রজতের ফোনটা তখন থেকে বাজছে কেন যে ধরছে না’,ঘুমের ঘোরের মধ্যে প্রিয়া বিরক্ত হয়ে সবে রজতকে ঠেলতে যাবে ফোনটা কেটে দেয় রজত ঘুমের মধ্যেই। সারাদিনের এই দৌড়ে চলা জীবনে এত রাতের ফোন কল গুলো যেন বেঁচে থাকা জীবনরস শুষে নেবে মনেহয়। তাই যত দরকারী ফোন কল হোক না কেন রজত এগুলো ধরেনা। অন্যদিন ফোনটা সাইলেন্ট করে দেয় ঘুমোতে যাওয়ার সময়,আজ প্রিয়ার সাথে কথা কাটাকাটির মাঝে খেয়াল ছিল না। ঘুমের ঘোরের মধ্যে একচোখ অল্প খুলে ফোনের স্ক্রিনে দেখে রাত তিনটে দশ বাজে। ফোনটা সাইলেন্ট করবে বলে আনলক করতে যাওয়ার আগেই আবার বাজতে থাকে ফোনটা। তাড়াহুড়ো করে ফোনটা কাটতে গিয়ে রিসিভই করে ফেলে ও।
গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলে,”হ্যালো”,পাশে তখন প্রিয়া বিরক্তির শব্দ করছে।
“মিস্টার রজত রায় বলছেন? আমি কলকাতা থেকে সার্জেন্ট স্বরূপ ঘোষ বলছি। আপনি সৃজিত রায়ের দাদা হন?” এক সিরিয়াস অচেনা গলার স্বর শুনতে পায় রজত।
“হ্যাঁ আমি সৃজিত রায়ের দাদা আন্ধেরি, মুম্বাই থেকে বলছি”,ঘুমের ঘোর কিছুটা হলেও পাতলা হয় রজতের।
“আপনার ভাইয়ের ভয়ঙ্কর এক এক্সিডেন্ট হয়েছে। ওঁকে আপাতত কলকাতা হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওঁর ফোনের ডায়াল লিস্ট থেকে আপনার নামের এন্ট্রি পেয়ে আপনাকে ফোন করছি…”,বাকি কথা কানে ঢোকেনা রজতের।
প্রিয়াও ইতিমধ্যে উঠে বসে সৃজিতের নাম কানে যাওয়ায়। ওর দেওর এমনিও খুব শান্ত শিষ্ট না,ওর দাদার একদম উল্টো। বদ সঙ্গে পরে বখে যাচ্ছিল বলে শ্বশুর মশাই পড়াশোনা শেষ করার আগেই নিজের ব্যবসায় বসিয়ে দেন।
বুদ্ধি কম কোনোদিনই ওর ছিলোনা,ফলে নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বাবার এক্সপোর্ট ইমপোর্ট এর ব্যবসা কে আজ আরো উঁচুতে নিয়ে গেছে। কিন্তু গতবছর রজতের বাবা মারা যাওয়ার পর পুরোনো বন্ধুরা আবার ওর জীবনে এসে ঢুকেছে। রজত অনেক বুঝিয়েছে,কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ যে হয়নি আজকের ঘটনাই তার প্রমান।
রজত পুলিশ ইন্সপেক্টরের ফোন কেটে আবার কাউকে এটা ফোন করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রিয়া এবার বিরক্ত হয়ে বলে,”কার ফোন ছিল? এত রাতে সৃজিতের নাম করে কে কী বলছিল?”
“সৃজিতের একসিডেন্ট হয়েছে। দাঁড়াও মানসকে ফোন করছি। যদি ও এখন কলকাতায় ওর পিজি তে থাকে। বাবা তো চলে গেছে, সমস্ত দায় চাপিয়ে গেছে আমার ওপর। একে এই ফালতু একটা কোম্পানিতে ফেঁসে আছি,তারওপর সৃজিতের নিত্যনতুন সমস্যা। আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাবো। এই উইকেন্ডে ভেবেছিলাম একটু রিল্যাক্স করবো,তা নয় আবার ছোটো কলকাতা”,রজত ফোনে নিজের মামাতো ভাইকে ধরার চেষ্টা করতে করতে নিজের মনে বকতে থাকে।
প্রিয়া কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়ে আবার। ওর বিয়ে হয়েছে ছ’বছর হলো। প্রথম এক বছর ও কলকাতার বাড়িতেই ছিল। ও আর রজত তখন এক কোম্পানিতে কলকাতা অফিসে কাজ করতো। শাশুড়ি অনেক আগেই মারা যান,সৃজিতের বয়স তখন পাঁচ বছর আর রজতের চোদ্দো। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবা দাদার অত্যধিক প্রশয়ে যে সৃজিত এরকম হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। যতই সম্পর্কে একটা দূরত্ব থাকুক,প্রিয়ার চিন্তা হতে থাকে দেওরের জন্য।
“…হ্যাঁ রজতদা মারাত্মক একসিডেন্ট হয়েছে। তুমি কাল চলে এসো। ডাক্তার বাহাত্তর ঘন্টা সময় দিয়েছে। ও যে স্পট ডেড হয়নি,এটাই আশ্চর্যের ! ওর নতুন কেনা বাইকটার যা অবস্থা হয়েছে…ওর মাথায় তো একটা ইনজুরি আছেই,কিন্তু স্পাইনেও মারাত্মক আঘাত লেগেছে। তুমি কিন্তু বেশ কিছুদিন হাতে নিয়ে এসো”,রজতের ছোটমামার ছেলে মানস যথেষ্ট উত্তেজিত স্বরে কথাগুলো বলে।
“আমি এখন এয়ারপোর্টে বেরোনোর জন্যেই তৈরি হচ্ছি। কিন্তু সৃজিত বাইকে একসিডেন্ট করেছে!! ও বাইক কবে কিনলো? ওর তো গাড়ির শখ ছিল বলেই জানি”,ভাইয়ের সাথে ইদানীংকালে খুব দরকার ছাড়া কথা একদম ই হতো না রজতের,তাই তার শখ বদলানোর খবরও ওর কাছে ছিলোনা।
হঠাৎ প্রিয়া পাশ থেকে বললো,”সৃজিত একটা রয়্যাল এনফিল্ড নিয়েছে লাস্ট উইক,আর আরও একটা বাইক,কী যেন নাম…উমমম…হ্যাঁ প্রবাবলি ট্রিমফ এর বাইক বুক করেছে…সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট দিয়েছিল লাস্ট উইক”।
“কই কিছু বলোনি তো?” রজত ফোন কানে ধরেই বলে।
প্রিয়া ভ্রু তুলে ঘাড় নাড়িয়ে বলে,”এই কথাটা আলাদা করে বলার কী আছে? আমি ভেবেছিলাম তুমি দেখেছো বা সৃজিত তোমায় বলেছে”।
রজত প্রিয়া কে কিছু না বলে প্রশান্তকে বলে,”ঠিক আছে প্রশান্ত,তুই একটু দেখে রাখ আমি যতক্ষন না পৌঁছছি। আমি বিকেলের মধ্যে পৌছে যাব। মর্নিং কোনো ফ্লাইটে টিকিট পেলাম না।এখন রাখছি।দশটা অবধি আমার ফোন হয়তো অ্যাভেইলেবল পাবি। দরকারে ফোন করিস”।
সৃজিতের সাথে এমনিও ফোনে কথা বরাবরই কম হত,তবে চ্যাটে দুই ভাই টুকটাক আলোচনা করতো,কথা হত।লাস্ট কমাস সেটাও কমে গিয়েছিল।প্রিয়ার সাথেও এবিষয়ে কথা বিশেষ হতোনা।তাই ও বিষয়টা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলেনি।
প্রিয়াও যাচ্ছে রজতের সাথে,যদিও রজত বলেছিল,”দরকার নেই”,কিন্তু কেন কে জানে ও কিছুটা জোর করেই যাচ্ছে। প্রিয়াকে এত বছরেও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি রজত।আজকাল চেষ্টাও বিশেষ করেনা।
ওদের আন্ধেরির ফ্ল্যাট থেকে ওরা যখন দুজন বের হলো ঘড়িতে তখন সকাল ছটা। ভাইয়ের সাথে সম্পর্কে যতই ফাঁক আসুক,নিজের ছোট ভাইয়ের জন্যে দাদা হিসেবে তার উৎকণ্ঠা নজরে আসাই স্বাভাবিক। ভারতের পশ্চিমের বানিজ্য নগরী তে তখনও ভালো করে ভোর হয়নি। সপ্তাহান্তের ঘুমিয়ে থাকা শহরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললো ওদের গাড়ি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
ক্রমশ..