“দাদাভাই তুই এই যাতায়াত করছিস তোর তো সব দিক দিয়ে চাপ পড়ছে বল। আমি বাড়ি আসার পর দুমাসে দুবার এলি,অফিসের চাপে বেশিদিন থাকতে পারছিস না…তুই জবটা ছেড়ে দে দাদাভাই।চল বাবার ব্যবসাটাই দুভায়ে মিলে আরও বড় করি”,এই দুমাসে সৃজিত অনেক টাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। মাথার ক্ষতটা প্রায় সেরে গেছে,শুধু ফিজিওথেরাপি করেও পায়ে বিশেষ জোর আসেনি,বিশেষ করে ডান পা টা। এই মাসের শেষে হয়তো সার্জারি করতে হবে। কবে যে বিছানা আর হুইল চেয়ার ছাড়তে পারবে সৃজিত নিজেও জানেনা।
“না রে এখন চাকরি ছাড়ার প্ল্যান কিছু করিনি।আর ব্যবসা তো তুই ভালই চালাচ্ছিস।এরকম বিছানায় শুয়ে শুয়েও ব্যবসাতে কোনো আঁচ আসতে দিসনি।তোর ওপর আমার পুরো ভরসা আছে”,রজত ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে।
“তোর শোভন আঙ্কেলকে মনে আছে? ওঁর ছেলে অয়ন আঙ্কেল মারা যাওয়ার পর আমাদের ব্যবসায় জয়েন করে। ও খুব রেসপনসিবল পুরো আঙ্কেলের মত। ও ছিল তাই এই যাত্রায় উৎরে গেলাম। আসলে এই অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে আর একা একা ভালো লাগেনা। তুই আসলে দুদিন খুব ভালো কাটে “,একদম আলাদা লাগে সৃজিতের কথাবার্তা আজকাল রজতের। ও অবাক হয়ে তাকায়।
“অমৃতা তোর ঠিকঠাক দেখাশোনা করে তো রে? তোর বৌদির বোন,চেনাশোনার মধ্যে বলে ওকে রাখা হয়েছে,আর ওর নিজের কেউ নেই তাই জন্যে…”,রজত কথা ঘুরিয়ে বলে।
“নিজের কেউ নেই? তাহলে ও প্রতি রবিবার বিকেলে বাড়ি যাবো বলে যে ঘণ্টা তিন ছুটি নেয়!…”,সৃজিত ভেবেছিল অমৃতার মা আছে। এতদিনে অমৃতা ওর কাছে ওর কর্মজীবনের সমস্ত গল্প করলেও ব্যক্তিগত জীবন আড়ালেই রেখেছিল। তাই আজ রজতের কথায় সৃজিত ভাবতে থাকে।
“সে তো ও থাকতো ওর কাকার বাড়ি,সেখানে যেতে পারে। তোর এখানে কাজ মিটলে তো ওকে ওখানেই ফিরতে হবে। ওর বাবা মা দুজনেই কোভিডে মারা যান। তবে প্রিয়া বলছিলো ওকে এবার ও সাজেস্ট করবে কোনো পিজিতে শিফট করে যেতে। দেখা যাক আপাতত তুই সুস্থ না হওয়া অবধি তো এখানে থাকুক,আমরাও নিশ্চিন্তে থাকি।
সৃজিত আর মুখে আগ্রহ দেখায় না অমৃতা সম্বন্ধে,কারণ এটা ওর চরিত্র বিরোধী।
অমৃতা এখন ওর খুব কাছের একজন বন্ধু হয়ে উঠেছে ঠিকই,কিন্তু সেই বন্ধুত্বের একটা সীমারেখা আছে। সৃজিতের ভালো লেগেছিলো অমৃতাও সেই সীমারেখা বোঝে,কোনোদিন সেটা পার করার চেষ্টা করেনি। সৃজিত এখনও প্রকৃত অর্থে অথর্ব প্রায়। যেদিন প্রথম অমৃতা ওকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করতে আসে, সিঁটিয়ে গিয়েছিলো ও।কিন্তু নিজের কিছু করার সামর্থ্য ছিলনা। হসপিটালের ওই পরিবেশে অর্ধ অচেতন অবস্থায় যা অস্বাভাবিক না,সেটাই বাড়ির পরিবেশে অস্বস্তি তৈরি করেছিল। বাড়ি ফেরার পরেরদিন দুপুরে অমৃতা যখন সমস্ত গুছিয়ে এনে ওকে তুলে বসাতে এসেছিল কী বলবে বুঝতে পারছিলনা ও। তখন আগেরদিনের মতোই মুখে হাসি টেনে এনে অমৃতা বলেছিল,”সৃজিত আপনি কিন্তু আমার পেশেন্ট।আর এটা আমার ডিউটির পার্ট। আপনি এখন অসুস্থ তাই আমাকে রাখাই হয়েছে আপনাকে হেল্প করতে”।
ওর কথা বলতে বলতে অভ্যস্ত হাতে কাজ করে যাওয়া সৃজিতের মধ্যে প্রথমদিন অস্বস্তি পুরোপুরি কাটাতে পারেনি। কিন্তু ওর আন্তরিকতা,স্বাভাবিক ব্যবহার এখন সৃজিত কেও অনেক সাবলীল করে দিয়েছে। নিজের মায়ের পর অমৃতার কাছে মনেহয় সৃজিত এতটা ফ্রি। এখন ওর সাহায্য ছাড়া জীবনটা ও ভাবতেই পারেনা।
রজতের সাথে কথা বলার মাঝেও সৃজিতের মনে একটা কাঁটার মত খচখচ করতে থাকে প্রতি রবিবার অমৃতার ছুটি নেওয়া। ও খেয়াল করে দেখে ওকে স্বাভাবিক করার জন্যে যতটুকু দরকার অমৃতা ঠিক ততটাই নিজের সম্বদ্ধে বলেছে সৃজিতের কাছে,যার বেশিরভাগটাই ও কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত। ও ব্যক্তিগত জীবনের কিছুই গল্পছলেও বলেনি এই দুমাসে, এমনকি সৃজিতের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কোনো আগ্রহ ও দেখায়নি। হঠাৎ করে অমৃতার সাথে কথা বলার জন্য সৃজিতের ভেতরটা ছটফট করতে থাকে। রজত শেষ দশ মিনিট কী বলেছে কিছুই কানে নেয়নি সৃজিত,উল্টে বলে ওঠে,”দাদাভাই অমৃতা কে একটু ডেকে দিবি।একটু দরকার আছে”।
রজত ভাবে হয়তো ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার।তাই ও নিজেই নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠে সৃজিত। কিছুটা পুরোনো টোনে বলে,”প্লিজ তুই বুঝবি না। একটু ওকে দেবে দে, আমার দরকার শুধু ওর সাথেই”।
খুব বেশি অবাক রজত হয়না। কারণ ও চেনে ওর খামখেয়ালি ভাইকে। কখন মাথায় কী আসে ও নিজেও হয়তো জানেনা। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ও বেরিয়ে যায় অমৃতার খোঁজে।
-“…তুমি যে টা বলছো এই মুহূর্তে সেটা মানা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি এখন এই জব টা ছাড়তে পারবো না কিছুতেই। একে আমার হাতে কোনো চাকরি নেই,সামনে আমার সরকারি চাকরির পরীক্ষা,তারওপর কাকার বাড়ি আমি কিছুতেই ফিরবো না। প্লিজ পার্থ বোঝার চেষ্টা করো..”,অমৃতার ঘরের সামনে গিয়ে থমকে যায় রজত। বুঝতে পারে নিতান্তই ব্যক্তিগত ফোন করছে তার মাসতুতো শ্যালিকা। কিন্তু পার্থ নামের ভদ্রলোকের নাম আগে প্রিয়ার বা ওর মায়ের কাছে শুনেছে বলে মনে করতে পারেনা। কারোর ব্যক্তিগত কথার মাঝে হস্তক্ষেপ করা বা সেটা আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনা দুটোই ওর চরিত্র বিরোধী হলেও কোনো অজানা কারণে ঘরের ভেতরে ঢোকা বা চলে যাওয়া কোনোটাই করতে পারেনা ও।
অন্যদিকের কথা শুনতে পাওয়া সম্ভব না তাও অমৃতার একদিকের কথাই মোটামুটি বুঝিয়ে দেয় ওর সমস্যা,”ঠিক আছে নেক্সট যেদিন দেখা হবে কথা হবে ডিটেইলস এ,কিন্তু তুমি শিওর থাকো আমি এই জবটা আপাতত ছাড়ছি না। একে এটা আমার দিদির শ্বশুরবাড়ি।তারওপর একজন এরকম পেশেন্ট যিনি আমার ওপর ডিপেনডেন্ট হয়ে গেছেন…”।
-“…”।
-“কী…কী বললে তুমি ! মানেটা কী? এটা আমার কাজ। এতদিন ধরতে এটাই করে আসছি আমি। তুমি যখন এক বছর আগে সম্পর্ক শুরু করেছিলে তুমি সবটা জানতে। সোশ্যাল প্লাটফর্মে যোগাযোগ হলেও কিছুই লুকোয়নি আমি তোমায়। তাহলে আজ এতদিন পরে এসবের মানে কী! না মানে সৃজিত রায় পেশেন্ট…”,অমৃতার কথা থেমে যায়। ওর কানে আসে সৃজিত বেল দিচ্ছে। আর বেলের মুহুর্মুহু আওয়াজ বুঝিয়ে দিচ্ছে সৃজিত ওকে ইমিডিয়েট ডাকছে,”পরে কথা বলবো আমি।এখন ফোন রাখছি”।
ফোন কেটে বেরোতে গিয়ে দরজার বাইরে এসে রীতিমত চমকে যায় অমৃতা,রজত দা দাঁড়িয়ে…
“সরি অমৃতা সুজু তোমায় খুঁজছিল।কিন্তু ডাকতে এসে দেখলাম তুমি ফোনে ব্যস্ত। অপেক্ষা করছিলাম…কিন্তু বাবুর মনেহয় অপেক্ষা সইছে না।একটু দেখো প্লিজ”,সত্যি কথা সরাসরি বলে দেয় রজত।
নিজে অপ্রস্তুতে পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে সামলে নেয় অমৃতা।
“হ্যাঁ আমি বেল শুনতে পেয়েছি।দেখছি রজত দা”,কথা শেষ করে ও প্রায় ছুট লাগায় সৃজিতের ঘরের দিকে। নিজের ভাইয়ের হাবভাব বাড়াবাড়ি না লাগলেও অমৃতার এরকম আচরণ অবাক করে রজত কে,’এতটা গুরুত্ব দেয় ও সুজু কে!’
নিজের চিন্তাকে লাগাম পরিয়ে বাড়ির ছাদের দিকে পা বাড়ায় রজত।
ক্রমশ…