মুখোশের আড়ালে – পঞ্চম পর্ব

by Tamali

পঞ্চম পর্ব:-


পুজোর ছুটি শেষে কলেজ খুললো ভাইফোঁটার দুদিন পর।কিন্তু পুজোর রেশ যেন রয়ে গেছে।বাতাসে হালকা ঠান্ডার আমেজ আসছে সকালের দিকে।দিনের রোদ গায়ে লাগলেও অতটা কড়া আর নেই।পুজো শেষে হুজুকে বাঙালির মনে শীতের আমেজ।যারা পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যায়নি,শীতের ছুটিতে কোথায় যাবে সেটার পরিকল্পনায় ব্যস্ত।  সেইদিনের ঘটনার পর আজ সেই বিল্ডিঙে পর্ণা উঠছে।থার্ড ইয়ারের ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো,যেন ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলো খারাপ স্মৃতি টুকু। থার্ড ইয়ারের এখন ক্লাস সেভাবে হচ্ছেনা,শুধু অনার্স ক্লাস করতে আসে সেকেন্ড হাফে।একদিক দিয়ে শান্তি।পর্ণার দিক থেকে আর কোনো সাড়া না পেয়ে দশমীর পর সৌরভ নিজে ফোন করেছিল,কিন্তু পর্ণা ধরেনি।তখন দুদিন বাদে মেসেজ করে ক্ষমা চায়।কিন্তু পর্ণা অনুভব করতে পেরেছিল ওই মেসেজটা শুধুই কতগুলো শব্দ মাত্র যাতে কোনো আন্তরিকতা বা আবেগ নেই।পুজোয় একদিন সুশী ওদের বাড়ি এসেছিল,পর্ণা ওকে সব বলে।শুনে সুশী ওকে যা বলেছিল,তাতে পর্ণার নিজের ওপর রাগ বেড়ে যায়।সুশী শুধু না, অনেকে জানে সৌরভের চরিত্র,তাই ওরা চাইতোনা পর্ণা মেশে ওর সাথে।কিন্তু সুশীরা যতদিনে জেনেছিল ততদিনে পর্ণা শুধু জড়িয়েই যায়নি,অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল সৌরভকে।তাই সুশী বুঝেছিল পর্ণা সুশীর কোনো কথাই বিশ্বাস করবেনা।সুশী বলেছিল,”আমি অপেক্ষা করছিলাম সৌরভের অফিসিয়াল প্রোপোসের জন্যে।ভাবিনি ও অতো তাড়াতাড়ি রূপ দেখাবে….তবু আমারও ভুল,সেদিন ফাঁকা বিল্ডিঙে তোকে একা ওর সাথে যেতে দেয়া ঠিক হয়নি।আসলে ও তোকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ ধরে নিয়েছিল,ভাবেনি তুই বাধা দিবি।” সুশী পর্ণার হাত দুটো ধরে বলে,”তুই বলেই পেড়েছিস ওই হায়নার কবল থেকে এত তাড়াতাড়ি নিজেকে মুক্ত করতে।ও ওর বাইরের রূপ আর গান দিয়ে অনেক মেয়েকে মানসিক ভাবে শেষ করে দিয়েছে।তবে ও কোনো প্রমাণ রাখেনা।সেই জন্যেই তোকেও প্রপোজ অবধি করেনি।ওর বাবার টাকা ওকে অতো বেপরোয়া বানিয়ে দিয়েছে।ওর বাবার ক্ষমতার জন্যেই স্যারেরাও ওকে সমঝে চলে।” ওই দিনকার কথাগুলো পর্ণার মধ্যে বেঁচে থাকা সামান্য দুর্বলতাকেও কফিন বন্দি করে শেষ পেরেক মেরে দিয়েছিল।এরপর সৌরভের মুখ দেখার ইচ্ছাও ওর ছিলোনা।শুধু এস.এস স্যারের কথাটা কাউকে বলতে পারেনি,এমনকি বাড়িতেও না।কারণ ও নিজেও জানতোনা সত্যিটা।শুধু স্যারের ক্লাসের অপেক্ষায় ছিল।কলেজে গিয়ে থেকে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল কথাটা।টিফিন খেতে গিয়ে সেকেন্ড ইয়ারের থেকে জানা গেল ব্যাপারটা।নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলা ডিপার্টমেন্ট একটা উইকেন্ড ট্যুরে আশেপাশে কোথাও বেড়াতে যায় প্রতিবছর।তবে যারা ইচ্ছুক তারাই যায়,জোরাজুরি কিছু নেই।শেষ বার শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়েছিল,এবার সবাই চাইছে সমুদ্র দেখতে।প্রতি বছর দ্বিতীয় বর্ষে যারা থাকে তারাই সব  পরিকল্পনা করে আর সিদ্ধান্ত নেয়।তবে স্যারেরা সব ক্ষেত্রে সাথে থাকেন।কলেজের পারমিশন নেওয়া,বুকিং সব স্যারদের দায়িত্ব থাকে। এবছরের দায়িত্বে থাকা ছেলে মেয়ে গুলোর প্রথম পছন্দ চাঁদিপুর, বালেশ্বর থেকে গাড়িতে যেতে হয়।ওড়িশার বালাশোর বা বালেশ্বর অবধি ওরা ট্রেনে যাবে,সেখান থেকে গাড়ি।ওরা টিফিন টাইমে ইচ্ছুক যারা তাদের নাম জানতে এসেছিল।প্রথম বছর কলেজে,স্বভাবতই সবাই ওই কদিনের স্বাধীনতা ভোগ করতে উৎসাহী হয়ে উঠলো,কিন্তু কেউই বাড়ির অনুমতি ছাড়া কথা দিতে পারলোনা,বিশেষ করে মেয়েরা।পর্ণা জানতো ওর মা বাবা স্বেচ্ছায় ওকে অনুমতি দিতে পারবেননা,হয়তো অমত করবেননা।কিন্তু কোথাও অবচেতনে দুশ্চিন্তা নিয়ে ওনারা ভালো থাকতে পারবেননা,বিশেষ করে ওই সৌরভ ঘটনার পর।ওকে ঘিরেই ওর মা বাবার দুনিয়া,হয়তো ও একমাত্র সন্তান বলে।তাই ও বিশেষ উৎসাহ দেখালনা।কিন্তু সুশীরা প্রথমবার বাড়ির গন্ডি ছেড়ে বেরোতে বদ্ধপরিকর।সুশী পর্ণা কে বোঝাতে লাগলো,”যদি তুই সায়েন্সের কোনো বিষয় নিতিস, এই ট্যুরটাই বাধ্যতামূলক থাকতো,তখন কি করতিস?কাম অন পর্ণা,বি এডাল্ট।তুই বাড়িতে বলে তো দেখ,আমরা সবাই যাবো।যদি না বলে দেয় তখন দেখা যাবে”,এইভাবে যুক্তি পাল্টা যুক্তিতে সময় পেরিয়ে এস.এস স্যারের ক্লাসের সময় হয়ে গেল।স্যার ক্লাসে ঢুকে ওই হট্টগোলে অবাক হয়ে গেলেন।সাধারণত ওনার ক্লাস থাকলে পুরো ক্লাস চুপ করে বসে ওনার অপেক্ষা করে,আজ কি হলো এদের!”সাইলেন্ট, সাইলেন্ট” হটাৎ এস.এস এর চিৎকারে সবাই চমকে উঠলো,কখন স্যার ক্লাসে এসেছেন কেউ খেয়ালও করেনি।ভয় সব কটা মুখ একসাথে বন্ধ হয়ে গেল,শুধু সুশী এত উত্তেজিত ছিল ওই আওয়াজও ওর কানে যায়নি।পুরো ক্লাস থেমে গেলেও ওর চিৎকার অব্যাহত ছিল।এস.এস সোজা ওর দিকে ঘুরলেন,”এই যে মিস সুস্মিতা,পুজোর গল্প কি এখনো শেষ হয়নি।বাকি থাকলে বাইরে বেরিয়ে যাও, আর সঙ্গে যাকে গল্প বলছো তাকেও নিয়ে যেতে পারো।”এস.এস স্যারের আওয়াজে সুশীর সম্বিৎ ফিরে এলো।কিন্তু ভয়েতে মুখ দিয়ে কথা বেড়োলো না।কেউ লক্ষ্য না করলেও পর্ণা দেখলো স্যারের বাঁকা স্বরের আসল লক্ষ্য সে…কথা গুলো সুশীকে বললেও উনি মুখবিকৃত করে আছেন ওর দিকে তাকিয়েই।কারণটাও বুঝলো,আর তাই লজ্জায় মুখটা নামিয়ে ফেললো।সুশী অনেক কষ্টে সাহস জোগাড় করে বললো,”না মানে স্যার।ওই কলেজ থেকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করছিলাম।” সুশীর কথায় যেন স্যারেরও হুঁশ ফিরল।নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,”সেটা ক্লাসের পর করলেও হবে।এখন বসো।”তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে পড়ানো শুরু করে দিলেন।অন্য স্যার হলে নিজেই উৎসাহী হয়ে হয়তো আর কত কিছু আলোচনা করতেন,কিন্তু এস.এস এমনি।সবাই ওনার এই ব্যবহারেই অভ্যস্ত।কিন্তু এস.এস স্যার আজ যেন কোনোভাবেই পড়াতে পুরো মনোযোগ দিতে পারছেন না।শেষে তাঁর জীবনে প্রথমবার ক্লাস শেষের ঘন্টা পরার আগেই ,”সরি স্টুডেন্টস” বলে মাঝ পথে পড়া বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন।এ যেন বেড়াতে যাওয়ার থেকেও বড় ঘটনা।যিনি পরের ক্লাস অফ থাকলে ঘন্টা পরার পরও পড়িয়ে যান,তিনি পুরো ক্লাস করলেন না এ যেন অবিশ্বাস্য।শুধু একজন বিস্ময়ে চুপ করে রইলো।সব কিছু যেন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।স্যারের চোখে সে কি দেখলো?ঘৃণা!!সে জানে সে ভুল করেছে,কেউ দেখলে পুরোটাই ভুল ভাববে,ভুল মানে করবে।কিন্তু শুভঙ্কর স্যার!?….ওনার এত অস্থিরতার কারণ কি অন্য কিছু?তাহলে সুশীর রাগ ওকে দেখালেন কেন? পর্ণা চুপচাপ নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসতে গেল,”ওই কোথায় যাচ্ছিস?শেষের পাস ক্লাসটা করবিনা?”সুশীর প্রশ্নে ও চমকে বললো,”নারে।মাথাটা ভীষণ ধরেছে।বাড়ি চলে যাই”।”তুই আবার ওই খ্যাপা স্যারের কথায় মন খারাপ করলি নাকি?ওনাকে কি নতুন দেখছিস?জানিসনা ওনার কথা?ছাড়, ছাড়।চল ক্লাস করে সবাই একসাথে ফিরবো”।বন্ধুদের কথা ফেলতে না পারা পর্ণা আজ কিছুতেই ওদের কথা রাখতে পারলোনা।জোর করে বেরিয়ে গেল।রাস্তা দিয়ে হেঁটে যখন স্টেশন যাচ্ছে, পাশ দিয়ে ফুল স্পীডে শুভঙ্কর স্যারের বাইক বেরিয়ে গেল।চমকে উঠলো পর্ণা।কোনোদিনও স্যার কে এত খারাপ ভাবে বাইক চালাতে দেখেনি।ওর মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগলো,যেন নিজের সমস্ত রাগ উগড়ে গাড়ি চালাচ্ছেন।কি হলো কি স্যারের।!!!একে তো নিজে লজ্জায় স্যারের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলনা,কোনোদিন বলতেও পারবেনা ওইদিন ওর নিজের ভূমিকাটা,তার ওপর স্যারের এই বেখেয়ালি আচরণ।কলেজে আসাটাই একটা অনিচ্ছার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে যেন।কিছু ভালো লাগছেনা,কিছু না।
       ‘উফ,উফ!সেই চোখ।পাগল হয়ে যাবো আমি।কেন কেন কেন পারছিনা আমি,কেন পারছিনা নিরপেক্ষ থাকতে, অথবা….ঘৃণা করতে।কেন ওই চোখদুটো যেন না বলা কথা গুলো বলতে চায়, আর আমাকেই বলতে চায়।ওই চোখ গুলো বলছিল,আমি ভুল,ভুল ভাবছি।এতদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা কঠিন মনটা কেন ওই চোখে আর্দ্র হয়ে ডুবতে চাইছে।ভগবান,প্লিজ আমায় আবার দুর্বল করে ভেঙে দিওনা”।ওপরের এই স্টাফ রুমটায় ভাগ্গিস কেউ ছিলোনা।তাই ঘন্টা পড়ার আগে ফিরে এসে কাউকে জবাবদিহী করতে হয়নি।হটাৎ নজর গেল দরজার ফাঁক দিয়ে,পর্ণা একাই বেরিয়ে গেল ব্যাগ কাঁধে। না আজ আর ক্লাস করা সম্ভব না।নিজের ইমেজ ভেঙে আজ প্রথম ক্লাস ক্যান্সেল করে বাড়ি চলে যাওয়াই মনস্থির করলো শুভঙ্কর।নিজের বাহনকে অবধি আজ নিজের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই,প্রচন্ড বেগে ওই মেয়েটার পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গিয়ে তবে যেন মাথাটা একটু ঠান্ডা হলো।কিন্তু এভাবে কিকরে চলবে? পুরো পুজোর ছুটিটা জোর করে প্রতি মুহূর্তে ভোলার চেষ্টা করতে হয়েছে সবটা।প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে গেছে মা কে নিয়ে বা একা আর মনে হয়েছে যদি সেই ডক্টর চেম্বারের মতো দেখা হয়ে যায়,আবার পর মুহূর্তে মনে হয়েছে না না,সাথে ওই ছেলেটাকে দেখলে আবার সব বিস্বাদ হয়ে যাবে।  নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মার সাথে রত্না পিসির বান্ধবীর বাড়ি গেছিল।কিন্তু একটা মুহূর্ত মনটাকে শান্ত রাখতে পারেনি,এমনকি যখন মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠেছিল তখনও অবচেতনে ছিল ওই চোখটাই।মেয়েটা কলেজের সেই বান্ধবী,যে অবস্থার কারণে দশ বছর আগে শুভকে অপমান করেছিল।ভাগ্যের পরিহাসে টাকা পয়সা রূপ থাকা স্বত্তেও তার এখনো বর জোটেনি।একটা সামান্য প্রাইভেট স্কুলে পড়ায়… বাবা গত হয়েছে…দাদা ওদের দেখেনা…সব মিলিয়ে জীবন শুধু চলে যাচ্ছে।মেয়েটা জানতো ওদের বাড়ি আজ সেই কলেজের মুখচোরা ছেলেটাই আসছে, কিন্তু ভাবেনি পুরোনো দুর্বলতা আজ অবজ্ঞায় পরিণত হয়েছে।শুভ একটা মিষ্টি অবধি মুখে দেয়নি ওখানে,কিন্তু কোনো খারাপ ব্যবহারও করেনি।আলাদা কথা বলার উত্তরে জানিয়েছিল ‘দরকার নেই’।হয়তো শুভ্রা দেবী তখনই বুঝে গেছিলেন ছেলের মত,কিন্তু পরে কারণ শুনে ছেলেকে সাপোর্টই করেছিলেন।যে মেয়ে টাকা পয়সাকে গুরুত্ব দেয় জীবনের প্রথম থেকেই,সে আর যাইহোক তাদের সংসারকে সুখে রাখতে পারবে বলে তাঁরও মনে হয়নি।কিন্তু ওই সম্বন্ধটা কোনো কারণে না হওয়ায় যেন স্বস্তি পেয়েছিল শুভ।আগেও চাইনি বিয়ে করতে কিন্তু কোনো কারণে পাত্রীর বাড়ি ১-২বার যেতে হলেও মনের কোথাও একটা অল্প হলেও উত্তেজনা থাকতো।কিন্তু এবার যেন বাড়ি থেকে পা বেরোতে চাইছিলোনা।কিন্তু কেন সে এটা করছে? কি লাভ?কেন পারছেনা বরাবরের বাস্তববাদী ছেলেটা নিজেকে বোঝাতে যে এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই!কি করলে কোথায় গেলে শান্তি পাওয়া যাবে?নিজের জগৎ,নিজের জীবন এভাবে ঘেঁটে যাচ্ছে কিন্তু কিচ্ছু কিচ্ছু করতে পারছেনা নিজে।

      শেষ অবধি চাঁদিপুরেই চলেছে প্রায় পুরো বাংলা বিভাগ।স্যারেরা সব্বাই প্রায় যাচ্ছেন,এমনকি এস.এস ও। পর্ণা শেষ অবধি সুশীকে এড়াতে পারেনি,ও নিজে গিয়ে পর্ণার মা বাবার অনুমতি জোগাড় করেছে।ভোর বেলা বাবা মা দুজনে এসে তুলে দিয়ে গেছে ‘রূপসী বাংলা’ এক্সপ্রেসে।খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন প্রথমবার মেয়েকে একা দূরে ছাড়ছেন বলে।সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার এস.এস স্যার মাকে দেখে নিজে এগিয়ে এসে শরীরের কথা জিজ্ঞেস করেছেন।হোকনা দু মাস আগের কথা,কিন্তু ডক্টরের চেম্বারের কথা ভোলেননি।তবে বাংলার বিভাগীয় প্রধান বি.ডি(বিমল দাস)কে দেখে অনেকটাই স্বস্তি পেয়েছে পায়েল।ওনার অভিভাবকত্ব সব বাবা মা কেই স্বস্তি দেবে।তাছাড়া শ্রীময়ী ম্যাম আছেন ,অতিথি অধ্যাপিকা,মেয়েদের সাথেই থাকবেন।সব দেখে শুনে পায়েলদের উদ্বেগ একেবারে না কাটলেও কমেছে কিছুটা।কিন্তু ট্রেন ছাড়ার শেষ মুহূর্তে যে এসে ট্রেনে উঠলো তাকে কেউ আশা করেনি, অন্তত প্রথম বর্ষের অনেকেই…সৌরভ,সৌরভ সরকার।তৃতীয় বর্ষের হাতে গোনা দু চারজনের মধ্যে একজন,যার যাওয়ার খবর কারোর কাছেই প্রায় ছিলোনা।পর্ণা চায়নি এই ছেলেটার সাথে ২-৩দিন একভাবে কাটাতে।ও জানতো সৌরভরা কেউ যাচ্ছেনা।তাই ওর উপস্থিতি মনের আলোটা অনেকটাই কমিয়ে দিলো।ভাগ্গিস মা’রা চেনেনা, নাহলে সাময়িক পাওয়া স্বস্তিটা চলে যেত মন থেকে।সুশীর আশ্বাসের স্পর্শ পেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো পর্ণা,আর সেই মুহুর্তে এস.এস স্যারের দিকে চোখ চলে গেল…কি অসম্ভব কঠিন হয়ে আছে মুখটা।আর চোখে সেই সেদিনকার ঘৃণা।সৌরভ খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করছে সবার সাথে,এমনকি পর্ণা না চাইতেও একবার চোখাচোখি হতে মৃদু হাসলো।ওর স্বাভাবিক দক্ষতায় জমিয়ে রেখেছে ট্রেনের কামরা, যারা ওর আসল রূপটা এখনো জানেনা ওর সাথে মেতে আছে।গানে গল্পে যেন ওই মধ্যমনি।পর্ণা না তাকিয়েও বুঝতে পারছে সৌরভের চোখ দুটো ওকে নজর করছে বেশির ভাগ সময়টা।হটাৎ ট্রেনের কামরা সৌরভের সুমিষ্ট কণ্ঠে ভরে উঠল,”মাফ ভি কার দো ইয়ার, মাফ কারো সারকার…..”।গানের লক্ষ্য যে পর্ণা সেটা বেশ কিছুজন বুঝলেও বাকিরা গানটাই উপভোগ করতে লাগলো।এত কিছুর মধ্যেও পর্ণার নজর ছিল স্যারের দিকে।ও লক্ষ্য করছিল সৌরভ যত জমিয়ে তুলছে স্যার যেন ততই আড়াল হয়ে যেতে চাইছেন।পর্ণার মন ওকে অনেক কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছে এ’কদিনে,কিন্তু মস্তিস্ক মানেনি।স্যার ওকে পছন্দ করে ভালো ছাত্রী হিসেবে,কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু চিন্তা করার স্পর্ধাটুকু যেন পর্ণা ভাবতেও পারেনি।বইপাগল, সেমিনার -থিসিস পেপার-লেকচার নিয়ে ব্যস্ত মানুষটা হয়তো বিয়ে করেনি এখনো সময় পাইনি বলে,আর ত্রিশ ছেলেদের বিয়ের বয়সের শুরু।হয়তো সম্পর্ক আছে,যেখানে আরো কিছুদিন সময় দরকার,তাই এখন ব্যাচেলর তকমা বয়ে বেড়াচ্ছেন।সেকেন্ড ইয়ারের অনেক দিদির স্বপ্নেও স্যার আসেন,কিন্তু সেটা অনেকটাই এস.আর.কে কে নিয়ে দেখা স্বপ্নের মতোই।আসলে ওনার ব্যক্তিত্ব,জ্ঞান সবার কাছ থেকে শ্রদ্ধা,সম্মান আদায় করেই বেশি।ওনাকে নিয়ে কল্পনার স্বপ্ন কেউ কেউ দেখলেও সেটা রুপোলি পর্দার নায়কদের নিয়ে দেখা স্বপ্নের মতোই থাকে।ওনার রূপের আকর্ষণ চাপা পড়ে যায় ওনার ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধার কাছে।আড়ালে থাকা মানুষটি যে সবার সেরা,সেটাই তাঁকে বিশেষ করে রাখে।ওনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কেউ বিশেষ কিছু জানেনা,আর জানতে চায়েওনা, তাই সেটা আড়ালেই থাকে।হয়তো হটাৎ দেখা হয়েছিল বলে পর্ণাই একমাত্র ওনার মা কে দেখেছে,নাহলে আর কে আছে ওনার জীবনে কেউই তেমন জানেনা।বি.ডি স্যার ওনাকে খুবই স্নেহ করেন এটা শুধু সবার জানা।   পর্ণা জানে ওই ঘটনাটা স্যার দেখেছেন,কিন্তু কেন ওইসময় ওদিকে এসেছিলেন…এলেও ওদের কিছু না বলে চলে কেন গেলেন…তারপর থেকে পর্ণার প্রতি ওনার ব্যবহার এতোটাও খারাপ কেন হয়ে গেছে…আর ওর সাথে কোনোভাবে সৌরভ একই জায়গায় থাকলে আপাত শান্ত স্যার কেনইবা এত অস্থির হয়ে ওঠেন…এইসব কিছুর উত্তর পর্ণা খুঁজে চলেছে।মাঝে দু একবার নোটস ঠিক করাতে স্যারের কাছে গিয়ে আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ততা পায়নি।এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই পর্ণা দেখলো, শ্রীময়ী ম্যামের সাথে শুভঙ্কর স্যার একান্তে গল্পে ব্যস্ত।দৃশ্যটা  পর্ণার বুকে যেন অকারণেই একটা জ্বালা ধরিয়ে দিল।দৃশ্যটার থেকে পালাতে পর্ণা উঠে পড়লো ওয়াশরুমে যাবে বলে।স্যারেরা পাসেজের ধারের সিটে মুখোমুখি বসে ছিল,পাশ দিয়েই যাওয়ার সময় তাকাতেই চোখাচোখি হলো শুভঙ্কর স্যারের সাথে।চোখে যেন অনেক প্রশ্ন।পর্ণা চোখ নামিয়ে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো একদিকের গেটে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন স্যার।হাওয়ায় ওনার চুল এলোমেলো হয়ে গিয়ে অচেনা এক বাউন্ডুলে ছেলের মতো লাগছে।যদিও উনি পর্ণার দিকে ফিরে তাকালেননা।কিন্তু কেন জানেনা পর্ণার মনে হলো ওকে পাহারা দিতে স্যার উঠে এসেছেন।হয়তো অলীক কল্পনা,কিন্তু কোথাও যেন সৌরভকে দেখে মনে তৈরি হওয়া অশান্তিটা আশ্রয় পেলো এক এলোমেলো চুলের শান্ত মুখের ভরসাতে।মা বাবা সাথে না থাকায় যে অনিশ্চয়তা গ্রাস করছিল, শুভঙ্কর স্যারের এই উপস্থিতিটা হয়তো অনেকটা স্বস্তি দিলো পর্ণাকে।অবিশ্বাসের ভয় পিছতে শুরু করলো বিশ্বাসের অদৃশ্য আশ্বাসে।চোখের ভাষা পড়তে পারা একমাত্র মানুষটা যেন বাতাসের মধ্যে দিয়ে বলে পাঠালো,’আমি আছি’।

ক্রমশ…

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!