ভালোবাসা মন্দবাসা-সপ্তম পর্ব

by Tamali

“বোল্ট বোল্ট কাম হিয়ার…না দাদাভাই আমি সত্যি অমৃতা কে বিয়ে করেছি। রতন ভুলভাল কোনো খবর তোদের দেয়নি। মন্দিরে করেছি আর আইনতও রেজিস্ট্রি করবো,নোটিস দেওয়া হয় গেছে”, অনেকদিন পর বোল্টকে কাছে পেয়ে মন দিয়ে আদর করছিল সৃজিত। রজতের ফোনটা আসবে ও জানতো কিন্তু আরো আগে আশা করেছিল।
“মানে!! বিয়েটা কী একটা ছেলেখেলা না কি? আর অমৃতা প্রিয়া কেও কিছু জানানোর প্রয়োজন অনুভব করলো না? ও তো আমাদের বাড়িতে এসেছিল প্রিয়ার কথায়…তুই এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি আমাদের কিছু না জানিয়ে।এমনকি আমাকেও জানালি না?” রজত এতটাই উত্তেজিত কথাগুলোও যেন খেই হারিয়ে যাচ্ছিল।
“রিলাক্স দাদাভাই। আমি কখনো কোনো কাজ কি কাউকে বলে করি? আমি বাইক কিনেছিলাম সেটা কি তুই জানতিস? এটাও তাই। আমার জীবনে সব কিছুই হঠাৎ হয়…”,সৃজিত নিজের পোষ্যকে আদর করতে করতেই বলে।
ওদের বিয়েটা যে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ এটা শুধু জানে ওর উকিল বন্ধু,যে কন্ট্রাক্টটা বানিয়ে দিয়েছে। যতদিন না অমৃতা সরকারি চাকরি পাচ্ছে বা যতদিন না সৃজিত সুস্থ হচ্ছে ততদিন ওরা স্বামী স্ত্রী থাকবে। ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হবে যদি দুজনের ইচ্ছে থাকে।তবে যদি কোনো ভাবে কোনো উত্তরাধিকার আসে,তার ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত দুজনেই নেবে,তবে সেক্ষেত্রে প্রায়োরিটি পাবে অমৃতার মত। আর যদি দুজনের যে কেউ কন্ট্রাক্ট ভাঙতে চায়,অন্যজন চাইলে তার বিরোধিতা করতে পারে। পুরো কন্ট্রাক্ট এর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ এক বছর। এই কন্ট্রাক্টের মূল কারণ সৃজিতের অসুস্থতা,তাই অসুস্থ সৃজিতকে কোনো সঠিক কারণ ছাড়া অমৃতা ছাড়তে পারবে না। সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট তথ্য কন্ট্রাক্ট এর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যে কেউ একজন চাইলেই ডিভোর্সের জন্যে অন্যজনকেও রাজি হতে হবে,আর চাইলে অমৃতা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নিজের ভরণ পোষণের দাবি করতে পারবে।
“সুজু গাড়ি কেনা আর বিয়ে করা এক নয়”,প্রায় গর্জে ওঠে আপাত শান্ত রজত। প্রিয়ার সাথে একটু আগেই হয়ে যাওয়া ঝামেলার রেশ থেকেই হয়তো।
“আমার কাছে এক। অমৃতা কে দেখে আমার ভালো লেগেছে,মনেহয়েছে আমার বউ হিসেবে ও ঠিকঠাক,আমি বিয়ে করেছি।তবে অবশ্যই ওর মতামত জেনে। বৌদির কাছে আমি গ্রেটফুল ওকে আনার জন্য”,আসল কথাটা হয়তো এড়িয়ে যায় সৃজিত। কারণ ভারতীয় বিবাহ আইনে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ আইন স্বীকৃত না। সেটা অমৃতাও জানেনা। আর কোনো আইনত বিয়ের নোটিশও ওরা দেয়নি।
সৃজিত অমৃতার মত সাধারণ মেয়ের দম্ভ স্বীকার করতে পারেনি,আবার ওর আন্তরিক সেবা,ব্যবহার অস্বীকার করতে চায়নি। ও চেয়েছিল প্রথম কারণে অমৃতা কে হাসিল করতে,সেটা ও করেছে। আর দ্বিতীয় কারণে অমৃতা কে মূল্য দিতে চেয়েছিল সেটাও ও পারবে নির্দিষ্ট সময়ের পর। ও নিজেও জানেনা এটা আসলে কী করলো ও,হয়তো ছেলেখেলা, হয়তো টাইম পাস। অমৃতাকে যেদিন খুশি যাতে ও কেটে ফেলতে পারে তাই এই কন্ট্রাক্ট এর নাটক,সাগরেদ উকিলবন্ধু। সৃজিত ছেলে বলে ছোটবেলায় কোনোদিন পুতুল খেলেনি,হয়তো খেললে যে ভাবে পুতুল বদলাতো এটা তার ই নমুনা।
“সুজু আমি ভেবেছিলাম তুই বদলেছিস।আমি ভুল ছিলাম। কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্যে, ও জানেনা ও কী ভুল করলো। প্লিজ পারলে ওকে আর কষ্ট দিসনা। ভালো থাকিস,আর ভবিষ্যতে কখনো দাদা কে দরকার হলে জানাস”,কথা শেষ করেই ফোন কেটে দেয় রজত,সৃজিতকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না।
সৃজিত রাগে না,শুধু একটু হাসে। ও জানে দাদাভাই কোনোদিনও ওর সেভাবে ক্লোজ না থেকেও ওকে ছোট থেকেই একটু ভালোকরে চেনে,বোঝে।
বোল্টও আজকাল বড্ড অমৃতার ন্যাওটা হয়েছে। তবে ভালো এখনও সৃজিতকেই সবচেয়ে বেশি বাসে। বোল্টকে আদর করতে করতে নিজের জয়ে হাসতে থাকে ও।

 

সারাদিন সৃজিতের ঘরে যায়না অমৃতা এখনো।শুধু রাতে যায়,তাও ওর পাশে ঠিক শোয়না।একটা ডিভান কিনে এনে দিয়েছে সৃজিত,ওর বড় খাটের নীচে খাপে খাপে ঢুকে যায়।দিনেরবেলা ওটা ঢোকানো থাকে,রাতে টেনে বের করে ও।
অমৃতা আর সৃজিত কন্ট্রাক্ট পেপারে সই করলেও ও জানে এদেশে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের কোনো আইন স্বীকৃতি নেই।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁদুর পরতে পরতে হাসে অমৃতা।
সৃজিত ভেবেছে ও জানেনা বিষয়টা,কিন্তু আজকের দিনে এটা জানাটা কোনো বড় ব্যাপার না।
ও সব জেনেই সৃজিতের হাত থেকে সিঁদুর পরেছে। ওর আসলে টাকার দরকার এই মুহূর্তে অতটাও না,যতটা দরকার একটা আশ্রয় আর সময়ের। সরকারী চাকরিতেই ওর মুক্তি। আর সেটার জন্যে এই মুহূর্তে ওই দুটো জিনিস বেশি দরকার।
মাঝে মাঝে নিজের বাবার জন্যে বড্ড মন খারাপ করে। আজ বাবা থাকলে ওকে এতোটাও খারাপ থাকতে হতনা। ও জানে ছেলেদের জীবনে দাগ পড়েনা,পড়ে শুধু মেয়েদের নামে। সারাজীবনের মত ওর জীবনেও ছাপ একটা পড়বেই। কিন্তু চাকরিটা ওকে সব কিছু ভুলিয়ে দেবে।
উঠে দাঁড়িয়ে ওর ঘরের জানলার কাছে চলে যায় ও। এখনও শহরের প্রান্তের এই বাড়ির জানলা দিয়ে দূরের সবুজ দেখা যায়। মাঝে মাঝেই ওইদিকে তাকিয়ে থাকে ও।
হঠাৎ কোথা থেকে বোল্ট ছুটে এসে ওর পায়ে মাথা ঘষতে লাগে। বসে পড়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অমৃতা। একমাত্র পুরো পৃথিবীতে এই অবলা জীবটা ওকে এখন বড্ড ভালোবাসে,ও বুঝতে পারে। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটা শান্তি পায় ও আজকাল। ভালোবাসা জিনিসটা বড্ড আপেক্ষিক এটা ও এই অল্প বয়সে বুঝে গেছে। আর এটাও বুঝে গেছে সব সম্পর্কের একটাই মন্ত্র ‘গিভ এন্ড টেক’,শুধু কিছু ভালোবাসার সম্পর্ক এসব কিছুর ঊর্ধ্বে হয়।
বোল্ট কী বোঝে জানেনা অমৃতা।কিন্তু ওকে মন খারাপ দেখলে ওর জিভ দিয়ে গালটা যখন চেটে দেয়,কেন কে জানে নিজের বাবা মার ভালোবাসার মতোই স্বার্থহীন ভালোবাসার একটা গন্ধ পায় বোল্টের লালা থেকে।

-“…তুই এতটা চালাক আর লোভী বিশ্বাস কর আমরা ভাবিনি।আমি জানতাম তোর একটা আত্মসম্মানবোধ আছে। তুই এবাড়ির বউ হতে চেয়েছিলি ফাইন,কিন্তু এভাবে!! এবারও তোর মনে হলোনা আমায় জানানোর কথা?”
-“দিভাই প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো,সৃজিত বারণ করেছিল।এমনকি বাড়িতে যারা আছে তাদেরও ও কিছু জানাতে চায়নি।”
-“তুই চাইলে জানাতে পারতিস না এটা আমি বিশ্বাস করিনা। আসলে প্রথম থেকেই তোর টার্গেট ছিল…”।
-“আচ্ছা। তাহলে তো মিটেই গেল। টার্গেট পূরণ হয়ে গেছে,ব্যাস আর কী চাই?”
-“দেখ অমৃতা বাইরের অচেনা নার্স রাখিনি চুরির ভয়ে।কিন্তু ভাবিনি তুই সবচেয়ে বড় চুরিটা করে নিবি। আমার জাস্ট লজ্জা করছে রজতের সামনে দাঁড়াতে।তুই এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবি…”,প্রিয়ার সাথে কথার মাঝেই অমৃতা শুনতে পায় সৃজিত ওকে ডাকছে।
“আমি এখন ফোন রাখছি।সৃজিতের ডিনারের সময় হয়ে গেছে।আমি জানি আমি কিছু করিনি,এবার তোমরা বিশ্বাস করবে কি না…”,অমৃতার কথার মাঝেই প্রিয়া হিসিহিসিয়ে ওঠে,”পার্থর বুঝি আমার দেওরের মত পয়সা ছিল না? তাই ছাড়তে অসুবিধা হয়নি? তোদের মত মেয়েরা পয়সার জন্যে ক’টা পার্থকে যে ছাড়তে পারে…”,ওর কথার মাঝেই অমৃতা ফোন কেটে দেয়।
ফোন রেখে চোখে আসতে চাওয়া জলটা চেপে দেওয়ার চেষ্টা করে অমৃতা। শেষ কেঁদেছিল বাবা মারা যাওয়ার দিন,আগেরদিনই মা চলে গিয়েছিল। তারপর থেকে শত অসহায় অবস্থায়ও চোখের জল ফেলেনি। ও জানে ওর চোখের জল মোছার কেউ নেই।
নিজেকে সামলে নিয়ে যখন সৃজিতের ঘরের দিকে এগোচ্ছে তখন আবার ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকিয়ে চমকে যায়,পার্থ ফোন করছে।হাতের মধ্যে ভাইব্রেট হতে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চমকে ওঠে বেলের একটানা আওয়াজে। সৃজিত অধৈর্য্য হয়ে টানা বেল বাজাচ্ছে। ফোন কেটে ছোটে ও সৃজিতের ঘরের দিকে।

ক্রমশ…

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!