আরও একবার – দ্বাদশ পর্ব

by Tamali

“তুমি বাড়ি গেছো? কই আমায় জানাওনি তো?” অভিমানী গলায় বলে মানিনী।সারাসপ্তাহ কাজের চাপে বিশেষ ফোন করতে পারেনি অয়নকে।দিন চারেক আগে অফিস বেরোনোর সময় অয়নের ফোন ও কেটে দিয়েছিল ব্যস্ততার কারণে।আজ শনিবার একটু বেলার দিকে ফোন করে শুনছে অয়ন কিছুদিনের জন্য বাড়ি গেছে।
“আরে বলবো বলেই তো ফোন করেছিলাম।তুমি তো ধরলে না।তারপর তুমিও করোনি, আমিও সময় পায়নি।মায়ের শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়েছিল,তাই তৎকালে টিকিট কেটে আসতে হলো”,ওর অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা করে অয়ন।
মানিনীর মেজাজটা আজ এমনিও ঠিক নেই।উৎসবের সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর ও নিজেও নিজের দিক থেকে উৎসবের ফোন নম্বর বাদে ওর বাকি সমস্ত কন্টাক্ট ব্লক করে দিয়েছিল,এমনকি দিল্লি এসে নতুন নম্বর নিয়ে পুরোনো নম্বরও বন্ধ করে দেয়।আর সেই নম্বর ছিল সীমিত কিছু মানুষের হাতে।
ফেসবুকে কদিন আগে এক বান্ধবী ওর নম্বর চেয়েছিল,প্রমিসও করেছিল আর কাউকে দেবেনা সে নম্বর।কিন্তু উৎসবকে নম্বরটা ওই দিয়েছে ,শিওর মানিনী।নাহলে উৎসব ওর নম্বর পাবে কীকরে!!
কাল রাতে ফোন করেছিল উৎসব ওকে,নিজের পুরোনো নম্বর থেকেই।
অয়নের ফোন কেটে মানি বিছানা ছেড়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে ঢুকলো।কমোডে বসে অন্যদিন ফোন খুটখাট করে কিন্তু আজ মনের মধ্যে বারবার ঘুরে ফিরে উৎসব ফিরে আসতে লাগলো।
গতকাল ফোনটা যখন আসে মানিনী খাচ্ছিল,আর ভাবছিল খেয়ে উঠে বাড়িতে ফোন করবে,বাবার খবর সারাদিন পায়নি।
হঠাৎ ফোনের রিংয়ের আওয়াজে ভেবেছিল বাবা ই ফোন করছে,কিন্তু নামের বদলে নম্বর দেখে যখন ধরবে কিনা ভাবছে,ভালো করে নম্বরটা নজরে আসতেই বুকটা ধক করে উঠলো…বড্ড চেনা নম্বরটা তো। আর কোনোদিন ওই নম্বর থেকে ফোন আসবে না ভেবে নামটা ডিলিট করে দিয়েছিল কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে,সেই কবেই। কিন্তু… ওর দীর্ঘ চিন্তার মাঝে ফোনটা কেটে যেতে মনে মনে কেন কে জানে অদ্ভুত এক শান্তি পেয়েছিল। কিন্তু মিনিটের ব্যবধানে আবার নম্বরটা আওয়াজ করে ফোনে ভেসে উঠতে ধরেই নিয়েছিল কলটা।
“মানি?” সেই পুরোনো কণ্ঠস্বর।
“হ্যাঁ।তুমি এতদিন পরে?” বিস্ময়টা লুকোতে পারেনি মানিনী।
“হমম,কদিন বড্ড মনে পড়ছে তোমার কথা।আমার জন্মদিন গেল,কই উইশ করলে না?” বড্ড বেশি কানে লাগে মানিনীর উৎসবের কথার টোন টা।
কিছুক্ষন থেমে উত্তরটা দিয়েই দেয় ও,”আমার নম্বর তো ব্লক ছিল তোমার ফোনে!”
শব্দ করে হাসে উৎসব,”তাই বুঝি একবার রিং করেও দেখোনি নতুন নম্বর থেকে?অভিমানে কদিন ওই পুরোনো নম্বরটা ব্লক করে রেখেছিলাম বলে কি নিজের প্রিয় দিনেও তোমায় ভুলে থাকবো?সারাদিন অপেক্ষার পর নিজেই রাতে তোমার ওই নম্বরে কল করেছিলাম,কিন্তু…যাইহোক নতুন নম্বর জোগাড় করতে সময় কদিন লেগেই গেল।”
কথাগুলো একটু বেশি অবাক করে মানিকে।একবার মনেও পড়ে যায় শেষদিন ফোনের কথাগুলো,’তুমি তো আর সুযোগ পাবেনা।এখনই যদি তোমার ঔদ্ধত্য এইরকম হয়,বিয়ের পর তো তুমি আমায় পাত্তাই দেবেনা।আমি এরকম মেয়ের সাথে বাকি জীবন কাটাতে পারবো না।দুঃখিত মানিনী।আর তুমি আমায় ফোন করবেনা,কোনো সম্পর্ক নেই আমার আর তোমার।এটা মাথায় রেখ।’ কথাগুলো যেন মনে ছেপে গেছিল ওর।কত রাত ঘুমোতে পারেনি,কথাগুলো কানে বেজেছে।আজ এতদিন পর অন্য কথা শুনে বড্ড মেকি মনে হচ্ছে সবটা।কিন্তু এতদিন পর! কী চায় কী উৎসব! কিছুটা কৌতূহলেই জিজ্ঞেস করেছিল মানিনী,”কদিন!!! তুমি তো সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলে সেদিনই,তাহলে আজ এসব কথার মানে কী?”
“তার আগে বলো তুমি কি সত্যি ভালো আছো আমাকে ছাড়া? তুমি তো জানতে আমার অভিমান বেশি,তাহলে কেন আর একবার ফোন করলে না মানি? আমি তো অপেক্ষা করছিলাম”,উৎসবের বলার ধরণ আবার ঘেঁটে দেয় মানিনীকে। নতুন ভাবনা এসে ভিড় করে মনে।
কী বলবে ভাবনা গুলো এলোমেলো হয়ে যায়।বেশ তো নিজেকে গুছিয়ে ভালোই কাটছিল দিনগুলো। বরং সত্যি বলতে কি শেষ চার বছরের তুলনায় বেশিই ভালো ছিলো ও। তাহলে হঠাৎ কেন আবার এই যন্ত্রনা?
উৎসব চাইলেও মানিনী কথা বেশিক্ষন চালাতে পারেনি।মিনিট পাঁচেক পর উৎসবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলটা কেটে দেয় ও।বলেছিল,”বাবা ফোন করছে,পরে ফোন করবো তোমায়”।
কিন্তু বাবার সাথে কথা বললেও অজানা কারণে তারপর ফোনটা সুইচ অফ করে শুয়ে গেছিল ও,কিন্তু ঘুম আসেনি।
শনিবারের সকালে ঘুম ভেঙেই মনে পড়েছিল অয়নকে।
‘দূর আজকেই মুড টা অফ,আর আজকেই অয়ন নেই।ভালো লাগেনা,একমাত্র ওই পারে মনটা ভালো করে দিতে’,কথাগুলো নিজের মনে বলেই চমকে উঠেছিল ও।
আজ তিনমাস হয়ে গেল অয়নের সাথে বন্ধুত্ব,হয়তো বা অসম বন্ধুত্ব।কারণ বয়সে অয়ন বড়,দুজনের কাজের জগৎ ও আলাদা।এমনকি দুজনের প্রকৃতিও বিশেষ মেলেনা।চুপচাপ মানিনী শুধুই শোনে,আর বকে যায় অয়ন।
কিন্তু তারপরও আজকাল মন খারাপ করলে,একা লাগলে ওর কথাই মনে পড়ে। দীপক কাকু-কাকিমাও সেদিন রাগ করছিল যাওয়া কমে গেছে বলে।কিন্তু কী করবে মানি,আজকাল ছুটির দিনগুলো অয়নের সাথে একবার অন্তত দেখা না হলে একটু যেন ফাঁকাই লাগে।ওর বাইকে একটু ঘোরা, আর তারপর কোনো চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া,সম্পূর্ণ করে দেয় সপ্তাহান্তের ছুটি।
ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসে নিজের বিছানায় বসে পড়ে ও। ওর রুমমেট এখনো ঘুমোচ্ছে। কী করবে বুঝতে না পেরে আবার কম্বলটা জড়িয়ে শুয়ে পড়ে ও নিজের বিছানায়।
সারা সপ্তাহ কাজের যা চাপ থাকে! মানি কখনো আগে ভাবেইনি সরকারী দপ্তরে এত চাপ থাকতে পারে! চাকরি জয়েন করার প্রথম দিকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে উৎসব যে উঁকি মারতো না তা নয়,উৎসবের সম্পর্ক শেষ করার প্রায় একমাস পরও মন খারাপের রোগটা তখনও ছিল। সপ্তাহান্তে তখন যাওয়ার একটাই ঠিকানা ছিল,কাকুর বাড়ি।কিন্তু যে শনি রবিবার সেখানেও যাওয়া হত না,উৎসবের সাথে কাটানো সময় গুলো ক্লান্ত নির্জন দুপুরে মনের ক্যানভাসে ভিড় করে আসতো।
এরপর উৎসব ঝাপসা হচ্ছে যে সময়টা সেই সময় অয়ন ঢুকলো জীবনে। ঝিমিয়ে পড়া জীবনটা একটা গতি পেলো,অবসর যেন চলেই গেল জীবন থেকে।আর তার সাথে তাল মিলিয়ে হারিয়ে গেল উৎসব।
এখন মানিনী ঠান্ডা মাথায় যখন ভাবে,অনুভব করে উৎসব ওকে কী পরিমাণ ডমিনেট করতো। উৎসবের অনুপস্থিতি আজও কি মনে অস্থিরতা তৈরি করে,না কি অদ্ভুত একটা শান্তি দেয় বুঝতে পারেনা ও। কখনো কয়েক মুহূর্তের জন্য ওর কথা মনে এলে মানি নিজেকে এই প্রশ্নটা করে।কিন্তু উত্তরটা যেন ও খুঁজতে চায়না। আজও প্রশ্নটা মনে এলো ওর,কিন্তু উত্তরটা বুঝতে পেরে একটু অবাকও হলো ও মনে মনে। আজ সহজে উত্তরটা পেলো,তার কারণ হয়তো আগের রাতে উৎসবের ফোন কল।ওই কলটা কাটার পরের মুহূর্তে ওর ভীষণ দমবন্ধ লাগছিলো। মনেহচ্ছিলো আবার একটা দমবন্ধ পরিস্থিতিতে হয়তো ঢুকে পড়ছে ও।
‘ধুর যত উল্টোপাল্টা চিন্তা ভিড় করছে মাথায়’,নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুলে নিলো ও।
কানে হেডফোন লাগিয়ে কল লিস্ট অন করে কিছুটা দোনামনা করে অয়নের নম্বরে আবার কলটা করেই ফেললো।
দুবার রিং হতেই ওপাশে ফোনটা রিসিভ হলো।

-“বলো কী হলো আবার? রাগ কমলো একটু?”
-“আমি রাগ করবো কেন? তোমার দরকার ছিল বলেই তো হঠাৎ বাড়ি গেছো। কেমন আছেন এখন মাসিমা?”
-“ভালো আগের থেকে। আমি ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি এখান থেকে। হয়তো আর দিন সাতেক থাকতে হবে। মায়ের আসল সমস্যা একাকীত্ব। লাস্ট মাসে বললাম না মায়ের এক কলিগ কাম ফ্রেন্ড হঠাৎ মারা গেছেন? ওটাই একটু বেশি ধাক্কা দিয়েছে মনে,আর তার থেকেই শরীর খারাপ। মনের প্রেসার পড়েছে শরীরে।কী করে আরও পাঁচ বছর কাটাবে জানিনা। দরকারে ভলেন্টারী রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নেয়াবো। দেখি কদিন?”
-“মানে কবে ফিরবে ঠিক নেই,তাই তো?”
মানির গলার স্বরে চমকে ওঠে অয়ন, অভিমান বাজলো কি কণ্ঠস্বরে? হার্টবিট নিজের অজান্তেই ফাস্ট হয়ে গেল ওর।

“কেন? কিছু দরকার আছে?” ইচ্ছা করেই প্রশ্নটা করলো অয়ন।
উত্তর দিলোনা মানিনী সঙ্গে সঙ্গে,চুপ করে রইলো কিছুক্ষন।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”না কোনো দরকার না। আসলে কিছু কথা…অনেক কথাই তো বলা হয়নি তোমায়…তাই ভাবছি”,উত্তরটা এলো এলোমেলো হয়ে।
“বলো কী বলবে?” অয়নের কান উৎসুক হলো।
“না এভাবে বলা যাবেনা।বলবো, সামনা সামনি দেখা হলে। আমার জীবনের সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট ঘটনা। ফিরে এসে জানিও”,কিছু না ভেবেই বলে দেয় মানি।
ওর মনের মধ্যের অস্থিরতা প্রকাশ পায় ওর এলোমেলো কথাতে।
অয়ন এটুকু বুঝতে পারে কিছু হয়েছে মানিনীর,আর ও সেটা শেয়ার করতে পারছে না কারোর সাথে। বড্ড অসহায় লাগে ওর। এখনই ও নেই কাছে,আর এই প্রথম মানি ওর অভাব বোধ করছে।

একদিকে মা,আর একদিকে ওর মনের গভীরে লুকোনো ভালোলাগা,বলা ভালো ভালোবাসা…অসহায় করে অয়নকে।

ক্রমশ..

You may also like

2 comments

Anaya Chatterjee July 9, 2024 - 9:01 AM

sundor

Reply
বন্দনা দাস July 9, 2024 - 9:28 AM

নতুন করে পড়তে ভীষণ ভালো লাগছে

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!