আরও একবার – পঞ্চবিংশ পর্ব

by Tamali

“অয়ন…অয়ন…”,মানিনী এত জোরে চিৎকার করে ওঠে যে হোটেলের ওয়াশরুমে বসে চমকে যায় অয়ন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ চলছিল,সবাই বলছে ভারতেও লকডাউন শুরু হবে,কিন্তু অয়ন বিশ্বাস করেনি।জোর করেই নির্ধারিত দিনে সিমলা এসেছে ও মানিনীকে নিয়ে।কাল ফেরার কথা।
“কী হলো কি? এমন চেঁচালে যে যে কাজে গেলাম সেটাই মাঝপথে আটকে গেলো”,হাসতে হাসতে মজার ছলে বলে অয়ন ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতে।
“আরে পরশু দেশ জুড়ে কার্ফু পালন হবে ছটা থেকে ছটা, আর তারপর বিকেলে আবার পিএম ভাষণ দেবেন।মনেহচ্ছে এ দেশেও লকডাউন শুরু হয়ে যাবে।কাল ফিরেই মাসের বাজার করে নিতে হবে,বুঝলে? জানিনা কী করে কী হবে? মা বাবারাও কীকরে সামলাবে?” মানিনীর কথায় উদ্বেগ ধরা পড়ে।
“মা তো সেই জন্যেই বলেছিল ওখানে থেকে যেতে।আমরাই তো…”,মুহূর্তে অয়নের গলার স্বর বদলে যায়।সত্যি তো বয়স্ক মানুষটা একা একা কী করবে! নিজের মায়ের চিন্তাটাই মনে আসে আগে।
“হ্যাঁ কিন্তু তখন তো আমরা শিওর ছিলাম না সত্যি লকডাউন হবে কি না? অফিসে ছুটি দিত না এতদিন টানা ছুটির পর।সব মিলিয়ে…দাঁড়াও একবার সায়নীকে ফোন করি।অফিসের কী ডিসিশন হলো শুনি”,মানিনী নিজের ফোনটা সেন্টার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে হোটেলের ব্যালকনিতে চলে যায়।আর অয়ন অন্যমনস্ক ভাবে নিজেদের বিছানায় গিয়ে বসে।
মায়ের মুখটা মনে পড়তে থাকে বারবার।ফোন করতে ইচ্ছা করলেও ফোন করে কী বলবে বুঝতে পারেনা।হঠাৎ মনে হয় মায়ের তো বয়স হয়েছে,এ ক’দিনের মুদিখানার জিনিস কিনে না রাখলে খাবে কী? রোজের বাজার তো করতে পারবে কী না সন্দেহ! সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা নিয়ে মায়ের নম্বরে কল করে।
-“হ্যাঁ বাবু বল”,প্রতিমা দেবীর গলায় কোনো তারতম্য খুঁজে পায়না অয়ন।
-“মা তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলে।মনে হচ্ছে লকডাউন হয়ে যাবে।তুমি পাপাইদার দোকানে ফোন করে মাসের যা কিছু দরকারি আনিয়ে নাও।শোনো সোয়াবিন, পোস্ত, আলু,ডিম এগুলো বেশি করে আনিয়ে রাখবে।রোজের মাছ, শাক-সবজি পাবে না হয়তো।আর হ্যাঁ…”,বাধা পেয়ে থেমে যায় অয়ন।
-“বাবু তোকে চিন্তা করতে হবে না রে এত।আমি ঠিক গুছিয়ে নিয়েছি।সব প্রায় কেনা আছে।কাল বেরিয়ে কিনে এনেছি,তাছাড়া বিয়ের সময়ের বেঁচে যাওয়া জিনিস ঘর ভর্তি।আমার চিন্তা হচ্ছে তোদের নিয়ে।শহর গুলোতে সব বাড়ি ফেরার হিড়িক পরে গেছে।আর মুদিখানার দোকান গুলোর সামনেই লাইন পড়েছে।তোরা কাল ফিরে কিছু পাবি কী না ওটাই চিন্তা।খুব ভালো হত যদি বাড়ি ফিরে আসতে পারতিস।”
-“আসলে মা মানিনীর অফিসে কী হবে ঠিক জানিনা।ও ফোন করেছে ওর কলিগকে।কী বলে দেখি।আমার তো বাড়ি থেকেই কাজ হওয়ার কথা ছিল ,শুধু সপ্তাহে দুদিন অফিস যাওয়ার কথা ছিল।আমাদের ও পুরো ওয়ার্ক ফ্রম হোম দেবে কী না সন্দেহ।তবে লকডাউন হলে তো কিছু করার নেই।দেখি অফিস গুলোতে কী বলে?”
-“হ্যাঁ দেখ।বড্ড চিন্তা হচ্ছে তোদের দুজনকে নিয়ে।কাল কখন ফেরা তোদের?”
-“সকাল বেলাই বেরিয়ে যাবো।কালকা থেকে দুপুরে ট্রেন।পৌঁছতে সন্ধের পর হয়ে যাবে”।
-“তোদের মুদিখানা কিছু করা আছে?” উদ্বিগ্ন লাগে অয়নের মায়ের গলা।অয়ন আর ওর মায়ের কথার মাঝে মানি রুমে এসে ঢোকে।
-“না মা।এখনই অনলাইনে অর্ডার করে দেব।কাল রাতে ডেলিভারি টাইম নেব।আর বাই চান্স পৌঁছতে না পারলে গেটে বা ঘরের সামনে রেখে দিয়ে যেতে বলবো।দেখি…ঠিক আছে মা।আজ বিকেলে তুমি পারলে কিছু কাঁচা বাজার করে নিও।এখন রাখছি।কাল গাড়িতে উঠে ফোন করবো।”
-“হ্যাঁ বাবু সাবধানে আসিস সব।আর দেখ তোদের যেটুকু কেনাকাটা করার করে রাখিস।খুব খারাপ দিনকাল আসছে”,মায়ের কথায় মন খারাপ হয়ে যায় অয়নের।এত বছর একা ওকে সমস্ত কষ্টে আগলেছে।আর আজ এরকম দিনে মা একা অত দূরে।ফোন কেটে তাকিয়ে দেখে মানিনী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
“বলো কী বললো সায়নী?” অয়ন নিজের মনের ভাব চেপে প্রশ্ন করে।
“তুমি মা’কে ফোন করেছিলে?” মানি জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
-“হুঁ! আমি ফোন করেছিলাম।জানি মা নিজের খেয়াল রাখতে পারে,তাও এরকম পরিস্থিতিতে একা কী করবে চিন্তা হচ্ছিল।তুমি বলো তোমার অফিসের আপডেট কী?”
-“আপডেট মানে সোমবার সবাইকে অফিস যেতে হবে একবার যদিনা ওই দিন থেকেই লকডাউন অ্যানাউন্স করে দেয়।মানে মাঝে যে কদিন থাকছে যেতে হবে।মা কী বললো?”
-“মা আর কী বলবে? চিন্তা করছে আমাদের জন্যে।বললো মুদিখানার বাজার করে রাখতে।যদি সোমবার থেকেই লকডাউন হয়ে যায়,ভাবছি আজকে অনলাইনে অর্ডার করে রাখি কাল রাতের দিকের টাইম স্লট দিয়ে।মানে আটটার পর ডেলিভারি নেব।এতদিন ছিলাম না,রসদ নেই ও তো সেরকম কিছু।”
-“হ্যাঁ সেটা করতে পারি।কিন্তু যদি না পৌঁছতে পারি।তবে অর্ডার করে রাখাই ভালো।নাহলে রবিবার খাবার জুটবে না হয়তো…”,মানিনী কেও অন্যমনস্ক লাগে।
অয়ন বুঝতে পারে এবার মানি বুঝতে পারবে অবস্থার গুরুত্ব।মায়ের বলা কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি মানিনী সেদিন।ওর কথার টোন খারাপ লেগেছিল সেই রাতে অয়নের।ও নিজের মা’কে যতদূর জানে ওর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ মা কখনোই করবে না।উল্টে ওদের জীবন যাতে নির্বিঘ্নে কাটে সর্বদা সেই চেষ্টাই করবে।আর সেই কারণেই হয়তো আরও কিছুদিন বাড়িতে থাকতে বলেছিল।কিন্তু সেদিন মানিনীর কথা খারাপ লাগলেও ও ইচ্ছে করেই মায়ের হয়ে কোনো কথা বলেনি।ও চায় মানিনী নিজে ওর মা’কে চিনুক। শাশুড়ি মানেই এক ধরণের বা কোনো স্বাভাবিক গোত্রের মানুষ না।বৌমা মানেই যেমন খারাপ না,শাশুড়ি মানেই হিংসুটে না।অয়ন জানে ওর মা তাদের দলে পরে যারা জোর করে কিছু আদায় করেনা,বা অধিকার ফলায় না।তাহলে অন্তত ওর বাবাকে এত সহজে মুক্তি দিতনা।
আর কথা না বাড়িয়ে অনলাইন অ্যাপ খুলে ও প্রয়োজনীয় জিনিসের অর্ডার করায় মন দিলো।কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো অর্ধেক জিনিস ‘আউট অফ স্টক’ হয়ে গেছে এই অল্প সময়েই।এবার কিছুটা হলেও টেনশনে পরে গেল ও।একদিনের কার্ফু ঘোষণায় যদি এই অবস্থা হয় তাহলে দেশে লকডাউন ঘোষণা হলে কী হবে! মানিনী ওকে লক্ষ করছে এতক্ষন খেয়াল করেনি অয়ন।মানি পাশ থেকে ঝুঁকে ওর খোলা অ্যাপে তাকিয়েই বুঝে গিয়েছিল অয়নের ভ্রুকুটির কারণ।হঠাৎ অয়ন শুনলো মানিনী বলছে,”আর রিস্ক নেওয়া ঠিক হবেনা।যা টাকা লাগে লাগুক,চলো আজ এখনই বেরিয়ে পড়ি।কাল সকালের মধ্যে পৌঁছে যাবো, সারাদিনে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।তুমি রিসেপশনে ফোন করে গাড়ি অ্যারেঞ্জ করে দিতে বলো।”
অয়ন কথা গুলো শুনলেও সঙ্গে সঙ্গে সেটা মেনে নিতে পারেনা।এখন এই মুহূর্তে গাড়ি ভাড়া করে ওদের ফ্ল্যাটে ফিরতে গেলে অনেক গুলো টাকা খরচ হয়ে যাবে।একেই বিয়েতে কত খরচ হয়েছে।তারওপর এই বেড়াতে আসা।সব মিলিয়ে অয়ন দিশেহারা হয়ে পড়ে।
“কী হলো কী ভাবছো?” মানিনী অধৈর্য্য হয়ে পড়ে।
“আজ যাওয়া সম্ভব না।একে সন্ধে হতে চললো।এই পাহাড়ী রাস্তায় এভাবে হঠাৎ করে বের হওয়া ঠিক না।কাল সকালেই যাবো।এখন আপাতত অনলাইনে যা পাই অর্ডার করি।কাল রাতে ফিরে যত রাতই হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করবো”,এই প্রথম মানির মতের সাথে মেলেনা অয়নের। মানিনী কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়।ও বুঝতে পারে অয়ন যা বলছে ভেবেই বলছে।
“তুমি অর্ডার করো,আমি বাবাকে একটা ফোন করে আসছি”,মানিনী আবার ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায়,ওর সিম যে কোম্পানির তার নেটওয়ার্ক এই অঞ্চলে দুর্বল,রুমে বসে তাই কথা বলা যায় না।
অয়ন একবার মুখ তুলে দেখে আবার ফোনের স্ক্রিনে মনোনিবেশ করে।

“বল মানি,আমি মিনিট দশ হয়ে গেল তোকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছি,লাইন ই লাগছে না”,মানিনীর বাবা ফোন ধরেই বলে।
“আরে আমার এখানে ফোনের নেটওয়ার্ক খুব খারাপ।বলেইছিলাম তো অয়নের ফোনে কল করতে।….”,মানি বিরক্তির সুরে বলে।
“করেছিলাম রে।ওর ফোন ব্যস্ত ছিল”,মদন ঘোষ মেয়েকে বাধা দিয়ে বলে।
থমকে যায় মানিনী।তার মানে যখন নিজের মাকে ফোন করছিল তখন করেছিল বাবা,সেই সময় খেয়াল না করলেও কেটে তো মিসড কল দেখতে পাবে।তাহলে ওকে বললো না কেন?
“শোন না মানি তোরা আজ কোনো ভাবে বেরিয়ে পড়তে পারবি না? তাহলে কাল সারাদিন সময় পেতিস।কাল বেরোলে তো পৌঁছে খুব সমস্যায় পড়বি রে”,মেয়ের মনের ভাবনা না জেনে বাবাও একই কথা বলে।
“আমিও সেটাই বলেছিলাম বাবা অয়নকে।কিন্তু ও যে টা বলছে সেটাও ঠিক।এই পাহাড়ি অচেনা রাস্তায় রাতে গাড়ি করে যাওয়া ঠিক হবেনা।সেরকম হলে কাল এখান থেকে বেরোনোর সময় কিছু রসদ কিনে নেব।তুমি চিন্তা কোরোনা”,বাবা কে যা’ই বলুক মনে মনে অয়নের ওপর একটু বিরক্তই হতে থাকে ও। নিজের মাকে নিয়ে ও যেমন চিন্তায়,মানিনীরও তো নিজের বাবাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। সেদিন অয়নের মা চেয়েছিল ওরা থেকে যাক আরও কিছুদিন,যদি লকডাউন হয়। কিন্তু সেটা কী আদৌ সম্ভব ছিল? হ্যাঁ সেদিন মানিনী মানেনি সত্যি লকডাউন এদেশে হতে পারে।কিন্তু লকডাউন হলেও ওকে তো বেশি করে অফিসের কাছাকাছি থাকতে হবে।ওদের তো ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সুবিধে নেই।কী সিদ্ধান্ত নেবে সরকার সেই মত ওদের চলতে হবে।সেদিন রাতে দেরিতে হলেও অয়ন বুঝেছিলো ওর সমস্যাটা।কিন্তু যেহেতু মা চেয়েছে,মা মুখ ফুটে কিছু বলেনা,মনের মধ্যে ওর খচখচানি রয়েই গিয়েছিল।মানি বুঝেও পাত্তা দেয়নি।কারণ ওর পাত্তা দেওয়া সম্ভব ছিলোনা।
বিয়ের পর সত্যি সম্পর্কে অনেক পরিবর্তন আসে।এক্সপেক্টেশন বেড়ে যায়।সেই এক্সপেক্টেশন শুধু নিজের না,অন্যের জন্যেও।অয়নের মায়ের লড়াই মানিনী জানে,শ্রদ্ধাও করে,কিন্তু অহেতুক দখলদারী ওর পছন্দ না।হয়তো ও শুধু বাবার কাছে স্বাধীন ভাবে মানুষ হয়েছে বা শেষ এক বছর একা থাকছে স্বাধীন ভাবে তাই ওর এই মানসিকতা।কিন্তু ওর খারাপ লাগাটা ও উপেক্ষা করতে পারেনা কিছুতেই।আর বিয়ের পর কেন কে জানে অয়নকে কিছুটা হলেও আলাদা লাগে।ফলে ওর মনে কিছুটা হলেও তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
মানিনীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ওর নিজের ভাবনা গুলো সঠিক মনে হয়।ওর মনে শাশুড়িমা দের নিয়ে একটা ধারণা তৈরি আছে,যা তৈরি হয়েছিল ওর নিজের ঠাকুমাকে দেখে।আর পরবর্তী কালে উৎসবের মায়ের গুরুত্বও কম ছিলোনা এই ধারণা ওর মনে বদ্ধমূল করতে।কিন্তু অয়নের পুরোনো কথাগুলো মনে থাকলে হয়তো এতোটাও ভুল ধারণা প্রথম থেকে তৈরি হতনা।অয়নের সাথে পরিচয়ের প্রথমদিন রাজধানীর কামরায় অপরিচিত ছেলেটার মুখে তার মায়ের কথা শুনে মনে একটা শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছিল,কিন্তু সেই যখন শাশুড়িমা হলো মানিনীর মনের পুরোনো ধারণাটাই রয়ে গেল,যা চাপা দিয়ে দিল অয়নের মায়ের প্রতি পুরোনো শ্রদ্ধাকে।বিয়ের আগের রীতিনীতির আদান প্রদানেও শাশুড়িমাকে জিতিয়ে দিলো অয়নের মা,কিছু আচার মানিনীর ওপর আরোপ করে।সরকারী চাকুরি মানিনী রীতি পালন করেছিল,কিন্তু চাপ পড়েছিল প্রাত্যহিক রুটিনে।মানিনী মাঙ্গলিক হওয়ায় অয়নের মায়ের কথা মত কিছু নিয়ম মানতে হয়েছিল বিয়ের আগে।সব মিলিয়ে মনের গভীরে কোথাও একটা মন খারাপ তৈরি হয়েছিল,সেটাই বিয়ের একমাসের মধ্যে তৈরি করেছে ছোট একটা ক্ষোভ।
সংসার এরকমই একটা গোলকধাঁধা যেখানে মানুষ নিজের নিজের ভাবনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।এই গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেলে জীবন জটিল হয়ে পড়ে।মানিনী অয়নের ক্ষেত্রে এটা আরও জটিল হয় বিশ্বব্যাপী মারণঘাতী রোগের দাপটে।সমস্ত মানুষের মত ওদের জীবনেও জটিলতা গুলো বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

ক্রমশ..

You may also like

1 comment

Anonymous July 25, 2024 - 12:07 AM

khoob bhalo lagche

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!