আরও একবার – পঞ্চদশ পর্ব

by Tamali

“দেখো উৎসব বারবার তুমি সিদ্ধান্ত নেবে তা তো হয়না।তুমি ভাবছো প্রতিবার তুমি বলবে আর আমি সেই মত সব কিছু মেনে মানিয়ে নেব।সরি,তা সম্ভব না।আমি এবারে তোমার সিদ্ধান্ত মানতে পারলাম না।আমার পক্ষে আবার নতুন করে সব শুরু করা সম্ভব না।আমি…”,উৎসবের কাছে বাধা পায় মানিনী,কানে হেডফোন থাকায় উৎসবের গলা অনেক বেশি জোরালো হয়ে কানে এসে ধাক্কা মারে।
“আরে আগেরবার আমি হয়তো একটু বেশি রিয়াক্ট করেছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি আমার ভালোবাসার কাছে নত হয়ে আমার থেকে দূরে যাবেনা।তোমায় দূরে পাঠাতে চাইনি আমি।ছেড়ে থাকতে হবে ভাবলেই…যাইহোক যখন বুঝলাম বাড়াবাড়ি করেছি তখন নিজেই তো ফিরে এলাম বলো?আমি সিদ্ধান্ত কেন চাপাবো, আমি বোঝাতে চাইছি আমার অসহায়তাটা।প্লিজ আমায় ফিরিয়ে দিওনা মানি”,ফোনের মধ্যে দিয়ে কৃত্রিম কষ্ট যতটা সম্ভব গলায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে উৎসব।
প্রথম ভালোবাসা,তাই মানিনী একটু থমকায় ওই গলা শুনে। ওর বুঝতে ভুল হচ্ছে,নাকি উৎসব সত্যি অনুতপ্ত ঠিক বুঝতে পারেনা।অতীতের অভিজ্ঞতা ওকে উৎসব সম্পর্কে কোনো আশা জাগতে না দিলেও ওর অতীত দুর্বলতা ওর মনের মধ্যে খোঁচা দেয়।
“সরি আমি অলরেডি অন্য একজনের সাথে এনগেজড,তাই…”,ইচ্ছা করেই মিথ্যেটা বলে মানি।ও বুঝতে পারছিল প্রতিবারের মত এবারেও উৎসব নিজের মতটাই প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর।আর তার জন্যে কোনো সময় মানিনীকে দিতেই সে রাজি না। মানি যে শান্ত মনে কদিন ভাববে,অনুভব করবে কোনো দুর্বলতা আদৌ আর বেঁচে আছে কিনা সেটার সুযোগটুকুও এ’কদিনে ও পায়নি।
যত উৎসব ওকে টেনে ধরতে চাইছে ও বুঝতে পেরেছে তত হাঁফিয়ে উঠেছে ও মনে মনে।আজকের ফোনেও উৎসবের নাছোড়বান্দা মনোভাব সেই দমবন্ধ অনুভূতিটা এত বেশি করে উপলব্দি করাচ্ছে যে ও বাধ্য হয়ে মিথ্যের আশ্রয় নিয়েই নিলো।
“তুমি এনজেগড !! কার সাথে…না মানে সেই ভাগ্যবান কে? আর আমার প্রতি ভালোবাসা এতটাই ঠুনকো ছিল যে সম্পর্ক ভাঙার ছ’মাস হওয়ার আগেই তুমি নতুন সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়লে!!আশ্চর্য!!” উৎসবের গলার স্বর বুঝিয়ে দেয় ও পুরোপুরি বিশ্বাস করছে না।
উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে মানি।উৎসবের প্রশ্নে যে মুখটা মনে ভাসতে চাইছে প্রানপণে সেটা আটকে রাখে সচেতনভাবে।
না,এই জীবনটা এই মুহূর্তে আর জটিলতায় জড়াতে চায়না ও। বন্ধুত্বের সুন্দর সম্পর্কটা অন্য কোনো জটিল সম্পর্ক দিয়ে আবদ্ধ করতে মন চায়না। তাই ভরসার মানুষটা বন্ধু হয়েই থেকে যাক সেটাই এখন ওর একমাত্র চাওয়া।
কিন্তু উৎসবের সাথে জড়ালে আর কোনো কিছুই,এমনকি অয়নের বন্ধুত্বটাও থাকবে না সেটা বোঝার মত বুদ্ধি ওর আছে।তাই সবার আগে উৎসবকে আটকাতে বদ্ধপরিকর হয় ও।
“কী হলো বলতে আপত্তি আছে তার নাম? নাকি আমার ওপর অভিমানে মিথ্যে বলছো? প্লিজ সোনা বলছি তো এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল করেছি,এই ক’মাস তোমার থেকে দূরে থেকে তার ফলও ভোগ করেছি।আর পারছিনা তোমার সাথে কথা না বলার এই চাপ নিতে।দেখো বিয়ে হলে তুমি যেমন চাকরি করছো করবে,আমি বাকি সব সামলে নেব।দরকারে আমি দিল্লি গিয়ে থাকবো।এখন তো অনলাইনের যুগ।আমার লেখালিখি নিয়ে কোনো সমস্যাই হবে না।আর মা’কে…”,উৎসবের নিজের মত বানানো প্ল্যান আবার চাপ বাড়ায় মানিনীর মনে।চেঁচিয়ে চুপ করায় ও উৎসবকে,”প্লিজ…জ উৎসব থামবে? এসব প্ল্যান করার অনেক সময় পাওয়া যাবে।কিন্তু সবার আগে জানা দরকার আমাদের মানসিকতা আর মেলে কি না? আমি সত্যি আর তোমার সাথে সম্পর্ক রিজিউম করতে ইচ্ছুক না।প্লিজ আপাতত তুমি আমায় আর ফোন কোরোনা।সত্যি বলতে আমি এখন কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ত আছি।এ মুহূর্তে অন্য কিছু নিয়ে ভাবছিও না।”
“আসলে কী বলতো একটা বেকার ছেলের সাথে কোন স্বাবলম্বী মেয়েই বা জীবন জড়াতে চায় বলো? তুমি তো এগিয়ে গেছো অনেকটাই,সেখানে আমি এখনো…”, উৎসব চেষ্টা করে মানিনীর সেন্টিমেন্টে যদি একটু নাড়া দেওয়া যায়।কিন্তু ফল হয় উল্টো,প্রায় ছ’মাসের কাছাকাছি প্রবাসে কাটানো মানিনী উৎসবের পুরোনো ট্রিক ধরে ফেলে সহজেই।আর তাই প্রচন্ড বিরক্তিতে উৎসবের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে,”তুমি প্লিজ এসব ফালতু কথা বন্ধ করবে?একটা কথা ক্লিয়ারলি বলি তোমায় আমি আর সেই আগের মানিনী ঘোষ নেই।আগের মত বোকা,সব কথায় তোমায় বিশ্বাস করা মেয়েটা আজ অনেক পরিণত। বাইরে থাকতে থাকতে,লোকের সাথে মিশতে মিশতে আমি কিছুটা হলেও মানুষ চিনতে শিখেছি।আর তুমিই তো বলেছিলে বউয়ের টাকায় সংসার চালানোর মত মানসিকতা তোমার না,তাহলে এসব কথা আসছে কেন?নিশ্চই তুমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তবে সংসার শুরু করবে,কিন্তু আমি এই মুহূর্তে সংসার করার ভাবনাতেই নেই।জানিনা ভবিষ্যতেও করবো কী না।আমি যেমন আছি ,ভালো আছি।বলা ভালো বেস্ট আছি। অ্যাম আই ক্লিয়ার্ড?”
উৎসবের কোনো জবাব সঙ্গে সঙ্গে যোগায় না।মুখের ওপর এরকম জবাব ও মানিনীর থেকে পাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।কথা হাতড়াতে থাকে ও নিজের মধ্যে।
“উৎসব আমি আজ খুব ক্লান্ত।সারাদিন খুব কাজের চাপ গেছে।এবার ফোন রাখছি।তুমি বন্ধু ছিলে,আছো,থাকবে। কিন্তু তার বেশি মনেহয় না আমাদের কারোর পক্ষে সেটা ঠিক ছিল।আমি অনেক পরে বুঝেছি আমরা কেউ কাউকে চিনিনি ভালো করে ওই পাঁচ বছরে।এই ছ’মাসে আমি অনেক কিছু শিখেছি,জেনেছি নিজের সম্বন্ধে।হয়তো সেটাই রিয়েল আমি।আর সত্যি বলতে জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় আমি কাটাচ্ছি নিজের সাথে।তুমিও তোমার মত করে ভালো থেকো।দরকারে,অদরকারে যখন খুশি ফোন করো, কিন্তু কোনো সম্পর্কের আশা কোরোনা।রাখছি এখন,গুড নাইট”,উৎসব কে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দেয় মানিনী।আর সাথে সাথেই এক আশ্চর্য শান্তি অনুভব করে নিজের মনে।
অন্ধকার প্রকৃতির দিয়ে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয়।ব্যালকনির এই আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ওর মনেহয় এই শহরটা যেন ওর খুব নিজের,আসার পর থেকে অনেক কিছু দিয়ে ওকে আপন করে নিচ্ছে শহরটা প্রতি মুহূর্তে।

“তুই ভেবে দেখেছিস সৌরভ তুই কী বলছিস? এই মার্কেটে তুই চাকরি ছেড়ে দিবি হাতে কোনো অফার না নিয়ে? নেক্সট ইয়ার বলেছিলি বিয়ে করবি…”,অয়ন এত হতবাক হয়ে গেছে যে অনুভূতি চাপতে পারেনা,শেষ করতে পারেনা কথাটাও।
সৌরভের সাথে বসের ঝামেলা হয়েছিল,তারপর থেকে রোজই ক্ষোভ বাড়ছিল…সব খবরই রেখেছিলো অয়ন।কিন্তু তাই বলে ঝামেলা এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে সৌরভকে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে দুঃস্বপ্নেও সেটা ভাবেনি ও।
হ্যাঁ যদি অন্য কোথাও ভালো সুযোগ পেয়ে এই কোম্পানি,এমনকি এই শহর ছেড়েও চলে যেত সৌরভ খুব খুশি হত অয়ন।কিন্তু এভাবে চাকরি ছাড়লে কেরিয়ারে ফাঁক হবে,আবার চাকরি পাবে কী না,পেলেও কতদিন পর…ভাবতে গিয়ে মাথা ঘুরে যায় ওর।
সৌরভ উত্তর না দিয়ে গোমড়া মুখে রুটি চিবোতে থাকে।ও জানতো অয়ন শুনলে এই ধরণের অভিব্যক্তিই দেখাবে,তাই ও অফিসে থাকার সময় এ বিষয়ে কিছু বলেনি।কিন্তু আজ ওই সাউথ ইন্ডিয়ান ম্যানেজারের সাথে যে রকম তর্কাতর্কি হয়েছে আর একদিনও ওর পক্ষে ওই প্রজেক্টে কাজ করা সম্ভব না।আজকেই প্রজেক্ট চেঞ্জের জন্যে এদিক ওদিক মেইল করেছে।কিন্তু এখন নাকি এই প্রজেক্ট ছাড়তে চাইলে চাকরি ছাড়তে হবে।তাও কদিন ও চেষ্টা করবে,যদি অন্য প্রজেক্ট পায় ভালো,নাহলে চাকরিটা ও ছেড়ে দেবেই। ওই সবজান্তা ম্যানেজারের সাথে ও কিছুতেই কাজ করতে পারবেনা।
“দেখ সৌরভ আমি জানি তুই যা ঠিক মনে করবি সেটাই করবি।কিন্তু ভালো করে ভেবে সিদ্ধান্ত নিস।কাকু রিটায়ার করেছেন আগের মাসে।এখনো পেনসন চালু হয়নি।সামনে পুজোর তিনমাস বাকি।সব মিলিয়ে এই সময় চাকরি ছাড়াটা কী ঠিক হবে?” ডালের বাটিতে রুটি ভেজাতে ভেজাতে কথাগুলো বলে মুখে রুটি ভরে অয়ন।
এরপরও সৌরভ মুখ খোলে না।ও জানে ওর অবস্থা বোঝার ক্ষমতা অয়নের নেই। অয়ন এমনিও কথা গায়ে মাখার ছেলে না।তারওপর প্রজেক্ট এক হলেও ওদের ফাংশনাল স্ট্রিম এক না।ফলে টিমও আলাদা।অয়নের টিম লিড অনেক ভদ্র,ফলে ম্যানেজার যতই খারাপ হোক,ওদের টিমকে বিশেষ ঘাঁটায় না।
সৌরভকে চুপচাপ খেতে দেখে অয়নও কথা বাড়ায় না।কিন্তু দুজনের মনের মধ্যে চলতে থাকে কথার খেলা।অয়ন নিজের মনে সাজাতে থাকে সৌরভ আর ওর কাল্পনিক কথোপকথন।অন্যদিকে মুখে কিছু বলতে না পারলেও সৌরভও একই ভাবে মনের মধ্যে উত্তর-প্রত্যুত্তরের খেলায় মন ভারি করতে থাকে।
এর মাঝে হঠাৎ অয়নের ফোন গোঁ গোঁ করে বাজতে থাকে।নাম না দেখেই অস্বাভাবিক পরিবেশে ফোন ধরবে না বলে ফোনটা কেটে দেয়।
অয়ন ফোন কেটে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।মনটা বড্ড খারাপ লাগছে ওর,যত না সৌরভের জন্যে তার চেয়েও বেশি নিজের কারণে।ওর এই প্রবাস জীবনের পুরোটা জুড়েই তো সৌরভ।সৌরভ মানে জ্বর হলে জলপট্টি দিয়ে রাত জেগে পাশে থাকার আশ্বাস।সৌরভ মানে মন খারাপের রাতে একটা বিয়ার ক্যান হাতে নিয়ে সারারাত ওর ঘরে রাত কাটিয়ে দেওয়া।সৌরভ ওর সমস্ত পাগলামো, একাকীত্বের একমাত্র সঙ্গী।
একদম খেতে ইচ্ছে করেনা অয়নের। বুকচাপা কোনো এক কষ্ট ওকে অনুভব করায় সৌরভের মত গোঁয়ার গোবিন্দ একবার যখন ভেবেছে আগাপাশতলা না ভেবেই চাকরি ঠিক ছাড়বেই।ওর মন ক্রমশ ও ভারী হতে থাকে।

উৎসবের ফোন কেটে মনটা বিরক্তিতে ভরে ছিল বলে মানিনী অয়নের নম্বরে ফোন করেছিল,ভেবেছিল আজ সবকিছু খুলে বলবে ওকে।নিজের মনের মধ্যেটা পুরো খুলে হালকা করে দেবে নিজেকে ওর এখনকার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর কাছে।মানিনী বুঝতে পারে অয়ন কিছুটা হলেও জানে ওর অতীত সম্পর্কের কথা।প্রথমদিন ট্রেনে উৎসবের সাথে কথা কাটাকাটির মাঝেই তো ও এসেছিল।
কিন্তু মানিনী কে অবাক করে এই প্রথমবার অয়ন ওর ফোন কেটে দিলো।যত ব্যস্ততাই থাকুক এই কমাসের সম্পর্কে অয়ন ওর ফোন দুবারের বেশি রিং হওয়ার আগেই ধরে নেয়।আজ তাহলে কী হলো? খারাপ হয়ে থাকা মনে খারাপ লাগার ছোঁয়া না চাইতেও লেগে যায়। অয়নের সাথে ওর এখন যা সম্পর্ক এই ধরণের তুচ্ছ ঘটনায় স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে খারাপ লাগার কথা না,কিন্তু সারাদিন কিছুই ঠিকঠাক হয়নি বলেই হয়তো মানি এই সাধারণ ঘটনায় মনে মনে অয়নকে উৎসবের সাথে তুলনা করে ফেলতেও পিছপা হয়না।সম্পর্কের শেষ দিকে অসময়ে ফোন করলে উৎসব বেশিরভাগ সময় এভাবেই ফোন কেটে দিত।আর কল ব্যাকও করতো না।ফোন আসতো সেই মাঝ রাতেই,নিয়ম মেনে।
ওর প্রিয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিজের চিন্তায় ডুবে ছিল মানিনী,হঠাৎ ওর হাতের ফোন নড়ে উঠলো আওয়াজ করে।কানে লাগানো হেডফোনে বাজতে থাকা রিংটোন বুঝিয়ে দিলো অয়ন কল ব্যাক করেছে।অন্যদিন হলে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা হয়তো ধরে নিত মানিনী।আজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।ধাক্কা খাওয়া মনটা হয়তো জটিল কিছু অঙ্ক মেলাতে মেলাতে ভাবছিল উৎসবের মতোই অয়নের কাছেও নিজেকে কী সহজলভ্য করা ঠিক হবে,নাকি অয়নের ফোন না ধরে জবাব দেবে ওর ফোন কেটে দেওয়ার।হতাশাগ্রস্ত মন হয়তো এভাবেই সরল জিনিস জটিল করে ভাবায় অভ্যস্ত হতে থাকে ধীরে ধীরে।

ক্রমশ..

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!