সাত পাকে বাঁধা – অন্তিম ভাগ

by Tamali


পঞ্চদশ পর্ব:-


“সুজন ফোনটা অন করতে পারলে?”সুশী পর্ণার মামাতো ভাইয়ের দোকানে সকাল সকাল চলে এসেছে।”হ্যাঁ দিদি অন হয়েছে,কিন্তু ডিসপ্লে টা একদম নষ্ট হয়ে গেছে,তবে পি.সি বা ল্যাপি তে কানেক্ট করলে ফাইল গুলো দেখা যাচ্ছে।”সুজনের কথায় একটু হলেও হতাশ হয় সুশী।পরক্ষণেই বলে,”তুমি একবার তোমার কম্পিউটারে লাগাবে,আমি দেখবো ফাইল গুলো?”

“হ্যাঁ দিদি লাগিয়ে দিচ্ছি,এক মিনিট।”কিন্তু সুজন যেন কিছু বলতে চাইছে..কয়েক মুহূর্ত থেমে সুশীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”সুস্মিতা দি,আমার দিদির কোনো খবর পেলে?…এদিকে পিসিও অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি…কি যে হয়ে গেল হঠাৎ করে।..এখনো ওর বিয়ের দিনটা মনে টাটকা।কত্ত আনন্দ করলাম সবাই মিলে।..তুমি তো জানো,আমাদের এদিকের বংশে তো ওই একমাত্র মেয়ে,তাই সবার কত আদরের।…”

সুজনের কথায় সুশীর খারাপ মন আরো খারাপ হতে থাকে,ও যে কি মানসিক অবস্থায় আছে ওই জানে।প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে কেন সেদিন পর্ণাকে একা ছেড়ে গেল?কেন রাজি হলো একা যেতে?ও রোজকার মতো সঙ্গে থাকলে তো মেয়েটার কোনো ক্ষতি হত না।যদি পর্ণার কিছু হয়ে যায় সুশী কোনোদিনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা।সুশী এসব ভাবনার মাঝে সুজন আক্ষেপ করতেই থাকে,সব কথা সুশীর কানেও ঢোকেনা।এদিকে সুজনও কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক  হয়ে যায়।তারপর মাথা নাড়িয়ে গলার কাছে আটকে যাওয়া কান্নাটা গিলে সুশীর দিকে ফেরে, একটা চেয়ার এগিয়ে দেয় বসার জন্য।চেয়ারে বসে ফাইল গুলো এক এক করে দেখতে থাকে সুশী, পিকচার ফাইল গুলো এড়িয়ে যায়,কারণ যদি কোনো পার্সোনাল ফটো থাকে…সুজনের সামনে…হঠাৎ, অডিও ফাইলে গিয়ে ও আটকে যায়।পর্ণা নিখোঁজ হওয়ার দিন বিকেলের অনেক গুলো অডিও।আসলে পর্ণার এই অদ্ভুতুড়ে শখটা শুধু সুশী জানতো,ও গান শোনার অছিলায় প্রায়ই রেকর্ডার অন করে দিত,ফলে অনেক সময় বন্ধুদের অনেক গোপন আলাপচারিতা রেকর্ড হয়ে যেত,বিশেষ করে সুশীর,আর পরে সেগুলো শুনিয়ে মজা করতো।অভিকের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছে এরকমই একটা রেকর্ড।সুশী কোনো এক  আবেগঘন সময়ে অভিকের প্রশংসা করে,আর সেটাই রেকর্ড হয়ে চলে যায় ওর কাছে।অভিকের দুর্বলতা সুশী আর পর্ণা বুঝতো, কিন্তু সুশী সেটার মজা নিয়ে অভিককে যেন পাত্তা দেয়না এমন হাবভাব করতো।কিন্তু ওই রেকর্ডটা সুশীর দুর্বলতাও প্রকাশ করে দেয়,অভিক সেটা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে প্রোপোজ করে।সুশী জানে অভিক পর্ণার ঘটনায় কতটা ডিপ্রেসড,আর সুশী?ও তো যেন দুদিন প্রাণহীন হয়ে ঘুরছে।এই সাড়ে তিনবছরে পর্ণা যে ওর কত কাছের হয়ে গেছিল,সেটা শুধু ওই জানে।আর সুশী প্রথম থেকে এস.এস আর পর্ণার সম্পর্কের সবটুকু জানে বলে ও উপলব্ধি করতে পারে শুভঙ্করের অবস্থাটা।শুভঙ্করের এই অধিকারবোধে পর্ণা কিন্তু খুশিই হতো।ও বারবার বলতো,”এটা জানবি অত্যধিক ভালোবাসার ফল।আমি তো সৌরভের সাথেও মাস দুই সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম আমি তাই বুঝি প্রকৃত ভালোবাসা কোনটা?হ্যাঁ সবার হয়তো ভালোবাসার ধরণ এক হয়না,কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসায় অধিকারবোধ কম বেশি থাকবেই।সেটাকেও ভালোবাসতে হয়।যে ছেলের মধ্যে একটা অনুভূতিশীল ছোট বাচ্চার মন থাকে সে তোকে কোনোদিন বিট্রে করবেনা।অনেকে এতে বিরক্ত হয়,সম্পর্ক ভেঙে দেয়,হয়তো দম বন্ধ লাগে,কিন্তু ছেলেটা নিজে কোনোদিন তোকে ছাড়বেনা সেটা শিওর।”আজ সুশী পর্ণার কথা উপলব্ধি করতে পারে বর্ণে বর্ণে।দুদিনের সম্পর্কে এত ব্যস্ততার মধ্যেও অভিকের একটা চোখ ঠিক ওর ওপর থাকে,সুশী জানে এটা একধরনের কেয়ারিং।আজ ও এখানে এসেছে অভিকের পরামর্শেই।অভিকই ওকে প্রথম প্রজ্ঞার ব্যাপারে সতর্ক করে।এইসব ভাবতে ভাবতেই সুশী ফাইল খুলে একটা রেকর্ড চালায়,কিন্তু কিছু শুনতে না পেয়ে তাকায় সুজনের দিকে।সুজন জিভ কাটে, পোর্ট থেকে হেডফোনটা খুলতে যায়।সুশী ওকে থামিয়ে বলে,”সুজন তোমার খারাপ না লাগলে হেডফোনে শুনি?”

“হ্যাঁ দিদি কোনো ব্যাপার না।তুমি শোনো,আমি অন্য কাজ করি।”সুজনের কথায় আস্বস্ত হয়ে সুশী কানে হেডফোন লাগায়।রেকর্ড অন করে শুনতে শুনতে ওর মুখে মিশ্র অনুভূতি আনাগোনা করতে থাকে।একটা ইম্পরট্যান্ট মুহূর্তে একজনের গলাও পায়,যে পর্ণার সাথে এসে একবার কথা বলে যায়।সুশী জানে রেকর্ড অনেক সময় দুর্বল প্রমান হয়,তাই ওই মেয়েটা চাইলে জোরালো প্রমান হবে।হঠাৎ সুশী একটা ভিডিও ফাইল পায় ওইদিনের ওই সময়টার।ওটা অন করে দেখতে দেখতে মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে।সুজনও কথা না শুনলেও ভিডিও দেখে কিছুটা আন্দাজ করে।সুশী বুঝতে পারে পর্ণা ঠিকই বলতো,কিছু মেয়ে ছেলেদের থেকেও সাংঘাতিক হয়,আর হয়তো মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রুও।


অভিকের পাশে বসে শুভঙ্করের মনেহয় আকাশটা আজ অনেক বেশি নীল।এরকম সময় তিনবছর আগে সৌরভ সরকারের লোভী দৃষ্টি থেকে পর্ণাকে আগলে রাখার শুরু।তখন ভালোবাসা ছিল একতরফা,জানা ছিলোনা নিজের থেকে ১২বছরের ছোট পর্ণার মনের হদিস।শুধু ভেবেছিল ওই ছটফটে মেয়েটার হাসিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।না আর কোথাও লুকোবে না পর্ণা ওর স্ত্রী,তাতে যদি ওকে উনিভার্সিটি ছেড়ে আসতে হয় আসবে।আর কোনোভাবেই পর্ণাকে হারাবে না ও।অমিত ,ওর বন্ধু বলেছে পর্ণার অবস্থা ভালো নয়,কিন্তু ও জানে ও একবার পৌঁছে পর্ণার হাতে হাত রাখতে পারলে পর্ণা ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে।পর্ণা যে জানে তার শুভ তাকে ছাড়া এখন কিছু বোঝেনা,এমনকি বাপের বাড়ি গিয়ে থাকলেও একাকিত্বে ভোগে,তাহলে কিকরে পর্ণা শুভকে একা ছেড়ে দেবে বাকি জীবনের জন্য?না,শুভ ভগবানে বিশ্বাস না করলেও পর্ণা তো করে,মা তো করে,পর্ণার মা তো করে…এই যাহ!আজ সকাল থেকে মায়ের খোঁজ নেওয়া হয়নি।সঙ্গে সঙ্গে ‘বাবা’ বলে সেভ করে রাখা সুকান্তবাবুর নম্বরে ফোন করে শুভ।পর্ণা যে ওদের সন্তান,তাই পর্ণা যেমন শুভর দায়িত্ব তেমনি শত শোক দুখেও পর্ণার অনুপস্থিতিতে তার মা বাবা শুভর কর্তব্য এটা ও বিশ্বাস করে।”হ্যাঁ বাবা…মার শরীর এখন কেমন?স্যালাইন চলছে এখনো?”ফোনে নিজের গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে শুভ জিজ্ঞেস করে।সুকান্ত বাবুর থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো খবর আসে।হয়তো পায়েলকে আজ বিকেলে ছেড়ে দেবে শুনে শুভঙ্কর বলে,”আমি এবেলা হয়তো হসপিটালে যেতে পারবোনা,একটা কাজে আটকে গেছি।”তারপর একটু থেমে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে জোরের সাথে বলে,”ওবেলা ঠিক যাবো।”মনে মনে বলে,’দেখবেন বাবা খুব ভালো খবর নিয়ে যাবো’।তারপর দু একটা মামুলি কথা বলে ফোনটা কেটে দেয়।দাঁতে দাঁত চিপে খারাপ সময়টা কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে,মনে দুরকম বোধই আনাগোনা করতে থাকে,একবার তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতে ইচ্ছা করে নার্সিং হোমে,পর্ণার কাছে।আবার পর মুহূর্তে অবচেতনের ভয় যেন সময়টা আটকে দিতে চায়,যাওয়ার ইচ্ছাকে বাধা দেয়।শুভঙ্কর মনটাকে চিন্তাশূন্য করার চেষ্টায় চোখটা বুজে মাথাটা সিটে হেলিয়ে দেয়,আর অভিক ছুটিয়ে নিয়ে চলে গাড়িটাকে ভালো অথবা সবচেয়ে খারাপ খবরের উদ্দেশ্যে।
সকালে প্রজ্ঞার বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করেনা,বেলা প্রায় ১১টা বাজে।কাল রাতে থেকে অজানা ভয় শরীরটা অবশ হয়ে আছে যেন।যদিও ও কোথাও কোনো প্রমাণ রাখেনি,এমনকি পর্ণার মনেও।তাও অবচেতন কেন যে বারবার অশুভ ইঙ্গিত পাঠাচ্ছে।ঘুমও হয়নি ভালো করে।গরম মাথা চিলড বিয়ারেও ঠান্ডা হয়নি কাল।রাতে বাবা ফোন করেছিল,ধরেনি।মা রাত ১০টায় ফিরে ডিনারের জন্যে ডাকতে এসেছিল,ঘুমের ভান করে ওঠেনি।সব মিলিয়ে শরীর মন বিধ্বস্ত হয়ে আছে।যদি মাথা মোটা সৌরভ সরকার ধরা পরে যায়,আর প্রজ্ঞার নাম জড়াতে চায় প্রজ্ঞা ওকে রেপ কেসে জড়িয়ে দেবে ভেবেই রেখেছে,তাতে ওর নিজের সম্মান নিয়ে টানাটানি হলেও ও বেঁচে যাবে।তিনদিন হয়ে গেছে মেডিক্যাল রিপোর্টে তো কিছু আসবেনা।কিন্তু পর্ণাকে বাঁচাতে যে ও চেষ্টা করেছে নিজের সম্মানের বিনিময়,এটাই ওকে সবার কাছে উঁচুতে বসিয়ে দেবে।এমনকি পর্ণাকে বাঁচাতে ও বারবার ওই বাস্টার্ড টার ফ্ল্যাটে গেছে তাও বলবে।দরকারে রত্নাকেও টাকা দিয়ে কিনে নেবে।কিন্তু কি হলো সেই খবরটা তো পেতে হবে।কি ভেবে এস.এস এর নম্বর টেপে, ও পাশে বেশ কয়েকবার রিং হতে শুভঙ্কর সেন ফোন ধরেন।প্রজ্ঞা কিছু বলার আগেই ফোনটা ডিসকানেক্ট ও হয়ে যায়।’কি হলো ব্যাপারটা বোঝার আগেই সৌরভ সরকারের নাম ভেসে ওঠে প্রজ্ঞার ফোনের স্ক্রিনে।ফোনটা ধরবে কি ধরবেনা করে ধরেই ফেলে।

অন্তিম পর্ব:-


“পর্ণা,প্লিজ চোখ খোল।দেখো আমি এসেছি,প্লিজ পর্ণা।তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব,শুধু একবার তাকাও সোনা।আমার মতো অমানুষের সাথে থাকতে হবেনা, শুধু তুমি ভালো হয়ে যাও পর্ণা”,আর নিজেকে ধরে রাখার কোনো কারণ পায়না শুভঙ্কর,হাউ হাউ করে বাচ্চা ছেলেদের মতো কেঁদে ফেলে।অভিক জোর করে শুভকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে,কিন্তু শুভকে ওই জায়গা থেকে সরাতে পারেনা কেউ।…”কি জবাব দেব আমি ওর মা বাবার কাছে…কি জবাব দেব আমি আমার মার কাছে…শুধু..শুধু একদিনের ভুল আমার জীবন শেষ করে দিলো…”,এস.এস এর আর্তনাদ পুরো নার্সিং হোম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।অভিক নিজেও চোখের জল মুছছে, ও কি বলবে বুঝতে পারেনা।
প্রজ্ঞা সৌরভের ফোনটা ধরেই নেয়।কানে দিয়ে একটু চুপ করে থাকে।হঠাৎ ওদিক থেকে সৌরভের “হ্যালো,হ্যালো” শুনে শিওর হয়ে, বলে,”কি ব্যাপার সৌরভদা, তোমার পর্ণা বাঁচলো?তারপর ঘুম ভেঙে চিনতে পারলো তো তোমায়?”ওর প্রতিটা কথায় ব্যঙ্গ ঝরে পড়তে লাগে।সৌরভ ভাঙা গলায় বলে,”চেষ্টা তো করেছিলাম।কিন্তু…।তুই প্লিজ একবার ফ্ল্যাটে আসতে পারবি?কথা ছিল।”সৌরভের উত্তরে অবাক হয় প্রজ্ঞা।”কিন্তু?কিন্তু মানে কি?!!পর্ণা বেঁচে আছে না নেই?”প্রজ্ঞার গলা উত্তেজনায় চড়ে যায়।”সব বলবো বোন,তোকে বলবো বলেই তো ডাকছি।কিছু আলোচনাও আছে।প্লিজ একবার আয়।বেশিক্ষন নেবোনা।আসবি তো?”সৌরভ আকুতি মেশানো গলায় বলে।”ঠিক আছে দেখছি।তুমি এখন কোথায়?”প্রজ্ঞা নিমরাজি হয়।”আমি ফ্ল্যাটেই আছি।তুই হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছিস।উঠিসনি এখনো,এই ভেবে অপেক্ষা করছিলাম,ফোন করিনি আগে।কতক্ষনে আসছিস বল?”সৌরভ আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করে।”হমম,উঠতে দেরি হয়েছে।এই উঠলাম,রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করে আসছি।ঘন্টা খানেক লাগবে”।বলে প্রজ্ঞা ফোন রেখে বাথরুমে যায়,কিন্তু মনে হাজারো প্রশ্ন ঘোরা ফেরা করতে থাকে।একঘন্টাও লাগায় না,আধ ঘন্টায় রেডি হয়ে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে ক্যাব ডেকে বেরিয়ে পড়ে।
“হ্যালো সুস্মিতা,কোথায় তুমি?”অভিক একা আর সব কিছু সামলাতে পারছেনা, সুশীকে দরকার।সুশীর উত্তর শুনে বলে,”ঠিক আছে,একটা নার্সিং হোমের ঠিকানা মেসেজ করছি… মাসিমা,মানে স্যারের মা কে নিয়ে চলে এস।…আরে না না তুমি আগে এস,তারপর সব বলছি”,বলে অভিক সুশীকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেয়।বেশি কথা বললে ও হয়তো নিজেকে সামলাতে পারতোনা।একই ভাবে পর্ণার বাবাকেও ফোন করে স্যারের ফোন থেকে।পর্ণার মা কে কিছু না জানিয়ে চলে আসতে বলে নার্সিং হোমের ঠিকানায়।কিন্তু বাবার মন তো,তাই সুকান্ত বাবুকে ফাঁকি দিতে পারেনা অভিক,সত্যিটা বলতেই হয়।এবার আসল কাজ বাকি।ওরা এলে ওদের বুঝিয়েই বেরিয়ে যেতে হবে।যদিও সব প্ল্যান মতো ওখানে সেট হয়ে গেছে,কিন্তু স্যারকে একা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব না।একদমই নরমাল নেই উনি।কিন্তু পর্ণার সাথে যারা এরকম নৃশংস কাজ করলো তাদের শাস্তি তো দিতেই হবে।সুতনুরা নার্সিং হোম থেকে বেরছিল।কি মনে হতে অভিক বলে,”প্লিজ দাদা একটু ওয়েট করো,আমিও যাবো।”বলে ছুটে ভেতরে গিয়ে দেখে অমিত আছে কিনা।তারপর অমিত কে দেখে এগিয়ে যায়,”স্যার একটু কথা ছিল।”

“হ্যাঁ, কি যেন নাম তোমার?অভিক তো?বলো কি বলবে?”অমিত হাতের গ্লাভস খুলে এগিয়ে আসে।ও সব কাজ ক্যান্সেল করে এখানে থেকে গেছে।”স্যার আমি একটু কাজে এক জায়গায় যাচ্ছি।প্লিজ আপনি এস.এস স্যারের একটু খেয়াল রাখতে পারবেন?আমি জাস্ট আধ ঘন্টার জন্যে যাবো।বড়জোর এক ঘণ্টা লাগবে ফিরতে।তার মধ্যে স্যারের এর মা আর পর্ণার বান্ধবী সুস্মিতা এসে যাবে।”অভিকের কথায় অমিত উত্তর দেয়,”আমি এমনিও আজ শুভঙ্করকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা।তুমি সম্ভবত যে কাজে যাচ্ছ আমি জানি,আমিও চাই তোমরা ওদের শাস্তি দাও।তুমি নিশ্চিন্তে যাও, আমি আছি।”অভিক অমিতের হাতটা চেপে ধরে,হঠাৎ চলে আসা চোখের জল হাতের চেটোর উল্টোদিক দিয়ে মুছে অমিতকে বলে,”থ্যাংক ইউ স্যার।আজ আপনি যা করেছেন…আপনার মত বন্ধু যেন সবার থাকে।”
ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি লাগিয়ে খুলতে গিয়ে প্রজ্ঞা বুঝতে পারে দরজার চেনটাও হুকে লাগানো আছে,বাধ্য হয়ে বেল বাজায়।সৌরভ যেন ওর জন্যে তৈরি হয়েই অপেক্ষা করছিল,প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেয়।”কি ব্যাপার! কি জন্যে ডেকে আনলে আমায়?”প্রজ্ঞা যথেষ্ট কর্কশ স্বরে কথাটা বলে।”তুইও তো এলি।…যাইহোক এই ফ্ল্যাটটা কার প্রজ্ঞা?”সৌরভের প্রশ্নে থমকে যায় ও।তারপর কেটে কেটে বলে,”হঠাৎ এই প্রশ্ন?তুমিতো পর্ণার খবর বলবে বলে ডাকলে।তাহলে?”

“হ্যাঁ বলবো,কিন্তু তুই মিথ্যে বলেছিলি আমায়,এমনকি দুর্গাপুজোয় পর্ণা শুভঙ্করের সম্পর্ক জানতে পেরে অতীত খুঁড়তে শুরু করে যখন আমার কাছে পৌঁছস তখন থেকেই সবটাই তোর প্ল্যান ছিল।কি ঠিক কিনা?”সৌরভের এই হঠাৎ আক্রমণে প্রজ্ঞা হকচকিয়ে যায়।তাও গলার তেজ বজায় রেখে বলে,”প্ল্যান আবার কি?আর হ্যাঁ তোমার সাথে যোগাযোগও তো পর্ণা শুভঙ্করের জীবন নরক বানাতে,সেটা তো প্রথম দিনেই ঠিক হয়।আমি নাহলে তোমায় খুঁজে যোগাযোগ করতাম কেন?”

“প্রজ্ঞা তুই…তুই এতটা স্বার্থপর?!!!তুই সেই সময়ই এই ফ্ল্যাট আমার নামে ভাড়া নিস,নকল আই.ডি প্রুফ দিস আমার।সেদিন থেকে তোর বিষাক্ত জালে জড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকিস আমায় ফাঁসিয়ে নিজের কাজ উদ্ধার করবি বলে।কোথাও নিজের নামের প্রমান রাখিসনি তুই?”সৌরভের দোষারোপে হাহা করে হেসে উঠে প্রজ্ঞা।”তোমায় তো কালকেই বলেছিলাম ,’ফাঁসবে তুমি’।”আবার কিছুটা থেমে বলে,”আরো শুনবে?তোমার পর্ণা,ওর মনেও বিষ ঢালা ছিল তোমার নামেই।ও এখানে এসেছিল আমায় বাঁচাতে…সৌরভ সরকারের হাত থেকে বাঁচাতে…হো হো হো হো… আমি ওকে বুঝিয়েছিলাম তোমার সাথে আলাপ হয়েছে আর তুমি আমায় ফাঁসিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছো।বোকা মেয়ে…বেচারা।”…”কিন্তু ..কিন্তু ও কি সত্যি মরেই গেল?!আমি ওকে তো শুধু পাগল করতে চেয়েছিলাম।হয়তো দুর্বল প্রাণ,নিতে পারেনি এত ঘুমের ধকল।আহা রে,বেচারি।ছমাসও বরের আদর খেতে পেলোনা।হাহাহাহা। এবার আমি …”,প্রজ্ঞার কথার মাঝে ভিতরের ঘর ,যেখানে পর্ণাকে রাখা হয়েছিল,সেখান থেকে তীর বেগে বেরিয়ে আসেন ডি.এস.পি ব্যানার্জী।অত্যাধিক অবাক প্রজ্ঞার সামনে এসে সপাটে এক চড় মারেন।চড়ের আঘাতে ছিটকে পড়ে প্রজ্ঞা।রাগে অন্ধ এক বাবা প্রজ্ঞাকে টেনে দাঁড় করিয়ে আবার এক চড় মারেন।কিন্তু প্রজ্ঞা ব্যানার্জী তো এত সহজে ভাঙার মেয়ে নয়।তার বাবার দ্বিতীয় চড় খেয়ে ওর সম্বিৎ ফিরে আসে,স্বরূপ ধারণ করে চিৎকার করে ওঠে,”মারছ কেন আমায়?কি করেছি আমি?”ইতিমধ্যে সুতনু,অভিক আর অখিল এসে ডি.এস.পি ব্যানার্জী কে ধরে ফেলে,সুতনুর বাঁশির আওয়াজে ভিতরে ঢুকে আসে মহিলা পুলিশ সহ সাদা পোশাকের অসংখ্য পুলিশ।মিস্টার ব্যানার্জী কে  আটকে রাখতে তিনজনের ঘাম বেরিয়ে যায়।উনি নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা,নিজের কর্মক্ষেত্রের সম্মান সব ভুলে পাগলের মতো হয়ে যান।প্রজ্ঞাকে পেলে শেষ করে দেবেন এভাবে ফুঁসতে ফুঁসতে উনি যা মনে আসে বলতে থাকেন,”তোর মত মেয়ে মেয়েজাতের কলঙ্ক।তোর গায় আমার রক্ত ভাবতেই আমার ঘেন্না হচ্ছে।যে আমি সারাটা জীবন সততার সাথে চাকরি করে এলাম তার মেয়ে একটা জোচ্চোর,খুনি?এই দিনটা দেখার জন্যে আমি বেঁচে ছিলাম?”নিজের আবেগকে সামলাতে অবধি উনি পারছিলেননা।কান্নায় ওনার গলা বুজে আসছিল।”শুধু মাত্র তোর মুখ চেয়ে বেঁচে থেকেছি।তোর মার অসম্মান গায়ে মাখিনি,ছেড়ে যায়নি তোর কথা ভেবে।হ্যাঁ তোর মা অহংকারী,স্বার্থপর মহিলা কিন্তু তাকে কোনোদিন অন্যের ক্ষতি করতে দেখিনি,শুনিনি।তুই,তুই ক্রিমিনাল হয়ে গেলি?!!কিসের লোভে করলি বলতো এসব?”ওনাকে সামলানো সত্যি হয়তো সম্ভব ছিলোনা।কিন্তু প্রজ্ঞা অন্য ধাতুতে গড়া।এত কিছুর পরও সমানে বলতে থাকে,”আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা তোমরা কি বলছো?আমি তো সৌরভ সরকারের ফোন পেয়ে ছুটে এসেছি পর্ণার খবরের আশায়।ভুল হচ্ছে তোমাদের কোথাও”।…মহিলা কনস্টেবল এর হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে বলতে থাকে।এবার মুখ খোলে অভিক,”শাট আপ ইউ বিচ”,ভুলে যায় প্রজ্ঞার বাবা সামনে আছে।এতক্ষনের জমে রাখা রাগে চেঁচাতে চেঁচাতে বলতে থাকে,”তোমার মত মেয়েকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জামা কাপড় খুলে বেত দিয়ে মারা উচিত।আরে তুমি মেয়ে দূরের কথা মানুষ জাতের কলঙ্ক।এই বয়সে এত নিষ্ঠুর তুমি?হয়তো সৌরভ সরকারের গায়ে কিছুটা হলেও মানুষের রক্ত আছে বলে পর্ণা মৃত্যুর সাথে লড়ার সুযোগটা পেলো।নাহলে আমাদের পর্ণার লাশও হয়তো মিলতোনা।…”,সুতনু এবার এগিয়ে এসে অভিককে জড়িয়ে ধরে,এতদিন নিজেকে সামলে রাখা ছেলেটা আর পারেনা নিজেকে আটকে রাখতে।প্রজ্ঞা তখনও লড়ে যায়,”প্রমান কই তোমাদের হ্যাঁ, প্রমান?শুধু কি মুখের কথায় কোর্ট শাস্তি দেবে নাকি?”এবার সুতনু মুখ খোলে, “প্রমান অনেক গুলোই হয়ে গেছে মিস ব্যানার্জী।তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রমান আপনার নিজের মুখের কনফেশন।এতক্ষন আপনার কথা রেকর্ড আর ভিডিও হয়েছে।সৌরভ সরকার সেই সকাল থেকে পুলিশি হেফাজতে।পুলিশই তাকে বাধ্য করে ফোন করে আপনাকে এখানে ডাকতে।তবে বাকি পুরোটাই ওর কৃতিত্ব,আপনার মুখ থেকে সব কথা বলিয়ে নেওয়া।..”,সুতনুর কথা শেষ করতে দেয়না প্রজ্ঞা,সৌরভের দিকে তেড়ে যায়,”ইউ সোয়াইন,আজ তোর বোকামোর জন্যে এই অবস্থা হলো।তুই না ভালো বন্ধু,না শত্রু।তোরাই সমাজের আসল বোঝা।তোদের…”,আবার প্রচন্ড জোর চড়ে প্রজ্ঞার কষ কেটে রক্ত বেরিয়ে যায়।মিস্টার ব্যানার্জীর বলিষ্ঠ দুটো হাত প্রজ্ঞার গলা টিপে ধরে।সবাই ছুটে এসেও কিছুতেই ছাড়াতে পারেনা।দাঁতে দাঁত চেপে নিজের সন্তানের প্রাণ নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে এক হেরে যাওয়া বাবা।কিন্তু পুরোপুরি শেষ করার আগে সবাই মিলে ছাড়িয়ে নেয়।গলা চেপে কাশতে কাশতে মাটিতে বসে পড়ে প্রজ্ঞা।প্রচন্ড ভয় পায় এবার।কাশির সাথে কান্না মিশে হাহাকার হয়ে সবার কানে বাজতে থাকে।অভিক সুতনুকে বলে,”অপহরণের দিন পর্ণা প্রজ্ঞাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি।ও পর্ণার সাথে যা যা কথা বলে পর্ণা নিজের ফোনে রেকর্ড করে,আর ওর গাড়িতে উঠে প্রজ্ঞাকে বুঝতে না দিয়ে ভিডিও অন করে দেয়।না জেনেই প্রজ্ঞা ফোনের ডিসপ্লে নষ্ট করে দিয়েছিল,নাহলে ও পরে নিজেই ওগুলো দেখতে পেত।যাইহোক,পর্ণার বন্ধু সুস্মিতা আর পর্ণার ভাই মিলে ওগুলো উদ্ধার করেছে।ওগুলো আমি পরে তোমায় সিডি করে দিয়ে দেব”।এবার সৌরভ সরকারের দিকে ফিরে সুতনু বলে,”তোমার দোষও কম কিছুনা,তবে মানবিকতা এখনো বেঁচে আছে বলে ক্রিমিনাল পুরোপুরি হয়ে উঠতে পারোনি।তোমার বাবার কথা শেষ অবধি শুনে প্রজ্ঞার ফাঁদে পা না দিলে বেঁচে যেতে,আগের অপরাধের কথা সবাই ভুলে গেছিল।তবে শেষে তোমার এই সাহায্যের জন্যে আশা করি শাস্তি কম হবে।এখন চলো”।বলে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয়।মেয়ে কনস্টেবল প্রজ্ঞা কেও হ্যান্ডকাফ এ আটকে টেনে নিয়ে যায়।প্রজ্ঞা তখন ভয় কাঁপছে।সুতনু মিস্টার ব্যানার্জীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,”স্যার এবার চলুন।”ওর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনি বলেন,”প্লিজ আমায় একটু সময় দেবে?তোমরা এগোয়,আমি নিজেকে একটু সামলে আসছি।”অভিক আর সুতনু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে।অভিক বলে,”ঠিক আছে স্যার,আমরা বাইরে দাঁড়াচ্ছি।আপনি সময় নিয়ে আসুন।”ওরা রুমের বাইরে বেরিয়ে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দেয়।হেঁটে সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে কেঁপে ওঠে পিস্তল গর্জে ওঠার আওয়াজে।কয়েক মুহূর্ত লাগে বিষয়টা বুঝতে,যতক্ষনে ছুটে যায় সব শেষ হয়ে গেছে।আজীবন সম্মানের সাথে,সততার সাথে নিজের কর্তব্য পালন করা,ব্যক্তিগত জীবনে কোন সুখ না পাওয়া মানুষটা নিজের ডিউটি রিভলভার দিয়ে নিজের মাথা এফোঁড় ওফোঁড় করে চির নিদ্রায় চলে গেছে।নিজের আত্মজার দেওয়া শেষ জীবনে এই অসম্মান বইবার ক্ষমতা আর তার ছিলোনা।গুলির আওয়াজে লিফটের সামনে থেকে ছুটে আসা প্রজ্ঞাও জীবন থেকে চরম শাস্তি পায়,সেই শাস্তি উপেক্ষা করার ক্ষমতা হয়তো আর তার থাকেনা।
“শুভদা”,একটা হাতের স্পর্শে মাথা ঘুরিয়ে শুভঙ্কর দেখে সুশী,মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে।পর্ণার হাতটা ছেড়ে মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে মাথা দিয়ে ছোট ছেলের মতো ডুকরে ওঠে সে।শুভ্রা দেবী মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”কাঁদছিস কেন বোকা ছেলে?ডক্টর তো বলেছেন বিপদ কেটে গেছে।দেখবি জ্ঞানও ফিরে আসবে।”তারপর এগিয়ে যান পর্ণার দিকে।মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেই চোখের জল মোছেন।আর কয়েক ঘন্টা দেরি হলে সব শেষ হয়ে যেত।এই সময় সুকান্তবাবুও এসে ঢোকেন,সাথে অসুস্থ পায়েল।”একি মা আপনি?”শুভঙ্কর এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসায় অসুস্থ পায়েলকে। মা বাবার নিজের মেয়েকে ওভাবে দেখে কষ্টে বুক মুচড়ে উঠলেও ভগবানের উদ্দেশ্যে দুহাত জোর করে।আজ ঠাকুর না চাইলে সব শেষ হয়ে যেত।দুর্বল শরীরে পায়েল এগিয়ে যায় মেয়ের দিকে।মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।আর সুকান্ত বাবু সবার অলক্ষ্যে চোখের চশমা খুলে একবার পরিষ্কার করে নেন,বড্ড ঝাপসা হয়ে গেছিল।

প্রায় বিকেল ৫টা…পর্ণার চোখের পাতার নীচে মনি গুলো নড়তে থাকে।এতক্ষন এক দৃষ্টে পর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা শুভ উত্তেজিত হয়…বেল বাজিয়ে সিস্টার কে ডাকে।”ওনার জ্ঞান আসছে,আমি ডক্টর চ্যাটার্জি কে কল দিই।”বলে সিস্টার বেরিয়ে যায়।শুভঙ্করের হাতের মধ্যে পর্ণার হাত নড়ে ওঠে,যেন আঁকড়ে ধরে হাতটা।খুব অল্প ফাঁক হয় চোখের পাতা দুটো।”পর্ণা”,শুভর ডাক ক্ষীণ হয়ে কানে যায় ওর।আর একটু ফাঁক করে চোখটা।মাথা এখনো কাজ করার অবস্থায় নেই,তাও যেন একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে পর্ণার ঠোঁটে।বাইরে অপেক্ষা করা সবাই..পায়েল,সুকান্ত,শুভ্রা, সুশী,অভিক.. শুভঙ্করের পিছনে এসে  ভিড় করে দাঁড়ায়।প্রায় বাহাত্তর ঘন্টা পর পর্ণা চোখ হালকা ফাঁক করে।নিজেদের আপনজনের মুখ অনুভব করতে না পারলেও হয়তো অবচেতনে একটা ধাক্কা দেয়।আবার চোখ বুজে ফেলে।ডক্টর চ্যাটার্জী রুমে ঢুকে একটু রেগেই যান,”কি ব্যাপার কি,এত ভিড় কিসের?সবাই বাইরে যান।শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে বলে ,”আপনিও যান।আমি একটু চেক আপ করবো।”সবাই বেরিয়ে গেলে পর্ণার দিকে এগিয়ে যান ডক্টর।কিছুক্ষন পর স্বস্তির ভাব ফুটে ওঠে মুখে।সিস্টার কে পরবর্তী সব বুঝিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।শুভঙ্করের দিকেই এগিয়ে যান,হাতটা ধরে বলেন,”সেই সকাল থেকে একটানা পর্ণার পাশে আছেন।যান খেয়ে আসুন।ও এখন বিপদমুক্ত।কিন্তু আপনারা অসুস্থ হয়ে পড়লে বিপদ বাড়বে।সত্যি যে ভালোবাসা ওষুধের থেকেও শক্তিশালী আজ অনুভব করলাম।নাহলে প্রায় কোমায় চলে যাওয়া একটা প্রাণ এভাবে রিকভার করেনা।যে ড্রাগটা এই কদিন ওকে ইনজেক্ট করা হয় সেটা খুবই সাংঘাতিক।রত্না বলে মেয়েটি ওই নামটা বলতে পেরেছিলো বলেই তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট শুরু করা গেছে।আপনারা দেখবেন মেয়েটির যেন কোনো শাস্তি না হয়,অভাবী হলেও ওর উদ্যোগেই পর্ণা প্রাণে বেঁচেছে।যাইহোক,কিছুদিন তো পর্ণা কে এখানে থাকতে হবে,আর বাড়ি নিয়ে গিয়েও যত্নে রাখবেন।বিশেষ করে ওর মনের যত্ন করবেন”।ডক্টরের কথায় শুভঙ্করের মুখ কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হয়।দাঁতে দাঁত চিপে ইতিবাচক ঘাড় নাড়ে।আস্তে আস্তে পুরোনো শুভঙ্করের কনফিডেন্স ফিরে আসতে থাকে।আজ সারাদিন পর্ণার পাশে বসে অতীত রোমন্থন করেছে…পর্ণাকেও শুনিয়েছে সেসব গল্প।অভিক এতক্ষন বলেনি কোনো কথা,এবার ডক্টর চ্যাটার্জী চলে যেতে শুভঙ্করকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে সবটা বলে।”কি বলছো অভিক!মিস্টার ব্যানার্জী!!?…আমি ভাবতেও পারছিনা।কিন্তু যার জন্য এরকম করলেন তার কি কোনোরকম অনুশোচনা দেখলে?একটা ওই বয়সী মেয়ের মনে এত বড় ক্রিমিনাল লুকিয়ে ছিলো সত্যি বুঝিনি।জানতাম বড় লোকের আদুরে মেয়ে,কিন্তু এতটা নির্দয় নিষ্ঠুর…যাইহোক ডি.এস.পি ব্যানার্জীর মতো লোককে সত্যি এডমিনিষ্ট্রসনের দরকার ছিল,ওনার চলে যাওয়াটা আমাদের সাধারণ মানুষের ক্ষতি।কেন যে সৎ মানুষরা নিজেরা জীবনে সুখী হয়না কে জানে?”শুভঙ্করের মুখে এসব আলোচনা শুনে অভিক বুঝতে পারলো স্যার অনেকদিন পর চিন্তামুক্ত হয়েছেন।ওর নিজেরও কোনোদিন এসব কিছু..আত্মহত্যা, অপরাধীদের ধরা..দেখা ছিলোনা,তাই শরীরে একটা পাক খাচ্ছে।একটা মানুষ চোখের সামনে নিজেকে শেষ করে দিলো আর কেউ কিছু করতে পারলোনা।যদিও ওর দাদা ছিল বলে এইসব কনফিডেন্সিয়াল ঘটনা দেখতে পেলো,কিন্তু ডাক্তারদের মতোই পুলিশের জীবনও খুব আবেগহীন হয়।এসব ভাবতে ভাবতে দেখলো শুভঙ্কর স্যার সুশী কে নিয়ে এসেছে।একহাত দিয়ে সুশীর হাত আর অন্যহাত দিয়ে অভিকের হাত ধরে এস.এস আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন,”আজ আমার জন্যে এত কিছু,জানি মুখে না বললেও সবাই আমার ওপরই বিরক্ত ছিলে।আজ প্ৰকৃত অর্থে তোমাদের দুজনের জন্যে পর্ণাকে ফেরত পেলাম।তোমরা খুব ভালো থাকো।আর জীবনে কোনোদিন শুভদা কে প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই জানিও।”বলে দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন।সুশী শুধু একটাই কথা বললো,”শুভদা প্রজ্ঞা যেরকম ঘুঁটি সাজিয়াছিলো আজ নাহয় কাল ও এটা ঘটাতোই।তুমি আমি নিমিত্ত মাত্র”।অভিক ও তাতে সাপোর্ট দিলো,”এই বুদ্ধিটাই যদি কোনো ভালো দিকে লাগাতো…”।
প্রজ্ঞার কোনো ধারণা ছিলোনা জেল এরকম হয়,জীবনে এরকম দিনও আসে।ওর বাবি ওর জন্যে লজ্জায় ঘৃণায় নিজেকে শেষ করে দিলো।মা এসেছিল একবার দেখা করতে,প্রজ্ঞা আনন্দে ভেবেছিল ওকে বেল দিতে এসেছে,কিন্তু ….মায়ের চড়ে অনেক্ষন বাঁ গাল টা জ্বলছিল।ও চাইলে মাকে বলতে পারতো কেন ও এতটা নিষ্ঠুর হয়েছে,বলতে পারতো দামি খেলনা,দামি গ্যাজেট নয় অনেক বাচ্চার মতো ওরও ওর মা বাবা দুজনের ভালোবাসা একসাথে দরকার ছিল।বলতে পারতো সুস্থ পরিবেশ পেলে ওর মানসিক বিকাশও স্বাভাবিক হতো।বলতে পারতো এতটা জীবন ওর মা বাবার অসুস্থ অস্বাভাবিক সম্পর্ক দেখার পর পর্ণা শুভর সম্পর্ক ওর মনে জ্বালা ধরিয়েছিলো,ও চেয়েছিল পর্ণার জায়গা নিতে।কিন্তু ভাবেনি অনেক কিছু জোর করে হয়না,হয়তো প্রকৃতি বাধা দেয়।এখন এই মুহূর্তে ওর মাথার মধ্যে এত চিন্তা এলোমেলো ঘুরছে মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রনায়।মনে হচ্ছে দেয়ালটায় মাথা ঠুকতে।মহিলা কনস্টেবলটা অনেক্ষন ধরে নতুন অল্প বয়সী মেয়েটার দিকে নজর রেখেছে।ওর মা চলে যাওয়ার পরই একটু অস্বাভাবিক আচরণ করছে,নিজের মনে কথা বলছে,হাসছে।মালটা নাটক করছে সম্ভবত।ডি.এস.পি ব্যানার্জীর মেয়ে কিকরে ক্রিমিনাল হয় সবাই সেটাই বলাবলি করছে।আরে ওকি, কি করছে কি মেয়েটা!ওই নোংরা জল গায়ে মাখছে কেন?তাড়াতাড়ি চাবি খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে মেয়েটা প্রলাপ বকছে।ওকে দেখে হাসতে হাসতে বলে,”পাপ ধুচ্ছি গো, পাপ ধুচ্ছি।”না,মেয়েটার মাথা স্বাভাবিক নেই মনে হচ্ছে।ভগবানের কি অদ্ভুত খেলা,ও ওষুধ দিয়ে অন্য একজনকে পাগল করতে গেছিল,পরিস্থিতি ওকেই পাগল বানিয়ে দিলো।সত্যি কখন কার সাথে কি হবে কেউ জানেনা।কিন্তু সত্যি বলতে কি কেউ জন্ম ক্রিমিনাল হয়না।পরিবেশ ,পরিস্থিতি,ভালোবাসার অভাব,বিশ্বাসের অভাব,একাকীত্ব জন্ম দেয় অপরাধী মনের।অকালেই ঝরে যায় কত কুঁড়ি।

রাত্রিবেলা একজনকে থাকতে বললেন ডক্টর।শুভঙ্কর কিছুতেই অন্য কাউকে থাকতে দিলোনা।সবাই চলে যেতে আধো অন্ধকার ঘরে পর্ণার বিছানার পাশে গিয়ে  বসলো।পর্ণার বসে যাওয়া চোখ মুখ ওকে আবার একবার  বিবেক যন্ত্রণা আর মানসিক কষ্টে জর্জরিত করতে লাগলো।প্রজ্ঞা বা সৌরভের সাথে নিজেকেও সমান দোষী মনে হলো।পর্ণার হাত ধরে চুপচাপ অন্ধকার ঘরে বসে ভেসে উঠতে থাকলো স্মৃতিরা।পুরোনো এস.এস কে পর্ণা কবেই ভুলিয়ে দিয়েছিল।বয়সের তুলনায় প্রথম থেকে পর্ণার মানসিক পূর্ণতা বেশি।কিন্তু প্রজ্ঞাকে বিশ্বাস না করেও সেদিন কেন ওর গাড়িতে উঠেছিল ওই বলতে পারবে।সৌরভের প্রথম বারের ক্ষত অনেকদিন লেগেছিল ভুলতে,এই অন্ধকার দিন গুলো ওর ঘোরে কাটলেও মনে কোথায় তো ছাপ থাকবে,জীবন থেকে কতগুলো দিন হারিয়ে যাওয়ার মানসিক যন্ত্রনা কাটতে সময় লাগবে।শুভঙ্কর ঠিক করলো পর্ণা,মা,পর্ণার বাবা মা সবাইকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসবে।আস্তে আস্তে পর্ণার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে নিজে কখন মাথা নিচু করে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই।ঘুম ভাঙল মৃদু স্পর্শে,তাড়াতাড়ি উঠে বসে দেখলো পর্ণা ক্লান্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।কথা বলার ক্ষমতা এখনো আসেনি।আলতো করে হাতটা সামান্য তুলে শুভঙ্করের গালে রাখলো।চোখের ইশারায় এগিয়ে আসতে বললো ওর দিকে।তারপর অনেক কষ্টে বোঝালো শুভর গালটা ওর গালের ওপর রাখতে।হালকা করে ওর মুখে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলো।শুভ শুধু একটা কথাই বলতে পারল ইশারায়,”সরি,ক্ষমা করে দাও।” মৃদু হেসে খুব কষ্টে শুভঙ্করের ঠোঁটটা হালকা করে নিজের ঠোঁটের ওপর রেখে আস্তে করে চোখ বুজল পর্ণা।শুভ কিছুক্ষন পর নিজের বুকের মধ্যে পর্ণাকে জড়িয়ে নিলো,পর্ণার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা,সবচেয়ে বড় আশ্রয়,অসীম শান্তি…ক্লান্ত পর্ণা শুভঙ্করের বলিষ্ঠ বুকে গাল ঠেকিয়ে চোখ বুঝে আদর অনুভব করতে লাগলো।আর শুভ জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখল একটা নতুন উজ্জ্বল দিন শুরু হচ্ছে আবার।রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো মনে শান্তি প্রতিফলন হয়ে ঘরে ঢুকছে।
সমাপ্ত….

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!