মুখোশের আড়ালে – অষ্টম পর্ব

by Tamali

অষ্টম পর্ব:-


অন্ধকারের বুক চিরে ছুটে চলা ট্রেনের কামরায় অন্ধকারের দিকে চাইলে মনে ভেসে ওঠে হাজারো শব্দ।সেই শব্দ জন্ম দেয় কখনো কল্পনার,আবার সেই শব্দ জন্ম দেয় কান্নারও।কারণ তখন কথা হয় নিজের সাথে,নিজের সুখ,দুঃখ,অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যৎ… সব সব সব মিলে মনটাকে এলোমেলো করে দেয়। বিশ্লেষণ চলে আশেপাশের মানুষদের নিয়ে।তাদের মুখ গুলো মুখোশের আড়ালে ঢাকা থাকায় চেনা যায়না, কিন্তু একার সাথে আলাপের সময় সেগুলোই চিনতে চায় মন।      সৌরভ সরকারের সুন্দর মুখোশটা সবাইকে আকর্ষণ করে,পোকা হয়ে তারা ছুটে যাই আগুনের দিকে।কিন্তু পোকা আকারে বড় হলে আর আগুনের সলতে পুড়ে এলে কি পোকা নিজে মরে আগুন নেভায়!হয়তো না।সৌরভ পর্ণার মানসিকতার না, পর্ণা তাড়াতাড়িই বুঝে ফেলেছিল,কিন্তু এতটা ভয়ঙ্কর…ভাবলেও কেঁপে উঠছে পর্ণা।হয়তো কোন ক্ষতি ওর হয়নি,কিন্তু এই যে মনের মধ্যে ভয়…ঘটনাটা মনে পড়লে ভয়,ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ভয়,আবার যদি ঐ শয়তানটা আঘাত করার চেষ্টা করে সেটা কল্পনা করে ভয়…মুখ মুখোশ আলাদা করলে মানুষ চেনা যায় ঠিকই কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এইরকম ভয় তাড়া করে।কিন্তু পর্ণাকে যে এই ভয় কাটাতেই হবে।আর একটা চিন্তা সৌরভের বাবা ছেলে অন্ত প্রাণ,তার ছেলের দোষ তার কাছে কখনোই অপরাধযোগ্য হয়না।তাহলে শুভঙ্কর স্যারের কি হবে? সৌরভের ঠোঁটের পাশে ওই কালসিটে তো কোনোভাবেই মানবেন না উনি।ওনার ছেলের গায় হাত তোলার শাস্তি কি হবে ভেবেই পর্ণা শিউরে উঠলো।ও এখনো জানেওনা কলেজের বাকি ছেলে মেয়েদের সৌরভের ওই কালসিটের কি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।কিন্তু এটা জানে ওর এস.এস স্যার এসবের পরোয়া করেনা।       সুশী যে এত ভালো বন্ধু ওর, এই ট্যুরে না এলে বুঝতেই পারতোনা।এতটা ভালোবাসে ওকে!পর্ণার কোনো দিদি বা বোন নেই,কিন্তু সুশীর মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়িয়েও নিজের বোনের ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছে ও।সুশীকে অনুরোধ করেছে এখনই মা বাবাকে কিছু না বলতে,তবে বলতে তো হবেই,ওরাই যে পর্ণার জীবনের দুটো গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ট্রেনে সবার হুল্লোড়ের মাঝে পর্ণার চুপ করে জানলার ধারে বসে থাকা সবার নজরে না এলেও যে নজর করার ঠিক করছেন,জানে পর্ণা।আসলে কফি শপে সুশীর সাথে স্যারের দেখা করার কথাটা শুনে থেকে পর্ণার চিন্তা ভাবনা গুলিয়ে গেছে।কলেজে সবাই জানে বছর ত্রিশের এই যুবক স্যার পড়া আর পড়ানো ছাড়া কোনো বিষয় উৎসাহী নন।ওনার রূপ উনি ব্যক্তিত্বের মুখোশে ঢেকে রাখেন।অনেক মেয়ের ‘ক্রাশ’ এস.এস শুধুমাত্র তাদের স্বপ্নের নায়ক হয়েই থেকে যান।যারা খুব পাগল লুকিয়ে চিঠি দিলেও উনি তা না পড়েই ছিঁড়ে ফেলে দেন।এরকম একজন মানুষ তার জন্যে চিন্তিত শুনলে যে কোনো মেয়ের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাবে,কিন্তু পর্ণা এখনো বিভ্রান্ত…সুশীর সাথে কথা বলা খুব দরকার।হঠাৎ স্থান কাল ভুলে,পাশে বসা সুশীর দিকে উত্তেজিত স্বরে পর্ণা বলে,”সুশী দুপুরের কথাটা?….শেষ হলোনা তো।”সুশী তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বলে ওঠে,”কাল তো কলেজ ছুটি,তোর বাড়ি যাবো।তখন কথা হবে”।আসলে ট্রেনে সবার সামনে কোনো কথাই সম্ভব না।পর্ণা বুঝতে পেরে নিজেকে গুছিয়ে নেয়।হাওড়া স্টেশনে ট্রেন কিছুটা দেরিতে ঢোকে,পর্ণার মা বাবা দুজনেই নিতে এসেছিলেন ওকে আগের দিনের মতোই।সুশিও ওদের সাথে ফিরে যায়।আসার সময় পর্ণার চোখ শুধু একজনকেই খুঁজছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি হয়তো আগেই বেরিয়ে গেছিলেন।    বাড়ি ফিরে খেতে বসে পর্ণা মা কে বলে,”মা আজ আমার সাথে শোবে?বড্ড ইচ্ছা করছে তোমায় জড়িয়ে ঘুমোতে”,বলতে পারেনা,’একা ওই অন্ধকার ঘরে আমি ঘুমোতে পারবোনা মা।ওই অন্ধকার আর একটা অন্ধকারকে মনে করিয়ে ভয় দেখাবে’।ওর মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”কেন শোবনা?তুই ই তো ‘রাত জাগি, তোমার ঘুমোতে অসুবিধা হবে’ বলে শুতে দিসনা।””না মা শরীরটা ভালো নেই তো।তাই একা শুতে ইচ্ছা করছেনা।তোমায় জড়িয়ে শুলে তোমার গায়ের ওই ‘মা,মা’গন্ধে ঘুমটা ভালো হবে।”পর্ণা জ্বর হওয়ার অজুহাত দেয়।ওর মা হেসে বলেন,”পাগলী একটা”।    কিন্তু গতরাতের শরীর মনের ক্লান্তি আর ওষুধের প্রভাবে যেরকম ঘুম হয়েছিল আজ মায়ের স্পর্শেও ভয় কেটে গেলেও সহজে ঘুম এলোনা।পায়েল যতক্ষন না মেয়ে ঘুমোলো জড়িয়ে শুয়ে থাকলেন।পর্ণা জানেনা,উনি সব জানেন।ওদের শুভঙ্কর স্যার আজ সকালেই সুশীর থেকে বাড়ির নম্বর নিয়ে ফোন করেছিলেন।উনি বারবার বলেছেন পর্ণার কোনো ক্ষতি হয়নি,কিন্তু মনের চাপটা কাটতে সময় লাগবে।আর ওকে একদম একা না রাখতে।পর্ণা না বললেও পায়েল আজ ওর কাছেই শুতেন যে কোনো অজুহাত দিয়ে।কিন্তু পায়েলের কানে লেগেছে শুভঙ্কর স্যারের ওই অসহায় গলাটা।ওনার উদ্বেগ ছিল কোনো আপন জনের মতোই।হয়তো পায়েলের ভুল।উনি বারণ করেছিলেন পর্ণাকে কিছু না বলতে।ঘটনাটা নাড়া খাওয়ার মতো হলেও স্যারের উৎকণ্ঠিত গলা পায়েলকে ভাবতে বাধ্য করেছিল।ছোটবেলার মতো আদর খেতে খেতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো পর্ণা তার মায়ের বুকে ঢুকে,কিন্তু মায়ের স্নেহ,চিন্তা পায়েলকে সারারাত জাগিয়ে রাখলো।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সারারাত প্রায় জেগে কাটালো সে।      মায়ের চোখ শুভ ও এড়াতে পারেনি।শারীরিক ক্লান্তি ছাড়াও মানসিক ভাবে যে ছেলে বিধ্বস্ত মায়ের চোখ তা বুঝেছিল।কালি পরে যাওয়া চোখ মুখে বেশি প্রকট হচ্ছিল ক্লান্ত চোখ দুটো,যা মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছিল যেন।কিন্তু স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই শুভ্রা দেবী ছেলে কে কোন প্রশ্ন করেননা।খেতে দিয়ে শুভর বিছানা করতে চলে যান,আজ একাদশী তাই ওনার খাওয়া আগেই হয়ে গেছিল।      যাহোক কিছু খেয়ে নিজের ক্লান্ত শরীরটা টেনে নিয়ে বিছানায় ছেড়ে দিলো শুভঙ্কর।বড্ড ক্লান্ত লাগছে,ক্লান্ত লাগছে শুধু শারীরিক ভাবেই না মানসিক ভাবেও।মেয়েটা যেন ওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে এই দুদিনে।বিশেষ করে দুপুরে বলা কথাগুলোর পর,শুভঙ্কর সেটা বুঝতে পারছিল।ফেরার সময় ভাগ্যের কারণে একই গাড়িতেও স্টেশন আসার সময় সামনের সিটে বসেও অনুভব করছিল ওর চাহুনি।ট্রেনে চুপচাপ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে চোখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি ওকেই খুঁজছিল।আড়ালে থেকেও ওর দিকেই তো নজর ছিল,তাই সবটা বুঝতে পারছিল শুভ। বাবা মার সাথে স্টেশন ছাড়ার সময় শেষবারের মতো ওকেই খুঁজছিল,কিন্তু সামনে আসতে চাইনি ও।না ও পর্ণার দুর্বলতা হতে চায়না, চায় ভালোবাসা হতে,সত্যিকারের ভালোবাসা।অন্তর দিয়ে যেদিন পর্ণা ওকে ভালোবাসবে,পরিণত ভালোবাসা, সেদিনই শুভঙ্কর ধরা দেবে।এই দুর্বল মুহূর্তে আশ্রয় হলে সারাজীবন ওর কাছে পর্ণা শুধু আশ্রয়ই খুঁজবে,আর কে বলতে পারে কোনোদিন সত্যি অন্তর অন্য কাউকে ভালোবাসলে ও শুভকে ছেড়ে চলে যাবেনা? তাই হয়তো পরিণত ,জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ শুভঙ্কর এতটা সময় নিচ্ছে।তাছাড়া কলেজে থাকাকালীন সম্পর্কে জড়ালে সেটা দুজনের সম্মানের ক্ষেত্রেই ভালো হবেনা।তার চেয়ে সময় নিয়ে সঠিক সময় যদি আসে তখন ভাবা যাবে।ও চায় পর্ণাও ওর মতো নিজের মধ্যে ভালোবাসাটা উপলব্ধি করুক।তবেই সে ভালোবাসা,সেই সম্পর্ক ভবিষ্যতে বয়ে বেড়াতে হবেনা,সেই ভালবাসা ওদের ভালো রাখবে।যতবার শুভ চোখ বুজল ভেসে উঠতে লাগলো সেই কান্না ভেজা চোখ দুটো,সেই ম্লান হাসিটা,সেই শুকনো মুখটা।যেগুলোর কোনোটাই ও দেখতে চাইনা।পর্ণাকে নিজেকেই পারতে হবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে।নাহলে কোনোদিন ও আগের মতো প্রাণচঞ্চল কথাপ্রিয় হয়ে উঠতে পারবেনা।ওর পর্ণা মনের জোরে হেরে যাবে সারাজীবনের মতো।সেটা শুভ কোনোদিনও মানতে পারবেনা।ও সবসময় থাকবে পর্ণার জন্যে।কিন্তু ভীতু নয়,হেরে যাওয়া নয়,মেনে মানিয়ে নেওয়া নয়…শুধু সেই প্রাণচঞ্চল,সারা কলেজ দাপিয়ে বেড়ানো,গলা ছেড়ে আবৃত্তি করা,প্রানের দোসর শাস্ত্রীয় সংগীতকে শাসন করা পর্ণার জন্যে।ও অপেক্ষা করবে,যদিও সেটা কষ্টের তাও করবে।

“ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল,লাগলো যে দোল”….পর্ণার মনেও যেন ডাক দিয়ে গেল রঙের উৎসব।শীত শেষ হয়ে বসন্ত প্রায় শেষের দিকে।শুকনো পাতা উড়ে গিয়ে গাছপালা সবুজের আবরণে সেজেছে, কদিন পর থেকে প্রখর রৌদ্রে দগ্ধ হবে তারা।কাল দোল, রঙের উৎসব।এবারে বসন্তের প্রায় শেষে দোল পড়েছে।পর্ণা বাড়িতেই আছে আজ,কাল মা দোলপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে পুজো করবে বলে বাড়ি গুছিয়ে মা কে সাহায্য করছে।নিচ থেকে মা ডাকলো মনে হলো,ঘরের মিউজিক সিস্টেমে রবীন্দ্রসংগীত বাজিয়ে কাজ করছিল,তাই ডাকটা ভালো করে শুনতে পায়নি।না ঐতো আবার ডাকছে।”যাই মা”,বলে পর্ণা নীচে নেমে এলো।”কত জোরে গান শুনছিস!”পায়েল রাগ করে বলেন।”সুশী সেই থেকে ল্যান্ডে ফোন করে ধরে আছে।নে কথা বল।” জিভ কেটে মায়ের থেকে ফোন নিয়ে কানে চাপে পর্ণা।”হ্যাঁ বল।আমার মোবাইলে করিসনি কেন?””কটা মিসড কল হয়েছে গিয়ে দেখিস?”সুশী রাগ দেখায় রীতিমতো।”সরি,সরি।জোরে গান চলছে তাই খেয়াল করিনি।বাই দা ওয়, তোর এত তাড়াই বা কিসের?আমি তো দেখলেই কিছুক্ষনের মধ্যে ফোন করতাম।অপেক্ষা না করে শুধু শুধু ল্যান্ডে ফোন করে ব্যালান্স নষ্ট করছিস কেন?দাঁড়া, আমি কেটে….”পর্ণাকে কথা শেষ করতে দেয়না সুশী,”ওসব ছাড়।আগে আমার কথা শোন।তোর কি আজ কলেজ যাওয়ার প্ল্যান আছে? না থাকলে এখুনি রেডি হয়ে স্কুটি নিয়ে আমাদের বাড়ি আয়।কলেজ বেরোতে হবে এক্ষুনি।”সুশীর কথায় পর্ণা আকাশ থেকে পড়ে। “তুই কি পাগল হলি?আজ পর্যন্ত মা এমনি সময় কোনোদিন স্কুটি নিয়ে কলেজ যেতে দেয়নি।কাল দোল,আর আজ আমি স্কুটি নিয়ে কলেজ যাচ্ছি বলবো আর ছেড়ে দেবে?!!” সুশী পর্ণাকে উড়িয়ে দিয়ে বলে,”কি ঘটনা ঘটেছে কলেজে তুই কি জানিস?” “কি এমন ঘটলো যে তুই এমন পাগলের প্রলাপ বকছিস?”পর্ণার কথায় সুশী বলে,”ঠিক আছে ছাড় স্কুটি নিতে হবেনা।জাস্ট একটা ড্রেস পরে স্টেশন চলে আয়ে।২০-২৫মিনিটে ট্রেন আছে একটা,পেয়ে যাব।আর হ্যাঁ খাওয়া না হলে কিছু খেয়ে নিস”।পর্ণা অধৈৰ্য্য হয়ে ওঠে,”ওয়েট, ওয়েট।কি হয়েছে ব্যাপারটা প্লিজ বলবি।আজ আমার কলেজ যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।ওই অকারণ রং আবির মেখে ভূত হওয়ার শখ থাকলে তুই একা যা”।”পর্ণা,এস.এস স্যারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে এসেছে,অভিযোগ মলেস্টেশন,সেই নিয়ে কলেজে ঝামেলা চলছে।..যেসব স্টুডেন্ট কলেজে ছিল,এমনকি অন্য ডিপার্টমেন্টের,সবাই ঘেরাও করেছে পুলিশকে।স্যারকে অন্যায় ভাবে গ্রেপ্তার করতে আসার প্রতিবাদে।আমায় এখুনি পারমিতা ফোন করেছিল,তোকেও করেছিল,কিন্তু পায়নি।” সুশী একটানা বকে গেলেও প্রথম বাক্যের পর পর্ণার কানে কোনো কথা ঢোকেনি,ফোনের পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়েছিল।ও বুঝতে পারছিল স্যারকে খুব বিশ্রী ভাবে ফাঁসানো হয়েছে।ও শুধু বললো,”স্কুটি চালানোর ক্ষমতা নেই।এক্ষুনি স্টেশন আসছি।”বলে সুশীকে আর  কিছু বলতে না দিয়ে ফোনটা রেখে দিল।পায়েল কাছেই ছিলেন। ৩মাসের চেষ্টায় মেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক আর হাসিখুশি হয়েছে বলে কদিন একটু চিন্তামুক্ত হয়েছিলেন।কিন্তু হঠাৎ মেয়ের ফ্যাকাসে শুকিয়ে যাওয়া মুখ দেখে এগিয়ে এলেন। “কিরে কি হলো?”পর্ণা শুধু বললো,”কলেজ বেরোচ্ছি।দরকার আছে।”পায়েল অবাক হয়ে বললেন,”হটাৎ!কিছু খাসনি তো।খেয়ে যা।আর তাড়াতাড়ি ফিরিস।” উত্তর এলো খুব ধীরে কিন্তু দৃঢ় স্বরে,”না মা কিছু গলা দিয়ে নামবেনা।আর কখন ফিরবো জানিনা।”তারপর হটাৎ পায়েলের বাঁহাত টা জোরে চেপে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আচ্ছা মা,তোমার ঠাকুর ভালো মানুষদেরই কেন কষ্ট দুঃখ দেয় বলতে পারো?”পায়েল অবাক হলেও শান্ত গলায় বলেন,”কি হলো সেটা বলবি তো?কি বললো সুশী?” পর্ণা হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বললো,”সময় নেই মা বলার।ট্রেন ধরতে হবে এখুনি।”তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”ওরা স্যারকে ফাঁসিয়ে দিলো মা।অত গুণী মানুষটাকে আমার জন্যে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে,মিথ্যে অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে….তা হয়না মা।বলো মা, তুমি তো বলেছিলে দরকারে মুখ খুলতে।আজ আমি চুপ করে থাকলে কোনোদিন নিজের কাছে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবোনা।তোমরা সরে যাবে মা পাশ থেকে?”পায়েল মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,”তোর কি দোষ?তুই ভেঙে পড়ছিস কেন?আর কে ফাঁসাবে?”…”তুমি চাঁদিপুরের ঘটনা জানোনা মা,তাই বলছো।ওই অকালকুষ্মান্ড সৌরভ সরকারের বাবা ফাঁসিয়েছে স্যার কে।”কেঁপে উঠলো মায়ের বুক।মেয়ের ঘটনাটা শুভঙ্কর স্যার জানালেও তাঁর নিজের কথা কিছু বলেননি।কিন্তু মেয়েটা কি বলবে?!পায়েল যথেষ্ট ওপেন মাইন্ডেড।কিন্তু মেয়ের মা তো।তার ওপর পুলিশ কেস।মেয়েকে আটকাতে পারবেননা বুঝে পর্ণার বাবাকে ফোন করলেন।৫মিনিটে যা বলার বলে ওনার উত্তরের অপেক্ষায় চুপ করতে পর্ণার বাবা বললেন,”মেয়েকে একদিন বলেছিলে না দরকারে সবাইকে বলবি।শুভঙ্কর বাবু তোমার মেয়ের জন্য কি করেছিলেন জানিনা,কিন্তু কিছু তো করেছিলেন ওই বাস্টার্ড টাকে।তাই আজ অতো ভালো মানুষটার এই পরিণাম।পর্ণাকে আটকিও না।আমিও এদিক থেকে কলেজ যাচ্ছি।”পায়েল কিছু বলতে যাচ্ছিলেন,কিন্তু ফোনের মধ্যে বিপবিপ শব্দ শুনে বুঝলেন উনি ফোন কেটে দিয়েছেন।এদিকে পর্ণা যাহোক করে একটা জিন্স টপ পরে নিচে নেমে জুতোয় পা গলিয়ে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে,কিন্তু পায়েল আটকাতে পারলেন না।আর কি বলেই আটকাতেন,কিন্তু মেয়ে তো,তার ওপর এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে….যতই শক্ত মনের হোক না কেন,ভয়ে কেঁদে ফেললেন। কলেজ গেট থেকে ঘেরাও করেছে সবাই,ইউনিয়ন ও আছে…প্রায় দুঘন্টা হয়ে গেছে পুলিশ শুভঙ্কর কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে বেরোতে পারেনি।পুলিশও ভাবেনি এই ভদ্রলোকের এত রেপুটেশন।ওদের ওপর অর্ডার ছিল কলেজ থেকে গ্রেপ্তার করার,যাতে সবাই জানতে পারে।কিন্তু এত সাংঘাতিক অবস্থা!এমনকি কলেজ কর্তৃপক্ষও কোনো সাহায্য করছেনা।কারণ যে মেয়েটার অভিযোগ, সে এই কলেজের কেউ নয়।স্যারের বাড়িতে ঘটনাটা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছে।কিন্তু তাতেও ওপর মহলের অর্ডার ছিল কলেজ থেকে তোলার।এমন দিনে তোলা হচ্ছে যাতে কাল বৃহস্পতিবার দোল, আর তার পরেরদিন হোলি…কোর্ট ছুটি।তারপর শনি-রবিও বন্ধ,ফলে অন্তত ৫দিন জেলের হাওয়া খায়।কিন্তু এখন যা অবস্থা,নিজেদের হাওয়া বেড়িয়ে যাচ্ছে।স্টাফ রুমে দু ঘন্টা ধরে বসে কেউ এক গ্লাস জল অবধি দেয়নি।যেন সব দোষ পুলিশের।যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে মাথা নামিয়ে টেবিলে ঠেকিয়ে বসে,কোনো চেঁচামেচি খারাপ কথা কিছু বলেনি।শুধু প্রথমে সব শুনে বলেছিল,”আমি কিন্তু নির্দোষ,ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে আমায়।” কিন্তু যেই বলা হলো,’কে ফাঁসাচ্ছে আর কেনই বা ফাঁসাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ‘ অমনি সেই যে মুখ বন্ধ করেছে আর খোলেনি।  হঠাৎ নিচ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজে অফিসার রেলিং এর ধারে গিয়ে দেখলেন,”দুটো মেয়ে নিচের পুলিশদের সরিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। হঠাৎ ‘অভিযুক্ত’ শুভঙ্কর সেন তীর বেগে দৌড়ে রেলিংয়ের ধারে এলেন।নিচের মেয়ে দুটোর মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বললেন,”পর্ণা কেন এসেছ তুমি এখানে?যাও বাড়ি যাও।সব ব্যাপারে কথা বলার বয়স তোমার হয়নি।” পর্ণা বলে মেয়েটা কোনো কথার জবাব না দিয়ে পুলিশ অফিসার এর উদ্দেশ্যে বললো,”স্যার আমার কিছু বক্তব্য আছে।শুভঙ্কর স্যার কে ফাঁসানো হয়েছে,আর কারণটা কি আমি বলতে চাই স্যার”। শুভঙ্কর চেঁচিয়ে ওঠে এবার,পুলিশ না মেনে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যায়।পর্ণার দু কাঁধে হাত দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,”তুমি বাড়ি যাবে।এটাই আমার শেষ কথা।অল রেডি অনেক কথা হয়ে গেছে আর না।”সুশীর দিকে তাকিয়ে বলে,”সুস্মিতা ওকে নিয়ে যাও এখান থেকে।”এস.এস এর হাত ছাড়িয়ে পর্ণা এগিয়ে যায় অফিসারের দিকে।”স্যার আমার কারণে স্যারের আজ এই অপবাদ।আমি বলতে চাই।প্লিজ স্যার….” আর কিছু বলতে পারেনা পর্ণা।শুভঙ্কর স্যারের একটা চড় ওকে থামিয়ে দেয়।চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে এবার পর্ণার।তাও দাঁতে দাঁত চিপে বলে,”এভাবে আর আমায় আটকাতে পারবেন না।আপনাকে নির্দোষ প্রমান না করে আমি বাড়ি ঢুকবনা কিছুতেই।তাতে যেখানে যেতে হয় যাবো”।সবার অবাক করা চোখের সামনে দিয়ে পর্ণা বেরিয়ে যায়,সুস্মিতাও ওর পেছনে ছোটে।

ক্রমশ…

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!