আরও একবার – সপ্তম পর্ব

by Tamali

মান্ডি হাউস মেট্রো স্টেশনে দুটো মেট্রো পরপর ছেড়ে দিলো মানিনী।অফিস টাইমে বড্ড ভিড়, এখনো এত ভিড়ে ওঠার অভ্যেস হয়নি।এখানে এসে মেট্রো বদলাতে হয়।একটা স্টেশনের জন্যে শুধু আর একটা মেট্রো চাপা,যদিও ওই রুটটা ফাঁকা থাকে।ও শুনেছে ভিড় হয় এই রাজীব চক থেকে আসা মেট্রো গুলোতে,আজ নিজের চোখেই দেখছে।মান্ডি হাউস মেট্রো স্টেশনে একটু বসে ও,অপেক্ষাকৃত ফাঁকা মেট্রোর অপেক্ষায়। তাছাড়া পিজিতে আগে পৌঁছেই বা কী লাভ! যাবে আর খেয়ে নিজের খাটে শোবে।বাবাকে ফোন করলেও খুব বেশি হলে দশ মিনিট ব্যস্ত থাকবে ফোনে,তারপর ঘুম না আসা অবধি চলবে আকাশ পাতাল চিন্তা।আজকাল বই পড়তেও ভালো লাগেনা ওর।তার চেয়ে এই ভালো।বিকেলে অফিস ক্যান্টিনে চাউমিন খেয়েছিল পেট তাই এখনও ভার আছে।বসে বসে এই ব্যস্ত মেট্রো স্টেশনে লোক দেখলে তাও চিন্তারা ভিড় করেনা।
না,তিন নম্বর মেট্রো মুখ বাড়িয়েছে।এটাতে উঠতেই হবে ওকে।নাহলে ময়ূরভিহার স্টেশনে নেমে রিক্সা পাবেনা এই ঠান্ডায়।উঠে দাঁড়ায় মানি যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্যে।চলন্ত মেট্রোর দিকে তাকিয়ে প্রস্তুত হয় মেয়েদের কামরার জন্যে।মেট্রোটা থমকে দাঁড়ানোর মুহূর্ত আগে,মহিলা কামরার ঠিক আগের কামরার একটা জানালায়, ক্ষনিকের জন্য যেন পরিচিত মুখের আদলে চোখ ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়।ভালো করে বোঝার আগেই ওর কামরার দরজা খুলে যায় মুখের সামনে।আর পিছনের ভিড় ঠেলে ওকে ঢুকিয়ে দেয় কামরার মধ্যে।কয়েক সেকেন্ডের চিন্তা মুছে যায় মুহূর্তে, মানিনী এগোতে চায় বন্ধ দরজার মুখোমুখি হতে।এবার আবার নামার লড়াই।জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত যেন লড়াইয়ের সামনে ফেলে দেয়।

ময়ূরভিহার এক্সটেনশনে নেমে পড়ে অয়ন।কিছুতেই ভুল দেখতে পারেনা ওর চোখ।ওই মুখটা আজ তিনমাস কিছুতেই মনের গুহা থেকে বেরই হচ্ছে না।কী করে ভুল করবে ও ওই হাসি,ওই চোখ দুটো।মান্ডি হাউস স্টেশনে নজরে আসতেই হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তে।সৌরভের সাথে কথা বলতে বলতে জানলার বাইরে চোখ পড়তেই কথা আটকে গিয়েছিল।সৌরভ অনেক জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পায়নি,উল্টে এখন এই মাঝরাস্তায় নামার জন্যে যথেষ্ট বিরক্ত।
“কী ব্যাপার কি তোর?হঠাৎ এরকম মাঝরাস্তায় নেমে পড়লি হুট করে?এই ঠান্ডার মধ্যে কী দাবি কী তোর ভাই?” সৌরভকে যথেষ্ট আপসেট লাগে।
একে আজ অয়নের মুড ঠিক করতে অফিস ডুব মেরে সিপি(কনট প্লেস-রাজীব চক) ঘুরতে গেল।যদিও বা তাতে মহারাজের মুড ঠিক হলো,কিন্তু ফেরার পথে এ আবার কী ভূত যে মাথায় চাপলো!!
“কিরে কিছু বলবি?”অধৈর্য্য সৌরভ অয়নের অদ্ভুত ব্যবহারের কোনো মানে খুঁজে পায়না।
“আচ্ছা সৌরভ লেডিস কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে কাউকে যেতে গেলে তো আমাদের সামনে দিয়েই যেতে হত বল?” হিসেবে কোথায় ভুল হলো বুঝতে পারেনা অয়ন।
মানিনী তো ওকে ট্রেনে বলেছিল ওর আঙ্কেল ময়ূরভিহার এক্সটেনশনে থাকেন।তাহলে এই রুটের মেট্রোতে উঠলে ওর এখানেই নামার কথা।আর অয়ন একদম দরজার সামনে ছিল,নেমেছে দরজা খুলতেই।তাহলে মানি গেল কোথায়!
মেয়েটা শিওর গভর্নমেন্ট জব জয়েন করেছে।তাহলে দিল্লি থেকেও ওকে একবার ফোন করলো না কেন? জানতে হবে অয়নকে।কেন ওর সাথে আর যোগাযোগ করলো না মানিনী?
আজ তিনমাস খুঁজেও সোশ্যাল মিডিয়ায় পায়নি ওকে অয়ন।ও নিজেও জানেনা কেন খুঁজছে ও মানিনী কে! ও শুধু জানে ওকে একবার কোনো না কোনো ভাবে মানির সাথে কথা বলতেই হবে।কী বলবে সেটা অবশ্য জানেনা।
মিনিট পাঁচ খুঁজে মানিনীর দেখা না পেয়ে আবার হতাশায় মন ভরে যায়।কিছুক্ষনের জন্যে ভালো হওয়া মনটা আবার বিষন্ন হতে থাকে।
লক্ষ করে সৌরভ অয়নের মুখের ভাবের পরিবর্তন।
জোর করে অয়নকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে ও।
“এই ছেলেটা তোর কী হয়েছে প্লিজ বলবি?গত কয়েকমাস এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখছি তোর মধ্যে।কোথায় গেল সেই হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল ছেলেটা, যাকে কখনো হতাশ হতে দেখিনি শেষ দুবছর।কী হয়েছে প্লিজ আমায় খুলে বল”,সৌরভের গলায় কিছু একটা ছিল যা অয়নকে সামলে রাখতে দেয়না ওর বোকা বোকা দুর্বলতা কে।
করুন ভাবে তাকায় অয়ন সৌরভের দিকে,”আমি একজনকে পাগলের মত খুঁজছি,কিন্তু কোথাও পাচ্ছিনা।আজ মেট্রো থেকে মান্ডি হাউস স্টেশনে দেখলাম,শিওর ও এই স্টেশনে নামবে কিন্তু নামেনি।একটুর জন্যে মিস করে গেলাম তাকে”,অয়নের গলায় আবেগ জড়ায়।
অবাক সৌরভ কিছুক্ষন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে।তারপর নিজের হাতটা অয়নের দুটো হাতের মুঠোর ওপর রেখে বলে,”কে সে?কোনো মেয়ে?চিনি আমি তাকে?”
মুখ নামিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে অয়ন।তারপর বলেই ফেলে মানিনির গল্প।
গল্প শেষে সৌরভ একটা কথাই শুধু বলতে পারে,”মেয়েটা কী অপরূপ সুন্দরী?”
এবার অয়ন অবাক চোখে তাকায় সৌরভের দিকে।সৌরভের চোখের প্রশ্নটা পড়ে নিতে পারে ও অনায়াসেই।
“হমম খুব সুন্দর নরম মন আছে মেয়েটার,কিন্তু তার সাথে আছে ‘সেলফরেসপেক্ট’।মেয়ে মানেই বয়ফ্রেন্ডের চাকরির জন্য অপেক্ষা আর তাগাদা না,বয়ফ্রেন্ডের শক্তি হতে চাওয়া একটা মেয়ে।নিজের বয়ফ্রেন্ডের স্বপ্ন পূরণ করতে নিজে চাকরি করে পাশে থাকতে চেয়েছিল তার।কিন্তু বোকা আত্মঅহংকারী ছেলেটা সেটা সম্ভবত বোঝেনি।আর এই ব্যতিক্রমী মেয়েটাকে তাই ভালো লেগেছিল আমার।ফোন নম্বর দিয়ে ভেবেছিলাম একবার অন্তত ফোন করবে।তাও করেনি।কেন,কেন করবে না আমায় ফোন? সেদিন ট্রেনে অতো গল্প,অতো নির্ভরতা সব মিথ্যে? একবার তো ফোন করে চাকরির খবরটা অন্তত দিতে পারতো? এইটুকু কি আমি আশা করতে পারিনা?” অয়নের মন বেরিয়ে পড়ে সৌরভের সামনে।নিজেকে আর আড়াল করতে পারেনা ছেলেটা।
কিন্তু সৌরভ বুঝতে পারেনা একরাতের আলাপে কেন অয়ন এতটা উতলা!এরকম আলাপ তো জীবনে কত হয়,রাস্তার আলাপ রাস্তাতেই শেষ হয়ে যায়,এমনকি ফোন নম্বর আদান প্রদানের পরও কোনো এক্সপেক্টেশন থাকেনা।সিম্পলি হারিয়ে যায় সেই আলাপগুলো।
“হয়তো মেয়েটা তোর নম্বরটা হারিয়ে ফেলেছে?আর সেটাই স্বাভাবিক।এমনিও আজকের দিনে কে কাগজে লিখে নম্বর দেয় বল!যাইহোক এরকম রাস্তার আলাপ নিয়ে তুই বোধহয় বড্ড বেশি আশা করে ফেলছিস।এখন চ ফিরি।নাহলে বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে আর ট্রান্সপোর্ট পাবনা।এমনি বাইক না নিয়ে বেরিয়ে ভুলই হলো”,সৌরভের স্বরে একটু বিরক্তি প্রকাশ পেয়েই যায়।
এই ছেলেকে কঠিন ভাবে না বললে হবে না।কোথাকার কে মেয়ে,কেমন মেয়ে ঠিক নেই,যত্তসব হাওয়ায় ঢিল ছোঁড়া।
একে তো পুরোনো প্রেম ভেঙে গেল,আবার এসব ছেলেমানুষি কাজ করে কষ্ট পাবে।
আড়চোখে অয়নের মুখটা দেখে খারাপ লাগলেও উঠে পড়ে ও বেঞ্চ ছেড়ে।
“চ মেট্রো আসছে।রাত হয়েছে,ঠান্ডা বাড়ছে।গিয়ে আবার খাবার অর্ডার করতে হবে,মাসি আসেনি।চ চ”,ওদের দুজনের ফ্ল্যাট নয়ডার এক সোসাইটি তে।রান্নার মাসি সকালে এসে দুবেলার রেঁধে রেখে যায়।আজ সেও আসেনি।
অয়ন তাকায় সৌরভের দিকে।দূরে তাকিয়ে থাকা ছেলেটা ভুল কিছু বলেনি।সত্যি তো কার কাছে আশা করছে ও?চেনে কতটুকু তাকে? হয়তো সব ঝামেলা মিটে গেছে ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে।কেন মনে রাখবে ও রাস্তায় আলাপ ছেলেটা কে?
উঠে পড়ে অয়নও,গিয়ে দাঁড়ায় সৌরভের পাশে।

ক্রমশ..

You may also like

1 comment

Anaya Chatterjee July 6, 2024 - 9:14 AM

দারুন

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!