সপ্তম পর্ব:-
পরের দিন সকালবেলা সবাই বেরিয়ে পড়ল চাঁদিপুরের আশেপাশে যা কিছু দেখার আছে দেখতে।বেশিরভাগ সময়টাই কাটলো পঞ্চলিঙ্গেশ্বর দেখতে।দুটো পাথরের মাঝখান দিয়ে প্রবল জলের প্রবাহের মধ্যে পাঁচটা শিবলিঙ্গ,যা বাইরে থেকে দেখা যায়না,জলের প্রবাহের মধ্যে দিয়ে হাত দিয়ে অনুভব করতে হয়।বিশ্বাস যদি কেউ সেগুলো ছুঁতে পারে মনস্কামনা পূর্ণ হয়।কিন্তু খুবই পিছল দুই পাথরে পা দিয়ে সেই কাজ খুবই কঠিন,পা পিছলে পরে গেলে বড় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা থাকে।পর্ণা খুব উত্তেজিত…ছুঁয়ে দেখতে মন করছিল ওর।কিন্তু বি.ডি স্যার কোনো মেয়েকে এর জন্যে অনুমতি দিতে রাজি ছিলেননা।মনটা খারাপই হয়ে গেল বেচারির,”ধুর আর কোনোদিন আসা হবে!আসলেও এখনকার যে মনস্কামনা সেটার কি হবে?!’..হটাৎ কি ভেবে বি.ডি স্যার চেঁচিয়ে বললেন,”আমি তো পারবোনা, বয়স হয়েছে।যদি কোনো স্যার সাহায্য করেন তাহলে মেয়েরা চেষ্টা করতে পারো।”কিন্তু কোনো স্যারের ইচ্ছাই দেখা গেলোনা।আরে,ও কি!!!এস.এস না!!!.. এস.এস স্যার জিন্সের পা যতটা সম্ভব গুটিয়ে সেই পাথরে পৌঁছে গেছেন।এবার মেয়েরাই ভয়েতে পিছিয়ে গেল।শুধু পর্ণার ইচ্ছা থাকলেও ইতস্তত করতে লাগলো শুভঙ্কর স্যার কে দেখে,যদি ও গেলে স্যার রাগ করে উঠে আসেন,ভালো করে কথাই তো বলেন না ওর সাথে।শেষ অবধি সুশীর উৎসাহে পর্ণা নামলো সেই পাথরে।শুভঙ্কর স্যারকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন পর্ণাকে দেখতেই পায়নি, কিন্তু পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতে অন্যদিকে মুখ করে পর্ণার হাতটা ধরলেন সাহায্যের জন্য।পর্ণার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করতে লাগলো…হাতটা স্যারের হাতের মধ্যে ঘামতে লাগলো।একবার পা টা পিছলে যেতেই শক্ত হাতটা নিজের ওপর ওর পুরো ভারটা নিয়ে ওকে আঁকড়ে নিলো।পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে হাত ছোঁয়ান মাথায় উঠলো পর্ণার,মনেহল এখুনি পালাতে না পারলে ধরা পড়ে যাবে বুঝি।হার্টবিট যেন সব রেকর্ড ভেঙে দৌড়াচ্ছে।শুভঙ্কর স্যারের চিবুক ছুঁয়ে গেল পর্ণার কপালে।নিজের ওপর ভার নিয়েই স্যার ওকে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের মাথায় হাত ঠেকিয়ে দিলেন।হয়তো দুজন নর নারী একই সঙ্গে একই প্রার্থনা করল পঞ্চলিঙ্গেশ্বর এর কাছে।সবটাই ঘটলো ঘোরের মধ্যে, এস.এস স্যারের পারফিউমের গন্ধ পর্ণার চেতনাকে অবশ করে দিয়েছিল।এদিকে দুজনেরই জামা কাপড় সব প্রায় ভিজে একসা।পর্ণার ঘোর কাটলো স্যারের কথায়,”যাও কোথাও রোদে গিয়ে দাঁড়াও কিছুক্ষন।নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে”।উফফ কতদিন…কতদিন পর স্যার কথা বললেন এইভাবে স্নেহের কণ্ঠে।এস.এস হয়তো সারাজীবন পর্ণার সাথে থাকবেননা, কিন্তু এই অনুভূতি গুলো…এগুলো রয়ে যাবে ওর সাথে।পঞ্চলিঙ্গেশ্বর এর দয়ায় পর্ণার স্বপ্নের মানুষ,তার প্রকৃত প্রথম প্রেমের ছোঁয়া তো পাওয়া হলো জীবনে একবার।এগুলোই জীবন ডাইরির এক একটা পাতা,যা পর্ণা পরে মনে মনে উল্টোতে পারবে।সামান্য রোদ দেখে পর্ণা দাঁড়ালো,যতক্ষন না সবাই ফেরার জন্যে এগোচ্ছে রোদে একটু চাঙ্গা হয়ে নেওয়া যাবে। ‘চা খেতে হবে একটু,আর ওকেও খাওয়াতে হবে’,এস.এস এর চিন্তা বাধা পেলো তরুণ স্যারের কথায়,”এই যে ইয়ং ম্যান,সামান্য এক ছাত্রীর জন্যে শীতের সকালে নিজেকে ভেজালে তো?” এস.এস সতর্ক হয়ে বললেন,”একজন কই!বি.ডি.স্যারের কথামতো তো গেলাম,পর্ণা ছাড়া কেউ তো এলোনা।একঘেয়ে জীবনে এমন এক্সপেরিয়েন্স মন্দ না।”তরুণ স্যার সঙ্গে সঙ্গে চোখ মটকে খুব আস্তে করে বলেন,”তা এক্সপেরিয়েন্স টা মন্দ হলোনা বলো?”এস.এস বুঝতে পারেন তরুণ স্যারের ইঙ্গিতটা, ইনি এরকমই,খালি সবার জীবনে আমিষ গন্ধ খুঁজে বেড়ান।শুভঙ্কর স্যার সতর্ক হয়ে উত্তর দেন,”হ্যাঁ, যে যেভাবে দেখে সব কিছু।দেখার ওপর সব নির্ভর করে,আর নির্ভর করে মানসিকতার ওপর”।তরুণ স্যার সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যান বদমেজাজি ছেলেটা চটেছে তার কথায়।সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে বলেন,”এইরে আমাদের ইয়ং ম্যান রেগে যাচ্ছে।সরি সরি।আমি জাস্ট মজা করছিলাম”।শুভঙ্কর স্যারের মাথা তখন অলরেডি জ্বলে গেছে,কিন্তু সামলে নেন নিজেকে।বেড়াতে এসে অহেতুক তিক্ততা,তাও নিজের সিনিয়ার কলিগের সাথে, কাজের কথা না।তার নিজের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিটা নিয়ে আসলে এরকম মন্তব্য তার ভালো লাগেনি।পারলে তিনি ওই সময়টা আটকে রাখতেন।কিন্তু সেটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ভালো লাগা।সেটাকে রসালো গল্প বানাতে দিলে হবেনা।নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন,”না সরি-র কি আছে?কিন্তু সত্যি পঞ্চলিঙ্গেশ্বর কে ছোঁয়ার অনুভূতিটা সুন্দর,সেটা নিয়ে কেউ ভুল চিন্তা করে এটা চাইনা।”তরুণ স্যার মানুষটা এমনিতে খারাপ নন,এস.এস এর পিঠ চাপড়ে বলেন,”একজন বাচ্ছা ছেলে এখানকার গাইড।বলছিল ঠিক উল্টোদিকের জঙ্গলে নাকি দেখার জিনিস আছে কিছু।যাবে নাকি?”এস.এস এর মন একটু বিগরেই গেছিল,তাও বললেন,”বি.ডি স্যার কি বলছেন?এত মেয়েকে নিয়ে ওই জঙ্গলে রাস্তায় যাওয়া ঠিক?”তরুণ স্যার বুঝে গেলেন তার রসিকতায় শুভঙ্কর বিগড়েছে,তাই কথা না বাড়িয়ে বলেন,”হ্যাঁ তা ঠিকই।ছেড়েই দাও।তাছাড়া এখানে ছেলে মেয়েদের খাওয়ানোর ব্যাপার আছে,সময় লাগবে।…দেখি বি.ডি স্যার কি ব্যবস্থা করছেন একা একা।”বলে এগিয়ে গেলেন বিমল স্যারের খোঁজে।এস.এস ও অনুসরণ করলো।জীবনে প্রথমবার নিজের প্রেমকে ছোঁয়ার অনুভূতিটাকে একা দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করবেন ভেবেছিলেন,তা আর হলোনা।তাকিয়ে দেখতে পেলেন সহজ সরল মেয়েটা দূরে রোদে দাঁড়িয়ে জামা শুকোচ্ছে।’কে জানে কি ভাবে মেয়েটা ওর সম্পর্কে!আজ মনে হচ্ছিল চোখে অন্য ভাষা,সমর্পণের ভাষা।দেখতে ভুল হলো কিনা ভাবার সময়ও পেলোনা।নিজেকে লুকোতে অন্যদিকে মুখ করে রেখেও মেয়েটার নজর এড়াতে পারল না।পা পিছলে যেতে কোনো কিছু না ভেবে আঁকড়ে ধরার সময় মনে হলো মেয়েটার চোখে তার নিজের স্বপ্নেরই প্রতিবিম্ব দেখল যেন!ওর হাতের স্পর্শেও ছিল বিশ্বাস আর নির্ভরতার ইঙ্গিত।যেন বলতে চাইছিল,’স্যার আপনি আছেন,আর কোনো ভয় নেই’।হয়তো মনের ভুল।তার কি অতটা ভালো ভাগ্য যে তার এক তরফা ভালোবাসা এত সহজে পরিণতি পাবে!চিন্তা ফেলে রেখেই এগিয়ে যায় সবাই যেখানে খাচ্ছে। হোটেলে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল।সবাই চেঞ্জ করে লনে বসেছে চা নিয়ে।শুধু পর্ণা যায়নি।ঠান্ডা লাগার ধাত তার,মা চেঁচাবে ভিজে জামা কাপড়ে এতক্ষন ছিল জানলে।শরীরটা ভালো লাগছেনা।মনে হচ্ছে জ্বরও এসেছে।তাই রুমেই শুয়ে থাকে।সুশীকে বলেছে আসার সময় ওর চা টা নিয়ে আসতে।জানলা বন্ধ থাকায় ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে শেষ বিকেলের আলো এসে ঘরটা আধো অন্ধকার হয়ে আছে।হঠাৎ রুমের দরজার লক ঘুরিয়ে খোলার আওয়াজে বুঝতে পারে সুশী চা নিয়ে এলো।”টেবিলে রাখ’।সুশীকে বলে খেয়াল করে খুব চেনা অথচ অন্য একটা পারফিউমের গন্ধ।মাথাটা ঘুরে যায়।লাফিয়ে উঠে বসতে গিয়ে দেখে যা ভেবেছিল তাই।ঠান্ডা হিমস্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া দিয়ে।চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”কি ব্যাপার তুমি?মেয়েদের ঘরে ঢুকেছ অনুমতি না নিয়ে,সাহস তো কম না।বেড়িয়ে যাও এক্ষুনি।নাহলে আমি চেঁচাব।”….সৌরভ সরকার ক্রুর হাসি হাসে।”কে শুনবে তোর চিৎকার।সবাই তো লনে চা খাচ্ছে।মিউজিক বাজিয়ে দিয়ে এসেছি ওখানে।সবাই রিলাক্স করছে।….তোকে অনেকবার বলেছিলাম কথা বলার জন্যে, পাত্তাও দিসনি।এবার?” ভীষণ ভয় পায় পর্ণা।ফোনটা হাতে নিয়ে কল করতে যায় সুশীকে।কিন্তু তার আগেই সৌরভ ফোন কেড়ে নেয়।কাঁদো কাঁদো গলায় পর্ণা আকুতি করে ওঠে,’কি চাই তোমার আমার কাছে?আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি,খারাপ কথা বলিনি তাহলে কেন এরকম করছো?তাছাড়া এখন নাহোক পরে সবাই জানবে।তখন তোমার কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছ?”..হা হা করে হেসে ওঠে সৌরভ।”কি হবে আমার!হাহাহা।কিছু হবেনা,কেউ আমার চুলটাও বাঁকাতে পারবেনা।সবাই জানে আমি হোটেলে নেই।মেইন গেট দিয়ে সবার চোখের সামনে বাজারে বেরিয়ে গেছি।আর পিছন দরজা দিয়ে ঢোকার সময় কেউ দেখেওনি আমায়।আর তুই তো জানিস আমি প্রমান রাখিনা।তাই এখানে এসেছি আমার ছায়াও জানেনা।”একটু থেমে আবার বলে,”কি করেছিলি বলছিলি না?…. অপমান বুঝিস?তুই আমায় অপমান করেছিস দিনের পর দিন শুধুমাত্র তোর মত একটা পাতি মেয়েকে ছোঁয়ার অপরাধে।তাও যদি ভালো করে ছুঁতে দিতিস।…তুই জানিস কত মেয়ে আমার সাথে বেড শেয়ার করার জন্যে মুখিয়ে থাকে।সব বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে।আর তুই একটা পাতি ‘সো কলড’ মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে আমায় ইগনোর করিস!!!?এত হিম্মত হয় কিকরে?” সৌরভ একটু থামতে পর্ণা বলে ওঠে,”আমার সংস্কার আছে বলে আমি এটা করি।আমার বাবা মার শিক্ষা আমায় এটা করতে শিখিয়েছে।”সৌরভ এতক্ষন দূরে দাঁড়িয়েছিল,”এগিয়ে এসে পর্ণার গাল দুটো টিপে ধরে।”শিক্ষা!?…শিক্ষা দেখাচ্ছিস আমায়!১০মিনিটও লাগবেনা,৫মিনিটে সব বড় বড় কথা বন্ধ করে দিতে পারি।তোর এই ঠোঁট গুলো ঠিক করে না খেয়েও সবার অবজ্ঞার দৃষ্টি কুড়োচ্ছি।আমার ভেতর জ্বলে যাচ্ছে।শুধু তোকে শিক্ষা দেব বলে এসব লো-স্ট্যান্ডার্ড লোকেদের সাথে এই ফালতু একটা জায়গায় দুদিন ধরে বসে আছি।কতকগুলো হা-ভাতে ছেলের সাথে রুম-বেড শেয়ার করছি।আজ সুযোগ পেয়েছি।তুই কোনোভাবে প্রমান অবধি করতে যাতে না পারিস সেসব ব্যবস্থা করে তবে এসেছি।”কথা শেষ করে ঠেলে পর্ণা কে বিছানায় ফেলে শুইয়ে দেয়।….গালটা টনটন করছে ব্যথায়,সেই অবস্থায় পর্ণার মন থেকে ভয় চলে গিয়ে আসে তীব্র ঘৃণা।চিৎকার করে বলে ওঠে,”তোর মত কুকুররা আর কি পারে?তোকে পাত্তা দিয়েছিলাম ভেবে নিজের ওপর ঘেন্না হয়।ওইদিন তোর অসভ্যতাই বুঝিয়ে দিয়েছিল তোর কালচার।কিন্তু ভাবিনি তুই এত নোংরা নরকের কীট….”পর্ণার কথার মাঝেই হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সৌরভ।চোখ বুঝে ফেলে পর্ণা।দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।হঠাৎ অনুভব করে ওর ওপর কেউ নেই।আর ঘরে যেন আলো বেড়ে গেছে।চোখ তাকিয়ে দেখে প্রায় ৬ফুট লম্বা শুভঙ্কর স্যার ইঁদুরের মতো করে সৌরভের গলা টিপে ধরে দেয়ালের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।দেয়ালে চেপে ধরে পাগলের মতো চড় মারতে থাকেন।শ্রীময়ী ম্যাম আটকাতে চেষ্টা করেও পারেন না।সুশী দৌড়ে এসে পর্ণাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।পর্ণা তখন জ্বর আর উত্তেজনায় প্রচন্ড কাঁপছে।ওর আর ক্ষমতা নেই চোখ খুলে রাখার।মাথা কাজ করছেনা।ও যে পশুটার হাত থেকে বেঁচে গেছে বিশ্বাস করতে পারছেনা।আর পারেনা… চোখ বুজে আসে ওর,আর ঠিক শেষ মুহূর্তে দেখে শুভঙ্কর স্যার সৌরভের ডান হাতটা মুচড়ে ধরেন।স্যার যেন পাগল হয়ে গেছেন,পাগলের মতো চড় ঘুষি মারছেন পশুটাকে।জ্ঞান হারায় পর্ণা। পর্ণা চোখ খুলে দেখে চারিদিক অন্ধকার।কয়েক মুহুর্তে মনে পড়ে সন্ধ্যের কথা।ভয় চিৎকার করে উঠে বসতে যায় ও,সঙ্গে সঙ্গে সুশী হাত বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে,”এই তো,এই তো আমি পর্ণা।শান্ত হ।”সুশীকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পরে ও।সুশী গা’য় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।একটু শান্ত হলে জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,”একটু খা”।পাশের বেডে শুয়ে থাকা ম্যাম ও উঠে আসেন।মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”এখন কেমন লাগছে পর্ণা?” নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে ও,ক্লান্ত গলায় বলে, “ভালো।কিন্তু ঘুম পাচ্ছে খুব।আমি আর একটু ঘুমাই”।সুশী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,”একটু বস।ওষুধ আছে।আগে এই স্যুপটা খা।তারপর ওষুধ খেয়ে শুবি।”পর্ণা ক্লান্ত চোখে তাকায়,”দে”।সুশী ছোট একটা হট-পট এর ঢাকনা খুলে স্যুপ চামচ দিয়ে এগিয়ে দেয়।বলে,”দাঁড়া আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”পর্ণা দেখে শ্রীময়ী ম্যাম সরে গিয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন এতো রাতে।পর্ণা দেখছিল সব কিন্তু চিন্তা করতে পারছিলনা।আসলে ঘুম দরকার বলে ডক্টর ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিলেন।স্যুপ খেয়ে,ওষুধ খেয়ে ঘুমোনোর আগে ও শুধু জিজ্ঞেস করলো,”এখন কটা বাজে?” সুশী বললো,”রাত ৩টে।তুই ঘুমো,আমরা আছি।”পর্ণা আবার জানতে চাইলো,”বাকিরা কোন ঘরে?”সুশী জবাব দিলো,”এস.এস স্যার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ওদের।তুই চিন্তা করিসনা ঘুমো।”এস.এস এর নামে পর্ণা একটু কেঁপে উঠলো আর দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে।সুশী তা মুছিয়ে দিয়ে বললো,”ঘুমো এবার”।”তোরাও শুয়ে পর”,বলে পর্ণা পাশ ফিরে চোখ বুজল।
সকালে পর্ণার যখন ঘুম ভাঙল অনেকটা বেলা হয়ে গেছে, হোটেলের জানলা দিয়ে রোদ এসে মেঝেতে পড়ছে।অলস চোখে তাকিয়ে দেখে সুশী ওর নিজের ট্রলিটা গুছোচ্ছে।পর্ণাকে চোখ মেলতে দেখে ও উঠে আসে পাশের বিছানা থেকে।পর্ণা আস্তে আস্তে উঠে বসে।জ্বর নেই,কিন্তু গায়ে হাতে পায়ে খুব ব্যথা।খুব ক্লান্ত লাগে।সুশী বলে,”কিরে শরীর কেমন লাগছে?চা খাবি?” পর্ণা খুব ক্লান্ত গলায় বলে,”ভালো না।কটা বাজে এখন?” সুশী পর্ণার পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে বলে,”জ্বর তো নেই দেখছি।ওষুধ খেলে আর রেস্ট নিলে বাকিটাও ঠিক হয়ে যাবে।…এখন ১০টা বাজে।২টো নাগাদ আমরা বেরোব।এখন একটু চা খা।” পর্ণা বিছানা থেকে মাটিতে পা নামিয়ে বলে,”একটু ওয়াশ রুম থেকে ঘুরে আসি।তারপর চা খাবো।” সুশী হাতটা ধরে ওকে ওয়াশ রুমের দরজা অবধি পৌঁছে দেয়। ফিরে এসে চা খেতে খেতে পর্ণা জিজ্ঞেস করে ওর মনে জমে থাকা কৌতূহল।জানতে চায় সুশীরা কিকরে এসে পৌঁছায় এ ঘরে কাল বিকেলে?সুশী বলে,”তোর জন্যে চা নিয়ে রুমে এসে দেখি দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।ঘুমিয়ে পড়েছিস বলে ফিরে যেতে গিয়ে হটাৎ তোর উত্তেজিত স্বর কানে আসে।সব দরজা জানালা বন্ধ থাকায় ভিতরের কথা কিছু শোনা যাচ্ছিলনা স্পষ্ট।ফিরে এসে ভালো করে শুনতে গিয়ে সৌরভ সরকারের গলা শুনতে পাই খুব আস্তে।সঙ্গে সঙ্গে চোরাস্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া দিয়ে।ছুটি এস.এস স্যারের কাছে।স্যার আর ম্যাম একসাথে বসে চা খাচ্ছিলেন।আমার মুখে সব শুনে দুজনেই ছুটে আসেন।পাশের রুম আর এই রুমের কমন দরজাটা সৌভাগ্য বশত ওই রুম থেকে আটকানো ছিল।তাই সহজেই ঢুকতে পারি।”পর্ণা ফাঁকা চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বালিশে আধশোয়া হয়ে বলে,”তোরা না এলে আমি শেষ হয়ে যেতাম।স্যার যে তোকে বিশ্বাস করে ছুটে এসেছিলেন এটাই বিশাল ব্যাপার।স্যার তোকে আর কিছু বলেননি তার পর?”সুশী কিছুক্ষন চুপ করে ভাবে।পর্ণা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কিরে কি ভাবছিস?এস.এস স্যার তোর কাছে কিছু জানতে চাননি পরে?”একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুশী তাকায় পর্ণার দিকে,”আচ্ছা পর্ণা তোর কি মনেহয় স্যার কেন জিজ্ঞেস করবেন আমায় কিছু?””কারণ স্যার জানতেন কলেজের ঘটনাটা,এটা আমার বিশ্বাস।ওইদিন আমাদের বিল্ডিঙের টিচার্স রুমে স্যার ছিলেন,শুধু তাই না কোনো কারণে ওই মুহূর্তে উঠে থার্ড ইয়ারের রুমের কাছে আসায় সেই মুহূর্তের ঘটনাটাও হয়তো দেখে ফেলেন।কিন্তু এগুলো সবই আমার অনুমান।পরে স্যারের অদ্ভুত ব্যবহার আমায় ভাবিয়াছিলো,কিন্তু কোনো উত্তর আমি পাইনি।…” সুশী পর্ণাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,” সত্যি কি কোনো উত্তর পাসনি?নাকি পেয়েও গুরুত্ব দিসনি?” পর্ণা অবাক হয়ে বলে,”মানে?”সুশী আবারো একটু চিন্তা করে ওর সাথে স্যারের কফি শপে হওয়া কথা সব পর্ণা কে বলে।সব শুনে পর্ণা কিছু বলতে যাবে ওদের রুমের দরজায় কেউ নক করে।সুশী উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।যাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তিনিই হাজির দরজায়।”কি খবর সুশী?পর্ণা উঠেছে?কেমন আছে এখন?” সুশী স্যারকে দরজা ছেড়ে দিয়ে বলে,”ভেতরে আসুন স্যার।” পর্ণা এবার দেখতে পায় শুভঙ্কর স্যারকে।সারারাত না ঘুমিয়ে চোখ মুখ বসে গেছে।চোখে রাত জাগা ক্লান্তি,কিন্তু সব ছাপিয়েও মুখে ধরা পড়ছে দুশ্চিন্তা,কোনো আপন জনের ঠিক না থাকার দুশ্চিন্তা। শুভঙ্কর স্যার পর্ণা কে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে পাশের খাটে বসেন।ওর মুখের দিকে তাকিয়ে উৎকণ্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করেন,”কেমন আছো পর্ণা?ঘুম হয়েছিল?”পর্ণা এতক্ষন হাঁ করে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়েছিল অবাক হয়ে।মুখ নামিয়ে শুধু ঘাড় নাড়ে, ওর যে হটাৎ ভীষণ কান্না পাচ্ছে।শুভঙ্কর স্যার কিছু একটা বোঝেন,তারপর বলেন,”রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা পাগলা কুকুর কামড়ালে তুমি কি লজ্জা পাবে?হয়তো ভয় পেতে পারো।কিন্তু কি জানতো ভয় পেলেই ভয় মনে জাঁকিয়ে বসবে।কিন্তু তোমার মত সাহসী মেয়ে যদি কুকুরটার চোখে চোখ দিয়ে রুখে দাঁড়াও,সে ঠিক লেজ গুটিয়ে পালাবে।আসলে এসব রাস্তার কুকুরগুলোর মনেই ভয় বেশি থাকে।”এতটা বলে উনি একটু থামলেন।লক্ষ্য করলেন পর্ণা মুখ নিচু করে কাঁদছে।উনি উঠে গিয়ে পর্ণার মাথায় হাত রাখলেন।পর্ণা একটু কেঁপে উঠলো।মনে হলো কয়েক লক্ষ গুন মনের জোর ওর ফিরে এলো,মনে হলো শুভঙ্কর স্যার একবার ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরুন,তাহলে সব কষ্ট কমে যাবে।কিন্তু ও জানে সুশী না থাকলেও উনি এটা করতেন না।উনি জানেন কতটা সীমারেখা।কিন্তু পর্ণার যে বড্ড ওই বুকটায় মুখ লুকোতে ইচ্ছা করছে।পর্ণা মনে মনে মুখ লুকোয় ওর ওই কাঙ্খিত জায়গাটায়।আগের জায়গায় এসে বসে এস.এস স্যার বলেন,”আমি তোমার মা বাবার দেয়া সংস্কারকে শ্রদ্ধা করি।আমি জানি তাঁরা সবসময় তোমার সাথে আছেন,তাহলে কাঁদছো কেন?নাও ওঠো,আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে নাও।রুম সার্ভিস থেকে গরম জল নিয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে চলে এসো দুজনে।খেয়ে অল্প রেস্ট নিয়ে নাও।আমরা সবাই দুটো নাগাদ বেরোবে।আর হ্যাঁ, তুমি রিলাক্স থাকো।আমি,শ্রীময়ী আর বি.ডি স্যার ছাড়া কেউ কিছু জানেনা।আর জানানোর দরকারও নেই।…ওই বাস্টার্ড টাকে চাইলে আমি পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতাম,কিন্তু তাতে ভবিষ্যতে তোমারই বেশি ক্ষতি হওয়ার চান্স থাকতো সব দিক দিয়ে।তবে ওকে আমি ছাড়িনি,ভবিষ্যতে কোনোদিন তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাতে এলে চোখ দুটো উপরে নেব”।কথাগুলো বলে আর এক সেকেন্ডও না বসে দরজা খুলে বেরিয়ে যান শুভঙ্কর স্যার।পর্ণার মনে হয় আবার শুনতে পেল সেই কথাটা,’আমি আছি’। পর্ণাদের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেলের ফাঁকা ছাদে চলে যায় শুভঙ্কর।ওর দরকার একটু একা থাকার।একটু নিজেকে নিয়ে ভাবার।পর্ণার প্রতি ওর ভালোবাসাটা শুধুই ছিল ‘প্লেটোনিক লাভ’ বা মনের টান,যেখানে ও কোনোদিন ভাবেনি পর্ণাও ওকে একই চোখে দেখবে।একে তো পর্ণা বয়সে প্রায় ১০বছরের বেশি ছোট,তার ওপর সৌরভ সরকারের সাথে প্রথম দিন থেকে ঘুরে বেড়াতে দেখা।সত্যি কথা বলতে কি পর্ণা কে প্রথম থেকেই প্রেমিকার ভালোবাসা বাসেনি, প্রথম ক্লাসে ওর ওই জলভরা চোখ শুভঙ্করকে যেন অনেক কিছু বলতে চেয়েছিল।খোঁজ নিতে গিয়ে বাংলার প্রতি ওরও একই রকম ভালোবাসা দেখে স্নেহ জন্মায়,বিশেষ নজর রাখতে রাখতে কবে যে ওকে ভালোবেসে ফেলে।কিন্তু সৌরভের সাথে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরেও নিজের ভালোবাসা নিয়ে ভাবেনি,ওটা ছিল একান্ত নিজের ভালোলাগা অনুভূতি,একা নিজের ভালো সময় কাটানোর রসদ।কিন্তু এই চাঁদিপুর ট্যুরটা অনেক কিছু বদলে দিলো।প্রথম ভালোবাসা ছুঁয়ে গেল তাকে…পর্ণার অলক্ষ্যে ওকে রক্ষা করতে করতেও শেষ রক্ষা হলোনা।পশুটা ওর শরীরটা নোংরা করতে না পারলেও ওর নরম মনে ক্ষত করে দিলো।ভগবানের দয়ায় শেষ রক্ষা করতে না পারলে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারতোনা।শুধু বি.ডি স্যার আর শ্রী জানে ওই জানোয়ারটার হাত মুচড়ে দিয়েছে এস.এস।ফুলের মতো মেয়েটাকে ওই হাত দিয়ে আঘাত করেছে ওই শয়তানটা,দরজা খুলে ঢোকার মুহূর্তে দেখেছিল।…ভালো লাগছেনা,কিচ্ছু ভালো লাগছেনা।কাল সারাটাদিন কত ভালো কেটেও দিনটা পর্ণার জীবনে ভয়ের দিন হয়ে থাকলো।আরো অনেক অনেক অনেক দ্বন্দ্ব মনের মধ্যে…পর্ণা কি চায়?ও কি আদৌ শুভঙ্করকে নিয়ে একটুও ভাবে?নাকি শুধুই শ্রদ্ধা।ওই চোখ,ওই হাতের স্পর্শ,ওর সমর্পণের দৃষ্টি,সেগুলো কি শুধুই শুভঙ্করের চোখের ভুল!সৌরভকে কাল পারলে প্রাণেই মেরে দিত ও,যদিনা শ্রী বি.ডি স্যার কে ফোন করে ডেকে নিত,কিন্তু এর ফল ভালো হবেনা এটাও জানে ও।এসব ভাবতে ভাবতে ওর মন আর মুখ কঠিন হয়ে উঠলো….যা হবে হোক,কিন্তু পর্ণার কোনো ক্ষতি ও বেঁচে থাকতে হতে দেবেনা।তাতে যদি সৌরভের বাবার শত্রুতা ওকে সহ্য করতে হয়,হবে।নিজের বিনিময় হলেও ও পর্ণাকে রক্ষা করবে।কারণ পর্ণা এখন ওর জীবন,মা বাদে পর্ণা ওর বাঁচার একমাত্র অবলম্বন।কিন্তু এড়িয়েও চলতে হবে ওই মেয়েটাকে,ধরা পড়ে যাবে নাহলে।ওর ভালোবাসা আগে প্রকাশ পাক ও চায়না।যদি পর্ণা ওকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে চায় শুভঙ্কর সহ্য করতে পারবেনা।পর্ণাও যদি একই ভাবে ভালোবাসে তবেই এই সম্পর্ক সম্ভব।একেই সৌরভ সরকারের দেয়া ঘা এখনো ওর মনে দগদগে।না,কিছুতেই ওকে আর কোনো কষ্ট দিতে পারবেনা শুভঙ্কর,তাতে যদি ওকে সারাজীবন একতরফা ভালোবাসতে হয়,তাই হবে।
ক্রমশ…