আজ রুক্মিণীকে জোর করেই ওর নিজের ঘরে শুতে পাঠিয়েছে অহনা।ওর নিজের সাথে রাতটা থাকা খুব দরকার ছিল।রাতে নিজের অস্তিত্ব কে উপলব্ধি করার সবচেয়ে সেরা সময়।নিশ্চুপ,নিস্তরঙ্গ পরিবেশে নিজেকে বোঝা যায়,নিজের মনের গভীরে ডুব দেওয়া সহজ হয়।ওর জীবনের এক দুর্গম বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে।পিছন দিকে উৎরাই ধরলে সমতলে পৌঁছে যাবে,কিন্তু তাতে এতটা কষ্ট করে আসা ব্যর্থ হবে।আর সামনের দিকে কুয়াশা ঘেরা চড়াই রাস্তা,কোনোভাবে মনের জোরে এগোতে পারলে একসময় হয়তো নিজের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারবে,যেখানে আছে অপার শান্তি।এখন দরকার শুধু চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।হঠাৎ কম্বল ঢাকা কানে এক শব্দের আওয়াজ ধাক্কা মারে।কম্বল সরিয়ে বুঝতে পারে কেউ ওর দরজা ঠেলছে।মোবাইলে সময় দেখে…১১.১৭ বাজে।রুক্মিণী দের বাড়িতে শীতের রাতে ১০টার মধ্যে সব ঘরের আলো নিভে যায়।একটু অবাক হয়,পরক্ষণেই মনে হয় ‘নিশ্চই রুক্মিণী’… অহনা কে একা শুতে দিয়ে নিশ্চই শান্তিতে ঘুমোতে না পেরে উঠে এসেছে।শীতের রাতে কম্বল ছেড়ে উঠে দরজা খোলার চিন্তায় একটু বিরক্তিই জাগে অহনার মনে,কিন্তু যাহোক করে উঠে নাইটিতে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের দরজা খুলে কিছু বলতে গিয়ে ধাক্কা খায়।ঘরের হালকা নীলচে আলোয় পাতলা রাত পোশাকে অহনাকে দেখে দরজার বাইরের অতিথিও একটু থমকে যায়।অহনা ঘোর কাটতেই হাত বাড়িয়ে বিছানা থেকে শালটা নিয়ে গায়ে জড়িয়েই ঘরের বড় আলোটা জ্বেলে দেয়।বড় আলোতে দরজার বাইরের মানুষটাও একটু ধাতস্থ হয়।পা বাড়িয়ে অহনার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে আসে।অহনা কিছু বোঝার আগেই ওর অনুমতি না নিয়েই ওর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দেয়।হতভম্ব অহনা অবাক হয় মানুষটার চরিত্র বিরোধী কাজে,ওর অবাক দৃষ্টিতে তাকানো দেখে রাজীব বোস বলে,”কিছু দরকারি কথা আছে।বলেই চলে যাবো।ততক্ষণ দরজাটা বন্ধই থাক”।অহনা কথা বাড়ায় না।চুপচাপ গিয়ে বসে খাটের এক কোনে।ওর বৌমনি বসবে বলে রুক্মিণী যে চেয়ারটা দুপুরে ওর ঘরে দিয়ে গেছিল সেটা টেনে রাজীব প্রায় অহনার মুখোমুখি বসে পরে।”অহনা আজ কটা কথা জানতে এসেছি তোমার কাছে।আশা করি তুমি নিরাশ করবেনা।আগে আসিনি কারণ মনে হয়েছিল সেটা এক্তিয়ার বহির্ভূত হবে।আমি কলেজের অহনা গাঙ্গুলী কে মনের মধ্যে নিয়েই সুখী ছিলাম,তাই সিঁদুর পড়া অহনা মুখার্জীকে নিয়ে আলাদা করে ভাবতে চাইনি।বুঝতে পেরেছিলাম তোমার জীবনে কিছু ঘটেছে,কিন্তু মনে হয়েছিল সেটা সাময়িক।তাই…”,বাধা পায় রাজীব।”তা আজ হঠাৎ চিন্তা ভাবনা বদলে গেল নাকি?”অহনার কথায় কোথাও যেন অভিমানের সুর বাজে।থমকে যায় রাজীব।
“আমি দুঃখ প্রকাশ করব নাকি ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেব জানিনা…আজ বিকেলে অ্যাক্সিডেন্টলি তোমার বৌদির সাথে তোমার কথার কিছুটা শুনে ফেলি।যেটা আমার চিন্তায় ধাক্কা দেয়।আমি সত্যি খুব কষ্ট পেয়েছি তোমার লেখা ডাইরিটার কথা শুনে।এরকম মানুষের সাথে তোমার মানসিকতা মিলবে না সেটা স্বাভাবিক।কিন্তু….মানে… তোমার এখন চিন্তা ভাবনা কি…সেটা আর কি…কি ভাবছো তুমি নিজেকে নিয়ে?” এই ধরণের কথা কিকরে বলবে সেটাই বুঝতে পারেনা রাজীব।রাজীব যতক্ষন কথা বলছিল অহনা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ওর মুখের দিকে।ও কথা শেষ করার পরও অহনার নজর একই ভাবে স্থির থাকলো রাজীবের ওপর।তারপর ধীরে ধীরে ও বললো,”রাজীবদা এত রাতে কি বলতে এসেছ আমায়?আমার কেন কারোর ব্যক্তিগত জীবনেই তুমি যেচে ঢোকনা আমি জানি।এমনকি তোমার নিজের বোন রুক্মিণী বিয়ে করবে না শুনে তুমি বড়দাদা হয়েও যেচে কিছু জিজ্ঞেস করোনি।সেই তুমি এত রাতে আমার ঘরে এসেছ আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা জানতে!!!আজ পাঁচদিন আমি আছি,এর মধ্যে একদিন যেচে তোমার ঘরেও গেছি,এত অসুস্থ হয়েছি তাও পরস্ত্রী ভেবে তুমি এই ঘরের চৌকাঠ পেরোওনি।আজ আমার কথা শুনতে নয়,তোমার কথা বলতে এসেছ।বল কি বলবে…”। অহনার মনের জোর যে এতটা রাজীবের তা জানা ছিলোনা।ওর এত স্পষ্ট কথায় ও কিছুটা হকচিকিয়ে যায়।ওর মাথাটা নেমে আসে বুকের কাছে।অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে,মনোবল কে সঙ্গী করে ও অহনার ঘরের দরজা ঠুকেছিলো, কিন্তু ভাবেনি কলেজের প্রাণচঞ্চল অথচ বোকা অহনা এতটা বাস্তব অনুভব করতে শিখে গেছে।কলেজে সবসময় যে রাজীবের মুখের কথাকেই চীর সত্য মেনে এসেছে,সে আজ এত সহজে ওকে পড়ে ফেলবে,ভেবেও দেখেনি!বড্ড অস্বস্তি বোধ করে রাজীব।কিন্তু আজ ও কিছুতেই পালাবে না।যত প্রশ্নের জবাবই দিতে হোক ও নিজের উত্তর নিয়ে তবেই ফিরবে।নিজের স্বভাববিরোধী কাজ করতে হলেও ও তাই করবে।”অহনা তুমি কি তোমার স্বামীর সাথে সম্পর্ক শেষ করার কথা ভাবছো?যদি নিজের মন না চায় তোমার স্বামীর সংসারে ফিরে যেতে,অথচ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাধ্য হয়ে ফিরতে চাও,তাহলে আমি বলবো ফিরোনা।আমি তোমার সাথে আছি।যেখানে মন থেকে ভালো থাকবেনা সেখানে প্লিজ ফিরোনা।তোমার অদ্ভুত সৃষ্টিকেও হারিয়ে যেতে দিওনা সংসারের যাঁতাকলে।তোমার মনটাই অর্ধমৃত হয়ে গেছে,তাকে আর মেরোনা।তোমার রাজীবদা এখনো বেঁচে আছে,হয়তো জীবনের অনেকটা মূল্যবান সময় চলে গেছে,তাও বাকি অনেকটা জীবন পরে আছে একসাথে পথ চলার,আনন্দ করে এগিয়ে যাওয়ার।শুধু তোমার মনের জোর দরকার অহনা।আমি বলছিনা আমার জন্যে সংসার ভাঙতে,কিন্তু আজও আমি আছি তোমার পাশে এটা ভুলনা।” একনিঃশ্বাসে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা কথা গুলো বলে রাজীব অহনার দিকে তাকায়।কিন্তু ওর দৃষ্টিতে কিছুই বুঝতে পারেনা।আবেগহীন গভীর চোখদুটো দেখে কিছুই বুঝতে পারেনা সাহিত্যের অধ্যাপক রাজীব।যে চোখ সব সময় হাসতো,আজ যেন তা নিষ্প্রাণ।রাজীবের কথা গুলো অহনা উপলব্ধি করেছে কিনা ওর চোখ দেখে কিছুই বোঝা সম্ভব হলোনা রাজীব এর পক্ষে,তাই ও অপেক্ষা করতে লাগলো অহনার মুখের কথার।অনেক্ষন সময় নিলো অহনা উত্তর দিতে,যেন নিজেকে গুছিয়ে নিলো।তারপর বললো, “আজ আমি সারাদিন ভেবেছি,আমি পারবো না ঋষির জীবনে বা সংসারে ফিরে যেতে।শেষ দেড় বছর আমি খালি শুনেছি ‘খারাপ আমি’ টার কথা,যেটা মাঝে মধ্যে ভাবাতো সত্যি হয়তো আমার মধ্যে ভালো কোনো গুন নেই।ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলেই সেই নিজেকে ঘেন্না করার ভয় আমার ফিরে ফিরে আসছে।মনে হচ্ছে ওখানে গেলেই আমি আবার খুব খারাপদের দলে পরে যাবো।এত বড় ঘটনার পর ফিরলে তো প্রতি মুহূর্তে শুনতে হবে আমার হেরে যাওয়ার গল্প।কিন্তু ফিরে না গিয়েও আমি কি করবো নিজের জীবনের সাথে?!আমি যে সেই সব ভীতু মানুষদের দলে পড়ি যারা চাইলেও নিজেদের শেষ করতে পারেনা।…”।
“অহনা প্লিজ।” আঁতকে ওঠে রাজীব অহনার শেষ কথাটায়।কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে মাথা নামিয়ে নেয়।অহনা আবার বলতে শুরু করে।”আমি ভেবেছি রুক্মিণীর সাথে ওদের এন.জিও.তে কাল যাবো।নিজের পায়ের তলায় মাটি শক্ত করতে ওদের সাহায্য চাইবো।ওদের সাথে কাজ করবো,আর অবসর সময়টা চাকরির জন্য পড়বো,লিখবো।আসতে আসতে নিজের পায়ের তলায় মাটিটা শক্ত হলেই আমি জিততে না পারি,হারবোনা।…দেখো রাজীবদা, লড়াইটা আমি কারোর মুখাপেক্ষী হয়ে শুরু করিনি।আর তোমার শুনতে খুব খারাপ লাগবে কিন্তু শেষ আড়াই বছর তুমি আমার কোথাও ছিল না।আমি জানতামনা অবধি তুমি বিয়ে করোনি,আমি আমার খুব প্রিয় একজনের কথায় তোমায় ছেড়েছিলাম,ভুলেছিলাম তোমায়।আর তাকে কথা দেওয়ার পর তোমার খোঁজ কোনোদিনও কোথাও নিইনি”।…”হ্যাঁ এটা ঠিক, প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো,আমরা যে খুব ভালো বন্ধুও ছিলাম।তাই কোনো সিনিয়র না,প্রেমিক না মিস করতাম আমার বন্ধু টা কে।তোমার বাড়ির দরজা খুলে তোমায় দেখার আগে অবধি তুমি আমার মনের চোরাকুঠুরিতে বন্ধই ছিলে,আমাদের ভাগ্য মুখোমুখি না করলে একে অপরের বর্তমান অবস্থা জানতেও পারতামনা।কিন্তু ওই যে হয়না ‘আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড’ তার জন্যেই ধুলো পরে গেছিল তোমার আমার সেই দিনগুলোর স্মৃতিতে।….তুমি আমার ক্রাশ ছিলে কিনা বোঝার আগেই তোমায় হারিয়ে ফেলেছিলাম,সরিয়ে দিয়েছিলাম মন থেকে।কারণ আমি এরকমই,ছোট থেকে ভীষণ বাস্তববাদী।”…”ঋষিকে বিয়ের পর ভালোবেসেছিলাম।কিন্তু ভালোবাসারও কিছু যত্ন লাগে,যা সব সম্পর্কের লাগে।দিনের পর দিন অবজ্ঞা, অপমান,অবহেলা সেই ভালোবাসাটা বাঁচতে দিলোনা।আর সত্যি কথা কি বলতো রাজীবদা,যে তোমায় ভালোবাসবে সে তোমার ভালো মন্দ পুরোটাকেই ভালোবাসবে।সম্মান করবে তোমার ভালো লাগা কেও,কিন্তু ওই যে ঋষি আমার ভালো লাগা টাকে সন্দেহ করে পুড়িয়ে দিলো,সেদিনই জ্বালিয়ে দিলো আমার বিশ্বাস আর ভালোবাসা কেও।”কেটে কেটে এতটা বলে একটু থামল অহনা।নিঃশ্বাস নিলো ভালো করে।রাজীব যেন অহনার কথায় সম্মোহিত হয়ে গেছে।চুপ করে শুধু শুনতে ইচ্ছা করছে।বুঝতে পারছে অহনার আর কোথাও ও বেঁচে নেই।অহনার কোনো দুর্বলতায় নেই ওর অস্তিত্ব,কিন্তু তাও আরো জানতে ইচ্ছা করছে ওকে,বুঝতে ইচ্ছা করছে।রাজীব জানে আজও অহনা ওকেই সব কিছু বলতে পারবে,যা হয়তো আর কাউকে পারবেনা।তাই বাধা দিয়ে থামিয়ে না দিয়ে ওকে বলার স্বাধীনতা দিতেই ওর ভালো লাগছে।”রাজীবদা তোমার মনে আছে সেই দিনটার কথা?আমাদের ক্লাস রুমে বসে আমি কিছু নোটস লিখছিলাম ছুটির পর…তুমি এসেছিলে….হাই বেঞ্চে আমার নোটসের খাতা টার পাশে বসে আমার ব্যাগের ওপরে রাখা ডাইরিটা হাতে নিয়ে যেই খুলতে যাচ্ছিলে আমি সব লেখাপত্র ছেড়ে লাফ মেরেছিলাম তোমার ঘাড়ে, হাত থেকে আমার ডাইরিটা ছিনিয়ে নেব বলে…ব্যালান্স করতে না পেরে দুজনে উল্টে পড়েছিলাম…ক্লাসরুমের আধো অন্ধকারে তুমি সেদিন আমায় প্রথম আর শেষ ছুঁয়েছিলে….তোমার সেই আলতো করে হঠাৎ ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকানো চুম্বনে কোনো কামনা ছিলোনা,ছিল পবিত্র এক ভালোবাসা।পরে ঋষি আমার ঠোঁট দুটো কামড়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে কিন্তু কোনোদিনও ওই ভালোলাগা ছোঁয়নি আমার মনে।সেইদিন আমি বুঝেছিলাম তুমি আমায় ভালোবাসো,তাই যেদিন তুমি ডাকলে দেখা করতে বুঝতে পেরেছিলাম কারণটা।” একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয় অহনার হৃদয়ের গভীর থেকে।”তাই বুঝি সেদিন আসিসনি?চাসনি আমায় স্বীকার করতে?সত্যি তো তখন কি ছিল আমার?”এতদিনের জমানো অভিমান পুরোনো সম্ভাষণের সাথে বেরিয়ে আসে রাজীবের মধ্যে থেকে।হাহাকার হয়ে অহনার কানে ধরা দেয়।
একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ও বলে, “না আসতে চেয়েও আসতে পারিনি।অপরিণত আমি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলাম।আগে থেকে সব কিছু যাতে বাধাহীন থাকে সেটার চেষ্টা করতে গিয়ে শুরুর আগেই শেষ করে ফেলেছিলাম আমার প্রথম ভালোবাসা।…জাতের অহংকারে অন্ধ পিতৃসম দাদার কথার অবাধ্যতা করতে পারিনি।..ছোট থেকে যে আমায় কন্যাস্নেহে সব আবদার মিটিয়ে বড় করেছে তার আশীর্বাদ আর সম্মতি নিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম নতুন জীবনের সূচনা।..কিন্তু..কিন্তু.. অনভিজ্ঞ আমি বুঝিনি কত বোকা কাজ করতে চলেছি।..পরে তাও বৌমনি তোমার কথা সব শুনে দাদাকে উপেক্ষা করতে বলেছিল।কিন্তু আমি পারিনি।আমার এক দুর্বলতার জন্যে আর এক দুর্বলতাকে ত্যাগ করতে পারিনি।এমনকি তার আড়ালে সম্পর্ক রেখে সময়টা কাটিয়ে সঠিক সময়ে অপেক্ষাও করতে চাইনি।দাদাভাই কে কষ্ট দিতে চাইনি”।…”কিন্তু আজ কি হলো জানো রাজীবদা??আমার সেই দাদা যখন জানলো আমি তোমার বাড়িতে এসে উঠেছি,সত্যিটা জানার চেষ্টা না করে আমায় কত সহজে চারিত্রাহিনা বানিয়ে দিলো।বলে দিল তোমার সাথে এতদিন সম্পর্ক রেখে তাকে ঠকিয়েছি।সেই কারণে সংসার ভেঙে বেরিয়ে এসেছি।..কিন্তু না।বার বার আমার দাদা কে তো আমি জিততে দিতে পারিনা।আগেরবার আমার ভালোবাসাকে হারিয়ে দাদাভাইকে জিতিয়ে দিয়েছিলাম,এবার মিথ্যে কলঙ্কের বোঝা নিয়ে নিজের সম্মানকে হারিয়ে ওকে জিততে দেবনা।তাই যে লড়াইটা একা শুরু করেছিলাম,সেটা একাই লড়বো যতদিন বাঁচবো।তুমি কেন,কাউকেই সাথে নেবনা।”
“মানে?বাঁচবি কিকরে তুই?”রাজীব যেন বিশ্বাস করতে পারেনা অহনার কথাকে।”যদি তোমার বাড়ি না এসে অন্য কোথাও যেতাম,যেভাবে বাঁচার লড়াই করতাম সেই ভাবে।বললাম না কাল রুক্মিণীর সঙ্গে যাবো।কাল থেকে শুরু হবে আমার প্রকৃত লড়াই।আমার এখন দরকার একটা আশ্রয় আর দুবেলা খাবার।কোন প্রাইভেট জব করে লেডিস হোস্টেলে থেকেও করা যায় সেটা,কিন্তু প্রাইভেটে চাকরি আমার দ্বারা হবেনা।আমি সেই মেটেরিয়াল নই।রুক্মিণীর কাছে শুনেছি ও যে এন.জি.ও তে আছে তারা শুধু মেয়েদের জন্যে কাজ করে।দুঃস্থ মেয়ে,বউ দের অর্থোপার্জনের পথ দেখায়,পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের মূল স্রোতে ফেরায়,অনাথ মেয়েদের আশ্রয় দিয়ে শিক্ষা,খাদ্যের ব্যবস্থা করে।আর এই মেয়ে গুলোর দেখাশোনা করে শিক্ষিত আশ্রয়হীন মেয়েরা।…আমি ওদের মতোই এখন আশ্রয়হীন।আমি যাব,কথা বলবো।যদি ওরাও মুখ ফিরিয়ে নেয় জানিনা কি করবো।ওরা সাহায্য করলে ধীরে ধীরে জীবনটা গুছোবার চেষ্টা করবো।আমার তো কোনো পিছুটান নেই,সাহায্যকারী ভালোবাসার জন বলতে আছে বৌমনি।ওকে বলবো আমার কোয়ালিফিকেশন এর যা কিছু দরকারি..রেজাল্ট, সার্টিফিকেট..ঋষির বাড়ি থেকে এনে দিতে,আর এনে দিতে আমার মায়ের গয়না।….ফিরতে আমাকে হবেই নিজের জীবনে,লড়াইটা একাই করতে হবে।ঋষির কাছে ডিভোর্স চাওয়ার ইচ্ছা নেই,কিন্তু ও চাইলে আটকাবো না,দিয়ে দেব।”এতক্ষন নিজের মনে কথা গুলো বলার পর ও রাজীবের দিকে ফেরে।স্মিত হেসে বলে,”তোমায় কেন সব বললাম বলো তো?!!”একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে রাজীব বলে,”জানিনা।হয়তো বোঝাতে তোর জীবনে আমার আর কোনো দরকার নেই।হয়তো অনুভব করাতে আমি একজন আউট-সাইডার।জানি না।কিন্তু কি জানিস জীবন সিনেমা নয়,তুই যেভাবে বলবি সব অত সহজ হবে কি?একা মেয়ে জীবনের প্রতি পদে ধাক্কা খায়।সবচেয়ে ঝামেলা আমাদের মধ্যবিত্তদের।যারা একদম নিম্নবিত্ত তাদের মেয়েরা স্বামীদের খুব সহজে ছাড়তে পারে,তারপর কিছু না হোক বাড়ি বাড়ি কাজ করে জীবন কাটিয়ে দেয়।উচ্চবিত্তদের কাছে ও এগুলো কোনো ব্যাপার না,মরি আমরা মধ্যবিত্তরা।…যাইহোক,তুই যাতে ভালো থাকবি সেটাই কর।কিন্তু তুই আমায় ভালো আজও বাসিস,জানিনা ঋষিকে ভালোবেসেছিলিস কিনা?কারণ আমি বিশ্বাস করিনা কোনো বিশেষ জায়গায় একজন থাকলে আর একজনকেও জায়গা দেওয়া যায়।সেই কারণেই আমি বিয়ের কথা ভাবিনি…আর একটা জীবন নষ্ট করে সংসার খেলা খেলতে পারবোনা বলে।আমায় তুই মনের ওই গোপন কুঠুরিতে বন্ধ রেখেছিলি সব স্মৃতি সহ।নাহলে প্রথম ছোঁয়ার কথা মনে থাকতোনা আজও”।….”আচ্ছা অহনা মানুষ কি সত্যি যান্ত্রিক নিয়মে বেঁচে থাকে?হৃদপিন্ড পাম্প করে,ব্রেইন চালনা করে,অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিজেদের কাজ করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে? তাহলে মন কি?এত সহজে কি অল-কন্ট্রোল-ডিলিট টিপে মনের মেমোরি উড়িয়ে দেওয়া যায়?বিশেষ করে যাকে মন থেকে ভালোবেসেছিলি?হ্যাঁ মনে বন্ধ রেখে অন্য কাউকে সাময়িক জায়গা দিতে পারবি, ভালোবাসার চেষ্টা করতে পারবি,তারজন্য হয়তো…নিজের শরীরটাও দিতে পারবি, কিন্তু ভালোবাসা না থাকলে একদিন না একদিন ক্লান্তি আসবেই শরীরে আর মনে।সুখী হতে পারবিনা।আর সুখী না হয়ে ভালো থাকতে চাওয়ার জন্যে কি অভিনয় করতে হয়না?হয়তো ঋষি তোকে বুঝলে,অনুভব করলে,শরীরের সাথে মনটাও ছুঁলে ওই বন্ধ কুঠুরির আড়ালে আমি পুরোপুরি হারিয়ে যেতাম,কিন্তু ও পারেনি তাই আমিও রয়ে গেছি।”অহনা চুপ করে থাকে।ও চায় রাজীব ওকে ভুলে যাক।ও ভাগ্যদোষে রাজীবের বাড়িতে এসেছে এই সত্যিটাই বেঁচে থাকুক।যারা বিনা কারণে ওকে কলঙ্ক দিচ্ছে তারা লজ্জা পাক।সত্যি মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।আজ ও রাজীবের বন্ধনে জড়িয়ে পড়লে ঋষি নয়,ও ছোট হবে।যে প্রকৃত কারণে ও সংসার ছেড়েছে তা মিথ্যের আড়ালে হারিয়ে যাবে।রাজীবকে গ্রহণ করা এই মুহূর্তে খুব সহজ সমাধান,কিন্তু সেটার ভীত পুরোটাই মিথ্যে।আর কেউ বলতে পারেনা,যে কারণে ও ঋষির কাছ থেকে চলে এসেছে,সেইভুল বোঝাবুঝি অন্য রূপ ধরে ওর আর রাজীবের মধ্যেও আসবেনা।অহনা ক্লান্ত হয়ে গেছে অশান্তির পরিবেশে।ও শান্তি চায়, তাই একার জীবন বেছে নিয়েছে অনেক ভেবে চিন্তে।তাছাড়া এতদিন অলস দুপুরে বা সুন্দর বিকেলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কখনো কখনো রাজীব মনের আয়নায় উঁকি দিলেও সত্যি করেই অশান্তির রাতে তো সে কোনোদিনও আসেনি।মন থেকেই অহনা ত্যাগ করেছিল ওকে।আজ অবস্থার দুর্বিপাকে, নিজের ভাগ্যের ফেরে এখানে এসে পড়েছে তাই,নাহলে…যাইহোক অনেক চিন্তা করেই অহনা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।তাই কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,”আগেরবারের মতো এবারও নাবলে হারিয়ে যেতে মন চাইলো না।সেদিনের ওই ডাইরিটা জুড়ে ছিলে শুধুই তুমি,কিন্তু আজ ওই ডাইরি টাও নেই।আসলে মনের মধ্যে চিন্তা গুলো এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল,কোনো কাউকে বলে সেগুলোকে সিদ্ধান্তে রূপ দেওয়ার খুব দরকার ছিল।তোমায় একটা অনুরোধ করবো রাজীবদা?”রাজীব চুপ করে থাকে।জানে অহনা উত্তর না পেলেও অনুরোধটা করবেই।রাজীবকে চুপ থাকতে দেখে সত্যি অহনা আবার বলে,”বিয়ে করো।শুধু শুধু কদিনের স্মৃতি আঁকড়ে সারাটা জীবন কাটিও না।তুমিও কষ্ট পাবে,আর সত্যিটা জেনে আমিও ভবিষ্যতে সুখী হতে পারবোনা।আমাদের দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে এটা বিশ্বাস করো।তুমি না বিয়ে করলে রুক্মিণীও বিয়ে করবে না।দাদা কে বোন কতটা ভালোবাসতে পারে আমি বুঝি।তোমার একাকিত্বের সঙ্গী হয়ে থাকবে বলে ওর এই সিদ্ধান্ত।ওর আদর্শ যে তুমি।বিয়ে হলে কেমন বর, শ্বশুরবাড়ি হবে,তোমার ভবিষ্যতে যদি দরকারে ও আসতে না পারে…তাই ওর নিজেও জীবনটা এরকমই রেখে দেবে পাগলিটা।অন্তত ওর মুখ চেয়ে বিয়ে করো।…”,রাজীব এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পরে। “তোর পুরো রাতের ঘুমটা নষ্ট করলাম।রাত প্রায় শেষ হতে চললো।তোর হাসব্যান্ডের কাছে ফিরলেও আমার কথা বলিসনা কোনোদিন অহনা।না বুঝে তোকে কলঙ্ক দিলে আমারও গায়ে লাগবে।দরজাটা দিয়ে শুয়ে পর।আমি এলাম।” অহনার কথাটাকে গুরুত্বহীন করে দিতে চায় রাজীব।দরজার দিকে এগিয়ে যায় ও। দরজার ছিটকিনি খোলার আগের মুহূর্তে অহনার দিকে আর একবার ঘোরে শেষবারের মতো,”তোর বালিশের পাশে রাখা ওই ডাইরিটা জানিনা বিয়ের পরের দুবছর কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি!!ওটা সেই ডাইরিটা আমি জানি।যেদিন ওটা পুড়িয়ে দিবি আর আমি জানতে পারবো সেদিন তোকে স্মৃতিতেও দাবি করবোনা।এতদিন তোর অপেক্ষা না করেই তোকে মনের মধ্যে আগলে ভালোবেসেছি।কিন্তু এরপর থেকে তোর অপেক্ষা করবো।এ জন্মে নাহোক পরের জন্মে নিশ্চই আমায় জায়গা দিবি তোর জীবনে।শুভেচ্ছা রইলো তোর আগামী জীবনের,সফল হ তুই।শান্তিতে কাটা বাকি জীবন।আমি দূর থেকেই নাহয় তোর ভালো চাইবো।…আর রুকু যাকে ভালোবাসে সেই ছেলেটি হিন্দু না,তাই মা বাবার মত পাবেনা বলে ও বিয়ে করেনি।ওর দাদা চেয়েছিল বিয়ে দিতে,কিন্তু ও বাবা মার শেষ বয়সে আঘাত দিতে চায়নি।…জানিস অহনা ভালোবাসা এরকমই।যখন জীবনে আসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়,বাস্তবের চিন্তা করার সময়টুকুও দেয়না।তুই ভালো থাক।তবে আমি সবসময় আছি এটা মনে রাখিস।” আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায় প্রেমিক রাজীব বোস, যার ভালোবাসা সত্যি অমূল্য।কিন্তু অসহায় নারীটি তার সেই বাড়ানো হাত আজ ছুঁতে পারেনা।ও এই পবিত্র প্রেমটাকে কলঙ্কের আগুনে কিছুতেই পোড়াতে চায়না।বিছানা ছেড়ে নেমে এসে দরজা বন্ধ করে…বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে কেঁদে ফেলে অহনা।রাজীবের স্মৃতিতে ভরানো ডাইরিটা কিছুতেই ও বিয়ের আগে নষ্ট করতে পারেনি,রেখে এসেছিল বৌমনির কাছে।আজ বৌমনি ওটা দিয়ে গেছে।হয়তো আগের জন্মে শ্রীলেখা ওর নিজের বড় দিদি ছিল।ও জানতে এসেছিল অহনার মন,যখন বুঝলো ওই মনে কোথায় আজ ঋষি নেই তখন এটা ওকে জোর করেই দিয়ে গেল।বিছানার কাছে এসে ডাইরিটা বুকে নিয়ে কেঁদে ফেলে আবার,জড়িয়ে ধরে ওর জীবনের একমাত্র সুন্দর ভালোবাসার স্মৃতিটা কে।
“মিস গাঙ্গুলী আমাদের এখানে বাচ্ছা মেয়ে গুলোর দেখাশোনার জন্যে সত্যি একজন অনুভূতিসম্পন্ন মহিলার এই মুহূর্তে খুব দরকার।ওদের মানসিক বিকাশে যিনি সাহায্য করবেন,বলতে পারেন আমরা যেরকম মহিলা খুঁজছিলাম আপনি একদম পারফেক্ট।আপনি চাইলে আজ থেকেই জয়েন করতে পারেন,কিন্তু আপনার কোয়ালিফিকেশন সার্টিফিকেট গুলো তো লাগবে।আপনি তো বলছেন ওগুলো এই মুহূর্তে নেই।তাই আরকি…”,কিন্তু কিন্তু করলেও অহনাকে বেশ পছন্দ হয় রুক্মিণী দের এন.জি.ও “দুর্গা”র চেয়ারম্যান মিসেস দাশগুপ্তর।”ম্যাম ওকে আপনি চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পারেন।কাল পরশু মধ্যেই ওর সার্টিফিকেট গুলো পৌঁছে যাবে।যদি অসুবিধা না থাকে ওকে আজ থেকেই ওর কাজ বুঝিয়ে দিতে পারেন।ও তাহলে আজ শিফট করতেও পারবে।ওর শরীরটা সামান্য দুর্বল,ঠিক করে খাওয়াদাওয়া না করে।তাই আমি চাইছিলাম ও আর দুদিন বিশ্রাম নিক,কিন্তু ও চাইছে আজ থেকেই শুরু করতে ওর নতুন জীবন।আর সার্টিফিকেট নিয়ে ভাববেন না।আমি ওগুলো কাল বা পরশু পৌঁছে দেব ওর কাছে।”রুক্মিণী অহনার হয়ে বলে।মিসেস দাশগুপ্ত একটু চিন্তা করে বলেন,”আজ দিনটা একটু সময় দাও রুক্মিণী।উনি যে ঘরটায় থাকবেন সেটা একটু পরিষ্কার করাতে হবে।আজ সারাদিনে রেডি হয়ে যাবে।কাল বিকেলে উনি আরামসে শিফট করতে পারবেন।আর শুধু তুমি এনেছ বলে নয়,ওনার মুখ দেখেও ওনাকে ভরসা করা যায়”।…”একটা কথা মিস গাঙ্গুলী…”।উনি রুক্মিণীর দিক থেকে অহনার দিকে ফেরেন কিছু বলতে,কিন্তু অহনার কথায় বাধা পান।”সরি ম্যাডাম আপনাকে বাধা দিলাম বলে,কিন্তু আমি মিসেস মুখার্জী।তবে এখন হাসব্যান্ডের সাথে মত পার্থক্য হওয়ায় চলে এসেছি,আর তাই নিজের মাথা উঁচু করে বাঁচার অবলম্বন খুঁজছি।” অহনার সত্যিকে স্বীকার করার দৃঢ়তা মিসেস দাশগুপ্তকে মুগ্ধ করে।”আমি সব জানি অহনা।আমার গল্পও বেশ কিছুটা তোমার মতোই।একটাই পার্থক্য আমার বাবা আমার সহায় ছিলেন।আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে “দুর্গা” তৈরি করেছিলেন।এখন এই সংস্থা আমার বাঁচার অবলম্বন,যা আর্থিক কারণে না,মানসিক অবলম্বন।ছাড়ো.. মিস -মিসেস এর জটিলতা থাক,তুমি শুধু অহনা হয়েই আমার “দুর্গা”র অংশ হও”।হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখা নিজের দুঃখটা একবার উঁকি মেরে যায় মিসেস দাশগুপ্তের মধ্যে।”…যা বলছিলাম এই মুহূর্তে খুব বেশি কিছু আমরা তোমায় দিতে পারবোনা।থাকা-খাওয়া আর তোমার চলার মতো হাত খরচ।হবে তো?” অহনার মনেহয় নিঃশ্বাস নেওয়াটা যেন সহজ হলো।ফাইনাল কথা মিটিয়ে ওরা যখন ফেরে তখন শেষ দুপুর।বাইরে খেয়ে এসেছিল বলে যে যার ঘরে যায় সামান্য বিশ্রাম নিতে।ঋষিকে ফোন করবে বলে অহনা রুক্মিণী কে বলে কর্ডলেস ফোনটা এনেছিলো।ঘরে রাখা চেয়ারটা জানলার কাছে টেনে এনে ওর পরিচিত নম্বরটা ডায়াল করে।বেশ কিছুটা সময় বেজে যাওয়ার পর জড়ানো গলায় ফোন তোলে ঋষি।একটু চমকে যায় অহনা।শনিবারের দুপুরে ঘুমের বদলে ল্যাপটপে কাটাতে যে পছন্দ করে তাকে ঘুমোতে শুনে।ঋষির আওয়াজে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে অহনা বলে,”আমি অহনা।”কিছুটা সময় নেওয়ার পর অহনা একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়।”বল কি দরকার?”
“সরি তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম।আসলে আমার কিছু জিনিস কাল বৌমনি আনতে যাবে,কখন গেলে সুবিধা হবে?” অহনা শান্ত গলায় বলে।”কি জিনিস?” ঋষিকে বড় আনমনা লাগে।”আমার রেজাল্ট আর সার্টিফিকেট গুলো।আর কিছু জামা কাপড়।”অহনাও মাপা উত্তর দেয়।”আমি আজ বিকেলে পৌঁছে দিয়ে আসবো দিদির বাড়ি।তুমি ওখানেই আছো?”ঋষি এই প্রথম জানতে চায় অহনার সম্বন্ধে কিছু।”না।আমি বান্ধবীর বাড়িতেই আছি।ঘুম চোখে হয়তো নম্বরটা খেয়াল করনি।”অহনা বলে।”তার মানে এখনো তুমি অন্যের বাড়ি পরে আছো।তোমার লজ্জা করছেনা।তার সংসারে কে কি বলবে ভাবছনা একবার ও?নিজের স্বামীর সংসার ছেড়ে গিয়ে অন্যের সংসারে এভাবে কেউ বোঝা হয়?”ঋষির গলায় আবার সেই আগের সুর ফিরতে থাকে।কিন্তু অহনা উত্তর দেয়না।চুপ থাকে।ইচ্ছা করেনা নতুন জীবনের সূচনার খবরটাও ওকে দিতে।ঋষির সাথে কথা বলতে গেলেই যেন মানসিক একটা ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরে।কিছুক্ষন চুপ থেকে শুধু বলে,”তাহলে বৌমনিকে বলে দিচ্ছি তুমি আজ পৌঁছে দেবে।অনেক ধন্যবাদ।এখন ফোন রাখছি।”
“শোনো অহনা।তুমি কি সত্যি আর ফিরবে না?” অচেনা স্বর যেন ধাক্কা মারে অহনার কানে।সম্পর্ক শুরুর সেই প্রথম সময়কার আওয়াজ যেন এটা।একটু আবেগ চেপে ধরতে যায় ,কিন্তু পরমুহূর্তে ও সতর্ক হয়…’না এক ভুল বারবার না’।”আপাতত না।আর আমি এখানেও থাকবোনা।একটা খুব ছোট চাকরি পেয়েছি…চলে যাবে আমার।এবার সেখানে শিফট করে যাবো।পরে যদি আর লড়তে না পারি,তখন না হয় ফেরার কথা ভাববো।..আর হ্যাঁ, যদি তোমার মনেহয় আমায় একেবারে কেটে ফেলবে…আইনি পথ নিও,আমি সই করে দেব।”
“বাব্বা!অনেক উন্নতি হয়েছে তোমার।কিছু কথা কানে এসেছে,সেগুলো তাহলে সত্যি?!!কিন্তু আমি তো ডিভোর্স দেবনা অহনা।করো করো কদিন চাকরি করে দেখো।তোমার দেখা দরকার।তোমার ঠিকানা দাও,আমি তোমার ডকুমেন্ট কুরিয়ার করে দিচ্ছি।”অহনা কে পুরোপুরি হাত ছাড়া করতে চায়না যেন ঋষি।কিন্তু অহনা সে ফাঁদে পা দেয়না।ঋষির কথা গুলোও আর মাথায় নেয়না।শুধু কঠিন স্বরে বলে,”না জামা কাপড়ও দরকার।তুমি বৌমনিকে পৌঁছে দিও।আমি বৌমনি কে ফোন করে দিচ্ছি”,আর ঋষিকে কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দেয়।এক অব্যক্ত যন্ত্রনায় বুকটা ভারী হয়ে যায়।নিজের সাজানো সংসার ছাড়ার কষ্ট ওর মনে পিন ফোটাতে থাকে।দু ফোঁটা জলকে কিছুতেই আটকাতে পারেনা ঝরে পড়তে।হঠাৎ নিজের সংসারের আনাচে কানাচের স্মৃতি মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।
“রুক্মিণী জানিনা এ জীবনে তোর ঋণ শোধ হবে কিনা।কলেজে হাই-হ্যালো তে আটকে থাকা বন্ধুত্ব যে ভবিষ্যতে এত মূল্যবান হয় সত্যি আগে ভাবিনি।হয়তো তুই সেদিন আমার ডেস্টিনি ছিলি, নাহলে তোকেই বা কেন ফোন করবো।ঋষির কাছে ফিরবো না যদি না জীবনে বিশাল কিছু পরিবর্তন হয় ওর অথবা আমার,বা ওর আমায় দরকার না পড়ে।তুই একটা রাস্তা দেখালি, এই ছাব্বিশ বছর বয়সে শুরু করে কোনো সরকারি চাকরি জোগাড় করতে পারবো কিনা জানিনা,কিন্তু চেষ্টা তো করতে পারবো।কতদিন লিখিনি,মনের আনন্দে লিখতে তো পারবো।কি বলবো বল তোকে?সারাজীবন এরকম আমরা বন্ধু থাকতে যেন পারি,আর কোনোদিনও আমার ছোট কোনো উপকার দরকার হলেও বলিস ভাই।তোর জন্যে একটা বিশেষ জায়গা রয়েই যাবে জীবনে।”রুক্মিণী দের বাড়ি ছাড়ার আগে অহনা অনেকদিন পর হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।”প্লিজ অহনা বন্ধুর জন্যেই বন্ধু করে।তুই যে দুর্বল হয়ে পিছিয়ে না এসে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাতেই আমার গর্ব হচ্ছে।এগিয়ে যা,ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছবি।যার কেউ নেই তার ভগবান আছে,আর তোর জন্যে আরো দুজন সব সময় আছে এটা জানবি।” কথা টা বলে চোখের ভাষায় রুক্মিণী বোঝায় ওর দাদার মনের ইচ্ছা ওর অজানা নয়।অহনার জন্যে ওদের মনের দরজা সব সময় খোলা।রুক্মিণী কথায় কোনো উত্তর অহনা দেয়না।আসলে ঋষির অন্যকে ছোট করে আনন্দ পাওয়ার মানসিকতা ওকে ওর থেকে দূরে এনেছে,কিন্তু ঋষি যতদিন না নিজে মুক্তি দেবে অহনার মুক্তি নেই।তাই হয়তো অন্য আর কাউকে জীবনে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা আর ওর নেই।ও জানে রাজীব আজও ওকে ততটাই ভালোবাসে।কাল মাঝরাতে যখন রাজীবের ঘর পেরিয়ে ওয়াশরুমে যাচ্ছিল ওর ঘরের বাজতে থাকা গান সেই কথাই বোঝাচ্ছিলো।থমকে গেছিল অহনা রাজীবের দরজার সামনে আয়ুব বাচ্চুর গানের কথায়, যেন মনে হচ্ছিল রাজীব ওকে বলছে….
“সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে/সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম/কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি/কিভাবে এত বদলে গেছি এই আমি/ও বুকেরই সব কষ্ট দুহাতে সরিয়ে/চল বদলে যাই…তুমি কেন বোঝনাতোমাকে ছাড়া আমি অসহায়/আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমায় ঘিরে/আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছেতুমি.. ক্ষমা করে দিও আমায়..।
কত রাত আমি কেদেছি/বুকের গভীরে কষ্ট নিয়ে/শূন্যতায় ডুবে গেছি আমি/আমাকে তুমি ফিরিয়ে নাও/তুমি কেন বোঝনা,তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়/আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমায় ঘিরে/আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছে/তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়।
যতবার ভেবেছি ভুলে যাবো/তারও বেশি মনে পড়ে যায়/ফেলে আশা সেই সব দিনগুলো/ভুলে যেতে আমি পারি না/তুমি কেন বোঝনাতোমাকে ছাড়া আমি অসহায়/আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমায় ঘিরে/আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছে/তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়।
সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে/সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম/কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি/কিভাবে এত বদলে গেছি এই আমি…”।
কিন্তু ও যে রাজীবের থেকেও বেশি অসহায়,কিকরে সেটা বোঝাবে।না আর পিছন ফিরবেনা,এগিয়ে যাবে অহনা।ও হেরে যাবেনা।রাজীব হয়তো ছিল,হয়তো আছে,হয়তো থাকবে।কিছু ঋষি এখনো আছে,এটাই রূঢ় বাস্তব।তাই একা ওকে এগোতেই হবে,ও জানে ও পারবে।যেদিন মনে হবে পারবেনা,সমাজের ভয় থাকবেনা,কলঙ্কের ভয় থাকবেনা,বা ঋষি থাকবেনা সেদিন নাহয় মন চাইলে আর রাজীব অপেক্ষা করে থাকলে ওর কাছে ফেরার কথা ভাববে।এখন কঠিন পথটাই কিছুটা চলে দেখুক না হয়।
রাজীবদের বাড়ির মেন দরজা খুলে যেদিন ওদের বাড়ি ঢুকেছিলো রাজীব কেই বাগানে দেখেছিল।আজ ওদের সেই গেট ভিতর থেকে খুলে বাইরে পা রাখার আগে রাজীবের ব্যালকনিতে তাকালো।হ্যাঁ আজ রুক্মিণীর নজর উপেক্ষা করেও রাজীব দাঁড়িয়ে আছে।একে অপরকে দেখলো,রাজীব হাত তুলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অহনাকে যখন ‘বেস্ট অফ লাক’ জানালো ওর চোখটা চিকচিক করছে,আর চোখে ছিল নতুন অপেক্ষার।অহনাও হাত তুলে ‘বাই’ জানিয়ে মুখ নামিয়ে বেরিয়ে গিয়ে রুক্মিণীর গাড়িতে উঠলো।আর সেই মুহূর্তে রাজীব পিছন ঘুরে দাঁড়ালো,নিজের চোখটা পরিষ্কার করে অস্ফুটে শুধু বললো,”ভালো থেকো অহনা”।
গানের লিরিক:আয়ুব বাচ্চু (সংগ্রহ গুগল)ছবি সংগৃহিত।
সমাপ্ত।
এই গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়ের জন্যে পাঠকদের চাহিদা অনেক দিনের।কিন্তু কোনো কোনো গল্পের সত্যি দ্বিতীয় অধ্যায় হয়না।কারণ অহনা সেই সমস্ত মেয়েদের প্রতিনিধি যারা কখনো জিতে যায় জীবনে,জেতার পরও কেউ রাজীবকে সঙ্গী করে,কেউ একা কাটিয়ে দেয় বাকি জীবন।আবার অনেক ক্ষেত্রেই দুর্ভাগ্য ফিরিয়ে নিয়ে যায় ঋষিদের কাছে,হয়তো ঋষিরা বদলে যায়,সুন্দর হয় জীবন,আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঋষিরা এক থেকে যায়,আর সেই একই যন্ত্রনা ভোগ করতে হয় অহনা দের।আমার অহনা লড়াই শুরুর যে সাহস দেখিয়েছে,এটাই গল্পের মূল কাহিনী।অহনা ঋষিকে,বা ঋষি অহনা কে ছাড়া হয়তো অসহায়।আবার রাজীব অসহায় অহনার ভালোবাসা না পেয়ে,তাকে ভুলতে না পেরে।আর গল্প এটাই।সব অহনা জয়ী হোক এই প্রার্থনা করে পাঠকদের ওপর ছাড়লাম তারা কোন অহনা কে চায় সেটা ঠিক করে নিতে।তাই গল্পটা এখানেই শেষ হলো।
9 comments
অনেকদিন পরে আবার পড়লাম। একই রকম ভালো লাগলো। 😘
অসংখ্য ধন্যবাদ।
অসাধারণ। এতটা বাস্তবতা মন ছুয়ে যায়
অনেকদিন পরে আবার পড়লাম। আগেরবারের মতোই ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল।😘
অনেক ভালোবাসা।
Osadharon
ধন্যবাদ।
Kato bar pore felechi tao valo lage
ধন্যবাদ।