‘উফফ তখন থেকে ছেলেটা দেখেই যাচ্ছে ক্যাবলার মতো,যেন কোনোদিনও মেয়ে দেখেনি।সবচেয়ে বড় কথা ছেলে ছোকরা নয়,রীতিমতো ভদ্র …এভাবে তাকানোর বয়সও আর নেই।একা মেয়ে দূরপাল্লার ট্রেনে যাচ্ছে দেখলেই যেন সব ভুলে তাকে হাঁ করে দেখার পুরো অধিকার আছে।আর কিছুক্ষন দেখি নাহলে গিয়ে সবার সামনে অপমান করে আসবো।’নিজের মনেই গজগজ করতে থাকে মিমি।দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরছে পুজোয়,দিল্লি হাওড়া রাজধানী তে।ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই দেখছে একটা গোলুপোলু নাড়ুগোপাল মার্কা ছেলে ওকে নজর করেই যাচ্ছে।মিমি মানে রাজনন্দিনী সেন দুবার সরাসরি ওর দিকে রাগি চোখে তাকিয়েও ছিল,তাতে সাময়িক চোখ সরিয়ে নিলেও কিছুক্ষন পর যে কে সেই।অন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখেছে এতে কাজ হয়।লজ্জায় অনেকে পিছু হটে, আর তাকায় না।কিন্তু এ ছেলে তো আচ্ছা বেয়াদপ আর নির্লজ্জ,এমন মুখ করে আছে যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা।অথচ পেটে পেটে দুস্টু বুদ্ধি।একে তো মিমির মাথা গরম,দিল্লিতে চাকরিটা পেয়েছে সবে এক বছর,এর মধ্যে মা দিল্লীতেও ওর জন্যে ছেলে জোগাড় করে ফেলেছে।যে বিয়ের ভয়ে ও কলকাতা ছেড়ে দিল্লি এলো,মা কে শর্ত দিলো যে বিয়ের জন্য ও নিজের চাকরি বা এই শহর ছাড়তে পারবেনা,সেই বিয়েই ওর পিছু ছাড়ছেনা।মা ঠিক এদিক ওদিক করে দিল্লিতে চাকরি করা ছেলে জুটিয়ে ফেলেছে,বলিহারি সত্যি ভদ্রমহিলাকে,পারেও।মিমিও কম যায়না,সাফ জানিয়ে দিয়েছে ছেলের সাথে একা দেখা করবে,ইন্টারভিউ নেবে তবে নিজের মতামত জানাবে।যদিও ও নিজে মনে মনে জানে দেখা করেই রিজেক্ট মেরে দেবে,ওর পক্ষে কোনো ভাবেই এই মুহূর্তে বিয়ে করা সম্ভব না।কারণ প্রথমত ওর কেরিয়ার আর দ্বিতীয় কারণ অব্যশই আর একটা আছে…কিছুদিন হলো ওর মন প্রাণ জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে ওম,ওমপ্রকাশ শর্মা,ওর টিম লিডার।চেহারার দিক দিয়ে এক কথায় বললে,’লেডি কিলার’।পুরো টিমে মিমিকে নিয়ে মোট ৩জন মেয়ে থাকলেও ওম ওকে যে একটু বিশেষ গুরুত্ব দেয় সেটা মিমি বোঝে।যদিও অফিসের বাইরেই এখনো কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কিন্তু এক দুদিন অফিসে দেরি হয়ে যাওয়ায় ওকে পিজিতে ড্রপ করে দিয়ে গেছে।তাছাড়া ওর এখনো চাকরিটাতে ‘পার্মানেন্ট এমপ্লয়ী’ ছাপ পড়েনি…আই.টি তে অন্যদের ১৫দিনের দীর্ঘ ছুটি পেতে যেখানে কাল ঘাম ছুটে যায় ও এক কথায় সেই ছুটি পেয়ে গেছে।ওম এমনিতে কম কথা বললেও মিমির সাথে কথা বলতে অনেকটাই সহজ।যা অশান্তি হয় হবেই মিমি কে ওর বিয়েটা ক্যানসেল করতেই হবে,তাতে মা বাবা ওকে আপাতত ‘ত্যাজ্য কন্যা’ করলেও কুছ পরোয়া নেই।
রাজধানী প্রায় আধ ঘন্টা দেরিতে যখন হাওড়া স্টেশন ঢুকলো তখনও মিমির বাবা অলোকবাবু স্টেশনে এসে পৌঁছাতে পারেননি।মিমি অনেকবার বারণ করেছিল বাবাকে আসতে, কিন্তু একমাত্র মেয়ে এতদিন পর বাড়ি ফিরছে তাই অলোক বাবু মিমির কথা শোনেননি,কিন্তু এম.জি রোডের জ্যাম অলোক বাবুকে আটকেই দেয়।
ট্রেন থেকে নেমে বিরক্ত মুখে মিমি এদিক ওদিক দেখে,তারপর এগিয়ে যায় স্টেশন থেকে বেরোবার মুখের দিকে।হঠাৎ একটা অচেনা গলা ওর নাম ধরে ডাকায় খুব বেশি চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।”মিস সেন শুনছেন?!!!”আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে গিয়ে চমকে গেল মিমি।আরে সেই গোপাল গণেশ যে,কিন্তু ওর হাতে ওটা কি?আরে মিমির হেডফোনটা।ওহ,তাড়াতাড়ি করে নামতে গিয়ে ট্রেনে ভুলে এসেছিল।কিন্তু ওই ছেলেটা ওর নাম জানলো কিকরে?এগিয়ে যায় গাবলুর দিকে।হেডফোনটা ওর থেকে নিয়ে অনিচ্ছাকৃত মৃদু ভাবে বলে,”থ্যাংক্স।”তারপর কিছুক্ষন থেমে কৌতুহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলে,”আপনি আমার নাম জানলেন কিকরে?”মিমির কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে গাবলু বলে ওঠে,”ওই যে লিস্ট…রিজার্ভেশন লিস্ট…ওখানেই দেখেছিলাম।”যথেষ্ট স্মার্টলি উত্তর দেয় ছেলেটা,কিন্তু মিমির কেমন যেন মনেহয় প্রশ্নটা ছেলেটার কাছে কমন ছিল,আর তাই উত্তর ঠোঁটস্থ ছিল।মিমি একটু অবাক ভাবে তাকিয়ে “ও আচ্ছা” বলে উল্টো মুখ করে আবার বেরোবার গেটের রাস্তা ধরে,সৌজন্য বেশি হয়ে যাবে ভেবে আর বেশি কথাতেও যায়না।
ষষ্ঠীর দিন ঠিক হয় সেই মায়ের পছন্দের ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের।মিমি চেয়েছিল একা বাইরে দেখা করতে তাতে কাটানো সহজ হয়,কিন্তু মিমির মা শুনলেন না।তিনি হাড়ে হাড়ে নিজের মেয়েকে চেনেন তাই ছেলেটির পুরো পরিবারকে ওইদিন সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন।ওইদিন মিমির কোনো প্রতিবাদই ধোপে টিকলোনা।মিমির সবচেয়ে অপছন্দের পোশাক শাড়ি পড়ে সেজেগুজে যথা সময়ে ছেলের বাড়ির সামনে হাজিরাও দিতে হলো।কিন্তু ঘরে ঢুকে সবাইকে হাত তুলে নমস্কার করলো মিমি,যেন মায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করল পায়ে হাত না দিয়ে।ভাবলো এতেই ছেলের বাড়ি তার সংস্কার নিয়ে সন্দিহান হবে,কিন্তু নমস্কার করতে করতে নিজেই বমকে থেমে গেল।’আরররে কি হলো কেসটা… ট্রেনের গাবলু এখানে কি করে?!!!’মনে মনে এসব ভাবার মাঝেই শুনতে পেল দুজন ভদ্রমহিলার মধ্যে বয়স্ক জন ওকে উদ্দেশ করে বলছে,”আরে রাজনন্দিনী অতো ফর্মালিটিস করার দরকার নেই।আর ঘরোয়া আড্ডায় তুমি এসব শাড়ি পড়তে গেছো কেন?আজ আমরা সবাই মিলে আড্ডা মারতে এসেছি।”তারপর কিছুটা থেমে হাসতে হাসতে বললেন,”আমার অবশ্য ইচ্ছা ছিল পুজোর ষষ্ঠীতে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে না দেখা করে বাইরে কোনো জায়গায় দেখা হোক।কিন্তু মিসেস সেন(মিমির মা) শুনলেনই না।ওনার বাড়িতেই টেনে আনলেন,এতগুলো লোকের ঝামেলা এখন ঘাড়ে।যাইহোক বসো বসো।”মিমি সৌজন্য দেখিয়ে মৃদু কৃত্রিম হাসি হেসে একটা একানে সোফায় বসলো।কিন্তু ওর মাথায় তখন হাজারো প্রশ্ন,আর মাথাও না চাইতে বেশ গরম।এখন ও বুঝতে পারছে গাবলুর ওরকম তাকিয়ে থাকার কারণ, ও শিওর মা ওর ফটো ওকে না জানিয়ে আগেই ওদের পাঠিয়েছিল আর তাই গাবলু ওর নামও জানতো।’ব্যাটাকে যতটা বোকা দেখতে লাগছিলো মোটেই না নয়,এ ব্যাটা ঘোরেল মাল।দাঁড়াও বাছাধন তোমায় আমি মজা দেখাচ্ছি’,নিজের মনেই কথাগুলো বলতে থাকে মিমি।কথায় কথায় মিমি বুঝতে পারে ওই বয়স্ক মহিলা গাবলুর মা…গাবলুর বাবা নেই।মা গাবলুর দাদা বৌদির কাছে কলকাতায় থাকেন,দাদা বৌদির একটা মেয়েও আছে।তাকে নিয়েই ভদ্র মহিলার সময় কেটে যায়।বৌদিও চাকরি করেন,আর মাও আগে একটা স্কুলে পড়াতেন।তাই চাকরি করা মেয়ে নিয়ে ওঁদের বিশেষ সমস্যা নেই।শুধু চান ছেলে আর বৌমা যেন চাকরির কারণে আলাদা না থাকে,তাই দিল্লিতে চাকরি করা ছেলের জন্য ওঁরা ওখানকার চাকুরীরতা মেয়ে খুঁজছিলেন।গাবলুর পোশাকি নাম সূর্য মুখার্জি।মিমির চুপচাপ বসে থাকতে এমনি বিরক্তি লাগছিলো,যদিও ও বুঝতে পারছিল লোকগুলো খারাপ না।কিন্তু ওর মনটাই ছিল ওদের বিরুদ্ধে,তাই শত ভালো কথাতেও ওর মনের বিরক্তি কাটছিলোনা।একসময় সূর্যর বৌদি সায়নি বলে ওঠে,”আচ্ছা মা সূর্য আর মিমি কি নিজেদের মধ্যে কথা বলবেনা?তোমরা কি গো ওরা তখন থেকে উসখুস করছে আর তোমরা নিজেরা গল্প করেই যাচ্ছ।ওদের দিকে ফিরেও দেখছো না।”ওর কথায় সবাই হেসে ওঠে, মিসেস মুখার্জি নিজের বড় বৌমাকে বলেন,”তুইও তো কিছু কম যাসনা।তুই তো বড় বৌদি,এসব দায়িত্ব তো তোর “।তারপর সবাই হাহা হিহি করতে করতে ওদের মিমির ঘরে পাঠিয়ে দেয়।মিমি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেই রাগী চোখে তাকায় ঘরের একটা মাত্র চেয়ারে বসে থাকা সূর্যের দিকে।মিমির তাকানো দেখে সূর্য একটু ঘাবড়ে যায়।আমতা আমতা করে বলে,”আমি সত্যি নামটা রিজার্ভেশন লিস্ট থেকেই জেনেছিলাম।আর আমার বাড়ির কেউই জানেনা আমরা একসাথে ফিরেছি”।মিমি কিছু না বলে গম্ভীর মুখে নিজের বিছানায় গিয়ে বসে।তারপর যথেষ্ট জোরের সাথে বলে,”আপনি বিয়েটা ‘না’ করে দিন।আমি না বললে আমার মা শুনবেনা,কিন্তু আমি এখন কোনোভাবেই বিয়ের জন্য তৈরি নই।আপনিই পারেন বিয়েটা আটকাতে।”সূর্য অবাক হয়ে তাকায়, এধরণের কথার জন্যে ও একদমই তৈরি ছিল বলে মনে হয়না।তাছাড়া ট্রেনের ১৬-১৭ঘন্টায় মনে হয়নি রাজনন্দিনীর অন্য কোনো সম্পর্ক আছে,তাহলে?মুখটা নামিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,”যদি কিছু মনে না করেন কারণটা জানতে পারি?””কারণ কি সবসময় থাকতেই হবে মিস্টার মুখার্জি?একজন মেয়ের মত বলে কি সত্যি কিছু থাকতে নেই?সে কি নিজের কেরিয়ার কে প্রাধান্য দিতে পারেনা?আজ আমিই যদি বিয়ের পর স্বাধীন ভাবে কেরিয়ার নিয়ে থাকি আপনারাই মানতে পারবেন না।আমি এখনো দুদিক সামলানোর মতো অভিজ্ঞ হয়ে উঠিনি,বাঁধা পড়তে চাইনা সংসারের জালে।আমার মা কে তো বোঝালেও বুঝবেনা।আমার দুর্ভাগ্য আমার মা তাঁদের দলে পড়েন যাঁরা মেয়ে বলতেই সংসার করা বোঝেন।কিন্তু আপনি তো আধুনিকমনস্ক,তাই আপনাকে বললাম।এবার সিদ্ধান্ত আপনার।”একটানা বলে মিমি থামে।সূর্য কিছুক্ষন চুপ করে থেকে উঠে পড়ে চেয়ারটা ছেড়ে,”চলুন বাইরে যাওয়া যাক”,বলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়, মিমির মনে রেখে যায় হাজারো ধোঁয়াশা।বিয়েটা আদৌ ভাঙল কিনা বুঝে উঠতে পারেনা মিমি।
পরের দিন সকাল ১০টা নাগাদ ফোন আসে মিমির বাবার ফোনে।মুখার্জিরা জানায় তারা খুব দুঃখিত,কারণ ছেলে আজ সকালে জানিয়েছে সে এখন কোনোভাবেই বিয়ের জন্য তৈরি নয়।তাই বিয়েটা আপাতত বন্ধ রাখা হোক,আর এর মধ্যে অন্যত্র মিমির ভালো সম্বন্ধ এলে মিসেস সেন এগোতে পারেন।খবরটা পেয়ে মিমির মা একটু চুপচাপই হয়ে যান,পরিবারটিকে সত্যি তাঁর খুব ভালো লেগেছিল,আর সূর্যের মতো জামাই পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।শুধু সে ভালো চাকরি করে বলে না,আজকের দিনে এমন স্বভাব চরিত্রের ছেলে খুব সহজে মেলেনা,মনটাও খুব সুন্দর।কিন্তু কি আর করবেন,ওনার ভাগ্যে নেই যখন।কিন্তু খবর শুনে মিমির চোখের আনন্দের ঝিলিকও ওনার নজর এড়ায়না,কিছু না বলে চুপচাপ রান্নাঘরে চলে যান।পুজোর দিন গুলো হইহই করে কেটে যায়।দেখতে দেখতে ফেরার দিন এসে পড়ে।মিমি ফেরার টিকেটটা ফ্লাইটে কেটেছিল।প্লেনে উঠে নিজের সিটে বসতে গিয়ে আবার হোঁচট খায়,উইন্ডো সিটে বসে আছে সূর্য মুখার্জী।কিন্তু চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা হেলিয়ে,তাই মিমি কে দেখতে পায়নি।মিমি চুপচাপ গিয়ে পাশের সিটে বসে।মিনিট দশেক পর মিমিই মুখ খোলে।”হাই”…কিন্তু মিমির কথা মনে হয়না সূর্যের কানে যায়।ও একইভাবে চুপচাপ বসে থাকে…মিমি খেয়াল করে সূর্যের কানে হেডফোন গোঁজা।বাধ্য হয়ে ও মৃদু ঠেলা দেয় সূর্যের বাহুতে।এবার চোখ খোলে সূর্য।কিন্তু রাজনন্দিনীকে ফেরার সময়ও ফ্লাইটে দেখতে পাবে ও ভাবেইনি।তাই যথেষ্ট চমকে যায়।কিন্তু মিমি কে অনেকটাই স্বাভাবিক লাগে।ও হেসে বলে,”দেখুন ফেরার সময়েও আবার একসাথেই হয়ে গেল।”সূর্য কিছু না বলে আলতো করে হাসে।যদিও ও চাইনি আর রাজনন্দিনীর মুখোমুখি হতে।মিমিই আবার হাসিমুখে বলে,”থ্যাংক্স মিস্টার মুখার্জী।আপনি সত্যি এভাবে বিয়েটা ভাঙবেন আমি ভাবিনি।থ্যাংক ইউ সো মাচ”,বলে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় হাত মেলানোর জন্যে।ইতস্তত সূর্য হাত বাড়িয়ে দেয় হাত ঝাঁকাতে।এরপর পুরো সময়টা মিমির বকবকানিতে কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় বুঝতেও পারেনা, পৌঁছে যায় গন্তব্যে।দিল্লি পৌঁছে যখন দুজনে দুজনের রাস্তা ধরে মিমির মনে সূর্য মুখার্জীর জন্যে অতটাও খারাপ লাগা আর থাকেনা।পরেরদিন অফিস পৌঁছে মিমি কাজের চাপে চোখে অন্ধকার দেখে।যদিও ওমের অনেক সাহায্যই পায়,কিন্তু পরের একসপ্তাহ চোখে কানে দেখতে পাইনা মিমি।দিন দশেক পর একটু চাপ যখন কমে দিল্লিতে তখন উৎসবের মরশুম এসে গেছে।দিওয়ালির রঙিন আলোয় সেজে উঠছে শহর।মিমির এটা প্রথম দিওয়ালি,কারণ আগেরবার দিওয়ালির পরে ও চাকরিতে যোগ দিয়েছিল।দিল্লির শব্দবাজি কান ঝালাপালা করলেও আলোর মেলায় গোটা শহর যেন খুশির আমেজ ছড়াতে থাকে।এই কদিন অফিসের চাপে ওম কে অনেক কাছ থেকে চিনেছে ও।কাজ পাগল ওম আরো বেশি করে ওর মন জয় করে নিয়েছে।ওম কত আর বড় হবে?মিমির থেকে বড়জোর বছর ৫/৭ এর বড়,কিন্তু কি অসম্ভব নিষ্ঠা কাজের প্রতি।মিমি তো পুরোপুরি ফিদা হয়ে গেছে ওমেতে।নিজের কিউবিকলে বসে এসব চিন্তা করার ফাঁকেই মিমির ডাক আসে ম্যানেজারের কেবিন থেকে।উঠে ম্যানেজারের কেবিনে গিয়ে দেখে ওম ও বসে আছে।”গুড আফটারনুন স্যার”,মিমি দুজনের দিকে তাকিয়েই বলে।”আফটারনুন মিস সেন…গুড নিউজ ফর য়ু… য়ু আর সিলেক্টেড ফর ‘বেস্ট পারফর্মার অফ দ্য কোয়ার্টার’..উই আর ভেরি মাচ হ্যাপি টু ওয়ার্ক উইথ য়ু…কংগ্ৰাজ”।মিমির যেন প্রথমে বিশ্বাস হয়না,সত্যি নিজের কাজের স্বীকৃতি কার না ভালো লাগে,কিন্তু ওমের মুখটা এত গম্ভীর কেন?ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা!!যাইহোক মিমি আনন্দ প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসে।কিছুক্ষন চুপ করে বসে খবরটা বাবাকে হোয়াটস্ অ্যাপ করে জানায়।কিছুক্ষন পর অফিসের সবাই খবর টা শুনে ওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যায়,শুধু ওম আর ওদের টিমের প্রীতি ছাড়া।একটু অবাকই হয় মিমি।হঠাৎ সন্ধ্যেবেলা ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে দেখে ওর টিম মেট কজন এক জায়গায় জড়ো হয়ে কিছু নিয়ে গুজুর গুজুর করছে,হঠাৎ মিমিকে দেখে সবাই চুপ মেরে যায়।মিমি ব্যাপারটা এড়িয়ে নিজের কফিটা নিয়ে অন্য দিকে চলে যায়,কিন্তু হাজারটা প্রশ্ন এসে ভিড় করতে থাকে ওর মনে।
রাতে ক্যাবে জীবনের সবচেয়ে অবাক করা খবরটা শুনে মিমির দুনিয়াটা যেন একটু টাল খেয়ে যায়।এসব কি শুনছে সে…তার এই স্বীকৃতিতে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওম,ও চেয়েছিল ওর এখনকার গার্লফ্রেন্ড প্রীতিকে এটা পাইয়ে দিতে,তাই অত সহজে মিমিকে ছুটিও দিয়ে দেয়!হ্যাঁ প্রীতিও খুব সিরিয়াস নিজের কাজ নিয়ে কিন্তু তাই বলে মিমির যেটা প্রাপ্য সেটা জোর করে অন্য কাউকে দিতে চাওয়া,তাও ওম!!!মুহূর্তে মিমির কাছে অন্যতম প্রিয় দিনটা তেতো হয়ে যায়,বিস্বাদ হয়ে যায় মনের কোনের ভালোলাগাটা।পরিষ্কার হয়ে যায় ওম আর প্রীতির ব্যবহার ওর প্রতি।সবচেয়ে বড় কথা এতোদিন ধরে ওমের প্রতি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা ভালোলাগা-ভালোবাসা অর্থহীন হয়ে যায় ওর কাছে।চোখ বুজে নিজেকে সামলাতে গিয়ে চমকে ওঠে মিমি।বন্ধ চোখের মধ্যে মনের গভীরে ভেসে ওঠে একটা গোলগাল মুখ,যার চোখ গুলো খুব করুনা মাখা।নিমেষে চোখ খুলে ফেলে মিমি।’এটা কি হলো?সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্তে ওই মুখটা কেন মনে ভেসে উঠলো?!!আজ মাসখানেক আগে এয়ারপোর্টে শেষ দেখা মুখের চোখটা ঠিক এমনই ছিল কি?এতটা কষ্ট ছিল ওই চোখে?’আর ভাবতে পারেন মিমি। যাকে কোনো মুহূর্তেই পছন্দের তালিকায় রাখেনি সেই আজ সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্তে মনের গভীরে উঁকি দিলো?ক্যাবের জানলার ধারে বসে পিছনের সিটে মাথা হেলিয়ে দিলো মিমি।অজান্তে চোখটা জলে ভরে উঠলো।সবাই বলছে ওম -প্রীতির সম্পর্ক অনেক দিনের,আর প্রীতি ওম কে পছন্দই করেছে কেরিয়ারের স্বার্থে,কিন্তু মিমি কিছুতেই মানতে পারছেনা।মানতে পারছেনা ও এতো বোকা ছিল,মানতে পারছেনা ও ওমের চোখ পড়তে ভুল করেছিল,মানতে পারছেনা ওর প্রতি ওমের বিদ্বেষ।সব মিলিয়ে খুবই ভেঙে পড়ে।মনে হয় ‘ছুটে চলে যাই বাবা মার কাছে’,কিন্তু সেটা করতে গেলে চাকরিটা ছেড়ে যেতে হবে।কিন্তু কিছুতেই মিমি এভাবে নিজের স্বপ্ন,কেরিয়ার এতো সামান্য কারণে শেষ করতে পারবেনা।হ্যাঁ সামান্য,কারণ কষ্ট যতই হোক সবটাই শুধু ওর দিক থেকে।তাই এটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে ও নারাজ।আস্তে আস্তে মিমি মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকে নিজেকে গোছাবার,আবার একবার নতুন করে জীবনের একটা লড়াই লড়বার।জীবনের প্রথম ভালো লাগা ভালোবাসার থেকে কম কিছু হয়না,তাই অসম্পূর্ণতা মন কে রক্তাক্ত করে,কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়।এই ঘটনা নির্দেশ করে যে ভগবান যাকে পাঠিয়েছে সে অন্যত্র হয়তো অপেক্ষা করছে।মিমি শুরু করে জীবনটাকে আবার পজিটিভ ভাবে দেখতে।বাড়ি ফিরে রাতের খাওয়া যা হোক কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ে মিমি।কিন্তু ঘুম আসেনা।ফোনে ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে অন্যমনস্ক ভাবে ফ্রেন্ড সার্চে গিয়ে লেখে ‘সূর্য মুখার্জী’….অনেক গুলো সূর্যের মধ্যে ওই গোলমুখের গাবলুর মুখও ভেসে ওঠে।কৌতুহল মিমি কে টেনে নিয়ে যায় ওর প্রোফাইলের দিকে।প্রথমেই যেটা অবাক করে মিমি কে,রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস…’এনগেজড’।জোর করে ওর প্রোফাইল থেকে বেরিয়ে এসে ফেসবুক লগ আউট করে ফোন লক করে শুয়ে পরে।অনুভব করে সময় কখনো কারোর জন্যে অপেক্ষা করেনা।সব কিছু জানার পর মিমির যেন এখন অফিসে যেতে ইচ্ছাই করেনা।বিশেষ করে ওমের ব্যবহার সব সময় মনে কাঁটা ফোটায়, ওম যেন কোনোভাবে ওকে আর ভালো পারফরম্যান্স করতে দেবেনা।স্বপ্নের সাথী যখন শত্রু হয়ে যায় সত্যি হয়তো জীবনটা এতটাই দুর্বিষহ হয়।মিমি মুখ বুজে আরো ৩মাস চাকরি করে ‘প্রবেশনারী পিরিয়ড’ কাটিয়ে দেয়।তারপর শুরু করে অন্য কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে।আজ মিমির একটা খুব বড় কোম্পানিতে ইন্টারভিউ আছে,কোম্পানির বিশাল ক্যাম্পাস নয়ডা তে।মিমি একটু ভয় ভয়ে আছে,কারণ নয়ডা জায়গাটা ও বিশেষ চেনেনা।টেলিফোনে প্রথমে একটা ছোট ইন্টারভিউ হয়েছে….ওই টেলিফোনের গলাটা মিমির খুব চেনা লাগছিলো।যিনি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন তিনি ছিলেন ম্যানেজার লেভেলের আর নাম শুনে বাঙালি মনে হয়েছিল।আজও সম্ভবত উনিই ইন্টারভিউ নেবেন।মিমি কে একটা কনফারেন্স রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে… লম্বা টেবিলের একপ্রান্তের চেয়ারে বসে আছে মিমি।মিনিট দশ অপেক্ষা করার পর ওর ঠিক পিছনে রুমের দরজা দিয়ে কেউ ঢুকলেন।মিমি তার দিকে না তাকিয়েই উঠে দাঁড়ালো।তিনি এগিয়ে তাঁর বসার জায়গার দিকে যেতে গেলে মিমি তার দিকে তাকিয়ে ‘গুড মর্নিং’ বলতে গিয়ে কথা আটকে গেলো।মিমিকে বলা হয়েছিল এই রাউন্ডটা নেবেন এই সেন্টারের এসিস্ট্যান্ট হেড।কিন্তু এতো এতো এতো ….!!!মিমি কিছু চিন্তা না করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমিও কি ইন্টারভিউ দিতে এসেছ?” কিন্তু এ যেন এক অচেনা কেউ।ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে,এমনকি ওর দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের সিটে গিয়ে বসে এই বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এসিস্ট্যান্ট হেড সূর্য মুখার্জী আর মিমির দিকে তাকিয়ে অসম্ভব গম্ভীর গলায় বলে,”টেক য়ুর সিট মিস সেন”….শুরু হয় প্রফেশনাল ইন্টারভিউ।মিমি বুঝতে পারে ইন্টারভিউ কাকে বলে,ঘাম ছুটে যায় ওর।প্রায় এক ঘন্টা পর যখন ইন্টারভিউ শেষ হয় মিমি রীতিমতো বিধস্ত।আর কোনো রাউন্ড হবে কিনা তা কিছুক্ষন পর জানানো হবে জানিয়ে সূর্য মুখার্জী রুম ছেড়ে বেরিয়ে যান।সূর্যের ব্যবহার ওর চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।মিমি মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করে এই চাকরি ওর হবেনা।ওর কোনো ধারণা ছিলোনা সূর্য কেমন পোস্টে কি চাকরি করে…এমনকি কোম্পানির নামটাও জানা হয়নি।কিন্তু কাজের জগতে ও সত্যি এতটা প্রফেশনাল নাকি মিমির ওপর প্রতিশোধস্পৃহা থেকে এমন করলো মিমি বুঝতে পারছেনা।আধ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর মিমি নিজে থেকে উঠে রিসেপশনে খোঁজ নিতে যাবে বলে ভাবছে এমন সময় কনফারেন্স রুমের দরজা খুলে ওর বয়সী এক তরুণী ঢুকলেন।মিমি আবার উঠে দাঁড়াতে তিনি বললেন,”হাই রাজনন্দিনী।অ্যাম নেহা,এইচ.আর অফ দ্য কোম্পানি।প্লিজ টেক য়ুর সিট।এন্ড কংগ্ৰাজ..য়ু হাভ কোয়ালিফায়েড অল রাউন্ডস অফ য়ুর ইন্টারভিউ।নাও নিড তো টক উইথ য়ু অবউট দ্য পলিসি এন্ড য়ুর স্যালারি”।প্রথমটা মিমির বিশ্বাস হয়না,নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করে,”ইস ইট লাস্ট রাউন্ড?”নেহা মৃদু হেসে ওকে আশ্বস্ত করে এটা শুধুমাত্র ওর স্যালারি নিয়ে আলোচনা।ও চাকরিটা পেয়ে গেছে। মিমি আনন্দ পাবে না দুঃখ বুঝে উঠতে পারেনা।তাড়াতাড়ি এইচ.আর রাউন্ড শেষ করে বাইরে এসে বাবাকে ফোন করে।সুখবরটা দেয়,তারপর মা কে খোঁজে।”মা, আমায় ক্ষমা করে দাও মা।”ফোন ধরেই ধরা গলায় মিমি বলে উঠে।অবাক হয়ে মিসেস সেন বলেন,”কি হয়েছে মিমি?এসব কথা কেন বলছিস?””তুমি খাঁটি সোনা খুঁজে এনেছিল আমার জন্যে,আমি অন্ধ তাই চিনতে পারিনি।আজ বুঝলাম।”মিমি হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।”আমি বুঝতে পারছিনা মিমি কি বলছিস তুই?”মায়ের কথার উত্তর মিমি এবার সরাসরি বলে,”সূর্য সত্যি খাঁটি মানুষ মা।শুধু বড় চাকরি করে বলে না,ওর মতো সৎ ছেলে আজকের দিনে পাওয়া কঠিন।জানো মা আমার ম্যানেজার কে এই নতুন কোম্পানিতে?…সূর্য মুখার্জী।না ও আমায় চেনা হওয়ার সুযোগ দিয়েছে,না আমার শিক্ষার অসম্মান করেছে।উপযুক্ত ইন্টারভিউ নিয়ে তবে আমায় সিলেক্ট করেছে।সেখানেও কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভকে প্রাধান্য দেয়নি।সত্যি মা ওর মতো বস পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার,যে পারসিউলিটি করবেনা অকারণ।”ওমের প্রতি ক্ষোভটা বেরিয়ে আসে মিমির শেষ কথাটায়।মিমির কথায় মিসেস মুখার্জী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।”যা হওয়ার হয়েছে মা।তুই মন দিয়ে কাজ কর।তারপর নিজে যখন বুঝবি নিজের পছন্দে বিয়ে করিস।সত্যি হয়তো,’জন্ম মৃত্যু বিয়ে,তিন বিধাতা নিয়ে’..যখন সময় হবে সব হবে”।মায়ের কথায় মিমির ও মন ভারী হয়ে যায়।এরপর এটা ওটা বলে ফোন ছেড়ে দেয়।হঠাৎ নজরে পড়ে সূর্য আর এক ভদ্রমহিলা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ক্যান্টিনে ঢুকে গেলো।মিমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে পিজি তে ফিরে আসে।দু মাস পর আগের কোম্পানির ‘নোটিশ পিরিয়ড’ শেষ করে মিমি যোগ দেয় নতুন কর্মক্ষেত্রে।মিমির নিষ্ঠা,সততা,পরিশ্রম করার প্রচেষ্টা খুব তাড়াতাড়ি ওকে পরিচিতি এনে দিতে থাকে।কিন্তু যার জন্য এত মন দিয়ে কাজ করে সে খুব কমই প্রশংসা সূচক কিছু বলে…ব্যক্তিগত কথা আজ অবধি কিছুই প্রায় হয়নি।এভাবেই চলতে থাকে।এভাবে মাস ছয় পর আবার মিমি এই কোম্পানিতেও “বেস্ট পারফর্মার অফ দ্য কোয়ার্টার”হয়।আর প্রচন্ড অবাক হয়ে যায় জানতে পেরে যে ওইদিন ই সূর্য ইস্তফা পত্র দেয় এই কোম্পানিতে।মিমির মধ্যে টা আবার ভাঙতে থাকে।কারণ মাস খানেক আগে অফিস পার্টিতে সুযোগ পেয়ে আর কিছুটা অ্যালকোহলের কারণে মিমি সূর্যের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের ভুল স্বীকার করেছিল।বলেছিল তার ভুল হয়েছিল সূর্যকে চিনতে।তবে মানুষ সূর্য কেই ও বেশি সম্মান করে আর করবেও।সেদিন সূর্য কোনো উত্তর দেয়নি,চুপচাপ সরে গেছিল ওর কাছ থেকে।মিমি ভাবলো আজ সেই কথার জবাব সূর্য দিলো।সেইদিন দুপুরের সময় মিমির ফোনে একটা মেসেজ এলো,একটা অচেনা নম্বর থেকে।”আজ সন্ধ্যেবেলা অফিসের পরে সম্ভব হলে দেখা করতে চাই।ডিনার করে রাতে পিজি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।বিশেষ দরকার।….সূর্য মুখার্জী”। ….মিমি চুপচাপ ফোনটা ধরে কিছুক্ষন বসে থাকলো।প্রায় ৬মাস পর সূর্য ওকে ব্যক্তিগত দরকারে ডাকলো।সূর্য কনভেন্টে পড়া ও জানতো, কিন্তু সে যে এত সুন্দর গুছিয়ে বাংলা হরফে আর ভাষায় লিখতে পারে মিমি জানতে পারেনি এতদিন।ও শুধু ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”ঠিক আছে।সন্ধ্যে সাতটার পর।”ওদিক থেকে উত্তর এলো জি.আই.পি মলের ২নম্বর গেটের সামনে সন্ধ্যে সাড়ে ৭টা”। ফোনটা মুঠোয় ধরে একটা জোরে শ্বাস নিলো মিমি। কিন্তু ওর মনের সেই আনন্দ বেশিক্ষন স্থায়ী হলোনা।ওর এই অফিসের বেস্ট ফ্রেন্ড রাধিকা কিছুক্ষন পর একটা খবরে ওর মনটা বেশিই খারাপ করে দিলো।”হেই রাজ শুনাহে ক্য, সুরিয়া(সূর্য) স্যার ইসি সাল মেই শাদী(বিয়ে) কারেঙ্গে।ইস লিয়ে আচ্ছা অফার মিলতেহি ইস জব ছোড় দিয়ে।সব কাহে রাহেহে কি দুলহান ইস কোম্পানিকা ভি হো সাকতি হ্য।আজ স্যার বহত খুশ থে,উনুনহে খুদ নেহা কো হিন্টস দিয়া হ্যয়।নেহা তো অভি সে প্ল্যান কারনা শুররু কার দি।সচমুছ স্যার জ্যসা ইনসান মিলনা বহত হি মুশকিল হ্যয় আজকে দুনিয়া মে।আগর মুঝে বুলায়েঙ্গে তো ম্যায় ভি জায়ুঙ্গি।”রাধিকা নিজের ভাষায় মিমির কাছে উচ্ছাস প্রকাশ করে,কিন্তু বুঝতেও পারেনা মিমির মুখটা ছোট হয়ে যাচ্ছে।রাধিকার কথায় মিমি বুঝতে পারে ওর সাথে সূর্য কেন দেখা করতে চেয়েছে আর কেনই বা সেদিন ওর কথায় কিছু বলেনি।”সরি স্যার আপনাকে অপেক্ষা করতে হল…আমার আজ একটু বেরোতে দেরি হয়েছিল”…৮টা নাগাদ নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে সূর্য কে দেখতে না পেয়ে ফোন করে মিমি।জানতে পারে ও ভিতরে ঢুকে একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে মিমির জন্যে।সেখানে পৌঁছে সূর্যকে একা দেখে কিছুটা শান্তি পায় ও।অন্তত এই কিছুক্ষন অন্য কারোর উপস্থিতিতে অস্বস্তি অনুভব করতে হবেনা,অন্য কেউ থাকলে তাকে পুরোনো কথা বলতে হতে পারে,তাতে মিমির নিজেকে খুব ছোট লাগবে।”বসো নন্দিনী,আর একটা কথা এটা কোনো অফিসিয়াল সাক্ষাৎকার নয় যে আমায় স্যার বলবে।আগে যেমন মিস্টার মুখার্জী বলতে সেটাও বলতে পারো বা….সূর্য”।নিজের নাম টা জোর দিয়েই বলে সরাসরি মিমির মুখের দিকে তাকায়।মিমি চোখ নামিয়ে নিয়ে চুপ করে থাকে।সূর্য ই আবার কথা শুরু করে,”বলো কি খাবে?এখন কিছু স্টার্টার আর কফি বলি?নাকি মকটেল কিছু?”মিমি একটু থেমে বলে,”শুধু কফি”।সূর্য ওর মুখের দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে বলে,”আমার খুব খিদে পেয়েছে নন্দিনী।একপ্লেট পকোড়াও বলছি।ইচ্ছে হলে খেও।”অর্ডার দিয়ে সূর্য মিমির দিকে ঘোরে।”তোমায় কিছু বলার জন্য আমি আজ দেখা করতে চেয়েছিলাম”।তারপর কথার ধরণ বদলে কৌতুক মিশিয়ে বলে,”….তোমায় তোমার পারমিশন ছাড়াই নন্দিনী বলে ডাকছি ঝগড়া করলে না তো?”বলে মুচকি হাসতে থাকে। এবার মিমি ভালো করে মুখ তুলে ওর ভ্রু কুঁচকে তাকায় সূর্যর দিকে।তারপর থেমে থেমে বলে,”মানে?!কি বলতে চাইছেন ঠিক বুঝলাম না”।সূর্য আরেকটু রাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলে,”আরে এখানে আমি তোমার বস নই।আমি শুধুই সূর্য মুখার্জী।তাই তুমি প্রাণ খুলে ঝগড়া করতে পারো।আমি জানি এই ছ’মাসে আমাকে মনে মনে অনেক গালাগালি করেছ।তোমার চোখ,তোমার মুখের ভাব দেখে প্রতি মুহূর্তে তোমার কথা গুলো যেন আমি শুনতে পেতাম।আর ভাবতাম এই বুঝি অফিসের মধ্যেই তেড়ে এলো।কত সাবধানে তোমার সাথে কথা বলতাম জানো?”বলে দুস্টুমি হাসি হাসতে থাকে।আসলে মিমিকে স্বাভাবিক ওর মতো করে কথা বলতে না পারলে কোনো কথাই যে বলা হবেনা।এবার মিমি নিজের পুরোনো ফর্মে ফেরে।এতদিন ‘স্যার’ ‘স্যার’ করে অভ্যস্ত মিমি নিজের জড়তা কাটাতে পারছিলনা।কিন্তু মুখের সামনে বসে কেউ তাকে সমানে ঝগড়াটে বলে যাবে আর এটা ও মেনে নেবে,’কাভি নেহি’।”কি ব্যাপার বলুন তো?যা মনে আসছে বলছেন ।কবে আমি আপনার সাথে ঝগড়া করেছি বলুন তো?আর হ্যাঁ এতদিনে কদিন আপনি আমায় পার্সোনালী কথা বলেছেন।অফিসে তো সবসময় হুঁকো মুখো হয়ে থাকেন।আলাদা কথা বললেও বাংলায় একটা শব্দও উচ্চারণ করেন না।আর হ্যাঁ ইন্টারভিউ এর দিন….মনে হচ্ছিল কেউ গুগলি ফেলছে কেউ।আমি নিজে ভালো ইন্টারভিউ না দিলে …”বলে চুপ করে যায়।আবার বলে,”আর আমি যদিও ঝগড়াটে হই তাতে আপনার কি?আর তো দেখা সেভাবে হবেনা।আর আমার এই মুখটাও দেখতে হবেনা।”বলে একদম চুপ করে যায়।তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভাব করে বলে,”আপনি কোম্পানি ছাড়ার পর হয়তো একদিন দেখা হতে পারে,তাও যদি আপনি চান তো”।”ঠিক বুঝলাম না”,সূর্য মুখে মৃদু হাসি বজায় রেখে উত্তর দেয়।”না যদি আপনি বিয়েতে সবার সাথে আমাকেও ডাকেন তাহলে….”মিমির কথা থেমে যায় সূর্যের হঠাৎ বিষম লেগে দমক কাশির চোটে।মিমি টেবিলের অন্য দিক থেকে উঠে পিঠ চাপড়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে জল খেতে দিয়ে তারপর মিনিট দুই পর একটু স্বাভাবিক হয়।তারপর মিমির দিকে তাকিয়ে চিঁ চিঁ করে বলে,”একটু তাকিয়ে দেখবে তো আমি কফিতে চুমুক দিচ্ছিলাম।তা না…”মিমি অবাক হয়ে যায়,”আরে আপনি এরকম বিষম খাবেন তা কি আমি হাত গুনব?আর বিষম খাওয়ার মতো কি এমন বললাম।আপনি নিজেই তো আজ অফিসে লোকজনকে বলেছেন।আবার আমায় দোষ দিচ্ছেন!!তাছাড়া কোন যুগ থেকে তো আপনি এনগজেড…বিয়ে না করার কি আছে?”সূর্য মিমির কথায় চুপচাপ কফিতে চুমুক দিতে থাকে।তারপর কফিটা শেষ করে কাপ টা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,”তুমি জানো কোন ভরসায় আমি বিয়ে করার ইঙ্গিত অফিসের কাছের মানুষদের দিয়েছি আর কোন সাহসে চাকরিটা ছেড়েছি?…তুমি কি জানো আমাদের অফিসের পলিসি হলো হাজব্যান্ড আর ওয়াইফ একসাথে এই কোম্পানির একই অফিসে থাকতে পারবেনা?আর তুমি বোধহয় কোনদিন বোঝোও নি যে একবার কাউকে মনে জায়গা দিলে আমার মতো ছেলের পক্ষে আর অন্য কারোর কথা ভাবা একেবারে অসম্ভব নাহলেও খুবই চাপের।সুতরাং তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?আর হ্যাঁ আগের বছর রাজধানী এক্সপ্রেসে কলকাতা ফেরার পরই আমি ফেসবুক স্ট্যাটাস বদলাই, কারণ আমার মা আমায় বলেছিল মেয়ের বাড়ি থেকে কোনো সমস্যা নেই আমি রাজি হলেই বিয়েটা হয়ে যাবে।”কথাটা শেষ করে মুখ তুলে মিমির মুখটা দেখে।কিন্তু কিছু বুঝতে পারেনা।তখন আবার বলতে শুরু করে,”শেষ অফিস পার্টিতে সামান্য নেশার ঝোঁকে তুমি আমায় কি বলেছিলে মনে আছে নন্দিনী?ওই কথা গুলো খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করেছিল,মনে হয়েছিল হয়তো ওটাই তোমার মনের কথা।আর তাই ওই কথা গুলো ভরসাতেই….”,চুপ করে যায় সূর্য।মিমি এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিল,”আপনিতো চাননি আমি এই জবটা পাই।নাহলে ইন্টারভিউ তে কেউ ওরকম চোখের জলে নাকের জলে করে?আমি তো সেদিন ধরেই নিয়েছিলাম চাকরিটা হবেনা।”এবার সূর্য চুপ করে থাকে।মিমি বাধ্য হয়ে এবার মনের কথা বলতে শুরু করে,”ইন্টারভিউ এর দিন থেকে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।সেদিন যদি সহজে চাকরিটা পেয়ে যেতাম,করতাম কি করতামনা পরের কথা,কিন্তু আপনাকে সাধারণ দের দলে ফেলে দিতাম।আর শুনতে নাক উঁচু মনে হলেও ছোট থেকে সাধারণ মানুষ আমার বিশেষ একটা পছন্দের না।আমার শিক্ষা কে,আমার সম্মানকে সেদিন সম্মান করেছিলেন আপনি।ওইদিন থেকে আমার ভালো লাগার শুরু।কিন্তু ….আপনি যে এনগেজড এটা আমায় সবসময় আপনার থেকে দূরে রেখেছে।তারপর আমার বস আপনি,আর আপনার ব্যবহারে প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয়েছে আপনি আগের বছরের পুজোটা ভুলে গেছেন।তাই আর নতুন করে কিছু ভাবিনি।কিন্তু আপনার কাজের প্রতি ভালোবাসা,নিজের টিমের প্রত্যেকের আলাদা করে খেয়াল রাখা,আপনার প্রতি টিমের সবার শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা আমাকে আপনার দিকে আকর্ষণ করেছে।আমি কিন্তু সেদিন অতটাও আউট ছিলামনা,তাই অফিস পার্টির কথা অনেকটাই মনে আছে।হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় যেটা বলতে না পেরে আমরা কষ্ট পাই,সামান্য অ্যালকোহল সেটা বলিয়ে দেয়।….আসলে আমি ভবিৎসতে আক্ষেপ করে বিশ্বাসী নই।তাই মন আর মুখ কখনো এক হয়ে যায়।এর থেকে বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব না।”বলে মিমি চুপ করে যায়।রেস্টুরেন্টে ভিড় বিশেষ নেই,সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে কফির কাপ ধরে রাখা মিমির হাতের উপর সূর্য ওর একটা হাত রাখে।মিমি চোখটা বুজে ফেলে।সূর্য তখন একটা হাত মিমির গালে ছুঁইয়ে বলে,”থ্যাংক্স মিমি আমার জীবনে আবার ফিরে আসার জন্যে।ছবি দেখে ভালো লেগেছিল..ট্রেনে ১৬-১৭ ঘন্টা একসাথে কাটিয়ে ভালোলাগা বাড়তে শুরু করে ছিলো..ফেরার ফ্লাইটের ২-৩ঘন্টায় তোমার মন চুরি করলো আমার মন।তারপর একমাসে তোমার ঘোর যখন কাটছেনা,তুমি নতুন করে এলে আমার জীবনে।তোমার কাজের প্ৰতি নিষ্ঠা দেখে অনুভব করছিলাম তোমার বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা।কিন্তু সব বাঁধ ভেঙে দিলো তোমার পার্টির কথাগুলো।নতুন করার ভাবলাম আমি আর তোমার প্রতি ভালোবাসায় বিশ্বাস করে ফেললাম ওগুলো।”তারপর সামান্য গাঢ় স্বরে বললো,”এবার কি আমায় বিয়ে করা যায় মিস রাজনন্দিনী সেন?মিসেস মুখার্জীর জায়গাটা যে খুব দরকার আমার জীবনে।খুব দরকার একটা ঝগড়াটে মিষ্টি মেয়েকে।হবে আমার স্বপ্ন সঙ্গী?”কিছু না বলে মিমি সূর্যর হাতটা আরেকটু চেপে ধরে।চোখ বন্ধ করে শুধু ঘাড়টা সামান্য নাড়ে।সূর্য সামনের চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে মিমির পাশে বসে।ওর কাঁধে হাত রেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।মিমি ঘাড়টা রাখে সূর্যর কাঁধে।সূর্য ওর গালটা আলতো করে মিমির রেশম চুলে ডুবিয়ে দেয়।পরের পুজোর অষ্টমীর অঞ্জলি একসাথে দেবে দুজনে সেটা স্পষ্টই হয়ে ওঠে ওদের একে অপরের প্রতি সুন্দর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে।