“মধু,কি খাবি জলখাবারে আজ?”মায়ের প্রশ্নে চমকে উঠে দরজার দিকে ফেরে মধুজা।মমতা বুঝতে পারেন আবার অতীতে উঁকি মারতে গেছিল তাঁর মেয়ে।তিনি এগিয়ে এসে জানলার ধারে বসে থাকা মধুজার মাথায় হাত রাখেন,মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে সস্নেহে বলেন,”আজ ছুটির দিনে পুরোনো কথা না ভেবে যা ছেলেটাকে নিয়ে একটু কোথাও ঘুরে আয়।ছেলেটা কদিন ধরেই বেড়াতে যাওয়ার বায়না করছে।”মমতা দেবীর কথায় মধুর মধ্যে থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
“বুবকা কি খেলো মা?”,কথা ঘোরানোর জন্যে সে বলে ওঠে।
“ওকে আজ একটু ওর প্রিয় পাস্তা করে দিলাম।খাওয়া নিয়ে তো ওর কোনো ঝামেলা নেই।”মায়ের কথায় আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।সত্যি ওই টুকু ছেলের কোনো কিছু নিয়েই ঝামেলা নেই।যে বাবা কে অতো ভালোবাসে তাকে ছেড়ে প্রায় একমাস আছে,কিন্তু একদিনের জন্যেও মধুর সামনে বাবার জন্যে কাঁদেনি।কিন্তু মায়ের কাছে শুনেছে দিদুনকে বলে বাবার কথা।ল্যান্ড ফোন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ফোন ও করে।সে রাতের ওই অর্থহীন অমানুষিক ঝগড়া আর তার পরের আরো এক সপ্তাহ ধরে চলা রেশ,আর শেষে মানসিক ভাবে বিদ্ধস্ত মধুর নিজের সংসার ছেড়ে চলে আসা…সবটাই আসলে ওই কচি মনেও প্রভাব ফেলেছিল।কোনোদিন বাবা মা কে এভাবে লড়তে তো দেখেনি,কথা কাটাকাটি হলেও তা ঝগড়ার পর্যায় পৌঁছায়নি,নীরব মান অভিমান হলেও বুবকা বোঝেনি,তাই হঠাৎ এই বাড়াবাড়ি মধুই মানতে পারছেনা…ওর নিজের কোনো দোষ খুঁজে না পেলেও ভাবছে সেদিন চুপ করে থাকলেই হতো,তাহলে হয়তো কথার পিঠে কথা না বললে ছোট বুবকাটা এতটা কষ্ট পেতনা।কিন্তু জিৎ এর এই ব্যবহারের কোনো কারণই মধু খুঁজে পাচ্ছেনা।মধুর শান্ত মেজাজ কিছুটা বদলেছে এটা সত্যি, কিন্তু সংসারের চাপ,কর্মক্ষেত্রে অশান্তি তাতে মন মেজাজ কি সব সময় ঠিক থাকে?বুবকার শিশুমন সবটা হয়তো বুঝতে পারেনি কিন্তু অনুভব করেছিলো অনেকটাই।তাই পরের শনিবার আবার ঝগড়া শুরু হতে মধু বিরক্ত হয়ে যখন মায়ের কাছে চলে আসবে বলে বেরোতে যায় অরিজিৎ মধুকে একবারও আটকাতে চেষ্টা করেনি,শুধু জোর করে বুবকা কে ধরে রাখতে চেয়েছিল,কিন্তু বাবার হাত ছাড়িয়ে মায়ের কাছেই চলে আসে বুবকা।আজও ঠান্ডা মাথায় বারবার ভেবেও মধুজা ঝগড়ার কোনো প্রকৃত কারণ খুঁজে পায়নি।আর এরকম ঝগড়া দশ বছরের বিবাহিত জীবনে কোনোদিন হয়েছে বলেও মনে পড়েনা।তবে বার বার একটা কথাই মনে হয়েছে এই ঝগড়ার বীজ অনেক আগেই বপন করা হয়েছিল।নাহলে জিৎ সেদিন অকারণ ওরকম আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলো?!!প্রথমে যখন মধুর কথার জবাব দিচ্ছিল না ও বুঝতে পারছিল সকালে অফিস পৌঁছতে দেরি হয়েছে বলে রেগে আছে,ওর নিজেরও খারাপ লাগছিল,কিন্তু ওর তো সত্যি কোনো উপায় ছিলোনা।আসল ঝামেলা শুরু হয় খেতে বসে যখন কেনা রুটি তড়কা খেতে জিৎ অস্বীকার করে,অথচ ওই তড়কা খেতে ও খুব ভালোবাসে।এমনকি এমনও হয়েছে কখনো বাড়ির তরকারি পছন্দ না হওয়ায় বাড়ির সামনের গুমটি থেকে রাতে গিয়ে তড়কা কিনে এনেছে ও।কিন্তু ওইদিন ঝগড়া করবে বলেই ও তৈরি হচ্ছিল।আবার আগাগোড়া ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করে মধুজা।….
“বাড়ির তরকারি দাও।শরীর ভালো নেই,কেনা তড়কা খাবোনা।”রুটির থালাটা সামনে থেকে ঠেলে সরিয়ে বলে অরিজিৎ।অবাক হয়ে মধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর আস্তে আস্তে বলে,”আজ রুটি তরকারি হয়নি বাড়িতে।তাই তো কিনে আনলাম।আর তোমারতো খুব প্রিয় এটা।তাই…”,মধুর কথা শেষ করতে দেয়না জিৎ।মুখ বেঁকিয়ে বলে,”বাড়িতে রান্না হয়নি কেন?এত রাত অবধি কোথায় চড়ে বেড়াচ্ছিলে যে রান্নার লোককে আসতে বারণ করে দিয়েছো?ওই জন্যেই শ্বশুর বাড়িতে পোষাচ্ছিলো না।এরকম নেচে বেড়ানো,যখন খুশি বাড়ি ফেরা কোনোটাই হতোনা না।আমি তো রাত করে ফিরি,তাই কিছু জানতেও….”,অরিজিতের কথা থেমে যায় মধুজার চিৎকারে,”জি-ই-ই-ত।কি বলছো ভেবে কথা বলো।কোনদিন বাইরের রুটি খেতে হয় তোমায়?আজ বাবার কাছে একটু বসলাম বলে দেরি হয়ে গেল।তাও তুমি তড়কা পছন্দ করো বলে…”,এবার মধু কে থামিয়ে দেয় জিৎ।”পছন্দ??আমার কোন পছন্দের গুরুত্ব দিয়েছো তুমি?তোমার বাবা অসুস্থ,তুমি চাইলে গিয়ে বসতে পারো,সেবা করতে পারো।আর আমার মা বাবা???যাদের একা অতদুরে ফেলে তোমার স্বার্থে এখানে আসতে হল,তাদের কিছু হলে কে দেখবে মধুজা ? তাদেরও ইচ্ছা হয়, ছেলে,ছেলের বউ,নাতি কাছে থাক।তাদের জন্যেও আমার চিন্তা হয়।কিন্তু তুমি…”,অরিজিৎ শেষ করতে পারেনা অভিযোগের তালিকা।গর্জে ওঠে মধু,”বাহ!বাহ! তা বিয়ের আগে তুমি কোথায় থাকতে মিস্টার অরিজিৎ?দিল্লি থাকতে চিন্তা হতোনা?নাকি ১০বছর আগে যখন তোমার বাবা অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন তখন তোমার ওনার বয়সের খেয়াল হয়নি?আর হ্যাঁ আমার স্বার্থ কতটা সে তুমি খুব ভালো জানো।আমরা এখানে এসেছি বুবকা দু বছরের হওয়ার পর।প্রথম এক বছর তো মায়ের কাছে ছিলাম বুঝতেই পারিনি ওই ছমাস বুবকাকে মা কিকরে সারাদিন রাখতো,আর তার পরের এক বছর আমার কিভাবে কেটেছে আশা করি তোমায় বলে দিতে হবেনা।কত দিন যে আমার ‘লিভ উইথআউট পে’ হয়েছে আমার থেকে তুমি ভালো জানো।তারপর আর যখন পারছিলামনা,এমনকি বুবকাকে প্ৰি স্কুলে দিলেও আনার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছিলনা বলেই না আমায় আমার বাপের বাড়ির কাছাকাছি আসতে হলো?আর হ্যাঁ তোমার বাবা মা কেও বারবার সাথে আসতে বলা হয়েছে,আজ পর্যন্ত আমার ছুটি না থাকলে কবে তারা এসে নাতির জন্যে এখানে থেকেছেন বলো তো?!”একটানা কথা গুলো বলে মধু একটু হাঁফ নেয়।শাশুড়ি মা কোনোদিন ই চাকরি করা বউ চাননি,কিন্তু ছেলের পছন্দ কে না বলে ছেলের অপ্রিয় হতেও চাননি।শুধু একটাই শর্ত রেখেছিলেন,বিয়ের পর ছেলেকে বউ নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকতে হবে,কলকাতায় থাকলে হবেনা।মধুকে না জানিয়েই জিৎ মা কে কথা দিয়ে দেয়।জিৎ এর বেলায় অফিস বলে যতটা না কষ্ট হতো তার চেয়েও বেশি অফিস টাইমে ট্রেনে যাতায়াতে অনভ্যস্ত মধুজার হতো।তাও ছোট থেকে মানিয়ে চলতে শেখা মধু কোনোদিনও কিছু বলেনি।এমনকি ছমাসের ছেলে কে ছেড়ে যখন অফিস যেত আর যাতায়াত মিলিয়ে প্রায় তেরো ঘন্টা ওই দুধের শিশু কে ছেড়ে থেকেছে তখনও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে গেছে।আয়া থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ দিন এটা ওটা বাহানায় মধু বেরোতে বাধা পেয়েছে।সব সামলেও ওই অত কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে পাওয়া ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্যে যখন শাশুরিমা চাপ দেন আর মানতে পারেনি মধুজা।জিৎ কে বলে সমস্যা গুলো।বছর পাঁচেক ধরে কলকাতায় রোজ যাতায়াত করে ক্লান্ত হয়ে পরা জিৎও মধুর অবস্থা সেদিন বোঝে।দুজনের জমানো টাকার সাথে লোন নিয়ে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনতে রাজি হয়েও যায়।সবচেয়ে বড় কথা,মধুর বাপের বাড়ির কাছে ফ্ল্যাট কেনার আইডিয়া টাও অরিজিৎ এর ছিল,কারণ ওই জায়গা থেকে দুজনের কর্মক্ষেত্রই কাছাকাছি ছিল।উপরন্তু মধুজা আরো কাছাকাছি ব্রাঞ্চে প্রমোশনও পাচ্ছিল।সবমিলিয়ে শুধু মধুর স্বার্থে বা ইচ্ছায় কোনো কিছুই হয়নি।একটু চুপ থেকে মাথা ঠান্ডা করে মধুজা বলে ,”এতদিন আমাদের সম্পর্কের আসল শক্তি ছিল একে অপরের প্রতি বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা।দুজনের সব সিদ্ধান্ত মিলিত ছিল।আজ এমন কি হলো যে তুমি এসব বলছো?আমি তো জানতাম আর কেউ না জানুক আমরা একে অপরের অবস্থাটা পুরোপুরি জানি বুঝি।”মধুর কথার প্রত্যুত্তরে জিৎ যা বলে মধু তার জন্যে কখনোই প্রস্তুত ছিলোনা,”কি তখন থেকে নিজের চিন্তাটা আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছো।এতদিন যা করেছ, করেছ,আর না।তোমার ভাবনা নিজের কাছে রাখো।এখানে এসে থেকে বুবকার সব দায়িত্ব তোমার বাবা মা নয় আমি সামলাচ্ছি।আরে আমার অফিস প্রাইভেট হতে পারে,কিন্তু একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নিয়ম তো তোমায় নতুন করে বোঝাতে হবেনা।আজ তোমার কারণে আমার মানসিক অস্থিরতা থেকে এত খারাপ প্রেসেন্টেশন দিয়েছি যে কোম্পানি প্রজেক্ট পাবেনা হয়তো।আরে এভাবে চাকরি থাকবেনা আমার।বোঝ….”,শেষটা জিৎ গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।আবার থেমে বলে,”এভাবে চলতে পারেনা মধু।তোমার সংসারের কারণে আমার কেরিয়ার শেষ হতে চলেছে।তোমার জবাবদিহি করে,কিছু কথা শুনে যে ঝামেলাটা মিটতে পারে,আমার সেটার কারণেই এক কথায় বেঞ্চে পাঠিয়ে চাকরি অবধি খেয়ে নিতে পারে কোম্পানি।আর সবচেয়ে বড় কথা কি জানো?বিয়ের আগের তুমি আর এখনকার তুমি এই দুটো কোনোভাবেই এক না।আর নাহলে আমার বোঝার ভুল ছিল।তবে তোমার মধ্যে যে শান্তি আমি আগে পেতাম,এখন তার ছিটে ফোঁটাও পাইনা।আমি দেরিতে বেরোই মানে এই নয় তুমি যা বলবে তাই করতে হবে।আর হ্যাঁ আমি বারবার আয়া রাখতে বলেছি,তুমি শোননি।আমি আর জাস্ট এডজাস্ট করতে পারছিনা।মুখ বুজে সয়ে সয়ে তুমি মাথায় উঠে গেছো।”
জিৎ এর কথা গুলো মধু চুপচাপ শুনছিলো,ওর আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছিলোনা।মেলাতে পারছিলনা ও ওর জিৎ এর সাথে এই মানুষটা কে।কি বলবে ও?একটা কথাও ঠিক বলছেনা…হ্যাঁ আজকের ঘটনায় হয়তো অরিজিৎ খুব ডিসটার্বড,কিন্তু তার মানে তো এই নয় মধু তার জন্যে দায়ী।মধু আর জিৎ রাতে একই সময় ঘুমোতে যায়,কিন্তু সংসারের প্রয়োজনে মধু ওঠে ৫টায়, আর জিৎ ১০টায়।সকালের পুরো ঝামেলা সামলায় ও একা,এমনকি মধুর ছুটির দিনেও জিৎ কে সংসারের দিকে ফিরে তাকাতে হয়না।ও বলছে না জিতের সুখের চাকরি,কিন্তু ও নিজে সারাদিন যে অমানুষিক পরিশ্রম করে,এমনকি সন্ধ্যেবেলা ফিরেও বসতে পায়না, সংসার বুবকা এগুলো সামলাতেই রাত হয়ে যায়।ফ্ল্যাটের ই.এম.আই দিয়ে আজকের দিনে একটা আয়া রাখলে সংসারে চাপ খুব বাড়বে এটা জিৎ ই বলেছিল।অনেক সময় হয়না মিথ্যে অপবাদে মানুষ চুপ করে যাওয়াকেই শ্রেয়ও মনে করে,মধুর এখন সেই অবস্থা।কিন্তু জিৎ চুপ করেনা।কোনো অন্য একটা হিংস্র,বুদ্ধিহীন,মিথ্যে কে আশ্রয় করে জেতার আকাঙ্খা সম্পন্ন মানুষ যেন জিতের ওপর ভর করেছে বলে মনেহয় মধুর,যে কথার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করতে চায় মধু কে।হঠাৎ মধুর এমনও মনে হয়েছে দীর্ঘদিনের শারীরিক দূরত্ব হয়তো ওদের মানসিক দূরত্বও তৈরি করেছে।রাতে জিৎ ফেরার পর খেয়ে শুতে যখন মাঝরাত হয় তখন মধুজার শরীর ক্লান্তিতে আর জাগতে পারেনা,জিৎ একা হয়তো কষ্ট পায়,কিন্তু মধুর কোনো সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা থাকেনা।সব মিলিয়ে শারীরিক সম্পর্ক এই বয়সেই প্রায় শেষ হতে চলেছে,যেটা নিয়ে জিৎ কখনো আক্ষেপও করে,কিন্তু মধুজা সত্যি আর শরীর টাকে জাগিয়ে রাখতে পারেনা।জিৎ এর আজ বাঁধ ভাঙা অভিযোগে একটা সময় মধু চুপ থাকতে থাকতে শেষ অবধি ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেনা।শুরু করে পাল্টা অভিযোগ।একসময় দুজন নিজেদের বাঁচাতে একে অপরের প্রতি কাদা ছোঁড়া ছুঁড়ি শুরু করে,বাদ যায়না একে অপরের পরিবার ও।কিন্তু ওই রাতের ঝগড়া রাতেই শেষ হয়না,তার রেশ চলতে থাকে।বাড়ির ঝগড়ার রেশ কাজেও পরে।মধু এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অনুভব করে একটা কচি হাত এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে পেছন থেকে,”মাম্মাম চলনা আজ বেড়াতে যাই, আমি তুমি দাদান দিদুন মিলে।খুব আনন্দ হবে,চলনা মাম্মাম।”ছোট হাত দুটো যেন মধুর জীবনে আসা হঠাৎ ঝড়টার থেকে মধুকে আগলে রাখে,ওই হাত দুটোই অদৃশ্য থেকে মুছিয়ে দেয় মধুর চোখের জল,ওই হাত দুটোই যদি পারতো অরিজিতের হাতটা টেনে এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিতে!এসব ভাবনার মাঝেই বুবকা মা কে ঠেলে তুলে দেয় বেড়াতে যাবে বলে,অন্যমনস্ক মধুজা তৈরি হতে যায় বুকের কষ্ট চেপে ছেলের জন্যে হাসতে।
ছুটির দিনে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করেনা অরিজিতের।শেষ একমাস ধরে না খাবার ঠিক আছে,না ঘুম।কেউ কিছু বলার নেই ঠিকই,কিন্তু এই স্বাধীনতা যেন জীবন শক্তি বাড়াবার বদলে কমিয়ে দিয়েছে।মধুকে ছাড়া প্রতিটা দিন যে কিভাবে কাটছে শুধু ওই জানে।বহুদিন ধরে মধুকে কাছে না পাওয়ার ক্ষোভ মনের মধ্যে ধিক ধিক করে জ্বলছিল,মনে হয়েছিল কি লাভ একসাথে থেকে ,শুধু একে অপরের পার্থিব চাহিদা পূরণ করে?এমনিতেই তো জিৎ ছোট থেকে নিজের কাজ নিজেই করেছে,নির্ভরশীল সেই অর্থে সে কোনোদিনও না।একমাত্র ছেলে হওয়ার আদর পেলেও আহ্লাদ সে কোনোদিনও পায়নি।বিয়ের পর বরং মধুর ওপর কিছুটা হলেও নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।বুবকা হওয়ার আগে মধু পুরো মনোযোগ ওকে দিত,বাড়ি থাকতেও।কিন্তু এখন….জিৎ বোঝে মধুর ওপর প্রচুর চাপ,তাও মন মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে।সেদিনের ঝগড়া একদিনের কারণে হয়নি,বহুদিনের জমানো ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিল।মধুও আগের মতো মিষ্টভাষী নেই,তার ওপর জিৎ এর এখন মনেহয় ওকে ছাড়া মধু সবাইকে নজর করে।শুধু জিৎ কে আলাদা করে নজর দেওয়ার সময় যেন ওর নেই।হয়তো বাড়াবাড়ি হয়েছে,কিন্তু এটা তো ওর ও সংসার এই একমাসে কি একবারও জানতেও ইচ্ছা করেনি কেমন আছে ওর সংসার টা।ছেলেটা কেও কতদিন আদর করেনি।সব মিলিয়ে আজকাল কিছু ভালো লাগেনা।এই ৮০০স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটা যেন ওকে গিলতে আসে।ছুটির দিন ও বেশিরভাগ বাড়িতেই থাকেনা,ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।আগে ছুটির দিন গুলো ফ্ল্যাটটা ভরে থাকতো,বাপ ছেলে মিলে হৈ হৈ,মধুর পিছনে লাগা,বাবা ছেলেতে একসাথে চান করা আর মাসে দুমাসে বাড়ি যাওয়া।আসলে মা ই কোনোদিন মধুকে মানতে পারেনি,জিৎ জানতো।কিন্তু মধু জানতো না আসল কারণটা।আসল কারণ হলো ব্রাহ্মনের ঘরে কায়স্থ ঘরের মেয়ের বউ হয়ে আসা।বাবা আর জিৎ অনেক বোঝাতে মা তখন মেনে নিলেন পরে মধুজা কে কোনোদিনও সেই সম্মান দিতে পারেনি।তাই মধুজা বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় ফ্ল্যাট নিতে বলায় জিৎ এক কথায় রাজি হয়ে যায়।মধু বা মা কাউকেই এক ছাদের তলায় থেকে ও একসাথে খুশি করতে পারবেনা,এটা ও বুঝে গেছিল।’দূর আজ আর নীজে রাঁধতে ইচ্ছা করছেনা,সুইগিতে অর্ডার করে দিই’,ফোনটা হাতে নিয়ে পাসওয়ার্ড দিয়ে লক খুলে ঢুকতেও সেই মধুরই ছবি।এই ছবিটা ওর এত প্রিয় যে এটা সরিয়ে অন্য ছবি ,এমনকি বুবকার ছবি দিতেও ইচ্ছা করেনি।ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ জিৎ এর চোখটা জ্বালা করে উঠলো।তাড়াতাড়ি ফোনটা লক করে বেডরুম লাগোয়া এক চিলতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো।অভিমানে বুকটা যেন চাপ হয়ে গেছে,’মধু কি সত্যি সময়ের চাপে ওকে ভুলে গেছে?তাহলে কিকরে একমাস আছে ওর কোনো খবর না নিয়ে?ওর জিৎ খাচ্ছে কি তাও জানতে মন চাইছে না?হ্যাঁ ও মধুর ওপর চেঁচিয়েছে কিন্তু আর কার ওপর চেঁচাত?!তাই বলে চলে গেল?!এত সহজ চলে যাওয়া?’ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়ে এবার,’আর পারছিনা মধু ফিরে এসো।আমি ভুল করেছি,কিন্তু প্রতিবারের মতো স্বীকার করতে পারছিনা।জানো তো তুমি?চেন তো তুমি আমায়?তোমায় ছাড়া,বুবকাকে ছাড়া ঘরটা বাড়ি হয়ে গেছে।তোমার ঠাকুরকে রোজ আমি শত তারাহুড়োতেও জল বাতাসা দিই, কিন্তু খুশি করতে পারছিনা।তুমি প্লিজ ফিরে এসে তোমার সংসার,তোমার জিৎ কে আপন করে নাও।ফিরে এসো ‘,ভাবতে ভাবতে ফোন হাতে নিয়ে হোয়াটস অ্যাপ খুলে দেখে মধুর স্ট্যাটাসে ছবি আপলোড করেছে।ক্লিক করে দেখে বুবকা,মধু ।বেড়াতে যাওয়ার ছবি, নিকোপার্ক,চিড়িয়াখানা…হাসি ঝলমল মুখ।হঠাৎ মনে হয় ওকে ছাড়াই তো ওর ছেলে বউ ভালো আছে।ও একাই হয়তো কষ্ট পাচ্ছে।মন টা আবার কঠিন হয়ে যায়।উঠে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার টা চালিয়ে দেয়।জলের সাথে চোখের জল মিশে নেমে আসে,ধুয়ে দিতে থাকে সব টুকু মন খারাপ।