সাত পাকে বাঁধা – তৃতীয় ভাগ।

by Tamali


“হ্যালো স্টুডেন্টস।আমি বাংলার হেড আর.ডি,রবিন দত্ত।আজ তোমাদের প্রথম দিন উনিভার্সিটি তে।ক্লাস তাই বিশেষ কিছুই হবেনা।..আজ তোমাদের সাথে সাথেই একজন ইয়ং ট্যালেন্টেড টিচার,এবং আমার খুব প্রিয় এক্স স্টুডেন্ট শুভঙ্কর সেন উনিভার্সিটি জয়েন করলেন।তাকে স্টুডেন্টদের সাথে পরিচিত করাতে এলাম।আজ প্রথম ক্লাস ওঁর।উনিও আজ প্রথম আর তোমরাও।তাই আজ আলাপ পরিচয় সেরে নাও।এস.এস আগে যে কলেজে পড়াতো সেখানকার কোনো স্টুডেন্ট থাকলে তো এস.এস এর ব্যাপারে জানোই।যারা জানোনা তাদের বলি এস.এস এর ক্লাস মন দিয়ে করলেই অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।ওকে স্টুডেন্ট, তোমরা স্যারের সাথে আলাপ করো।আমি পরে ক্লাস নিতে এসে তোমাদের সাথে আলাপ করে নেব।”একটানা পুরোটা বলে আর.ডি উনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ঘর থেকে চলে গেলেন।যদিও এত কথার একটাও পর্ণার কানে ঢোকেনি,ও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।ওর মধ্যে মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে… খুব আনন্দ,আর খুব রাগ।মনে হচ্ছে বাস্তব ভুলে ছুটে গিয়ে শুভকে জড়িয়ে ধরে,আবার অন্য একটা মন চাইছে রাগের চোটে কিল মারতে।শুভঙ্করকে নিয়ে এইচ.ও.ডি রুমে ঢুকতে সুশীও প্রচন্ড অবাক হয়ে মন্তব্য করে ফেলেছিল,তারপর ফিসফিস করে অভিমানী গলায় পর্ণাকে বললো,”গাড়িতে আসার সময় তো আমায় কিছু বললিনা তোরা!”সুশীকেও গাড়িতে তুলে নিয়েছিল ওরা নিজেদের সাথে,ওর বাড়ির কাছাকাছি একটা জায়গা থেকে।সুশীর কথায় পর্ণা ততোধিক বিরোক্তিপূর্ণ গলায় উত্তর দিলো,”তোর শুভদা,তুই জানিসনা,আমি জানবো কিকরে?”সুশী অবাক চোখে পর্ণার দিকে তাকিয়ে বুঝলো শুভদার কপালে আজ দুঃখ আছে,এ মেয়ে চট করে ক্ষেপে না,কিন্তু ক্ষেপলে সামলানো মুশকিল।শিওর চমক দিতে চেয়েছিল শুভঙ্করদা।আজ গেল সব।পর্ণাকে আর না ঘাঁটিয়ে চুপ করে যায় ও।কিন্তু পেছন বেঞ্চের মেয়েগুলো নতুন স্যারকে দেখে যে ফিদা হয়ে গেছে তাদের ফিসফিসানি কথায় পর্ণা সুশী ভালোই বুঝতে পারে।কলেজে প্রথমদিন এস.এস কে দেখে পর্ণারও যে মনে হয়েছিল ‘টলিউড শুধু না,বলিউড পেলেও লুফে নেবে’, সেটা মনে পড়ে।হঠাৎ খেয়াল পরে ওই জন্যে গেটের বাইরে ওকে আর সুশীকে  গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল শুভ।আর এমন ভাব করেছিল যেন ফিরে যাচ্ছে।এমনকি ওর সাথে ওর কলেজে যাওয়ার ব্যাগ দেখে পর্ণা প্রশ্ন করায় এড়িয়ে গেছিল।এখন সব পরিষ্কার হচ্ছে পর্ণার কাছে।পর্ণা আজ শুভর দেওয়া টপ পরে ওর ইচ্ছা অনুযায়ী নিজেকে সাজিয়ে উনিভার্সিটি এসেছে।ওর মাথার একবিন্দু সিঁদুর ছাড়া বাঁ হাতের নোয়াটা ওর বিবাহিত হওয়ার চিহ্ন,যেগুলোর কোনোটাই সেভাবে লক্ষ্য না করলে বোঝা যাবেনা।আচ্ছা মামনিও কি কিছু জানেনা?নাকি মামনিও ইচ্ছা করে ওকে কিছু বলেনি?ওদিকে শুভ পুরোটা সময় কখনো সোজা দৃষ্টিতে,কখনো আড়চোখে পর্ণাকে লক্ষ্য করে গেছে।একবার চোখাচোখি হতে কেউ যাতে বুঝতে না পারে শুধু পর্ণা ছাড়া সেভাবে বাঁ হাত দিয়ে বাঁ কান ধরে চোখে ক্ষনিকের ক্ষমা চাওয়ার ভাবও করে।কিন্তু রাগের কারণে পর্ণা চোখ নামিয়ে নেয়। শুভ মাথা ঠান্ডা পর্ণাকেই বেশি দেখেছে,যে কপট অভিমান দেখায় তাও বিয়ের পর।বিয়ের আগে কোনোদিনও পর্ণা ছাত্রীর গন্ডি পেরোতে পারেনি শুভর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও,তাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দেখলেও পর্ণার অভিমান অনেকটাই অদেখা শুভর।পর্ণার চোখ আর মন পড়তে পারা শুভঙ্কর বুঝতে পারে আজ প্রথমবার তার সম্পর্কে ঝড় অবশ্যম্ভাবী,তা সে বাড়ি ফিরেই আছড়ে পড়ুক কি তারও একটু পড়ে রাতে,ঘরের বন্ধ দরজার ওপারে।যদিও বাড়ি ফিরলে মা জানলেও ভীষণ রাগ করবে,সারপ্রাইজ বললেও মানবেনা।।মনে মনে একটু অস্থির হয় শুভঙ্কর,যদি পর্ণা ভুল বোঝে?!পারবে তো ও পর্ণাকে বোঝাতে ,কোন উৎকণ্ঠায় ও কলেজ ছেড়ে উনিভার্সিটি এসেছে?না ক্লাস শেষে ফিরেই ফোনে একটা মেসেজ করবে ওর পর্ণাকে।কে জানে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আবার কষ্ট দিয়ে ফেললো কিনা?এখন তো সেই প্রথম দিনের মতোই মুখ নামিয়ে বসে।হঠাৎ সামনের বেঞ্চ এর একজন উঠে দাঁড়ালো,এক সুন্দরী আর নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন মেয়ে,যার বাহ্যিক পোশাক বলে দিচ্ছে তার অর্থনৈতিক অবস্থা আর তার অহংকার,”হাই স্যার,আমি প্রজ্ঞা।এ বছরের উনিভার্সিটি টপার।”তার কথা বলার ধরণে এস.এস বুঝে গেল সে কোনদিক দিয়ে পর্ণার থেকে এগিয়ে।শুভঙ্কর ততক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছে।বললো,”ওকে,বসো।আমি রোল কল করার সাথে সাথে সবাইকে মোটামুটি চিনে নেব”।প্রজ্ঞার এস.এস এর কথার ধরণে অবাক লাগল,সুন্দরী টপারকে পাত্তাই দিলোনা যেন।ঠিক আছে,সবে তো আজ প্রথমদিন,কতদিন প্রজ্ঞা ব্যানার্জী কে উপেক্ষা করে দেখা যাক।বাকি পুরো ক্লাসের চোখ প্রজ্ঞার দিকে নিবদ্ধ থাকলেও এস.এস এর নজর থার্ড বেঞ্চের কোণে জানলার ধারের সিটের ওপরই বেশি সেটা একমাত্র সুশী বুঝলো,আর এস.এস সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতে মুখ টিপে দুস্টু হাসিও দিলো।তবে যার জন্য সব কিছু সে মুখ নিচু করেই বসে থাকল।কলেজের এস.এস এর থেকে উনিভার্সিটির এস.এস অনেকটাই বেশি প্রাণশক্তি সম্পন্ন।কলেজের সেই কঠিন মুখের মুখোশটা অন্তত উনিভার্সিটির প্রথম দিন তার মুখে ছিলোনা।হয়তো জীবনে ভালোবাসার উপস্থিতি তাকে অনেক স্বাভাবিক হতে সাহায্য করেছে।তার মনের সীমাহীন ভালোবাসার প্রভাব না চাইতেও তার উজ্জ্বল চোখ দুটোতে অনেক বেশি প্রানের সঞ্চার করেছে।তাই ছাত্রীদের বুকে ভয়ের থেকেও বেশি ভালো লাগার কাঁপন ধরছে তাদের নতুন ইয়ং স্যারকে দেখে।শুভঙ্কর ক্লাস শেষে বেরিয়ে যেতেই সব ছাত্রীর বুক থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস,শুরু হয়ে গেল ফিসফিসানি।সেইসব মজা সবার মধ্যে ঘুরে হাসির রোল তুললেও পর্ণার গরম মাথা আরো গরম করতে লাগলো,ওর মনে হলো চেঁচিয়ে সবাইকে বলে দেয় ওর আর শুভঙ্করের কথা।কিন্তু বাস্তববাদী পর্ণা সত্যিটা না বলাই যুক্তিসঙ্গত মনে করল।আগে শুভঙ্কর কি বলে জানা দরকার।ঠিক সেই মুহূর্তে পর্ণার ফোনটা ভাইব্রেট করলো ব্যাগের মধ্যে।খুলে দেখলো এস.এস হোয়াটসঅ্যাপ করেছে।

“হেই আমার একমাত্র সুন্দরী অর্ধাঙ্গিনী,আমি তোমায় সারপ্রাইজ দিতে শুধু কিছু বলিনি।মাও জানেনা।তুমি চাঁদিপুরের ঘটনা,বা তার পরবর্তী ঘটনা ভুলে গেলেও আমি ঐ ভয় থেকে আজও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি।তাই আমার প্রাণটাকে একা এই অচেনা পরিবেশে কার ভরসায় ছাড়বো ভাবছিলাম যখন, তোমাদের ভগবান পথ বাতলে দেয়।পরে ডিটেইলস এ সব বলবো।শুধু জেনে রাখ তুমি তোমার মতোই উনিভার্সিটি জীবন উপভোগ কোরো, এস.এস শুধু তোমার সেফটির দিকেই নজর রাখবে,তোমার কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমার কারণে কোনো অসুবিধা হবেনা।এখানে আর.ডি ছাড়া কেউ জানবেও না আমাদের সম্পর্ক।প্লিজ প্রথম দিন মুখ গোমড়া করোনা।খুশি থাকো।পরে সব তোমায় বলবো।”পুরোটা পড়ে রাগ কমার বদলে আরো বেড়ে গেল পর্ণার।’এই চিনেছে ওকে,ও ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে ভাবছে বুঝি।জানেনা শুভঙ্কর ছাড়া পর্ণার জীবনে কোন কিছুই উপভোগ্য না।…হমম বলবে কেন বিবাহিত,মেয়েরা তাহলে ওকে নিয়ে ফিসফাস করবে না যে’,নিজের মনেই পর্ণা উল্টোপাল্টা ভাবতে লাগলো।যদিও পুরোটাই ছেলেমানুষি মেশানো ছিল।আসলে ওর খুশি,ওর ভালোলাগা,ওর নিশ্চিন্ত হওয়া যে কতটা ছিল ও কাউকেই বোঝাতে পারবেনা।সারাদিন শুভঙ্করকে চাইলেই দেখতে পাবে,সেই পড়ানো, সেই ক্লাসের চেনা গন্ধটা উপভোগ করতে পারবে,সবচেয়ে বড় কথা নিজেকে নিয়ে কোনদিক দিয়েই ভাবতে হবেনা…পর্ণার ভগবানের দেওয়া সেরা গিফট মনে হলো।আবার নতুন করে বুঝতেও পারলো ও শুভঙ্করের কাছে কতটা দামি। উনিভার্সিটি গেটের বাইরে কিছুটা দূরে গাড়িতে উঠলো পর্ণা আর সুশী।পর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ কোনো কথা বলার সাহস পেলোনা।শুধু জিজ্ঞেস করলো,”কি খেয়েছো তোমরা?”পর্ণার বদলে সুশী বললো ওদের উনিভার্সিটি থেকে ‘ফ্রেশার্স ওয়েলকাম’ হয়েছে,ওরা খাবার প্যাকেট দিয়েছিল।কিছুক্ষন গাড়ি চলার পর পর্ণা শুধু বললো,”কাল থেকে আমরা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে আসব।কোথায় কে দেখে ফেলবে,ইয়ং স্যারের সম্মানহানি হবে…”,শুভঙ্কর পর্ণার কথা বলার ধরণে ঢোঁক গিলে একবার আড়চোখে সুশীর দিকে তাকালো।সুশীও হাওয়া গরম বুঝে কথা বেশি বলছিল না।সুশী ছিল ওদের সম্পর্কের একমাত্র মানুষ,যে বুঝতে পারতো ওদের পুরোটা।তাই হয়তো শুভও প্রথম থেকে সুশীর কাছে পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ থাকতে পারতো। বাড়ি ঢুকতে শুভ্রা দেবী শুভঙ্করকে উদ্দেশ করে বললেন,”আমি ভাবলাম তুই পর্ণাকে দিয়ে ফিরে আসবি।যাওয়ার সময় একমুঠো ভাত খেলি দেখে সন্দেহ হলো,কিন্তু…কোথায় ছিলি সারাদিন?”শুভঙ্কর একবার আড়চোখে পর্ণাকে দেখে নিয়ে বললো,”চেঞ্জ করে এসে সব বলছি।চা করো,আসছি”।বলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।পর্ণা বললো,”মামনি আমি চেঞ্জ করে এসে চা করছি।তুমি বসো।”

“আরে চা করে রেখেছি তোরা আসলে খাবো বলে।যা হাত মুখ ধুয়ে আয়”।শুভ্রা দেবীর কথা শুনে পর্ণাও নিজের ঘরে চলে গেল। চা খেতে খেতে ছেলের কান্ড শুনে শুভ্রা দেবী প্রথমে একটু অভিমান করলেও খুব খুশি হলেন।বেশি খুশি হলেন সেই ছেলেমানুষ শুভটাকে ফিরে আসতে দেখে।কঠিন আবরণে নিজেকে গুটিয়ে ফেলা ছেলেটা ভালোবাসার ছোঁয়ায় স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে চোখে জল এসে গেল তাঁর।এমনি তো ছিল তাঁর ছেলেটা,ছোটবেলায় বাবা মাকে খুশির খবর সব সময় সারপ্রাইজের মোড়কে দিত।শুভখবরটা দিয়ে শুভ মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে তিনি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন,আর দুফোঁটা চোখের জল গাল বেয়ে ঝরে পড়লো।ছেলের কাঁধে রাখা মুখে সেই চোখের জল নজরে এলো পর্ণার,ওর মনটাও ভিজে উঠলো।

চতুর্থ পর্ব:-


উনিভার্সিটি ক্লাস শুরু হওয়ার দিন পনেরো পর অফ পিরিয়ডে ক্লাস রুমে শুধু মেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে…বিষয় বয়ফ্রেন্ড।যে যার নিজেদের নিয়ে বলছে,যার বয়ফ্রেন্ড নেই শখ আছে সে আফসোস করছে,যারা বাড়ির ভয়েতে ওই রাস্তায় হাঁটতে পারেনি তাদের কাছে ‘আঙ্গুর ফল টক’ লাগছে।পর্ণা আর সুশী ক্লাসের সবার সাথে কথা বললেও একটু দূরত্ব তৈরি হয়েই গেছে,তার কারণ হয়তো ওরাই একমাত্র মফস্বল কলেজের থেকে এসেছে।তাছাড়া শুভঙ্করের ব্যাপারটা কতদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে পর্ণা শিওর নয় বলে একটু আড়ষ্ট হয়ে থাকে।হঠাৎ আড্ডার মধ্যমনি প্রজ্ঞা আপন মনে বলে,”বয়ফ্রেন্ড তো ‘টাইম পাস’।বিয়ে তো করবো ম্যাচিউর কাউকেই,অন্তত দশ বছরের বড়,প্রতিষ্ঠিত।এসব ছেলেরা বয়ফ্রেন্ড হয়ে যতই পাশে পাশে ঘুরুক এস.এস এর মত হ্যান্ডসাম ম্যাচিউর পারসোনালিটি ই পারফেক্ট হাজব্যান্ড ম্যাটেরিয়াল।উফফ কবে যে ফোন নম্বরটা পাবো,কিছুতেই দিচ্ছেনা।খালি চাইলেই কোনো উত্তর না দিয়ে বলে কোনো সমস্যা হলে উনিভার্সিটিতেই বলতে,উনি নাকি প্রাইভেট টাইমে প্রফেশনাল কথা বলেন না।…কদিন এড়িয়ে যাবে প্রজ্ঞা ব্যানার্জি কে।…”

পর্ণা এতক্ষন ওদের কথা শুনলেও চুপচাপ নিজের কিছু কাজ করছিল।সামনে শুভঙ্করের জন্মদিন তাই রান্না করে খাওয়াবে বলে রেসিপি ঘাঁটছিল।প্রজ্ঞার কথায় চমকে ওর দিকে তাকায়।সুশী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞাকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ও সুশীর হাত চেপে ধরে।ওর পুরো ভরসা আছে শুভঙ্করের ওপর,জানে ও ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।শুধু মনের মধ্যের অধিকার বোধের জন্যে মনটা একটু কষ্ট পায়।কিন্তু ওর ঘাবড়ায় না।মনে পড়ে উনিভার্সিটির প্রথম দিন রাতের কথা।অভিমানী পর্ণা শুভ ঘরে আসার আগেই তাড়াতাড়ি ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল।শুভ প্রথমে চুপচাপ এসে পাশে শোয়, তারপর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ রেখে বলতে থাকে নিজের কথা,”শুভঙ্কর সেন কোনোদিনও ভাবেনি একটা সরল সাধাসিধে ছোট মেয়ে তাকে এতটা আবিষ্ট করে ফেলবে।কলেজ উনিভার্সিটি তে কত মেয়ে বন্ধু হয়েছে,শ্রী তো সেই কোন ছোটবেলার বন্ধু।কিন্তু এই গভীর চোখের মেয়েটাকে না দেখে সারাদিন থাকা সত্যি হয়তো আর সম্ভব না।”তারপর পর্ণাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গাল দুটো ধরে বলে,”কি আছে তোমার মধ্যে পর্ণা,বলোনা?আমি ভয় পাই সব সময় তোমায় হারাবার।ওই সৌরভকে বিশ্বাস নেই,তাই পারলামনা কলেজের চাকরি করে নিশ্চিন্তে তোমায় একা ছেড়ে দিতে।ভুল বুঝনা আমায়,আমি কিন্তু তোমায় নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি,কিন্তু বিশ্বাস করিনা নিজের ভাগ্যকে।”এই প্রথম এত নরম মনের হদিস পায় পর্ণা।পর্ণাকে জড়িয়ে ধরে শুভঙ্কর বলে,”বাঁচতে পারবোনা তোমায় ছাড়া।আর কোনোদিন ভুল বুঝলেও আমি হারিয়ে যাব”।পর্ণা তার প্রিয় জায়গা শুভর বুকে মুখ রেখে শুধু বলতে পারে,”আমি খুব লাকি, তাই হয়তো এত বড় একটা গিফট পেয়েছি ভগবানের থেকে।সারাটা জীবন এভাবেই ঘুমোতে চাই,এই জায়গাটা শুধুই আমার”।

উনিভার্সিটি সবাই জানে পর্ণা বিবাহিত,কিন্তু স্বামীর কথা কেই বা জানতে উৎসাহী হয়।স্বামী তো আর বয়ফ্রেন্ড হয়না।বোকা মেয়ে গুলোর কথায় পর্ণা মনে মনে হাসে।সত্যি এরা কিকরে বুঝবে সাত পাকের বন্ধন কি হয়!হয়তো সবার হয় না,কিন্তু ওদের সেই বন্ধনের টানই ওদেরকে রোজ নতুন করে ভালোবাসতে শেখায় একে অপরকে।অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা থাকে ওরা সবসময়।সারাদিন একে অপরের সাথে সেভাবে কথা না বলেও সব কথা চলতে থাকে মনে মনে।প্রজ্ঞাকে যদি এস.এস নূন্যতম গুরুত্ব দিতে তাহলে ঠিক পর্ণাকে বলতো।ওদের দুটো মন যে খোলা ডাইরি হয়ে জুড়ে গেছে একে অপরের সাথে,কোনো প্রজ্ঞার ক্ষমতা নেই সেটা আলাদা করার।সেদিন রাতে পর্ণা ঘরে এসে দেখে শুভঙ্কর কোনো বই মন দিয়ে পড়ছে।রাতের সামান্য প্রসাধন টুকু সেরে যখন পর্ণা শুতে আসে ততক্ষনে শুভ শুয়ে পরে ফোন ঘাঁটতে শুরু করেছে।পর্ণা জানে মিনিট দশ ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করে শুভ ঘুমোনোর আগে।

“একটা কথা জিজ্ঞেস করব,যদি কিছু মনে না করো”।পর্ণার কথার ধরণে শুভ ফোন সরিয়ে রেখে ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।”তোমার আবার আমায় কিছু বলতে অনুমতি লাগে?”মৃদু হেসে উত্তর দেয়।”না মানে,আমাদের সম্পর্কটা কেন বলতে চাওনা…মানে বারণ করছো কেন,বলবে?”পর্ণার প্রশ্নে এস.এস কিছুক্ষন চুপ করে বলে,”যে কারণে কলেজে বলিনি আমরা।তুমি যাতে বন্ধুদের সাথে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারো।তোমার মেধাকে যাতে কেউ কোনোদিন ‘ওতো স্যারের স্ত্রী,ওর কি চিন্তা’ বলে খাটো করতে না পারে।আর সর্বোপরি ক্লাসে দুজনের স্বাচ্ছন্দ্য।…কিন্তু পর্ণা হঠাৎ একথা কেন?কিছু হয়েছে?”

“না আসলে কেউ তো জানেনা তুমি বিবাহিত,তাই আর কি…”পর্ণার কথায় শুভঙ্কর বোঝে ও কিছু একটা বলতে চেয়ে বলতে পারছেনা।

“পর্ণা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে কিছু বলতেও এত হেসিটেট করছো!!কি হয়েছে বলো আমায়।”শুভর এই গলার আওয়াজে পর্ণা নিজেকে সামলাতে পারেনা।চোখ ভর্তি জল নিয়ে বলে দেয় প্রজ্ঞার কথা।চুপচাপ সব শোনে এস.এস।তারপর পর্ণাকে বুকে টেনে বলে,”ভরসা করতো আমায়?”কোনো কথা না বলে পর্ণা আরো চেপে ধরে জোরে ঘাড় নারে শুধু।”তাহলে শোনো এসব মেয়েদের আমি বিবাহিত কিনা জানলেও কিছু এসে যায়না।এরা বড়লোকের সেইসব কিছু মেয়েদের দলে পরে যারা বাকিদের খেলনা ভাবে,তাই কিছু ইচ্ছা করলে সেটা না পাওয়া অবধি শান্তি পায়না, অনেকটা ওই সৌরভের মতোই।কিন্তু আমি জানি কিভাবে এদের সামলাতে হয়।কলেজে প্রথম দিকে একজন কে পেয়েছিলাম,তোমায় বলেছি তো।আমার ওপর ছেড়ে দাও।আমি ঠিক সামলে নেব।শুধু তুমি এসবে জড়িও না।দরকার হলে আমি তোমায় বলবো,আর দরকারে সবার সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রীকেও চিনিয়ে দেব।”একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পর্ণা শুভঙ্করের বুকে ঢুকে শোয়।শুভ আরো জড়িয়ে ধরে ওকে।ভরসার আলিঙ্গনে মিশে যায় একে অপরের সাথে।

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!