(এই গল্পের চরিত্র ,ঘটনা সবই লেখিকার কল্পনাপ্রসূত।এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই)
‘উফফ সেই কখন থেকে এলার্ম টা বাজছে,বন্ধ করতে যেন হাতে ব্যাথা হয়’,বিরক্ত হতে পাশ ঘুরে অহনাকে চেঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল ঋষি।’বাব্বা এত সকালে কোথায় গেল মহারানী।সকাল ৮টার আগে যার চোখ খোলেনা সে আজ সাড়ে ৬টার প্রথম এলার্ম বাজার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে।যত নাটক!..কাল রাতে ঝগড়ার সময় বলেছিলাম না, “সারাদিন কি করো?এমনকি দুধ দেওয়ার লোক এসে বেল না দিলে তো ঘুম থেকেও ওঠো না।রোজ দেরি হওয়ার নাটক করে যাতা করে রেঁধে দাও…”,তাই হয়তো আজ তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে এক গাদা রেঁধে তার উত্তর দেবে।যত্তসব নাটুকেপনা।যা পারে করুগ্গে যাক।’ নিজের মনে মনে ভেবে আবার পাশ ঘুরে কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে শোয় ঋষি,জানে ঠিক ৯টার সময় চা এনে অহনা ওকে তুলে দেবে।অহনার ভরসায় আজ অবধি কোনোদিনও এলার্ম দেয়নি।এমনকি বিয়ের আগেও কমাস ফোন করে ঠিক তুলে দিতো,কোনোদিনও ভুল হয়নি যদিনা ঋষির নিজের ফোন কোনো কারণে অফ হয়ে যেত।আজ সেই ভরসায় আবার ঘুমিয়ে পড়লো ঋষি।
ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙল ঋষির।মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে ফোনটা নিতে গিয়ে চোখে রোদ পরে মুখটা কুঁচকে গেল।’উঁহু কটা বাজে যে এত রোদ।আর অহনাই বা ডাকেনি কেন?’চোখ বন্ধ করে ফোনটা ধরে “হ্যালো” বলতেই ওপারের হেঁড়ে গলার চিৎকারে ঘুম গেলো চটকে।”কিরে কি খবর তোর?!! না বলে কয়ে হঠাৎ ডুব…একটা ফোন তো অন্তত করে রাখবি…আজ বিকেলে ইম্পর্টেন্ট ক্লায়েন্ট মিটিং আছে,ভুলে গেছিস??সেন স্যার তো শালা….”।ঋষি মাঝপথে থামিয়ে দেয় ওর কলিগ কাম বর্তমানে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু অতিন কে।”ওয়েট ওয়েট ওয়েট!!!ডুব মারলাম মানে?!!কটা বাজে কটা?”ঋষির কথায় অতিন প্রথমে থমকে যায়।তারপর ফিসফিস করার মতো করে বলে,”ওই তুই কাল রাতে একা একা বসেছিলিস নাকি কোথাও?…কই আমায় বলিসনি তো?..তা কি নিয়েছিলিস?সাথে অন্য কেউ ছিল নাকি রে?…”অতিন উল্টোপাল্টা বকবকম শুরু করে দেয়।
ঋষি এবার বিরক্ত হয়ে বলে,”অতিন এবার গালাগালি খাবি।ভাট না বকে যা জিজ্ঞেস করছি বলনা।নাহলে ছাড় আমি দেখে নিচ্ছি।”বলে রাগ করে ফোনটা কেটে দেয়।তারপর ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে ১২.৪০।ওর নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না।তারপর বেডে বসেই চেঁচাতে থাকে,”অহনা। অহনা।অহনা…”,কিন্ত কোনো প্রত্যুত্তর পায়না।তখন নিজের মনেই গজড়াতে থাকে,’কি ভেবেছে কি নিজেকে?ডাকতে পারবেনা আগে বললেই পারতো।এভাবে নাটক করার কি দরকার ছিল?আজ এত ইম্পর্টেন্ট একটা মিটিং আছে,শুধু মাত্র ওই অবুঝদারটার জন্যে…বুঝবে কিকরে!বুঝবে কিকরে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কাজের গুরুত্ব…অভিজ্ঞতা আছে না অনুভব করার ক্ষমতা আছে…বিদ্যের দৌড় তো ওই কলেজ অবধি।আমি না বিয়ে করলে ঘর-বর ও জুটত না।’….”অহনা,ওই অহনা।ডাকছি সারা দিতে পারছোনা”।বেড ছেড়ে কিচেন ডাইনিং স্পেস সব জায়গায় ঘুরেও অহনা কে দেখতে পায়না ঋষি।’জাগগে যাক।মরুগ্গে যাক।কোথায় আর যাবে?মোল্লার দৌড় ওই মসজিদ অবধি।হয় দাদার বাড়ি গেছে নাহলে নিজের বন্ধু সুজাতার বাড়ি,আর নাহলে পাড়ার মন্দিরে।কিন্তু আমায় জানিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলোনা।অফিস থেকে ফিরে আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে,…।’নিজের মনে গজড়াতে গজড়াতে বাথরুমে ঢোকে ঋষি।সকালে এক কাপ চা না খেলে ওর মাথা ধরে যায় অহনা জানে,তাও এভাবে শোধ নিচ্ছে।যাহোক করে তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে বাইকের চাবিটা পকেটে ভরে দরজা টানতে গিয়ে থমকে যায় ঋষি।’ওহ!ডুবলিকেট চাবিটা নিতে হবে তো।কে জানে কোথায় বেশ আছে…হঠাৎ নজরে যায় চাবি ঝোলানোর জায়গায় আসল চাবির রিংটা ঝুলছে।খটকা লাগলেও ভাবার সময় নেই বলে হাত বাড়িয়ে ওটাই নিয়ে মেন দরজা লক করে বেরিয়ে যায় ঋষি।আজকের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাইয়েন্ট মিটিং টার ওপর ওর পরের বারের প্রমোশন নির্ভর করছে।তাই গাড়িতে যেতে যেতে অহনার চিন্তা টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ও।গাড়ি চালাতে চালাতে অন্যমনস্ক হওয়া উচিত না,তাও মনের মধ্যে ঝালাতে থাকে নিজের চিন্তা ভাবনা গুলো।
“তুই ভালো করে ভেবে দেখ অহনা,যা করছিস ভেবে করছিস তো?এরপর কিন্তু ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।কারণ ঋষি কতটা গোঁয়ার আমার থেকে তুই ভালো জানিস।হয়তো মুখ ফিরিয়ে নেবে একেবারে।তার ওপর তুই কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে এসেছিস বলছিস।…তুই এক কাজ কর এখন আমার এখানে চলে আয়।তারপর সামনাসামনি কথা বলে ঠিক করা যাবে সবকিছু।…”,সুজাতা যতটা পারে ভয় দেখিয়ে ,কথায় ভুলিয়ে আটকাতে চায় ওর একমাত্র বান্ধবী অহনা কে।কারণ ও অহনাকে খুব ভালো করে চেনে সেই স্কুল থেকে।এমনিতে ঠান্ডা মাথার মেয়ে কিন্তু মাথা বিগড়ে গেলেই গন্ডগোল।কিন্তু অহনা সুজাতার কথায় কোনো জবাব না দিয়ে শুধু বলে,”আমি এখন ট্রেনে উঠবো।কাছে ফোন নেই,তাই আর যোগাযোগ করতে পারবোনা।তাই আগে তোকে জানিয়ে দিলাম।যদি তোর কাছে কেউ কোনো খবর নিতে আসে,এমনকি দাদাভাইও, বলবি আমি নিজের ইচ্ছায় চলে যাচ্ছি আর ভালো থাকব।দাদাভাই কে শুধু বলিস পরে যোগাযোগ করে নেব।তোকে ওই কারণে ফোনকল টা রেকর্ড করতে বললাম,যাতে তোর কোনো সমস্যা না হয়।চল এবার রাখছি,পরে সময় মতো যোগাযোগ করে নেব,বাই”।”কিন্তু যাচ্ছিস কোথায় সেটা তো …?…”,সুজাতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অহনা রেল স্টেশনের পাবলিক বুথের ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখে।তারপর বুথের টাকা দিয়ে তাড়াতাড়ি মিশে যায় শত মানুষের ভিড়ে আর একটা সাধারণ মানুষ হয়ে,যদিও ও জানে এত তাড়ার কিছু নেই …এই মুহূর্তে ওকে খোঁজার লোকের বড়ই অভাব এই পৃথিবীতে।এমনকি ও পুরোপুরি ভাবে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলেও বেওয়ারিশ লাশ হয়েই হিম ঘরে পরে থাকবে হয়তো কিছুদিন,কেউ ওকে খুঁজেও পাবেনা।নিজের সাথে ওর পরিচয়ের কোনো কিছু নিয়েই আজ অহনা বেরোইনি।যদি নিজের কোনো ব্যবস্থা করে নিজের পরিচয়ে বাঁচার সুযোগ করতে পারে তাহলে নাহয় পুরোনো পরিচয়পত্র গুলো…।
সুজাতা মোবাইলটা হাতে নিয়ে বোকার মতো বসে থাকে,একবার ভাবে ঋষিকে ফোন করবে,পরের মূহুর্তে মনেহয় ঋষির সাথে এটাই হওয়ার ছিল।দোনামনা করতে করতে অ্যাটেন্ডেন্স খাতা টা তুলে দ্বিতীয় বর্ষের অনার্স ক্লাসের দিকে পা বাড়ায়।
‘দূর গেল কোথায়!!এতক্ষন বেল বাজাচ্ছি’,নিজের ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কোঁচকায় ঋষি।সারাদিনের বাইরের যুদ্ধে মনেই নেই সকালের কথা।হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করতে গিয়ে হাতে ঠেকে বাড়ির চাবির গোছা।মুহূর্তে মনে পড়ে যায় সবটা,আর একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় মেরুদন্ড দিয়ে।তাহলে অহনা ফেরে নি?কোথায় গেল ও?নিজেকে উদ্ভ্রান্ত লাগে।দরজা খুলে তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকে ডাইনিং টেবিলে চেয়ার টেনে বসে,জাগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খায়।পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে অহনার নম্বরই ডায়াল করে….বেজে যায়।কিন্তু রিং টোনটা তো বেডরুম থেকে আসছে,তাহলে অহনা ভিতরে আছে…ইচ্ছা করে দরজা খোলেনি।”অহনা,অহনা”,উঠে গিয়ে বেডরুমে মুখ বাড়ায়।ঘুটঘুটে অন্ধকার নয় বেডরুম,বাইরের স্ট্রিট লাইটের আলো এসে ঘরে ঢুকে হালকা আলোকিত করে রেখেছে রাতের ফ্ল্যাটের বেডরুমকে।সুইচ টিপে আলো জ্বালায় ঋষি…ফাঁকা ঘর,ওর বুকের মতোই।শরীরটা টেনে নিয়ে গিয়ে সকালের অগোছালো বিছানায় ছেড়ে দেয়।হঠাৎ কি মনে হতে অহনার দাদা কে ফোন করে..কাল ঝগড়ার সময় বলেছিল বটে,’যাওনা কোথায় গেলে এরকম রানীর মতো থাকবে।তোমাদের মতো মেয়েদের না ঘাড় ধরে রাস্তায় বের করে দিতে হয়।তবে বাস্তবটা বুঝবে।হঠাৎ দু পাঁচ পয়সা হাতে পেয়ে ভাবছো বিশাল কিছু করে ফেলেছো।আরে এই মাগগি গন্ডার বাজারে তোমার ঐ দুশো চারশো টাকা লোকে গন্ধ শুঁকে ফেলে দেবে।..নিজের বুটিকও তো না,করো তো অন্যের বুটিকে হেলপারের কাজ।নিজের করতে হলেও তো এই শর্মাকেই বলতে হবে,তারপরও এত বড় বড় ডায়লগ।… ‘
“হ্যাঁ দাদা,আমি ঋষি।ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ নম্বর তো সেভ আছে আপনার।কি করছিলেন?”ঋষি চেষ্টা করে গুছিয়ে কথা শুরু করতে,কিন্তু প্রথমেই গন্ডগোল হয়ে যায়।যদি অহনা ওদের ঝগড়ার কথা বলে থাকে নিজের দাদা কে ঋষি লজ্জায় আর কোনোদিনও ও বাড়ি যেতে পারবেনা।কিন্তু এটা ওটা বলার পরও অহনার দাদা নিলয় ওর কথা তো কিছু বলেনা। হঠাৎ নিলয়ের কথায় শীতের রাতেও ঋষির কপালে ঘামের বিন্দু ফুটে ওঠে।”আমার ছোট্ট বোনটা কি করছে ঋষি।আজকাল নিজের বৌমনির সাথেই ওর যত দরকার,দাদাভাই কেP ফোনও করেনা।এমনকি এখানে এসে রাতেও থাকেনা তোমার অসুবিধা হবে বলে।কতদিন মা মরা বোনটা কে দেখিনি।একদিন ছুটির দিনে দুজনে চলে এসো দেখি।”অন্যমনস্ক হয়ে যায় ঋষি।তারপর একটু সময় নিয়ে বলে,”দাদা আপনার কাছে অহনার বন্ধু সুজাতার নম্বর আছে?আমার এই নতুন ফোনটায় ওর নম্বরটা…”,ঋষি থেমে যায়।”হ্যাঁ হ্যাঁ দাঁড়াও দিচ্ছি।কিন্তু ওটা তো অহনার কাছেই পাবে।….ঋষি এনিথিং রং?”নিলয়ের মনে এবার সন্দেহ জাগে।ঋষি কিছুটা ভেবে নেয়,”দাদা আমায় একটু সময় দিন।সুজাতাকে ফোন করে আমি আপনাকে সব কিছু বলছি”।কম কথার লোক নিলয় মনে মনে একটু বিচলিত হলেও কথা না বাড়িয়ে সুজাতার নম্বরটা দিয়ে দেয় ঋষি কে।
শান্তিনিকেতনে অহনার কলেজের এক বন্ধু আছে,যার কথা বিশেষ কেউ জানেনা।অহনা ওকে ফোন করেছিল,সেখানেই যাবে আপাতত,সুজাতা কে ফোন করে ট্রেনে উঠে পড়ে ও।কাল রাতে ঋষির কথাগুলো ওর মাথা যেন সারারাত কুরে কুরে খেয়েছে।ঝগড়াটা আজকাল ওদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে যাচ্ছে।কোনো কারণ ছাড়া ঝগড়া।অহনা বুঝতে পারে অফিসে ঋষির কাজের অত্যধিক চাপ,কিন্তু অহনা কি করবে? ও চাকরি করুক ঋষির এটা ইচ্ছা নয়,সত্যি বলতে কি স্কুলের চাকরি ছাড়া অহনার মতো মেয়ের পক্ষে অন্য কোনো চাকরি করা হয়তো সম্ভব না।ও খুবই সাদামাটা ঘরোয়া,রান্না সেলাই এসবেই ওর ইন্টারেস্ট বেশি।কিন্তু কাল তরকারিতে একটু নুন কম লাগায় ঋষি যে কথা গুলো বললো….না আর না।নিজের পছন্দের বিয়েতে সত্যি কাউকে কিছু বলা যায়না।বিয়ের দুবছরও হয়নি সবাই বাচ্ছার জন্যে তাড়া দিচ্ছে,কিন্তু ঋষি সত্যি করেই এখনো তৈরি নয়,বেচারার হয়তো আরও বছর খানেক লাগবে।সব কিছু মিলিয়েই হয়তো ও অহনার ওপর সর্বদা বিরক্ত হয়ে থাকে।কিন্তু অহনাও আর নিতে পারছেনা।ছোটবেলায় মা বাবাকে হারালেও দাদা পিতৃস্নেহ দিয়েই মানুষ করেছে।ও কলেজে পড়তে পড়তে দশ বছরের বড় দাদা যখন বিয়ে করলো অহনা একটু ভয়ই পেয়েছিল,কিন্তু কদিনেই অনুভব করেছিল কেন দাদা এরকম মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল।ওদের শ্রী চলে যাওয়া সংসারটায় শ্রীলেখাদি যেন লক্ষ্মী ফিরিয়ে এনেছিলো,সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল অহনার।সেই বৌমনির দূর সম্পর্কের ভাই ঋষি,নিজের বাবা মা পরিবার ছেড়ে কলকাতায় একা চাকরি করতো।তাই সম্পর্ক দানা বাঁধার সাথে সাথেই ওদের চার হাত এক হয়ে যায় অহনার এম.এ ফাইনাল পরীক্ষার পর ।ঋষি প্রথম অহনাকে বলেছিল নিজের ভালোবাসার কথা।সকলের সাথে খুব সহজে মিশে যাওয়া অহনার ছেলে মেয়ে সব রকম বন্ধু ছিল,কিন্তু বেশির ভাগের কাছেই বন্ধু অহনা ছিল বেশি প্রিয়,তাই ঋষির আগে জীবনে প্রেম সেইভাবে আসেনি,হয়তো নীরব কোনো গুণমুগ্ধকারী থেকে থাকবে অহনা জানার চেষ্টা করেনি।বৌমনির ভাই এর সাথেও ও বন্ধুর মতোই ব্যবহার করতো, তাই দুর্গা পূজার দশমীর রাতে ঋষির প্রপোসটা অহনার কাছে অপ্রত্যাশিতই ছিল।হাওড়া থেকে ছাড়া শহীদ এক্সপ্রেসের জানলার ধারে বসে অতীত ভিড় করে আসতে লাগলো অহনার চোখে,আর চোখটা ঝাপসা করে দিতে লাগলো বারবার।ঋষির মধ্যে সেদিন যে আকুলতা দেখেছিল অহনা কোনো দিন সেটা আশাও করেনি।ও ভাবেনি ও নিজে ভালোবেসে বিয়ে করবে।”প্লিজ অহনা একটা সুযোগ দাও।কোনোদিনও কোনো অভিযোগের সুযোগ পাবেনা।আমি আগে কোনোদিনও কারোর জন্যে এভাবে অনুভব করিনি।”বিশ্বাস করেছিল অহনা,সত্যি বলতে কি বিয়ের মাস ছয় পর অবধিও মনে হয়েছিলো বিশ্বাস করে ভুল করেনি,কিন্তু সমস্যা শুরু হলো তারপর থেকে।অহনার আগে ঋষির একমাত্র প্রেম ছিল পাহাড়।কিন্তু বিয়ের পর বেড়ানো,ট্রেকিং সব অনেক কমে গেল।প্রথম ছমাস নতুন বউয়ের গায়ের গন্ধ পাহাড়ের গন্ধ কে ভুলিয়ে রেখেছিল,কিন্তু তারপর পাহাড়ের টানে ঋষি পাগল হয়ে উঠলো।নিজের বাবা মার কাছে অহনা কে রেখে বিয়ের পর প্রথম পুজোয় ঋষি বেড়িয়ে পড়লো নেশার টানে।দুটো ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের মধ্যে শুরু হল জীবনের টানাপোড়েন।”কি চাই কি তোমার অহনা।কিসের এত না পাওয়া তোমার জীবনে?না চাইতেই এত কিছু পেয়ে গিয়ে তোমার সমস্যা।…”,ঋষি নিজের কথা শেষ করতে পারেনা।
“না চাইতে পেয়েছি?!!কি পেয়েছি?বিয়ের পর প্রথম পুজো…তুমি একা বেড়াতে চলে গেলে।আমি কি চাই একবারও জিজ্ঞেস করেছিলে?…তুমি না বলেছিলে কোনো অভিযোগের সুযোগ দেবেনা।তুমি…”,এবার অহনার কথা হারিয়ে যায়।
“সেই এক কথা।কিকরে জানবো তোমায় সব বিষয় এত অভিযোগ।কেন তুমি জানতে না আমি ট্রেকিং করতে ভালোবাসি,পাহাড় আমার প্রথম প্রেম….তাহলে সমস্যা কোথায়?আর প্রথম পুজো আবার কি..তুমি তো গ্রামের পুজো দেখতে চেয়েছিলে, মা বাবার কাছে থাকতে চেয়েছিলে।তোমায় একা কলকাতায় রেখে যাওয়া,ছুটি পাওয়া সব মিলিয়ে পুজোর সময়টা ঠিকঠাক মনে হয়েছিল,তাও সপ্তমীর দিন বেরিয়েছিলাম।”…এভাবেই অহনা আর ঋষি একে অপরকে ভুল বুঝতে বুঝতে দূরে সরতে থাকে।তবে ঝগড়া হয়েছে ,এক দুদিনে মিটেও গেছে এতদিন।সব ঠিক হওয়ার পর ঋষি বলেছে,”তুমি কথা না বললে কিছু ভালো লাগেনা।সারাদিন কাজে মন বসাতে পারিনা।কেন বোঝোনা আমি একটু অবুঝ।তুমি তো আমার থেকে বেশি সমঝদার,তুমি একটু মানিয়ে চলো।আমি তোমায় ছাড়া সত্যি অসহায়”,বলে অভিমানী অহনাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে ভেসে গেছে সেই রাতে,অথবা দিনেই।কিন্তু শেষ কিছু মাস নিজেকে ব্যস্ত রাখতে অহনা একটা লোকাল বুটিকের সাথে কাজ করছিল টুকটাক।অহনার কাজও ওদের খুব পছন্দ ছিল।আর ওই কাজের জন্যেই ওর সেলাই এর হাতেখড়ি যার কাছে সেই বৌমনির কাছে দরকারে অদরকারে ছুটতে হতো,আর ঋষির তাতেই ছিল আপত্তি…বিয়ের পর দাদার বাড়ি ওতো যাওয়ার কি আছে?!!অহনা জানেনা আর অন্য শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর মতো ঋষিও কেন ওরকম ব্যবহার করতো।এসব চিন্তার মাঝেই ট্রেন পৌঁছে যায় শান্তিনিকেতন স্টেশনে।ট্রেন থেকে সবার শেষে ধীরে ধীরে নামে অহনা,স্টেশনের বাইরে এসে একটা রিকশায় উঠে বলে, “প্রফেসর রাজীব বোস এর বাড়ি চেনো ভাই?রতন পল্লিতে থাকেন।”এর বেশি এই মুহূর্তে অহনার মনে পড়ছেনা,না চিনতে পারলে ঠিকানা লেখা কাগজটা বের করতে হবে ডিটেইলস এর জন্যে।কিন্তু কাজ হলো।রিক্সাওয়ালা সৌভাগ্যবশত বেশ কিছুদিনের পুরোনো বাসিন্দা প্রফেসর কে চিনতে পারে।দিদিমণি স্যারের অতিথি বুঝে যত্ন করে পৌঁছে দেয় রতন পল্লী রাজীব বোসের বাড়িতে।রিকশা থেকে নেমে নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখে লেখা ‘প্রতিচী’,খুব একটা অবাক হয়না সাহিত্যের ছাত্রী অহনা।মেইনগেট খুলে ঢুকতে লনের পাতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ভীষণ চেনা এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক,আর ভিতর থেকে একমুখ হাসি নিয়ে বেরিয়ে এল রুক্মিণী,ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো অহনা কে।কিন্তু অহনা তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওই ভদ্রলোকের দিকে….রাজীব…রাজীব বোস,ওদের থেকে দুবছরের সিনিয়র বাংলায় ওদের কলেজ টপার।তার সাথে রুক্মিণীর কি সম্পর্ক?!!!ভাবতে থাকে অহনা..কলেজের ভালো বন্ধু না হয়েও দুবছর আগে ফেসবুকে রুক্মিণী যেচে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় অহনা কে,তারপর ফেসবুকের মাধ্যমেই কলেজের ক্লাস মেট খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায় একদিন।কিন্তু ওর প্রোফাইলে কোনোদিনও রাজীবের কোনো ফটো দেখেছে বলে মনে পড়েনা।অবিবাহিত রুক্মিণী মা বাবার সাথে থাকে…ও হ্যাঁ ওর একজন দাদা ও আছে বলেছিল।তাহলে রাজীব???!!
অনেক কিছু মনে পরে যাচ্ছে অহনার।কিন্তু ওতো এভাবে রাজীব এর মুখোমুখি হতে চাইনি,আর আগেও সেই কারণে ওর থেকে পালিয়ে সরে গেছিল।রাত জাগা…এতটা আসা… তারপর এত বড় একটা সত্যি জানার পর অহনার পা গুলো দুর্বল লাগলো হঠাৎ,মাথা টা ঘুরে গেল।পরে যেত,কিন্তু শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরে রুক্মিণী ধরে নিলো।
সুজাতার সাথে কথা বলার পর ঋষির শরীরটা যেন দুর্বল হয়ে পরে।কোথায় খুঁজবে ও ওর অহনা কে।ইদানীং ঋষি একটু বেশি রাফ হয়ে গেছে,কথায় কথায় রেগে যায়।গতকাল সত্যি ও যা মুখে এসেছে বলেছে অহনা কে।ভাবেওনি কি বলছে।আবার এটাও ভাবেনি তার পরিণাম এতটা ভয়ঙ্কর হবে।অহনা শেষ দিকে চুপ করে গেছিল,আর ঋষি সেটাকেই নিজের জয় ভেবে মনে মনে উল্লাস করতে করতে ঘুমিয়ে যায়।সব জায়গায় হারতে হারতে অহনার কাছে জেতার জন্যে ও যেন মরিয়া হয়ে যায়।এখন ও বুঝতে পারছে অহনা ওকে পুরোপুরি হারাবে বলেই তখন জিতিয়ে দিয়েছিল।অহনা স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেছে।কে কি বলবে সেসব নিয়ে ঋষি মাথাও ঘামায়না।কিন্তু ও অহনাকে ছেড়ে কিকরে থাকবে।আজ তিন বছর অহনা ওকে চেনে কিন্তু কেন ওকে বুঝতে পারলোনা,কেন বুঝলনা ওর মুখ আর মন এক নয়।অবশ্য সত্যি ও সীমা ছাড়িয়ে গেছিল কালকে।ওর যে আজকাল কি হচ্ছে?কোথায় থামতে হবে ভুলে যাচ্ছে…অর্থহীন বকছে।যদি অহনা সত্যি হারিয়ে যায়,বাঁচতে পারবে তো ঋষি!রোজকার সাংসারিক চাওয়া পাওয়ার যুদ্ধের সাথে কখন ওদের ভালোবাসাটা বদলে যুদ্ধ হয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি।কিন্তু তার এমন পরিনতি হবে ঋষি সকালেও ভাবেনি।এখন আফসোস হচ্ছে কেন সকালেই অহনা কে খুঁজে দেখলনা?কেন ওকে হারিয়ে যেতে দিলো?সুজাতার কথার টোনে ওর প্রতি বিদ্বেষ প্রতি মুহূর্তে প্রকাশ পাচ্ছিল।ও যেন ঋষির ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল।
সকাল থেকে কিছু না খেয়ে দুপুরে একটা শুধু দোসা খেয়েছিল,ভেবেছিল রাতে ফিরে অহনার হাতের রান্না খেলে সব খিদে চলে যাবে।আসলে ও অহনাকে বড্ড বেশি সাধারণ করে ফেলেছিল।কাল রাতে খাবার টেবিলে নাটকটা যে ওই শুরু করেছিল আবার মনে পড়ে গেল ঋষির।ও বালিশে নিজের মুখটা গুঁজে দিলো।অহনা ভেবে প্রানপনে জড়িয়ে ধরলো পাশবালিশ টা কে।ভেবেছিল আজ ঝগড়া মিটবে আর এভাবেই অহনাকে আঁকড়ে প্রতিবারের মতো ও হারিয়ে যাবে ওর উষ্ণতায়।উফফ!!আর ভাবতে পারছেনা…কিভাবে কোথা থেকে খুঁজে বের করবে নিজে থেকে হারিয়ে যাওয়া একজন কে?!!খুঁজে পেলেও ফিরবে তো অহনা ওর কাছে?আজ রাত টা দেখতে চায় ঋষি…কিন্তু এত বড় বিছানা,এই ঘর সব যেন নিজেরাও নিঃসঙ্গ হয়ে গিলতে আসে একাকী ঋষিকে।চোখ বুঝে ফেলে ও…
ক্রমশ…
8 comments
শুধু গল্প মাত্র নয়, জীবনদর্শন।
ধন্যবাদ।
Tumi keno bojho na 3rd part?
প্রকাশিত।
Khub bhalo
ধন্যবাদ।
ভীষণ ভালো লাগলো
ধন্যবাদ।