“স্মিতা ক্যান য়্যূ প্লিজ এক্সপ্লেইন দ্য রিশনস? আই’ম ইন দিস প্রজেক্ট ফ্রম ভেরি ফার্স্ট ডে,দেন হোয়্যাই আর য়্যূ সিলেক্ট মি টু মেক দ্য ‘বাকরা’?…”,অয়ন ঠিক কী ভাষা ব্যবহার করবে বুঝতে পারেনা।
“সরি অয়ন…”,এরপর অয়নের কোম্পানির এইচআর তার মুখস্থ বুলিতে যা বলে তার সারমর্ম হলো পুরো বিশ্বে যে অবস্থা চলছে তার ফলে ওদের কোম্পানির অবস্থাও ভালো না। এই অবস্থায় প্রজেক্ট রাখাটা জরুরি,তাই ক্লায়েন্টের কথা মত খরচ কমাতে কিছুজনকে কোম্পানি পুরোপুরি বরখাস্ত করছে। শুধু অয়নের মত যারা কোম্পানির কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ তাদের আপাতত বেঞ্চে পাঠানো হচ্ছে,মানে চাকরি না গেলেও অয়নের প্রজেক্ট থাকছে না।
অয়ন এটা ভালো করে জানে বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন প্রজেক্ট পাওয়াও অত সহজ না। সেক্ষেত্রে দুমাস বেঞ্চে থাকার পর ওকেও কোম্পানি টাটা করতে পারে।
স্মিতার ফোন কেটে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও,আবার একটা লড়াই। প্রজেক্টের অপেক্ষায় না থেকে অন্য কোম্পানিতে চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আর তাতেও বিশেষ কোনো সুবিধা এই পরিস্থিতিতে হবে বলে মনে হয়না। এখন সব কোম্পানি যেখানে লোক কমাচ্ছে,সেখানে নতুন রিক্রুটমেন্ট এর সুযোগ বিশেষ আসছে না।
লাইটার আর সিগারেট নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় ও। বড্ড খারাপ সময় যাচ্ছে। মা সবে কাল বাড়ি ফিরেছে,আর আজকেই এরকম একটা খবর! মানিনীর সাথেও সম্পর্কের সুর কেটে গেছে। আজ দশদিন হলো মানি আলাদা ঘরে থাকছে। মায়ের অসুখের দিনে বলা কথাগুলো ও মানতে পারেনি। আর ও চিৎকার করে নিজের কথা কখনো বলে না,উল্টে চুপ করে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। যে টা বেশি চাপের।
কী ভেবে অনেকদিন পর মানিনীর বাবার নম্বরে গিয়ে কল করে অয়ন। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওর বাবা ফোনটা ধরে।
-“বলো বাবা অয়ন,কেমন আছো তোমরা?সব ঠিক আছে তো?” মানির বাবার গলায় উদ্বেগ স্পষ্ট শোনা যায়।
-“হ্যাঁ বাবা এখানে সব ঠিক আছে। কাজের চাপে আপনাকে ফোন করা হয়না।আজ একটু সময় পেয়ে তাই ফোন করলাম”।
-“ভালো করেছ বাবা। অনেকদিন তোমার গলা শুনিনি। আর চারিদিকে যা অবস্থা,কেউ আর অবসর সময় পাচ্ছে কোথায় বলো? আমি মানি কে রোজ জিজ্ঞেস করি তোমার কথা,কিন্তু ব্যস্ত আছো ভেবে ফোন করিনা।তারপর কাজকর্ম কেমন চলছে অয়ন?বেয়ান এখন সুস্থ?”
-“ওই চলছে বাবা।হ্যাঁ মা কাল বাড়ি ফিরেছে। আপনার তো দোকান বন্ধ আছে। কোনো দরকার হলে কিন্তু নির্দ্বিধায় বলবেন। জানবেন আমি আপনার ছেলের মত। সবসময় ফোন করে উঠতে পারিনা,কিন্তু চিন্তা থাকে।নিজের খেয়াল রাখবেন”।
-“হ্যাঁ বাবা।তুমিও ভালো থেকো”।
ফোন কেটে অয়ন দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মানিনী কদিন ভালো করে কথা অবধি বলেনি। ফলে ওর বাবা কেমন আছে এই পরিস্থিতিতে জানতে পারেনি অয়ন। নিজের মায়ের সাথে সাথে মানির বাবার চিন্তাও তো ওর হয়,সেটা ও মানি কেও বোঝাতে পারেনা।
ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে দেখে মানীনি কোনো দরকারে হয়তো ওদের বেডরুমে এসেছে।
কিছু বলতে যাবে অয়ন,তার আগে মানি ই বলে,”মা কেমন আছেন?”
হঠাৎ অয়নের পুরনো রাগ মাথা চাড়া দেয়।সহজ প্রশ্নের সোজা উত্তরের বদলে ঘুরিয়ে ও বলে,”কেন তোমার কাছে আমার মায়ের নম্বর নেই!”
অবাক মানি সরাসরি তাকায় অয়নের মুখের দিকে। কোনো চেনা অবয়ব পায়না খুঁজে,শুধু দেখে কঠিন মুখের অচেনা এক ছেলেকে।ও বুঝতে পারেনা ভুল কী বললো ও! আজকাল ওর কারোর সাথেই বিশেষ কথা বলতে ভালো লাগে না। নিজের বাবার খোঁজ নিতেও দিনে ফোন করে একবার,হয়তো সেই রাতের দিকে। অয়নের মা যতদিন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে ছিল রোজ সন্ধের দিকে ফোন করেছে,কিন্তু ফেরার পর করা হয়নি তার অনেক কারণ আছে। ওর অফিসে এবার ঝামেলা করছে। এখনও চারিদিকে ভয় কাটেনি,দোকান বাজার নিয়ম করে দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্যে খুলছে এর মধ্যে ওদের অফিস একটা মেইল করেছে যার বক্তব্য সপ্তাহে একবার এমপ্লয়ীদের একবার করে কয়েক ঘণ্টার জন্যে অফিস যেতে হবে। ওরা সবাই মিলে ঝামেলা করছে ঠিকই,কিন্তু কতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে কেউ জানেনা। মানি এসব কথা নিজের মধ্যেই রেখেছে,কারণ আজকাল ও নিজেকে বড্ড একা অনুভব করে। অয়নের ব্যবহারের সাথে আজকাল উৎসবের ব্যবহারের বড্ড মিল পায় ও। সেই কারণেই হয়তো ওর মায়ের মধ্যেও উৎসবের মায়ের রূপ খুঁজে পায়।
“আমি কাউকেই ফোন করিনা অয়ন,তুমি সেটা ভালোই জানো। কেন এক্সপেক্ট করো আমার কাছে এসব। তুমি কদিন আমার বাবার খোঁজ নাও যে বারবার আমায় ঠেস মারো…”,মানিনীর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে অয়ন,”খোঁজ নিই কিনা আগে নিজে সেটা খোঁজ নাও।আমার দায়িত্ব আমি জানি,তোমায় শেখাতে হবে না। কিন্তু তুমি অসুস্থ শাশুড়িকে ফোন করবে সেটাও আর পাঁচজনের সাথে তুলনা করো? আচ্ছা মানি,আমার মা কী কারণে তোমার এত অপছন্দের বলো তো? আমার মা’কে তো সবাই ভালোবাসে শুধু তুমি ছাড়া। সমস্যা কী বলতো,আমার মায়ের মত মানুষের সাথে যে মানাতে পারেনা,তার নিজেরই কোনো পার্সোনালীটি প্রবলেম আছে। সমস্যাটা তার নিজের,অন্য কারোর না। আর আমি এটা বুঝতেই দেরি করে ফেললাম”,এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো উগরে দিয়ে আর ওঘরে থাকেনা অয়ন। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
মানিনী চুপচাপ শুধু ওর বেরিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে। কিছু বলতে ওর ইচ্ছে করেনা।আজকাল নীরবতা কেই ও শ্রেষ্ট পন্থা মনে করে। অফিসের টুকটাক কাজ,সংসার সামলানো বাদ দিয়ে বাকিটা সময় ও আজকাল শুয়ে থাকে। কথা বলতে,টিভি দেখতে,গল্পের বই পড়তে বা ফোন করতেও ওর অনিচ্ছা আসে। দিনদিন যেন ওর চারিদিকটা বড্ড ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। চুপচাপ যখন শুয়ে থাকে বারবার ভাবে কেন বিয়েতে রাজি হলো ও!বেশ তো ভালো ছিলো একা একা।বিয়ের আগের অয়নের সাথে কাটানো ছমাস ওর কোনো এক স্বপ্ন মনেহয়। আজকাল ও এর পজিটিভ কিছু ভাবেনা।
এখনও অয়নের কথার উত্তরে ও হয়তো অনেককিছু বলতে পারতো, কিন্তু ইচ্ছে হলোনা।শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর ভেতর থেকে। কিছুক্ষন ও নিজেদের বেডে চুপ করে বসে রইলো।তারপর নিজের দরকারী জিনিসগুলো নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল বিয়ের পরের বেডরুম থেকে,গিয়ে ঢুকলো নিজের ঘরে। অয়নের জন্যে উদ্বিগ্ন না হয়ে ওর পুরোনো নিজের ঘরের দরজাটা লক করে দিলো।
মানির দরজা বন্ধের আওয়াজে ডাইনিং রুমে মুখ গুঁজে বসে থাকা অয়ন মুখ তুলে তাকালো,তারপর আস্তে আস্তে মুখটা নামিয়ে আবার দুহাতের আড়ালে ডুবিয়ে দিলো। ডিপ্রেশন গ্রাস করতে থাকলো অয়ন-মানিনীর জীবন, লকডাউনের খুব স্বাভাবিক এক ফল।
অয়ন বুঝতে পারছে ও ভুল করছে,কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন ওকে আটকাচ্ছে সমস্ত কিছু ঠিক করে নেওয়া থেকে। আসলে ও মানিনীকেও যেমন ভালোবাসে,নিজের মা’কেও ঠিক তেমন। ফলে ওর মায়ের প্রতি মানিনীর উদাসীনতা ও মানতে পারছে না।
ও ভেবেছিল মানির মা নেই,তাই মানি ওর মা’কে খুব সহজেই আপন করে নেবে। কিন্তু কোনো কারণে সেই সম্পর্কটা তোলা তোলা রয়ে যায়। আর অয়ন মনে মনে সেই কারণে দায়ী করে মানি কে।
সম্পর্কের আসলে কোন নির্দিষ্ট কোনো সমীকরণ হয়না। তাই কোন সম্পর্ক কেমন হবে কারোর পক্ষেই তা নির্দিষ্ট করা সম্ভব না। অয়নের মা কিছু ব্যাপারে গোঁয়ার, সেটা মানি অনুভব করলেও অয়ন সেটা বোঝেনা। তার ফলে স্বাধীনচেতা আধুনিকমনস্ক মানিনীর পক্ষে সমস্যা বাড়ে। আবার মানিনী নিজের মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা পুরোনো ধারণা থেকে সহজেই বিচার করে অয়নের মা’কে,অন্যভাবে অনেক ক্ষেত্রে ভাবা গেলেও ভেবে দেখেনা। ফলত মানি নিজের ভুলটা বুঝতে না পেরে অয়নের বিরাগভাজন হয়।
অয়নের মা নিজেও প্রচন্ড আত্মসম্মানী কিন্তু ছোট থেকে একা হাতে মানুষ করা ছেলের ক্ষেত্রে একটু পজেসিভও বটে। সেই আত্মসম্মান তাকে বাধা দিয়েছিল মানিনীকে দরকার ছাড়া অকারণ ফোন করতে,সেই আত্মসম্মান তাকে বাধা দেয় মানিনীকে যেচে আপন করতে। মানিনীর বয়স,ওর চাকরী, ওর চরিত্র অয়নের মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
কিন্তু অয়নের এক তরফা মানিনীকে দোষারোপ ওদের সম্পর্ককে দুর্বল করতে থাকে।
মানিনী আগের অয়নকে যেভাবে পেয়েছিল,এই অয়নকে তার সাথে মেলাতে পারেনা। সেই অয়ন ওকে আগলে রাখতো,ওর ভুল গুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত, ওর জন্যে সারাক্ষন চিন্তা করতো, সর্বোপরি ওকে খুশি রাখার চেষ্টা করতো সবসময়। ও জানে অয়নের মা ওর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ও নিজেও যে যথেষ্ট মূল্যবান অয়নের কাছে এটাই ছিল ওর বিশ্বাস।যদিও সেই বিশ্বাসে ভুল কিছুই ছিলোনা,কিন্তু অহেতুক ভুল বোঝাবুঝি সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে। আর মানিনী তাই বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে আরও একবার নতুন করে কাউকে ভালোবেসে বিশ্বাস করার জন্যে।
ক্রমশ..