“মানি সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো মা।বললাম অত দূরে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে না।কিছুতেই শুনলি না।এখন একা একা অতদুরে যাবি,কীকরে কী করবি…”,বাবার কথা শেষ হতে দেয়না মানিনী।হাসতে হাসতে বলে,”বাবা আমি চাকরি করবো যখন অতদূরে গিয়ে তখন কী করবে? আর তাছাড়া সরকারি চাকরি বাবা,এই মেডিকেল টেস্টটা কোনো ব্যাপার না,বিশেষ করে আমার মত সুস্থ সবল একটা মেয়ের জন্যে।এত সহজে সুযোগটা ছেড়ে দেব?”
মুখে কিছু না বললেও বাবার মাথা নাড়া দেখে মানি বুঝতে পারছিল মা মরা মেয়েকে প্রবাসে চাকরি করতে পাঠানোর একটুও ইচ্ছা নেই তার বাবার,সে যতই সরকারি চাকরি হোক।মুখে কিছু না বলে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিল ও।ওকে যে চেষ্টা একটা করতেই হবে।চাকরিটা যে বড্ড দরকার ওর।দরকার উৎসবের জন্যে,ওর বেকার প্রেমিক।বড্ড ভালোবাসে মানি উৎসব কে।
উৎসব একজন কলমচি।কলেজে পড়ার সময় থেকেই ম্যাগাজিনে লিখে কিছুটা পরিচিতি পেয়েছিল ও চেনাজানা গণ্ডিতে।আর পরিচিতি পেয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়।আর সেই পরিচিতি ওকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার।কলেজ ছাড়ার পর চার বছর হতে চললো উৎসব সেই স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করে চলেছে।ওর সোশ্যাল মিডিয়ায় গুণমুগ্ধ ভক্তের সংখ্যা বাড়লেও সাহিত্য ওকে পেশার সন্ধান দিতে পারেনি এখনো।অল্প স্বল্প পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প ওর আর্থিক স্বচ্ছন্দ তৈরি করা দূর,নিজের হাত খরচ জোগাড় করে দিতে অবধি পারেনা।
মানি অনেক বুঝিয়েছে, বলেছে,”লেখাটাকে পেশা না করে শখে রাখো তুমি।আর কতদিন এভাবে অপেক্ষা করবো আমি।তুমি জানো এই রাস্তাটা মোটেও সহজ না।একটা চাকরি করে পাশাপাশি শখটা ধরে রাখো।নাহলে তোমার অপেক্ষায় আমার জীবন কেটে যাবে”।
কিন্তু উৎসব নিজের জেদ ছাড়েনি।ওর গল্প লেখার হাত সত্যি ভালো,কিন্তু মানি ওকে বোঝাতে পারেনি আজকালকার দিনে শুধু ভালো লেখায় কিছু হয়না।তার সাথে দরকার হয় আর অনেক কিছুর,নিদেন পক্ষে একটা ভালো ভাগ্যের।
মানি উৎসবকে বোঝানোর সাথে নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে গেছে। উৎসবের স্বপ্ন পূরণ করতে গেলে ওকে উৎসবের দায়িত্ব গুলো পালন করতে হবে এই সত্যিটা ওকে আলাদা করে কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয়নি।
শুধু মানির মনে একটা খুঁতখুঁতে চিন্তা আছে,সেটা উৎসবকে নিয়ে,উৎসব জানেনা মানি এভাবে চিন্তা করে এতটা পথ এগিয়ে গেছে।এমনকি উৎসবকে লুকিয়েই মানি দিল্লি যাচ্ছে ওর চাকরির পরীক্ষার শেষ ধাপ সম্পূর্ণ করতে।
ওর রাস্তাও যথেষ্ট এবড়ো খেবড়ো ছিল।তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে,বন্ধুদের থেকে নোট জোগাড় করে বইয়ের দোকানির মেয়ে মানিনী এই জায়গায় এসে পৌঁছতে পেরেছে।
“খাবি আয় মা।আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পর।কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে।ট্রেন যতই বিকেলে হোক,বেরোনোর প্রস্তুতি কম থাকেনা”,নিজের বাবা মদন ঘোষের কথায় সম্বিত ফেরে মানিনীর।”তুমি চলো, আমি আসছি”,বলে বাবাকে পাঠিয়ে নিজের টুকটাক প্যাকিংয়ের শেষে ট্রলিটা চেন আটকে উঠে পড়ে ও।
যাওয়ার টিকিটটা বাবার পীড়াপীড়িতে রাজধানী এক্সপ্রেসেই কেটেছে ও।ওখানে ওর পিসির দেওরের পরিবার আছে,তাই কদিন থাকার অসুবিধা হবে না।পিসির বাড়িতে ছোট থেকেই গিয়ে থাকতো,তাই দীপক কাকু আর ওর স্ত্রী শোভনা কাকিমা ওকে ভালো করেই চেনে।
টুকটাক চিন্তার মাঝে রাতের খাওয়ার শেষ করে যখন নিজের ঘরে এসে ঢুকলো,ঘড়িতে প্রায় সাড়ে দশটা বাজে।কদিন উৎসবকে এড়িয়ে থাকতে হবে,যখন খুশি ফোনে কথা বলতে পারবে না…সব দিক ভেবে ও একটা মিথ্যে গল্পের সাহায্য নিয়েছে।ওর চাকরিটা পেলে উৎসবকে চমকে দেবে সেই উদ্দেশ্যেই এই প্ল্যান।
উৎসবের নম্বরে রিং করে মানিনী।
“বলো ,আজ এত তাড়াতাড়ি ফোন করলে?” ফোন ধরে ব্যস্ত গলায় বলে ও,কিছুটা বিরক্তিও যেন প্রকাশ পায়।
এই সময়টা ওর লেখালিখির সময়।লেখা শেষ করে শুতে যাওয়ার সময় রাত একটা নাগাদ মানিকে ফোন করে ও।
মানি ঘুমিয়ে পড়লে ঘুম ভেঙে উঠে কথা বলে,নাহলে উৎসবের রাগ হয়।সারাদিনের পর এইটুকুই তো সময় পায় মানিকে নিজের কথা বলার।সে ওর যতই সকালে উঠে টিউশন পড়ানো থাকুক না কেন,উৎসবের ফোনের সাড়া ওকে রাতে দিতেই হয়।এটাই প্রথম থেকে চলে আসছে।
“না একটা খবর দেওয়ার ছিল।কাল কদিনের জন্যে পিসির বাড়ি যাচ্ছি।কদিন যখন খুশি ফোন ধরতে পারবো না।রাতেও হয়তো ফোন করতে পারবো না”,একটানা কথাগুলো বলে থামে মানিনী।
“হঠাৎ?” গলায় বিরক্তি টা একটু বাড়লেও,তার সাথে মনোযোগটাও একটু বেড়েছে উৎসবের গলায় বুঝতে পারে মানি।
“হঠাৎ না।পিসি অনেকদিন ধরে বলছিল,তাই কদিনের জন্যে ঘুরে আসতে বললো বাবা।আমিও আর না করলাম না”,মানি মিথ্যেগুলো নির্দ্বিধায় বলেই দেয়।দরকারে মিথ্যে বলা নিয়ে ওর ছুৎমার্গ বিশেষ নেই।
“তাহলে আর কী? যাও নাচতে নাচতে ঘুরে এসো।তোমার আর কী কাজ! সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রিপারেশন নেওয়ার এই তো সুবিধা।এই দোহাই দিয়ে কয়েক বছর কেটে যাবে।তারপর ভাগ্যের দোহাই দিয়ে একটা ছেলের গলায় ঝুলে পড়বে।স্ট্রাগল করার দরকার হয়না”,উৎসবের এই ধরণের কথাগুলো শুনে শুনে মানির গা সওয়া হয়ে গেছে।ও ভাবে যেদিন ও চাকরি পাওয়ার কথা জানাবে,উৎসবের এই ধারণা ঠিক বদলে যাবে।আর পুরোনো কথা ভেবে বিবেক দংশনে ঠিক মানির কাছে লজ্জা প্রকাশ করবে ও।
উৎসব ছেলেটা এমনি খারাপ না।আগে এতোটাও কাঠখোট্টা ছিলোনা।এই কবছরের লড়াই আর বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে ইদানীং একটু বেশি খিটখিটে হয়ে গেছে।তবে ও ঠিক ঠোঁটকাটা না,শুধু মানিনীকেই এই ধরণের কথা বলে।
আরো কিছুক্ষন উৎসবের ঠেস দেওয়া কথা শোনার পর যখন মানি ফোন কাটে ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা বাজতে চলেছে।
মাথায় হাজারো চিন্তা নিয়ে বিছানায় গিয়ে সহজে ঘুম এলোনা মানির।জীবনে প্রথমবার শহরের বাইরে এক অজানা শহরে যাচ্ছে,তাও একা।উৎসবকে সঙ্গে যাওয়ার কথা বলা দূর,ওকে সত্যিটা অবধি জানাতে পারলো না। ছেলেটাকে ও চেনে পাঁচবছরের বেশি।সম্পর্কের বয়সই তো নয়-নয় করে পাঁচ বছর হয়ে গেল।কলেজে এক বছরের সিনিয়র উৎসব যখন ওকে প্রপোজ করে সে যেন অন্য এক ছেলে ছিল। আজকাল উৎসব মানিনীর মনে একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি করলেও ওকে ছাড়ার কথা ও এখনও কোনোভাবেই ভাবতে পারেনা।
ওর লেখা মানিনীর নিজেরও খুব ভালো লাগে,কিন্তু ও বোঝে শুধু ভালো লেখা আজকের দিনে যথেষ্ট না।কারণ ভালো লেখে অনেকেই,সবাই কি প্রতিষ্ঠা পায়?সময়,পয়সা আর নাহলে এক্সফ্যাক্টর এগুলো ছাড়া এপথে প্রতিষ্ঠা পাওয়া চাপ,এতদিনে বুঝে গেছে ও।শুধু এই এক্সফ্যাক্টরটাই ধোঁয়াশা ওর কাছে।
রাজধানীর থ্রী টায়ারে একটা সাইড লোয়ার বার্থে গুছিয়ে বসেছে মানি,ট্রেন ছাড়তে আর মিনিট পাঁচেক।বাবাকে মিনিট দশ আগেই প্রায় তাড়িয়ে ছেড়েছে ও।ওদের লাইনের একটা লোকাল ট্রেন রাজধানীর সাথে একই সময় ছাড়ে।ওটা না পেলে আবার এক ঘন্টা বাবাকে অপেক্ষা করতে হত।
সাইড আপার এখনো ফাঁকা,তাই ওর লোয়ার সিটের অন্যদিকটাও ফাঁকা,কেউ বসেনি।বসে বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে যাবে ট্রেনে বসার জায়গা পেল কিনা।ওর ফোনটা বাজতে শুরু করলো,আর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো উৎসবের নাম।চমকালো একটু মানিনী।’এই অসময়ে তো ও ফোন করেনা!!’
দোলাচলের মধ্যে রিসিভ বাটন টিপে ফোনটা কানে দেয়।মনে মনে ভাবে ফাঁকায় ফাঁকায় ফোনটা সেরে নেওয়াই ভালো।এখনো সহযাত্রীদের চেঁচামেচি অনেক কম।
“হ্যালো…”,মানিনী থমকে যায় উৎসবের চিৎকারে।বোঝার চেষ্টা করে কারণটা।
“তুমি আমায় মিথ্যে বলেছো? তুমি দিল্লি যাচ্ছো ট্যাক্স অ্যাসিস্ট্যান্ট পোস্টের মেডিকেল টেস্ট দিতে?” উৎসবের কাছে শেষ অবধি আর লুকিয়ে রাখতে পারেনা মানিনী আসল ঘটনাটা।ও কিছু বলতে যাবে কিন্তু সেই সুযোগটা পায়না।তার আগেই উৎসব আবার নিজের কথা বলতে শুরু করে দেয়।
ক্রমশ…
7 comments
গল্পটা আগেও পড়েছি।নতুন করে পড়তে ভীষণ ভালো লাগছে ❤️
thank you 🙂
সুন্দর লাগলো দিদি 😊
abaro lekhata pore valolaglo.
Ageo porechi abar porlam khub bhalo lekhoni bar bar mugdho hoi❤❤
Ageo porechi abar porlam asadharon lekhoni bar bar mugdho hoi
শুরু টা খুব ভালো লাগলো