“পার্থ তুমি নিজেও জানো না তুমি কী বলছো? তুমি আমায় চেনো এক বছরের ওপর,আমাদের সম্পর্কের বয়সও প্রায় এক বছর ,সবটা জানো তুমি আমার ব্যাপারে,আমার প্রফেশনের ব্যাপারে।তাহলে? কত রাত আমি নাইট ডিউটি করেছি।তখন তো তুমি কিছু…”,অমৃতার কথা বাধা পায়।
“তুমি শুধু বলো এই জবটা তুমি ছাড়বে কি না? হসপিটালে নাইট শিফট করা আর একজনের বাড়িতে গিয়ে থেকে তার সেবা করা,রাতে তার ঘরে কাটানো…বোথ আর নট সেম,য়্যূ নোও দ্যাট। আমি ক্লিয়ারলি তোমায় বলে দিচ্ছি ওই জবটা কন্টিনিউ করলে আমায় ছেড়ে দাও। আমার একটা ফ্যামিলি আছে,আত্মীয় আছে…একে মা নার্স শুনে এমনি মুখ তেতো করে আছে,তারওপর এসব শুনলে কখনো রাজি হবেনা।আর কোন মা’ই বা এসব মানবে বল?” পার্থ দূরে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বলে।
“কী সব? কী বলছো তুমি নিজেও জানো না। আমি এই জবটা নেব নাই তো ভেবেছিলাম।দিদি কে বলেও দিয়েছিলাম।তারপর তুমিই বললে ভালো অফার,কদিন করে দেখতে। তুমিই বলেছিলে না পছন্দ নাহলে ছেড়ে দেব।কিন্তু আমার কোনো সমস্যা হয়নি।আমি চাকরির পরীক্ষার জন্য পড়তেও পারছি। তাহলে এখন,এখন কী সমস্যা হচ্ছে বলো?” অমৃতা অধৈর্য্য হয়ে গঙ্গার ধারেই চেঁচিয়ে ওঠে। একে তো আজ বের হওয়ার সময় সৃজিত অশান্তি করছিল। ছুটি দিতে চাইছিল না। কাল রাতের অদ্ভুত কথাগুলো বলার পর আজ সকাল থেকে চুপ মেরেছিল।বুঝতে পারছেনা অমৃতা ঠিক চলছে ওর জীবনে।
“দেখো অমৃতা আমি যা চাকরি করি সরকারি তোমায় অনেকদিন বলেছি তোমার ওই নার্সগিরির দরকার নেই।তুমি চাকরি ছেড়ে দাও।তুমি শোননি। সরকারি চাকরি তুমি কোনদিনই পাবেনা,কারণ সেই এলেম তোমার আছে বলে আমি মনে করিনা। তাই নার্সিংহোমের চাকরি যা তে ছাড়ো এ জবটা নিতে বলেছিলাম।ভেবেছিলাম দিনকয়েক পর নিজেই ছেড়ে দেবে। এমনি আমার বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।মা বলেছে একটাই শর্ত তুমি বিয়ের পর চাকরি করতে পারবে না। আমাদের প্রতিষ্ঠা করা ঠাকুর আছে।তুমি রোজ নোংরা ঘেঁটে আসবে,সেসব হবেনা।আমি…”,পার্থর কথার মাঝখানেই উঠে দাঁড়ায় অমৃতা। “কী হলো দাঁড়িয়ে পড়লে?”
“পার্থ আমার মনেহয় আমাদের সম্পর্কটা এবার এখানেই শেষ করার দরকার। আমি তোমায় ঠিক চিনতে পারিনি,আর তুমিও আমায় চেননি। আমি ‘নার্সগিরি’ করি শুধু টাকা উপায় করতে না।আর জীবনে আমি স্বাবলম্বী হই এটা আমার বাবা-মার স্বপ্ন ছিল। আজ তাদের অবর্তমানে সেটাই আমার স্বপ্ন।চাকরি আমি কোনদিনই ছাড়বোনা। সরকারি চাকরি আমি পাবো কি না জানিনা কারণ শুধু এলেম দিয়ে সব কিছু হয়না। যাইহোক না পেলে বেসরকারীতেও আজীবন চাকরি করে যাব,যতদিন পারবো।তাই আমায় তোমার পক্ষে বিয়ে করা কখনো সম্ভব হবে না। এলাম।ভালো থেকো”,আর দাঁড়ায় না অমৃতা। একা হাঁটতে আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে। বাবা মা চলে যাওয়ার পর ভেঙে পড়লেও মনে হয়েছিল পার্থ আছে। আজ আর কেউ একান্ত আপন ওর রইলো না। গঙ্গার ধার ধরে হেঁটে আসতে আসতে একটা ফাঁকা বাস দেখে উঠে পড়ে।বাসের নম্বরও দেখে না।
“অমৃতার বয়ফ্রেন্ড আছে? রিয়েলি?” প্রিয়া কে খুশিই লাগে।
“হ্যাঁ। নাম সম্ভবত পার্থ,কী করে জানিনা”,রাতে বিছানায় শুয়ে ফোন নিয়ে খুটখাট করতে করতে বলে রজত।
“তারপর তোমার ভাইয়ের খবর কী? ইম্প্রুভমেন্ট কেমন? সার্জারি কি এই মাসেই হবে?” ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নাইট ক্রিম মুখে লাগাতে লাগাতে বলে।
“হমম…নেক্সট উইক চেকআপ আছে ডক্টর কী বলেন”,একটু চিন্তিত লাগে রজত কে।
-“কী হলো? চিন্তা হচ্ছে?”
-“হুম চিন্তা শুধু ওর জন্যে না,নিজের জন্যেও হচ্ছে।এত ঘন ঘন ছুটি ম্যানেজ করা চাপ হয়ে যাচ্ছে। যদিও ওয়ার্ক ফ্রম হোম দেখাচ্ছি। কিন্তু আসলে কাজ তো কিছুই করছি না”।
-“হুঁ সেতো একটা সমস্যা বটেই। কিন্তু ওর সার্জারির সময় আমাদের দুজনেরই যাওয়া উচিত।আমি না। পারলেও তোমার যাওয়া টা কর্তব্য। আর তো কেউ নিজের নেই ওর”।
প্রিয়ার কথায় রজত একবার আড়চোখে ওর মুখটা দেখে নেয়। ঠিক বুঝতে পারেনা এই মেয়েটা কে ও আজও। এমনি সুজুর সাথে ওর ভালোই সম্পর্ক। কিন্তু যে কোনো বিষয়ে দায়িত্ব নিতে ওর ভীষণ এলার্জি। রজত বুঝতে পারে,যদিও সরাসরি এবিষয়ে ওদের কোনো কথা হয়নি।
প্রিয়ার মা একা মানুষ,কিন্তু রজত জানে প্রিয়া তার ব্যাপারেও উদাসীন। রজত নিজে বলেছে মা কে মাঝে মাঝে ওদের কাছে এনে রাখতে। কিন্তু প্রিয়া পাত্তা দেয়নি।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রজত। অমৃতা মেয়েটাকে বেশ লেগেছে রজতের এই দুবার গিয়ে। ওর মনের কোথাও একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল সুজুর জন্যে এরকম একটা মেয়ের, যে ধৈর্য্য দিয়ে গুছিয়ে রাখতে পারবে ওর ভাইকে। কিন্তু এবারে যখন শুনলো ওর বয়ফ্রেন্ডের কথা সেই আশাটাও আর রইলনা। প্রিয়া অমৃতার মত না,ও নিজেকে নিয়েই সারাদিন কাটিয়ে দেয়।ওদের বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক,কিন্তু এখনও প্রিয়ার বাচ্ছার প্ল্যান করার কোনো ইচ্ছে নেই, কারণ ওই একটাই দায়িত্ব নিতে অনীহা।
নিজের বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়ে রজত। ক্লান্ত লাগছে,ঘুম পাচ্ছে। চোখ বুজে পাশ ফিরে শোয় ও। ঘুমিয়ে পড়ে দশ মিনিটে।
“সৃজিত তুমি ওষুধটা খেয়েছে?” সৃজিতদের বাড়ি ঢুকে আগে ওর ঘরে গিয়ে দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে অমৃতা।কিন্তু কোনো উত্তর আসেনা।
“দাঁড়াও চেঞ্জ করে আসছি”, বলে দ্রুত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে যায় ও। ঠিক সেই সময় ঘরের ভিতর থেকে সৃজিত বলে,”এখন আমার কোনো দরকার লাগবে না। সেই ডিনার টাইমে এসো”।
“আর ওষুধ?” অমৃতা থমকে দাঁড়িয়ে বলে।
“খেয়ে নিয়েছি।আমি এখন ফোনে ইন্টারভিউ নেব”,সৃজিত যেন অমৃতা কে শুনিয়েই কথাটা বলে।
দাঁড়িয়ে থাকে অমৃতা সৃজিতের ঘরের বাইরে।তারপর কিছু ভেবে আস্তে করে বলে,”তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ফ্রি হলে জানিও”।
“কী বলভে বলো”,উত্তর আসে সঙ্গে সঙ্গে।
“আমি বাইরের ড্রেসে এ ঘরে তো ঢুকবো না। দশ মিনিট সময় দাও,চেঞ্জ করে আসছি”,অমৃতার যে পার্সোনালিটি সৃজিত দেখেছে কোনোভাবেই এই গলার স্বর যেন তার সাথে যায়না।
“ঠিক আছে এসো,আমি অপেক্ষা করছি”,সৃজিতের ঠোঁটের কোণে একটা জয়ের হাসি হালকা করে ফুটে ওঠে,কিন্তু অমৃতা সেটা দেখতে পায়না।
দশ মিনিট পর অমৃতা যখন সৃজিতের ঘরে এসে ঢোকে তখন সৃজিত নিজের শরীর কিছুটা হেলিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। অমৃতা সেটা দেখে বুঝতে পারে ওর শরীর শুতে চাইছে,কিন্তু ও নিজে পারেনি আর বেশি হেলতে। ও এগিয়ে গিয়ে ওকে শুইয়ে দেয়। সৃজিত সরাসরি তাকায় অমৃতার মুখের দিকে,”কী করে বুঝতে পারো তুমি?”
“এটাই আমার কাজ। পেশেন্ট দেখে দেখে এখন বুঝে গেছি কে কখন কী চাইছে”,হাসে অমৃতা।
“তার মানে নতুন যে আসবে সেও এরকম আমার মুখ দেখে সবটা বুঝতে পারবে বলো?”, সৃজিতের কথায় কিছু একটা হতাশা অনুভব করে অমৃতা।
“সৃজিত তুমি সুস্থ না হওয়া অবধি আমি যদি তোমার নার্স হয়ে থেকে যাই সমস্যাটা কোথায়? যদি আমার জায়গায় তুমি নতুন কাউকে হায়ার করো সে তো তোমার নার্স হয়েই থাকবে।তাহলে?”,অমৃতা কৌতুহল সামলে রাখতে পারেনা।
“অনেক ব্যাপার আছে অমৃতা তুমি বুঝবে না।কারণ তুমি এরকম কাজ আগে করোনি”,সৃজিত এড়িয়ে যেতে চায়।
“দেখো আমি করিনি হয়তো।কিন্তু অনেকেই করে।যাইহোক আমিও এই মুহূর্তে এই কাজটা হারাতে চাইনা।এটা আমার জন্যে খুব দরকারী”,অমৃতা হেরে যাওয়া গলায় বলে।
“ওকে তাহলে বিয়ে করো আমায়। না সারাজীবনের জন্যে না, কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ। তাতে কিছু শর্ত থাকবে,একটা সময়সীমা থাকবে আর বিয়ে ভাঙার পর ডিভোর্সের জন্যে তুমি টাকাও পাবে”,সৃজিত বলে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অমৃতার মধ্যে থেকে। মনে মনে ভাবে,’কেন কেন কেন? শুধু আমার সাথেই কেন? আর পাঁচজন মানুষের ক্ষেত্রে নার্স হয়েই হয়তো এই সময়টা কেটে যেত।কিন্তু আমার জন্যেই এইসব অদ্ভুত মানুষ আসে,তৈরি হয় অদ্ভুত পরিস্থিতি’। মুখে বলে,”তোমার দাদা বৌদি,আত্মীয় এদের কী বলবে?”
“ওদের বলার দরকার নেই কন্ট্রাক্ট এর কথা। শুধু বলবো আমরা বিয়ে করছি। কন্ট্রাক্ট আমাদের মধ্যে থাকবে গোপনে”,সৃজিত নিজের জেদে অবিচল থাকে।
“আমায় দুদিন ভাবার সময় দাও। আর প্লিজ এমুহূর্তে অন্য কাউকে দেখোনা।এই কাজটা দরকার”,অমৃতা বিধ্বস্ত গলায় বলে।
“ডান”,জিতে যাওয়ার হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলে সৃজিত।
আর কথা বাড়ায় না অমৃতা। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে সৃজিতের ঘর থেকে। মনের মধ্যে তখন ওর ঝড় চলছে। একদিকে পার্থর কথাগুলো,এক বছরের সম্পর্ক ভেঙে ফেলার যন্ত্রণা, অন্যদিকে একটা অস্বাভাবিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার উদ্বেগ। চিন্তাগুলো সব জট পাকিয়ে আছে। পা বাড়ায় ও ছাদের সিঁড়ির দিকে।
ক্রমশ…