রাতের যখন মনটা গুছিয়ে নিতে কাউকে বড্ড দরকার ছিল।কাল তুমি নিজেরটা বলে হালকা হলেও আমি পারিনি।তাও তোমার হাসি ঠাট্টা অপমান গুলো ভুলিয়ে দিয়েছিল’।
ব্রেকফাস্ট করে একাই সাইড লোয়ারে বসেছিল মানি।অয়নকে ব্রেকফাস্টের পর থেকে দেখতে পায়নি,হয়তো ওয়াশরুমে গেছে।ওর শরীরটা ভালো লাগছে না।মাসের ওই দিনগুলো এই কদিনে থাবা না বসালেই যেন ভালো হত।ট্রেন টাইমেই চলছে,পৌঁছতে আর মিনিট দশ বাকি।কথা হয়ে গেছে কাকুর সাথে,স্টেশনে আসছে ওকে রিসিভ করতে।সব ঠিকঠাক চলছে,তাও কোথাও যেন মনটায় কাঁটা ফুটছে।’কেন’ ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছে উৎসবের কারণে।হয়তো কাল রাগের মাথায় ছিল,দুপুরের দিকে মানি ফোন করে ঠিক মানিয়ে নেবে ওকে।
ওর চিন্তার মাঝে একটা মেসেজ এসে ঢোকে,ফোন ভাইব্রেট করে জানান দেয় ওকে।
বাবার সাথে একটু আগেই কথা হয়েছে।তাহলে কি উৎসব?
তাড়াতাড়ি ফোন আনলক করে দেখে ওর অনুমান ঠিক।পড়তে যাবে,হঠাৎ কানে আসে অয়নের গলা।
“মানিনী সব গুছিয়ে নাও।শিবাজী ব্রিজ পেরোল।আর পাঁচ মিনিট।দেখো কম্বলের ভাঁজে কিছু ফেলে যেওনা।কম্বলটা গুছিয়ে চাদর ঝেড়ে দেখে নাও সব”।
ফোন লক করে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে অয়নের কথা মত সব দেখতে দেখতেই ট্রেন স্টেশনের মুখ ছুঁয়ে ফেলে।সমস্ত যাত্রীদের নামার তাড়া থেকে মানিকে আড়াল করে দাঁড়ায় অয়ন,”দেখে নাও।আর ফোন এখন ব্যাগে ভরো।স্টেশনে নেমে যা করার কোরো”।
সব গুছিয়ে মানিনী স্টেশনে নেমে দেখে ওর কাকু আসেনি।ফোন বের করে ফোন করতে গিয়ে প্রথমে নজর যায় উৎসবের মেসেজে।
“মানিনী,তুমি যেটা করলে খুব খারাপ করলে।আমি তোমায় বলেছিলাম আমার মা চাকরি করা মেয়ে মানবে না।তাও তুমি নিজের জেদে অটল রইলে।আমি হয়তো আরও কদিন সময় নিতাম।কিন্তু তোমার টাকায় সংসার চালানোর চিন্তাও আমি করিনি।তোমার স্বপ্ন তোমার থাক,আমার স্বপ্ন আমার।আজ থেকে আমাদের দুজনের রাস্তা আলাদা হলো।ব্লক করলাম আমি তোমায় সব জায়গায়।এমনিও আমাদের সম্পর্কে টান অনেক আগেই কমেছিলো।ভালো থেকো,প্রার্থনা করি জেদ বজায় রেখেই সুখী হয়ো”।
শেষটা পড়তে পারেনা মানি।ওর চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় ফোনের স্ক্রিনটা।যার জন্য এত লড়াই সেই শেষ অবধি সাথে থাকলো না!সত্যি হয়তো টান কমেছিল উৎসবের,মানিনী সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকতো।আর নিজের বাবাকে ভুল বুঝিয়ে সময়টা আটকে রাখতে চাইতো উৎসবের জন্যে।ভালোই হলো।
নিজের জগতে এতটাই হারিয়ে গেছিল ও ভুলে গেছিল পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে আছে,যে কোনো সময় পিসির দেওর এসে যেতে পারে।
হঠাৎ পিছনের পরিচিত ডাকে ফিরে তাকালো,তখনও চোখ জলে ভরা।
“মানিনী ভালো থেকো।খুব ভালো কাটলো কালকের সন্ধেটা,যেটা ভালো কাটার কথা ছিলোনা।আমি জানি তুমিও ডিস্টার্বড ছিলে।ট্রেনে ওঠার পর তোমার টুকরো ফোনালাপে বুঝেছিলাম।বেস্ট অফ লাক।এগিয়ে যাও।কিছু সময় নিজের মনের কথা শোনা খুব দরকার,তাহলে অন্তত আফসোস থাকেনা বাকি জীবন।একটা চাকরির লড়াই যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমি জানি।তাই বলি সফল হও।কারোর জন্যে না,আগে নিজের জন্যে।আর এই নাও,এই চিরকুটে আমার নম্বর লিখে দিয়েছি।কখনো দিল্লিতে,কলকাতায় বা জীবনে কখনো আমার দরকার পড়লে ফোন করো”,কথা শেষ করে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মানির চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জলটা মুছে দেয় অয়ন,”বন্ধুত্বের দাবিতে এটা করলাম।ভালো থেকো।আনন্দে থেকো।বাই”।
আর দাঁড়ায় না।পিছন ঘুরে হাঁটা লাগায় মানিনীর অর্ধ পরিচিত ছেলেটা।ভিড়ে মিশে যাওয়ার আগে মানিনীর কাছে দিয়ে যায় ওর ছোট একটা ঠিকানা,যা আজকের দিনে বড় দরকারি জিনিস।
উৎসব ছেড়ে যায় মানিনীকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে, অয়ন ছেড়ে যায় স্বাবলম্বী হতে।
ডান হাতে ধরা কাগজটা মুঠো করে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখদুটো ভালো করে মুছে নেয় ও।ততক্ষনে অয়ন হারিয়ে গেছে ভিড়ে।তাও ওর হাসিটা মনে করে নিজের ঠোঁটে হাসি টেনে অস্ফুটে মানিনী বলে,”থ্যাংক য়্যূ”।
ক্রমশ…
1 comment
Nice