আরও একবার- দ্বিতীয় পর্ব

by Tamali

বড্ড অসহায় লাগে মানির নিজেকে।কীকরে জানতে পারলো উৎসব আসল সত্যিটা।ওর হাতে গোনা দু তিনজন বন্ধু শুধু জানে সত্যিটা।তাদের মধ্যেই কেউ…
মানিনী মনে মনে ঠিক করে নেয়,উৎসবকে বলতে দেবে ওর কথা,তারপর নিজের পয়েন্ট গুলো বলবে।কিছুতেই উৎসবের অন্যায় মেনে নেবে না।ও অপেক্ষা করতে থাকে নিজের কথা বলার সুযোগের।
“আমি বলেছিলাম না স্কুল টিচারি আর ব্যাংক ছাড়া কোনো চাকরির পরীক্ষা তুমি দেবে না।মেয়েদের জন্যে ও দুটোই বেস্ট চাকরি।আর তাছাড়া ওই দিল্লিতে পোস্টিং দিলে তখন কী করবে তুমি?” একটানা চিৎকার করার ঢঙে কথা বলে থামে উৎসব মানিনীর উত্তরের অপেক্ষায়।
“কেন কী সমস্যা অন্য জবে? আমি জব না পেলে সংসার চলবে? দুজনের যে কোনো একজনকে তো চাকরি করতেই হবে।…”,শান্ত গলায় ও কথা বললেও উল্টো দিকের মানুষটা ধৈর্য্য ধরে কথা শোনেনা।
মানিনীর কথার মাঝেই চিৎকার করে ওঠে উৎসব,”আমি বলেছি তোমায় সংসার চালানোর দায়িত্ব নিতে?আর তুমি ভাবলেই বা কী করে তুমি চাকরি পেলেই আমি নাচতে নাচতে বিয়ে করে নেব? তোমার পয়সায় সংসার চলবে আর আমি সেই সংসার শুরু করতে রাজি হয়ে যাবো?এতোটাও কাপুরুষ নই আমি।আমি নিজেই পারবো সংসার চালাতে।কোনো ভরসা নেই না তোমার আমার ওপরে? যাবে না তুমি দিল্লি।তোমার চাকরি করা নিয়ে আমার প্রবলেম নেই,কিন্তু ব্যাস স্কুল নাহলে ব্যাঙ্ক।ওর বাইরে কিছু না।আর এটাই আমার শেষ কথা”,উৎসব কথা শেষ করে রীতিমত হাঁফায়।মানিনীর প্রাণের বন্ধু দিয়ার কাছ থেকে যখন ও সত্যিটা শুনেছে তখন থেকে মাথায় আগুন জ্বলছে ওর।
“আমি ট্রেনে চেপে ফেলেছি উৎসব।আর দুমিনিটে আমার ট্রেন ছেড়ে দেবে।আমি ফিরে কথা বলবো তোমার সাথে”,নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে মানি।
“না তুমি যাবেনা।নেমে পড়ো ট্রেন থেকে।ওই মেডিকেল টেস্ট তুমি দেবে না,জানো কী কী করে ওখানে!আর দিল্লি গেলে আমার সাথে কোনো সম্পর্ক থাকবে না তোমার।মনে রেখো আজ দিল্লি গেলে,এটাই আমাদের শেষ কথা।তোমার ওই চাকরির টাকায় তুমি খেও।যা রূপের ছিরি তোমার আরেঞ্জড ম্যারেজ কোনোদিনও দিতে পারবে না তোমার বাবা।সারাজীবন ওই চাকরির টাকায় নিজে ফুর্তি করো”,শালীনতার সীমা অতিক্রম করে উৎসব।
আর পারেনা মানি ভদ্রতা করতে ওই ছেলেটার সাথে।এবার গর্জে ওঠে ও,”ঠিক আছে তাই হবে।নিজেই ফুর্তি করবো আমি।অনেক ডমিনেট করেছ তুমি আমায়।আর না।দিল্লি তো আমি যাবই।এতদিনের দিনরাত এক করে কষ্ট করে পাওয়া চাকরি আমি তো হেলায় ছাড়বোনা।এসএসসি এ রাজ্যে কবে হবে কেউ জানেনা।ব্যাংকের চাকরি পাওয়াও অত সোজা না।সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের জব পাওয়া ছেলেখেলা না।আমার এতদিনের পরিশ্রম…”,আবার থমকায় মানিনী।
“মানি বাড়াবাড়ি করোনা।নেমে এসো এখুনি ট্রেন থেকে।আর এক মিনিট বাকি।আমি তোমার একা দিল্লি যাওয়া কখনো বরদাস্ত করবো না।তোমার বাবা মেয়ের টাকার লোভে তোমায় ছাড়তে পারেন,আমি কখনো…”,এবার ধাক্কা খায় উৎসব।
“শাট আপ উৎসব।আমার বাবাকে নিয়ে একটাও ফালতু কথা বলবে না।আমি ফোন রাখছি।দিল্লি থেকে ফিরে সামনাসামনি কথা হবে”,দাঁতে দাঁত চিপে অথচ দৃঢ় গলায় বলে মানিনী।
“না আর কথা হবেনা।তুমি দিল্লি গেলে এটাই আমাদের শেষ কথা”,উৎসবের কথা শেষ হয় আর দুলে ওঠে রাজধানী এক্সপ্রেস।
“বেশ তাই হবে।ভালো থেকো”,ফোনটা মনের সব জোর এক করে কেটে দেয় মানি।
জলভরা চোখে সামনে তাকিয়ে দেখে ওর প্রায় সমবয়সী একটা ছেলে এসে বসেছে ওর ঠিক উল্টো দিকে।এতক্ষন খেয়াল করেনি সাইড আপারে যাত্রী এসে গেছে।ছেলেটার চোখে চোখ পড়তে মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকায় ও।আস্তে আস্তে গতি নিচ্ছে ট্রেন।ছেড়ে যাচ্ছে ওর শহর।

কিছুক্ষন পর ওয়াশরুম থেকে ফিরে একটু অপ্রস্তুতে পরে মানিনী,ছেলেটা দিব্যি পা ছড়িয়ে বসে আছে ওর সিটে।বসতে পেলে শুতে চায়,মনে মনে এটা ভাবলেও মুখে কিছু বলেনা ও।এমনিও ওর মনে যে কী ঝড় চলছে ওই জানে। যার জন্য ওর এই চাকরির চেষ্টা আজ সে না বুঝেই অকারণে সম্পর্ক শেষ করার হুমকি দিল।সম্পর্ক থাকুক আর না থাকুক,এই কথাগুলো সম্পর্কে যে ছাপ ফেলবে সেটা ও অনুভব করতে পারছিল।কষ্টটা বুক ঠেলে বেরোতে চাইছিল বলেই ওয়াশরুমে গেছিল মনের ভার হালকা করতে।
“এক্সকিউজ মি”,মানিনীর ডাকে ছেলেটা তাড়াতাড়ি করে পা গুটিয়ে সোজা হয়ে বসে খুব মিষ্টি করে হেসে বললো,”সরি সরি।আসলে ছুটে এসে ট্রেন ধরেছিলাম।পা দুটোয় বড্ড কষ্ট হচ্ছিল।স্ন্যাক্সস দিলেই আমি ওপরে উঠে যাবো”,হাসিটা সত্যি বড় সুন্দর ছেলেটার।তার কারণ হয়তো দুদিকের দুটো গজ দাঁত।
“না ঠিক আছে”,কথা না বাড়িয়ে নিজের সিটে পা গুটিয়ে বসলো মানিনী।
“আমি অয়ন,অয়ন সেন।দিল্লিতে চাকরির কারণে প্রবাসী।বরাবর ‘হোমসিক’ ছিলাম।এখনো তাই চাকরি পাওয়ার তিনবছর পরও প্রতিবার ছুটে এসেই ট্রেন ধরি”,হাসিটা যেন ঠোঁটে লেগেই আছে।আর ওই হাসিটাই কেমন যেন একটা অস্বস্তি তৈরি করছে মানির মনে।
ওর প্রিয় অভিনেতা,যে দুর্ভাগ্যবশত আজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে,তার হাসির সাথে বড্ড মিল এই ছেলের হাসির,একই রকম সারল্য এরও চোখে মুখে আর হাসিতে।
মানিনীও হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকায়।
ছেলেটা কিন্তু থামেনা।এক অপরিচিত মেয়ের ওর বকবকানি কী রকম লাগবে যেন ভেবেও দেখেনা।কথার স্রোতে মানিকে ভাসাতে ও আজ বদ্ধপরিকর।
“আপনাকে দেখে কিন্তু আমার বয়সী লাগছে।কত বয়স আপনার? অয়নের প্রশ্নে চোখ বড় বড় করে তাকায় মানিনী।
‘পাগল নাকি এই ছেলেটা! একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়ের বয়স জিজ্ঞেস করছে,তাও আবার এক কামরা লোকের সামনে’!!!!
মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পেরে একগাল হাসিতে মুখ ভরিয়ে অর্ধ পরিচিত ছেলেটা বলে,”আরে সরি সরি।তখন থেকে কী ভুলভাল বকছি।আসলে আমি একটু ঘেঁটে আছি।গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে তো আজকে,তাই…”,হাসিটা যেন জোর করে মুখে ধরে রেখেছে বলে মানির মনে হয়।
চমকে তাকায় ও অয়নের চোখের দিকে।অয়ন মুখটা বাইরের দিকে করে কিছু বলতে যাবে সেই মুহূর্তে স্ন্যাকস নিয়ে এসে দাঁড়ায় ওদের কম্পার্টমেন্টের অ্যাটেন্ডেন্ট।
খাবার খেতে খেতে মানিনীর মনেহয় ওর সামনে বসে থাকা ছেলেটার সাথে ওর যেন সেরকম কোনো পার্থক্য নেই।নিজেকে চুপ রাখতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেলে কথাটা অয়নকে,”কেন ব্রেক আপ হয়েছিল আপনাদের?”
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে অয়ন বলে,”ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপ এর পরিণতি হয়তো এরকম ই হয়।’আউট অফ সাইট,আউট অফ মাইন্ড’ হওয়াটাই স্বাভাবিক।না ছোঁয়া যায়,না হাগ করা যায়,না কিস করা যায় ইচ্ছে হলে,না কষ্ট হলে কাঁধে মাথা রেখে কাঁদা যায়! কী করে টিকবে সম্পর্ক? ফোনে কথাও ফুরিয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে।তার সাথে আছে প্রাইভেট জবের ব্যস্ততা।খুব তাড়াতাড়ি কেউ এসে রিপ্লেস করে দেয়…”।
“মোটেই এটা সত্যি না।আমার এক কাজন পাঁচ বছরের বেশি ডিস্ট্যান্স রিলেশনে ছিল।এখন বিয়ে করে সংসার করছে।ওদের মধ্যে কথার শেষ হতনা।মন খারাপ হলে ফোনেই কাঁদতো।অদ্ভুত ওদের বোঝাপড়া ছিল।অনুভূতি বা আবেগ উপলব্ধি করার জিনিস,আর ওরা হাজার হাজার মাইল দূরত্বে থেকেও সেটাই করতো।আসলে সম্পর্কে দরকার ভালোবাসা।সেটা সত্যি হলে দূরত্ব কোনো ম্যাটার হয়না”,অয়নকে থামিয়ে দিয়ে মানি নিজের কথাগুলো উগরে দিলো।যেন নিজেকেই শুনিয়ে বললো ও।
“বাব্বা আপনার তো বিশাল অভিজ্ঞতা।তা অন্যের অভিজ্ঞতা দেখে বলছেন না পার্সোনাল অভিজ্ঞতা আছে?” অয়ন নিজের মন খারাপটা আবার লুকিয়ে ফেললো মনের গভীরে।
অন্যমনস্ক মানি ফ্লাক্স থেকে গরম জল কাগজের কাপে ঢালতে ঢালতে বললো,”সবাই কি ওদের মত লাকি হয়?আমার আরও দুএকজন বন্ধু কেও দেখেছি খুব ভালোভাবে দূরত্বের সম্পর্ক ধরে রেখেছিলো।আবার অনেককে দেখেছি দুজনে দূরে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ভেঙে গেছিল তাদের সম্পর্ক।ওই যে অনুভূতি উপলব্ধি করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা সবার থাকেনা।যাদের সম্পর্কে প্রকৃত ভালোবাসা থাকেনা।”
“হয়তো আপনি ঠিক, লাকি সবাই হয়না।প্রথমে খুব খারাপ লেগেছিল।আমি বলেওছিলাম যা স্যালারি পাচ্ছি দুজনের হয়ে যাবে,চলো বিয়ে করে নি।কিন্তু ওই যে ‘রিপ্লেসমেন্ট’,ততদিনে আমি ওর মনেই ছিলাম না।কষ্টটা বেশি হয়েছিল যখন জেনেছিলাম আমার নিজের বন্ধুই আমার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছিল ওর মনে।” কয়েক মুহূর্ত চুপ করে নিজের কষ্টটা ভুলে অয়ন বলে,”ছাড়ুন।শুধু শুধু আপনার মনটা খারাপ করছি।হয়তো আপনি কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন,খুশিতে আছেন।যদিও আমিও বেশ খুশিতেই আছি।এসব তুচ্ছ দুঃখ কষ্ট তো জীবনে আসতেই থাকবে।”
মানি ও চুপ করে থাকে।
“আপনি আরাম করে বসুন।আমি আমার সিটে উঠে যাই।আপার বার্থে একটাই অসুবিধা প্রকৃতি কিছুতেই ধরা দেয় না”,অয়নের মুখ দেখে মনেহয় না ওপরে উঠতে কোনো ইচ্ছে আছে।
“আপনি চাইলে আপনার বসার সিটে বসতে পারেন।আমার কোনো সমস্যা নেই।আমি যতদূর জানি ওটা আপনার জন্যেই বরাদ্দ”,মানি হাসিমুখে বলে।
“তাহলে বেশ ভালোই হয়।আমি আসলে বেশিক্ষন কথা না বলে থাকতে পারিনা।তারওপর আজ চুপ করে শুয়ে থাকলে মন বেইমানি করবে।মুভির স্টক ও শেষ।বাই দ্য ওয়ে,আমি কথা বললে আপনি ডিস্টার্বড হবেন না তো?” অয়ন সরল মনে জিজ্ঞেস করে ফেলে।
ঘাড় নেড়ে হাসিমুখে না বোঝায় মানি।ওর ও তো আজ মনের মধ্যে ঝড় চলছে।ছেলেটা বাস্তবে যাই হোক,এই পরিস্থিতিতে ওর কম্পানি খারাপ লাগছে না ওর। হয়তো ছেলেটা সত্যি বলছে না,হতেই পারে।কিন্তু তাতে মানির কী! ও তো ট্রেন থেকে নেমে আর ছেলেটার খবর রাখতে যাচ্ছে না।নিজের মনকে বোঝায় ও মনে মনে।
অয়নের গল্পের সত্যি শেষ নেই।ছেলেটা ঠিক বাচাল না,বরং মিশুকে বলা যায়।এরকম বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার ওর কলেজে একটা ছেলেরই ছিল,কিংশুক।ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবার কাছে সেও খুব প্রিয় ছিল।অয়ন অনেকটা সেই চরিত্রের ছেলে।ওর কথা সত্যি হলে,ওর জন্যে একদম ই ভালো হয়নি।এরকম ছেলে কাউকে ধোঁকা দিতে পারেনা,মেয়েটা সত্যি ভুল করলো।

ক্রমশ..

You may also like

2 comments

Anaya Chatterjee June 24, 2024 - 9:00 AM

sundor hoyeche….likhte thako

Reply
Anonymous July 9, 2024 - 12:28 AM

khoob bhalo lagche

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!