“মানি মা তোমায় আজ ফোন করেছিল?” মানিনী অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরে শুয়ে একটা ওয়েব সিরিজ দেখছিল,অয়ন ওর দরজার মুখে এসে বললো।
উঠে বসে কান থেকে হেডফোন খুলে তাকালো মানি অয়নের দিকে।অয়ন কিছু বলেছে ও দেখেছে,কিন্তু কথাটা কান অবধি পৌঁছয়নি।ওর মুখ দেখে অয়ন বুঝতে পেরে কথাটা আবার রিপিট করলো।
-“না মাসিমা তো ফোন করেননি।কেন কিছু বলার আছে?”
-“হ্যাঁ কী সব মাপের দরকার।চুড়ি,আংটি ওইসব নিয়ে কিছু বলবে।তোমার অফিস কেমন কাটলো?”কথা বলতে বলতে ওপেন কিচেনের দিকে পা বাড়ায় অয়ন।ঠান্ডা কদিন ভালোই পড়েছে এনসিআর এ।অফিস থেকে ফিরতে নটা হলেও এই ঠান্ডায় বাইক চালিয়ে এসে এক কাপ কফি নাহলে ঠিক জমে না।
-“তোমার কফি ফ্লাক্সে রাখা আছে”,মানিনী অয়নকে কথাটা বলতে একটু গলা তোলে।
-“ও আচ্ছা।থ্যাংক য়্যূ…থ্যাংক য়্যূ”,নিজের কফি মাগটা বাসনের তাক থেকে নিতে নিতে বলে অয়ন।
টিশার্টের ওপর ওর প্রিয় হুডি টা চাপিয়ে বিছানা ছেড়ে কিচেনের সামনের ডাইনিং স্পেসে এসে দাঁড়ায় মানিনী।
অয়ন দেখে হাসে মৃদু ।
“তোমার অফিস কেমন কাটলো? দুপুরে কী খেয়েছিলে?” মানিনী বলে।
“ভালোই কেটেছে।অনেক গুলো মিটিং ছিল।তবে আমাদের এই খ্রীস্টমাসে চাপ অনেক কম থাকে।ক্লায়েন্ট ছুটিতে থাকে”,কফির কাপ নিয়ে অয়ন ওদের ছোট ডাইনিং টেবিলে এসে বসে।
মানিনী ও ওর পিছন পিছন এসে বসে ডিভানে।
“অয়ন এই যে সব কিছু হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল।বিয়ের দিনও ফিক্সড হয়ে গেল।তোমার মনে হয় না বড্ড তাড়াহুড়ো হয়ে গেল?”,মানি বলবো কী বলবো না করে বলেই ফেলে।
অয়ন কিছু না বলে কিছুক্ষন মানিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর বলে,”তুমি এখনো রেডি নও, তাই তো? বেশ তো বিয়ের দিন পিছিয়ে দেওয়া যাবে,এখনো কার্ড ছাপেনি তো”।
“আরে না আমি সেটা বলছি না।আমাদের দুজনের বাড়িতে এখনো কিন্তু জানেনা আমরা লিভ ইন করি।আমাদের কাছে বিয়ে মানে সামাজিক ছাপ,আর আমাকে আর পিজির টাকা গুনতে হবে না,এই টুকুই…”,হাসতে হাসতে মজার ছলে বলে মানি।কিন্তু লক্ষ করে অয়নের মুখে মজার কোনো রেশ অবধি পড়েনি।কথা ঘুরিয়ে মানিনী তাই বলে,”কী হলো চুপ করে কী ভাবছো? ভুল কিছু বললাম আমি?”
“নাহ,ভুল ঠিক না।কিন্তু বিয়ে মানে কি শুধুই সামাজিক স্বীকৃতি?এখনকার জীবনের সাথে কী কোনো পার্থক্যই থাকবে না?এখন এক ফ্ল্যাটে,এক ছাদের নিচে থাকি আমরা।রুম কিন্তু এক না।বিয়ের পর কী এটা বদলাবে না?এখনো রান্নার মাসি কী রান্না হবে আমায় জিজ্ঞেস করে?এটাও কী বদলাবে না?আমাদের জীবনযাত্রা,নিজেদের শেয়ার করা,আত্মীয় বন্ধুদের যখন খুশি আসতে বলা,এত সব কিছু মনেহয় কিছুটা হলেও বদলাবে।এটা আমার চিন্তাভাবনা,অবশ্যই তোমারটা আলাদা হতেই পারে”,অয়ন খুব ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে মানিনীর দিকে তাকায়।
চুপ করে শোনে মানি।সত্যি বলতে এভাবে কখনো ভাবেনি ও।ব্যাচেলর জীবনে ফ্ল্যাটমেটের সাথে থাকা আর সংসার করার মধ্যে একটা পার্থক্য তো থাকেই।
মানিনীর মুখ দেখে আবার বলে অয়ন,”তাই বিয়ের আগে মানসিক প্রস্তুতি সবার দরকার।আর আমরা একসাথে থাকি সেটা না জানলেও আমার একার ফ্ল্যাটে তোমার আসা যাওয়া আছে এক শহরে থেকে এটা আন্দাজ আমাদের মা বাবা করবেই।তাই তাঁরাও বিয়ের জন্য তাড়া লাগাবেন।কিন্তু আমাদের তাড়াহুড়ো করলে চলবে না।লিভ ইন মানে কিন্তু দায়িত্ব নেওয়াটা অপশনাল,কিন্তু সংসারে সবাইকে দায়িত্ব নিতেই হবে সমান ভাবে।বিয়ের পরে অন্য ধরনের চাপের কথা ছেড়েই দিলাম।কারণ আমি নিজেও ওই দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে কখনো উপযুক্ত হবো কি না জানিনা”।
“কোন দায়িত্ব?” অন্যমনস্ক ভাবে বলে মানি।
“সংসার বাড়ানোর দায়িত্ব।এটা বিয়ের পরের সবচেয়ে বড় আক্রমন।কিন্তু এব্যাপারে আমি অন্তত মানসিক ভাবে নিজেকে তৈরি করতে খুব একটা তাড়াতাড়ি পারবো না।তোমারও সেটা জেনে রাখা দরকার।এই দায়িত্বটা ভবিষ্যতে নেব না একদম ই বলছি না,কিন্তু আমার অন্তত সময় লাগবে।তবে হ্যাঁ তুমি অন্তত আমার বর্তমানে কোনোদিনও এ সম্বন্ধে চাপ অনুভব করবে না।তাই বললাম ওই বিষয়টা ছেড়েই দাও।কিন্তু বাকি দায় দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে।এখন সম্পর্কটা শুধু আমার তোমার,তখন সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে দুটো বাড়ির মধ্যে।তাই আমার তোমার দুজনের দায়িত্বই দ্বিগুন হবে”,অয়ন যে বয়সেই মানিনীর থেকে বড় তা না,চিন্তা ভাবনাতেও এগিয়ে আজ প্রথম বুঝতে পারে মানি।চুপ করে থাকে।এবার প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারে বিয়ের মানে কী!
ওকে চুপ থাকতে দেখে অয়ন বলে,”ভেবোনা।বিয়ের এখনো তিনমাস দেরি যদি মার্চেও বিয়ে হয়।আর কার্ড ছাপাতে আরো মাসখানেক দেরি আছে।তাই তুমি যদি আরও সময় চাও অনায়াসে নিতে পারো।আমি সবসময় তোমার সাথে আছি”।
মৃদু হাসে মানিনী,”আসলে কী বলতো,চাপ ভাবলেই চাপ।এমনিও আমার বাবা একটু সংস্কারসম্পন্ন।তাই এই লিভ ইন এর মতো ব্যাপার স্যাপার মানতে পারবে না,যদি জানতে পারে।আর আমিও এখন তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবোনা।আমি তোমার ওপর পুরোপুরি ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেছি।তোমায় ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনা।যা হবে হবে,যা দায়িত্ব বাড়বে দেখা যাবে।দুজনে মিলে ঠিক সামলে নেব।তবে সত্যি বলছি আজ তুমি আমায় নতুন করে ইম্প্রেসড করলে।তুমি কত ডিটেইলস ভেবেছো,আমি তো এসবের কিছুই ভাবিনি।তবে কথাগুলো তো একদম সত্যি।আজকের পর আরো বেশি করে আমি তোমার প্রেমে পড়লাম হে প্রিয়তম…”,অয়নকে লেগ পুলিং করলেও সত্যি করেই মানিনী অয়নের কথায় মুগ্ধ হয়।ওর পরিণত চিন্তা ভাবনায় আশ্বস্ত হয়।অয়ন কিছু না বলে হাসতে থাকে।
“হ্যাঁ সৌরভ বল”,অসময়ে সৌরভের ফোনে অবাক হলেও কাজের মাঝেও ফোনটা রিসিভ করে অয়ন।এখন ফেব্রুয়ারী মাসটা একটু চাপ নিয়ে কাজ করছে ও,মার্চে আবার পনেরো দিনের ছুটি নেবে।আটই মার্চ ওদের বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে।একটা আলাদা উত্তেজনা হচ্ছে।ও তো ভাবেইনি এক বছরের সম্পর্ক এত তাড়াতাড়ি পরিণতি পাবে।সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হয় মাঝে মাঝে।
“হ্যাঁ রে কেমন আছিস তোরা?দিল্লিতে তো ডেঙ্গু বেড়েছে শুনলাম।তাছাড়া আরেকটা কী নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটেছে খবরে দেখাচ্ছে তাই ফোন করলাম”,সৌরভের গলায় উদ্বেগ শোনা যায়।
“হ্যাঁ আমিও শুনছিলাম।আমাদের অফিসেও শুনছিলাম কিছু নিয়ম চালু করবে।আরে প্রতি বছর এরকম কোন না কোনো অজানা জ্বর আসে,দুদিন থেকে হাওয়া হয়ে যায়।এবারেরটা চীনে একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে শুনলাম তাই এখানেও রেড এলার্ট চালু করছে,তাও ওই এয়ারপোর্টে।আর আমরা তো আর বাইরে যাচ্ছি না যে এত মাতামাতির দরকার আছে।আমার এমনিও যা অবস্থা এখন এসব জ্বর নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই”,নিজের কাজ করতে করতে জবাব দেয় অয়ন।
-“হ্যাঁ ভাই তোরা দুজনেই সাবধানে থাকিস।তা তোরা আসছিস কবে?”
-“এই তো ১লা মার্চ টিকিট দুজনের।যাওয়ারটা ট্রেনে কাটা আর ফিরবো প্লেনে,১৫ তারিখ,ফিরে কাছাকাছি একটু কোথাও ঘুরে আসার প্ল্যান আছে।তুই কিন্তু বিয়ের দুদিন আগে চলে আসবি আমার বাড়ি”,অয়ন এবার কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে বলে।
-“হ্যাঁ রে ভাই।আমি স্বাধীন মানুষ।সঙ্গে নিজের ল্যাপটপ নিয়ে যখন খুশি যেখানে খুশি চলে যেতে পারি।আমি তো এখন আর কর্পোরেট স্লেভ নই”,অয়নকে সুযোগ পেলে এখনো ঠোকে সৌরভ।
“হ্যাঁ ভাই তোর দম ছিল।আমার আগেও ছিলোনা।এখন তো আরও নেই।তোর ওই ডিজিটাল মার্কেটিং আমার মাথায় ঢুকবেও না।আর অফিসে না এসে সারাদিন ল্যাপটপের সামনে বসে কাজ আমার দ্বারা হবেও না।সারাদিন বাড়িতে বসে কাজ হলে আমি ল্যাদ খেয়েই দিন কাটিয়ে দেব”,অয়ন হেসে হেসে জবাব দেয়।
“দূর শালা বাড়িতে বসে স্বাধীন ভাবে মাসে লাখ টাকা কামানোর সুযোগ থাকলে ওই দক্ষিণী বসের গালাগাল খাবো কেন?স্বাধীন জব,কোনো টার্গেট নেই,কোনো বস নেই আর কী চাই?”সৌরভ নিজের স্বাধীনচেতা মনোভাব ব্যক্ত করে।
এরপর কিছুক্ষন হাসাহাসি কথার পিঠে কথার পর অয়ন বলে,”এই যে স্বাধীন ব্যবসায়ী আমি এখনো স্লেভ ভাই।আর বিয়ের পিঁড়িতে বসা অবধি এই চাকরিটা খুব দরকার ভাই।তাই এবার ফোন রাখ,উইকেন্ডে তোকে ফোন করবো”।
সৌরভ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে এবার,”ঠিক আছে বাবা।উইকেন্ডে ভিডিও কল করবো,মানিনীর সাথেও দরকার আছে।তবে রাতের দিকে।কারণ শনি রবি দুদিনই আমার লাইভ আছে দুপুরে আর বিকেলে।ওকে চল বাই, গুড নাইট।”
“গুড নাইট”,বলে ফোন কেটে দেয় অয়ন।
ফোনটা নিজের ডেস্কে রেখে নিজের মনে তখনও সৌরভের কথাই ভাবতে থাকে,মুখে লেগে থাকে মৃদু হাসি।
এবারের নবমীতে সৌরভের বাড়ি যাওয়া হয়নি ওর,বরঞ্চ ওর মুখে অষ্টমীর অভিজ্ঞতার কথা শুনে একাদশীর দিন সৌরভ ই ওর বাড়ি চলে এসেছিল।ওইদিন মানিনীর বাবাও এসেছিল অয়নের মায়ের সাথে কথা বলতে।সৌরভ ছিল বলে দুই পরিবারের কথাবার্তা অনেকটা সহজে মিটে গিয়েছিল।
অয়ন অবাক হয়েছিল নিজের পুরোনো ফ্ল্যাটমেটকে দেখে।কথাবার্তায় কত চৌখস হয়ে গেছে ছেলেটা।একটা আলাদা কনফিডেন্স লক্ষ করে।ভালোই লেগেছিল ওর।ওইদিন রাতেও থেকে গিয়েছিল সৌরভ ওদের বাড়িতে।সারারাত ধরে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল ওর কাজের ধরন ধারণ।ভবিষ্যৎ এ অনেক স্কোপ আছে বুঝেও অয়নের ঠিক উৎসাহ লাগেনি।
‘এই সৌরভ কতটা সময় নিয়ে নিলো।আজ ফিরতে রাত হয়ে যাবে আর মানি চিৎকার করবে…’,নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে কাজে আবার মনোনিবেশ করে ও।
সৌরভের বন্ধুত্ব অয়নের চাকরি জীবনের বিশেষ পাওনা।সৌরভ সবসময় ওকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট করে এসেছে,সঙ্গে থেকেছে।তাই হয়তো সৌরভ নিজের কাজের রাস্তা বদলালেও ওদের বন্ধুত্ব বদলায়নি।পরেও হয়তো সৌরভের হাতটাই শক্ত করে ধরতে হবে অয়নকে।সময় বলবে মানুষের জীবন কোন রাস্তায় হাঁটবে, কীভাবে বদল হবে জীবনে।
ক্রমশ…
1 comment
Daroon lagche