“কেমন আছেন সৃজিত? আজ আপনাকে ছেড়ে দেব। মাঝে প্রায় কুড়িদিন কেটে গেছে। তবে আমরা আশা করিনি আপনি এত তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ পাওয়ার অবস্থায় আসবেন। আপনার মাথায় চোটটা যতটা মারাত্মক,তার চেয়েও বেশি আঘাত আপনার স্পাইনে লেগেছে। এই মুহূর্তে আমরা সার্জারি করিনি।কিন্তু মাথার চোট টা সম্পূর্ণ ঠিক হলে,আর ততোদিনেও আপনার পা এখনকার মতোই দুর্বল থাকলে সার্জারি করতে হবে।সেই ক’দিন মানে প্রায় চারমাস আপনাকে হুইল চেয়ার ইউজ করতে হবে। জোর করে দাঁড়ানোর,বা স্ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটার কোনো চেষ্টা কিন্তু করবেন না। তাতে সমস্যা আরো বাড়বে…”,দরকারী আরো অনেক কথা সৃজিতের ডাক্তার বললেও হুইল চেয়ারের উল্লেখের পর আর কোনো কথাই ওর মাথায় ঢোকেনা।আজ দিন সাত হলো ওর জ্ঞান ভালো করে এসেছে। দাদাভাই তার পরেরদিন বাধ্য হয়ে মুম্বাই ফিরে গেছে।হয়তো এই উইকেন্ডে আসবে।
বৌদি আগেই ফিরে গিয়েছিল অফিসের কাজের চাপে।কিন্তু দাদা ওকে রেখে কিছুতেই ফিরতে পারেনি।
কাল যখন ডাক্তার জানালো আজ ডিসচার্জ করে দেবে একটু হলেও নিজেকে অসহায় মনে হয়েছিল সৃজিতের,বাড়িতে কে দেখাশোনা করবে এই চিন্তায়। কিন্তু সন্ধেবেলা দাদা বৌদির সাথে কথা বলে অনেক নিশ্চিন্ত হয়েছে ও,বৌদির কোন বোন না কি ট্রেইনড নার্স,সেই ওর দেখাশোনা করবে যতদিন না ও সুস্থ হয়।
উফফ কতদিন বাড়ির বিছানায় শোয়েনি ও। কতদিন বাড়ির খাবার খায়নি। বাড়িতে ওর নিজের লোক তো কেউ নেই,তাও বাড়ি আসলে বাড়ি হয়। জীবনে এই প্রথমবার বাড়ি ফেরার এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করে সৃজিত।
আর বাড়িতে একজনই আছে ওর আপন,ওকে ছাড়া যে আগে কখনো থাকেনি। কে জানে এ’কদিন কী করেছে সে ওকে ছাড়া। একমাত্র ওকেই মিস করে সৃজিত বাড়ি থেকে দূরে থাকলে।
যখন অফিসিয়াল সমস্ত কিছু মিটিয়ে ফেরার গাড়িতে উঠছে সৃজিত,তখন ঘড়িতে দুপুর প্রায় পৌনে তিনটে। নিজের গাড়ির সাচ্ছন্দ্য ছেড়ে অ্যাম্বুলেন্স ই ভরসা এখন। স্ট্রেচার আর হুইল চেয়ার আপাতত ওর জীবনের গতি এদের মধ্যেই আটকে। তাতেও ও দমেনি। হসপিটালের ওই গন্ধ ছেড়ে বেরোতে যখন পেরেছে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে ও ঠিক। ওর আরও বাইক কিনতে হবে না? রোড ট্রিপে আরও কত ঘুরতে হবে!
অ্যাম্বুলেন্সের জানলা দিয়ে বাইরে আকাশ দেখতে দেখতে সৃজিত বাড়ি পৌঁছে যায়। দরজায় ওর অপেক্ষায় নিজের লোক কেউ হয়তো নেই,কিন্তু এই মাসী,এই রতন,দারোয়ান মানুকাকা এরাই তো ওর পরিজন।নিজের উজ্জ্বল মুখ বুঝিয়ে দেয় এরাও ওর জন্যে কদিন উদ্বেগে ছিল। সবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ইশারায় ভালো আছে বুঝিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে যখন ঢোকে সৃজিত একটা অচেনা,কিন্তু আগে দেখা মুখ দেখতে পায়। ওকে বিছানায় শুতে হেল্প করে সেই মুখটা বলে,”আমি অমৃতা, প্রিয়াদির মাসতুতো বোন। ট্রেইনড নার্স হিসেবে আমায় দায়িত্ব দিয়েছে দিদি আপনার দেখাশোনার।আপনি এখন একটু রেস্ট নিন। এই বেলটা আপনার হাতের কাছে রাখা থাকলো। এটা টিপলেই আমি চলে আসবো”।
অমৃতা ঘুরে চলে যেতে যাবে হঠাৎ বেলের আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকায়,বুঝতে পারে সৃজিত কিছু বলবে।
এগিয়ে যায় সৃজিতের কাছে।
খুব ধীর স্বরে সৃজিত বলে,”আমার পেট বোল্ট কোথায়? ওকে দেখবো”।
অমৃতা জানতো সৃজিত ফিরেই ওর পোষ্যর খোঁজ করবে,তাই ও আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
“বোল্ট রতনদার কাছে আছে। আপনি এখনও সুস্থ নন আর ইনফেকশন হওয়ার চান্স এখনও আছে।তাই এখুনি ওকে এখানে আনা যাবেনা। অন্তত আরো মাস দুই বা ডাক্তারবাবু যতদিন না পারমিশন দিচ্ছেন…”।
অমৃতার কথা শেষ করতে দেয়না সৃজিত।নিজের অবস্থার কথা ভুলে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে স্বর উঁচু করে বলে,”না আমি বোল্টকে এখুনি দেখবো। ও আমায় ছেড়ে থাকেনা,ও সুস্থ আছে শুধু সেটা দেখতে চাই”।
“প্লিজ মিস্টার রায় উত্তেজিত হবেন না।এই মুহূর্তে আপনি ওকে দেখলে ও আপনাকে দেখতে পেয়ে কাছে আসতে চাইবে।আমরা সামলাতে পারবো না। রতনদা বলছিলো রজতদা চলে যাওয়ার পর দুদিন ও কিছু খায়নি। দিন দুই হলো একটু স্বাভাবিক হয়েছে। আপনি এখন রেস্ট নিন।সন্ধের ওষুধের আগে আমি আসবো। আর মাঝে দরকার হলে বেল দেবেন”,অমৃতা কথাগুলো জোর দিয়ে বলে।
একটানা বেশি কথা বলার শক্তি এখনও সৃজিতের হয়নি। শুধু চোখ বুজে হ্যাঁ বললেও মনে মনে বলে,’ আমি এরকম অসহায় হয়ে বেশিদিন থাকবো না। আর আপনাকেও বেশিদিন এখানে কর্তৃত্ব করতে হবেনা।”
কোনো অজ্ঞাত কারণে প্রথম দেখায় অমৃতাকে পছন্দ হয়না সৃজিতের। শুধুমাত্র সাধারণ দেখতে বলে না, ওর চোখে সৃজিত একধরনের আত্মবিশ্বাস দেখে যা শুধুমাত্র রূপের সৌন্দর্য্যে অহংকারীদের মধ্যে ও এর আগে দেখেছে,আর বারবার সেই অহংকার ভেঙে আনন্দ পেয়েছে। একজন সাধারণ নার্সের সাধারণ সৌন্দর্য্য নিয়ে এরকম চোখের ঔদ্ধত্য ওর সহ্য হয়না। আর বৌদির এই বোন সাধারণ এক নার্সিংহোমের চাকরি ছেড়ে ওর দেখাশোনা করতে এসেছে টাকার জন্যে,এটা ও জেনেছে। তাই তার মুখে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা ও আশা করেছিল,যা তে ওর পক্ষে কন্ট্রোল করা সোজা হয়।
এসব ভাবনা চিন্তা করতে করতে একসময় ক্লান্ত শরীরে সৃজিত ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম ভাঙে অমৃতার গলার আওয়াজেই।
“উঠুন সৃজিত বাবু,ওষুধ খাওয়ারর সময় হয়ে গেছে। আগে এই স্যুপটা খেয়ে নিন, হসপিটালে সেই দুপুরে লাঞ্চ করেছেন অনেকক্ষণ হলো”, স্যুপের বাটিটা বেড সাইড টেবিলে রেখে অমৃতা সৃজিতকে উঠে বসায় বালিশে হেলান দিয়ে। টেবিলে রাখা ঘড়িতে তখন সময় দেখাচ্ছে সন্ধে সাড়ে পাঁচটা।
হাত গুলো এখনও কাঁপলেও সৃজিত ডান হাত তুলে বাটিটা নেওয়ার চেষ্টা করে,কিন্তু অমৃতা বলে,”দাঁড়ান আমি খাইয়ে দিচ্ছি।কদিন একটু খাইয়ে দি,একটু সেরে উঠলে আবার নিজে খাবেন।”
“না আমি খেতে পারবো”, আবার হাত বাড়ায় ও বাটির দিকে। কিন্তু বাটিটা তুলতে গিয়ে বুঝতে পারে ও এখনও যথেষ্ট দুর্বল,আত্মবিশ্বাস পায় না।
অমৃতা চুপচাপ দেখে,যখন বুঝতে পারে সৃজিত পারছে না হেসে বলে,”হাত সরান। এটা আমার কাজের মধ্যেই পরে। এক্সট্রা কোন ফেভার আমি করছি না। আমি শুনলাম আপনি চিকেন স্যুপ ভালোবাসেন তাই করে এনেছি। খেয়ে দেখুন তো মাসীর মত হয়েছে কি না। মাসীর আসতে তো দেরি আছে তাই আমি রেসিপি জেনে রেখেছিলাম”,স্যুপ ভর্তি চামচ মুখের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলে ও।
মেয়েটার কথা বার্তা খারাপ না,চুপচাপ স্যুপ খেতে শুরু করে সৃজিত।
“আচ্ছা সৃজিত আমরা তো প্রায় সম বয়সী। আপনি আমায় বন্ধু ভাবতে পারেন। ডাক্টার নার্স যত এদের বন্ধু ভাববেন, রিকভারী করতে সুবিধা হবে। আমি এই দুবছরে কত মানুষের যে বন্ধু হয়েছি,একজন বয়স্ক মহিলা তো এখনও মাঝে মাঝে ফোন করেন…”, অমৃতা নিজের কাজের অভিজ্ঞতা কে কাজে লাগিয়ে সৃজিতকে সহজ করার চেষ্টা করতে থাকে।
উত্তর না দিয়ে সৃজিত চুপচাপ ওর প্রিয় স্যুপ খেতে থাকে। হসপিটালেও নার্স খাইয়ে দিয়েছে,কিন্তু বাড়ির পরিবেশে সাধারণ ড্রেস পরা অনাত্মীয় একজন ওর বয়সী মেয়ে ওকে খাইয়ে দিচ্ছে,একটা অন্যরকম অনুভূতিতে মন ছেয়ে যায়। তাতে যে কোনো খারাপ লাগা লেগে থাকে তা কিন্তু না।
খাওয়া শেষ করে ওষুধ খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে ও। এখনও একমাসও হয়নি,বিরক্তি এসে যাচ্ছে শুয়ে থাকতে থাকতে। এই মুহূর্তে ওর মনেহয় যদি কেউ কাছেরজন ওর থাকতো,বসে গল্প করতো।
সারাজীবন নিজের পরিবারের থেকে দূরেই ও স্বচ্ছন্দে থেকেছে। একার জীবন,ওর বন্ধুবৃত্ত,ওর নিজের পছন্দ অপছন্দের সাথেই ও ভালো থেকেছে।
অমৃতা বলে,”ঘুমোবেন না টিভিটা চালিয়ে দিয়ে যাবো?” সৃজিত নিজের বেডরুমে রাতে টিভি দেখে বলে একটা টিভি সেট রেখে দিয়েছিল।
“না টিভি চালাতে হবে না। যদি অসুবিধা না থাকে তুমি একটু বসো। তোমার অভিজ্ঞতা শুনতে ভালই লাগছিল”, সৃজিত স্বাভাবিক স্বরেই বলে। আর কখন অমৃতা ওর কাছে বন্ধুর মত ‘ তুমি ‘ হয়ে যায় ও বুঝতেই পারেনা। ও ভুলে যায় ঘণ্টা কয়েক আগে এই মেয়েটা কেই ওর ভালো লাগছিলো না।
অবাক হয়না অমৃতা। ও জানে অসুস্থ মানুষ বড্ড অসহায় হয়,একাকীত্বে ভোগে,লোকের দ্বারা ঘিরে থাকতে ভালোবাসে। সৃজিতের বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসে ও হাসিমুখে। শুরু করে ওর কর্মজীবনের গল্প।
ক্রমশ…