দ্বিতীয় পর্ব:-
‘উফ এত টেনশন নেওয়া যায়?!বললো ফোন করবে রেজাল্ট দেখে।..৪টে বাজতে চললো, এখনো কোনো ফোন নেই।এর থেকে সুশীদের সাথে কলেজ গেলেই ভালো হতো।’টেনশনে পর্ণা খালি এঘর থেকে ওঘর ছুটে বেড়াচ্ছে।ওর টেনশন দেখে ওর মা পায়েলও স্থির থাকতে পারছেননা।কাল যখন খবরে কাগজে দেখলো আজ রেজাল্ট বেরোবে ভয়েতে সবার আগে মার মুখটাই মনে পড়েছিল,মনে হচ্ছিল এক ছুটে মার বুকে গিয়ে মুখ লুকোয়।শুভকে বলেছিল রেজাল্টের দিন সকাল বেলা মায়ের কাছে যেতে চায়।মায়ের কাছে থাকলে সারাদিন তাও টেনশন ভুলে থাকতে পারবে,শুভ্রা দেবীও ওর মতেই মত দিয়েছিলেন।শুভঙ্কর বাধা দেয়নি,বরং বলেছিল কলেজ যাওয়ার সময় ও বাইকে করে পৌঁছে দিয়ে যাবে।তবে পর্ণার রেজাল্ট দেখতে যাওয়ার দরকার নেই,শুভই দেখে ফোনে খবর দেবে।পর্ণাও আপত্তি করেনি,বরং শান্তি হয়েছিল, ওই টেনশন নিয়ে কলেজ যাওয়াই চাপের। আর এখন তো ও শুধু স্টুডেন্ট না ওই কলেজের, ওখানকার লেকচারারের স্ত্রী,সব মিলিয়ে শুভর রেজাল্ট দেখে জানানোটাই ঠিক হবে।সেই মতো সুশীকেও ফোন করে দিয়েছিল।কিন্তু,কিন্তু,কিন্তু…শুভ তো এখনো ফোন করছেনা।আগেরবার তো ৩টে নাগাদ লিস্ট টাঙিয়ে দিয়েছিল।আর এই চাপ নেওয়া যাচ্ছেনা।এখন সুশীকে ফোন করে কিছু জানলে বাবুর আবার রাগ হবে ওর ফোনের অপেক্ষা করা হয়নি বলে।
“মা একটু আদা চা করে দাও তো”,চা খেলে একটু টেনশন কমতে পারে ভেবে পর্ণা পায়েলকে চেঁচিয়ে বললো।৫টা নাগাদ আর থাকতে না পেরে সুশীকে ফোন করতে যাবে এমন সময় বাইরে বাইকের আওয়াজ শুনে জানলা দিয়ে দেখে শুভঙ্কর নামছে বাইক থেকে।ভয়ে বুকের ভিতর থেকে হৃদপিন্ডটা যেন লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে মনে হয়।নিজের মেয়েবেলার বিছানায় চুপ করে কান খাড়া করে বসে থাকে,ঘরের বাইরে গিয়ে শুভর মুখোমুখি হতেও সাহস হয় না।…’উফফ কখন তো মা দরজা খুলে দিয়েছে,আসছেনা কেন এখনো এই ঘরে?!তবে কি এবার ফার্স্ট ক্লাস হলোনা?’টেনশনে পর্ণার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে প্রায়।
মিনিট পাঁচেক পর শুভ আর তার পেছনে পেছনে মা বাবা এসে ঢুকলো পর্ণার ঘরে।শুভ মায়ের উদ্দেশে বললো,”মা আমি পর্ণার সাথে একা একটু কথা বলি?”মা বাবাও সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ করে বেরিয়ে যায়।পর্ণা যেন আর পারছেনা,এবার জ্ঞানটাই হারিয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে।শুভ এসে পর্ণার পাশে বিছানায় বসে পর্ণার হাতে হাত রাখল,তারপর মুখ নিচু করে শান্ত স্বরে বললো,”দেখো যে কোনো বিষয়ে জ্ঞানটাই কিন্তু আসল,হ্যাঁ,নম্বর দরকার,কিন্তু সেটাই সব কথা নয়।…আমি জানি, তুমি চেষ্টা করেছিলে,আমিও তোমার সাথে পুরো চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু, ভাগ্য আর তোমাদের ভগবানের ওপর তো কারোর হাত নেই…”,শুভকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে পর্ণা বিরক্তি সহ বলে উঠলো,”উফফ,তুমি এসব ভূমিকা ছেড়ে আসল কথাটা বলবে?আমি আর টেনশন নিতে পারছিনা।কি হয়েছে কি?আমার ফার্স্ট ক্লাস হয়নি,তাই তো?”পর্ণার কোথায় শুভ এমন মুখভঙ্গি করলো দেখে মনে হবে যেন ভাবছে,’পর্ণা কিকরে এসব জানলো?’।”সুশী তোমায় ফোন করেছিল?”শুভঙ্করের কথায় পর্ণা আরো বিরক্ত হয়ে বললো,”ওর ওসব কাণ্ডজ্ঞান থাকলে তো হয়েই যেত।তাহলে এত টেনশন নিয়ে আমি বসে থাকি?”এবার শুভ নিশ্চিন্ত হয়ে পর্ণার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো,”পর্ণা তোমার ফার্স্ট ক্লাস হয়নি…তোমার… উনিভার্সিটিতে রাঙ্ক হয়েছে।তুমি ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে থার্ড হয়েছ।”পর্ণা শুনে চোখ গুলো বড় বড় করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো শুভর দিকে।মাথায় কথাটা এক্সিস্ট করতে সময় লাগলো কয়েক সেকেন্ড।তারপর শুভর পিঠে গোটা দুই কিল বসিয়ে দিল,অকারণ টেনশন দেওয়ার জন্যে।শেষে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা দিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেললো।নিজের মনেই বলতে লাগলো,”আমি যখন বাংলা নেব বলে জেদ ধরি বাবা মা অবধি মানতে পারেনি।বাংলা পড়তে না গেলে হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় গিফ্টটাও পেতামনা…তোমাকে পেতামনা।আমার জন্যে তুমি কতটা খেটেছিলে।তাই আজ খারাপ রেজাল্ট করলে সারাজীবন তোমার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতামনা।…থ্যাংকু থ্যাংকু..আমার জীবনটা সব দিক দিয়ে এত সুন্দর করে দেওয়ার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে”।পর্ণার উচ্ছ্বাস বাঁধ মানছিলো না।শুভ নিজেও প্রচন্ড খুশি ছিল,হয়তো নিজের রেজাল্ট বেরোনোর দিনের থেকেও বেশি।আসলে নিজের থেকেও বেশি কাউকে ভালোবাসলে তার জন্যে আনন্দ হয়তো সবসময় বেশি হয়।শুভও দুহাতের বেষ্টনীতে পর্ণাকে জড়িয়ে ধরে নিজের আবেগ প্রকাশ করে বললো,”দূর পাগলী!আমি,তোমার মা বাবা…আমরা সবাই তোমায় সঙ্গ দিয়েছি শুধু মাত্র। কিন্তু আসল কাজ তো তুমি করেছ পরীক্ষা হলে গিয়ে।তাই এই কৃতিত্ব পুরোটাই শুধু তোমার।তোমার কষ্ট,তোমার পরিশ্রম,তোমার আত্মত্যাগের ফল।আমি আজ সত্যি খুব খুব খুশি।খুশি শুধু আমার স্ত্রীর জন্যে না,খুশি আমার প্রিয় ছাত্রীটার জন্যেও,প্রথমদিন ক্লাসে গিয়ে যার মধ্যে আমি বাংলার প্রতি ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিলাম।তুমি অনেক উন্নতি করবে আমি জানি।তখন হয়তো এই বুড়ো বরটাকে মনেই থাকবেনা”,শেষ কথাটা বলেই শুভ মুচকে মুচকে হাসতে থাকে।এই কথাটায় পর্ণা তেলে বেগুনে জ্বলে যায়।আজ এই খুশির দিনে ওকে লেগ পুল করার লোভ সামলাতে পারেনি শুভ।পর্ণা রেগে গিয়ে শুভর থেকে ছিটকে সরে গিয়ে বলে,”দেখা যাবে কে আগে কাকে ভোলে?”বলে গটগট করে পাশের ঘরে চলে যায় মা বাবাকে প্রণাম করতে।শুভ দুস্টুমি হাসি হেসে ওকে অনুসরণ করে।
এর পরের একটা মাস প্রায় ঝড়ের মতো কেটে যায়। উনিভার্সিটির ফর্ম তোলা,ফিল আপ, জমা দেওয়া,ভর্তি সব মিলিয়ে খাওয়া সময়েরও ঠিক থাকেনা।তবে পর্ণা কখনো একা বোধ করেনা।কখনো শুভ,কখনো পায়েল,কখনো পর্ণার বাবা,আবার একদিন শুভ্রা দেবীও সাথে যান।সুশীও ভালো রেজাল্ট করে পর্ণার সাথে একসাথেই ভর্তি হয়,তবে সেকেন্ড লিস্টে। এই একমাসের মধ্যে শুভ নিজের জমানো টাকার বেশ কিছুটা খরচ করে নিজের খুব কাছের এক বন্ধুর থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড,কিন্তু খুব ভালো কন্ডিশনে থাকা একটা ছোট গাড়ি কেনে।পর্ণা বোঝেনি কেন হঠাৎ শুভঙ্কর গাড়ি নিলো কাউকে কিছু না বলে,কিন্তু শুভ্রা দেবীর মতো খুশি হয়তো কেউ হয়নি।তাই ভেবেছিল মায়ের জন্যেই হবে, ভাবেনি শুভ ওর জন্যে কলেজ ছেড়ে উনিভার্সিটি জয়েন করতে চলেছে,আর তাই যাতায়াতের সুবিধার জন্যেও গাড়িটা কেনা।তবে সবার আগে দুজন মিলে গাড়িতে চাপায় শুভ্রা কেই,দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি নিয়ে যায় পুজো দেওয়াতে।ওদের সঙ্গী হন পায়েলও। উনিভার্সিটির ক্লাস করতে যাওয়ার আগের দিন পর্ণার মনে ভেসে ওঠে কলেজের প্রথম দিনের কথা।নিজের মনে হাসে শুভর প্রথমদিন ক্লাসের কথা ভেবে।৩বছরে কতটা বদলে গেছে জীবনটা।হয়তো মেয়েবেলাটা মিস করে আর পাঁচটা মেয়ের মতো,কিন্তু এস.এস এর মত একজনকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাওয়াটাও হয়তো অনেকটা অহংকারের,বা শান্তিরও।নিজের স্বামী শুধু বেস্ট ফ্রেন্ড না জীবনে চলার পথে সবচেয়ে বড় গাইড হয় তার থেকে স্বস্তির কিছু হয়না।রাস্তায় একা হাঁটার সময়ও মনেহয় কেউ যেন পাশে আছে…জীবনের অর্ধেক যুদ্ধ সহজ যায় যায়।পর্ণা এসব ভাবতে ভাবতে শাড়ি গুলো নাড়াঘাঁটা করছে প্রথম দিন কি পরে যাবে তার জন্যে,এমন সময় শুভঙ্কর এসে ঘরে ঢুকলো।”কি করছো তখন থেকে আলমারি খুলে?”শুভর হঠাৎ প্রশ্নে চমকে ওঠে পর্ণা।”কাল কি পরে যাবো তাই ভাবছি।”অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দেয়।শুভ কিছু না বলে নিজের ছোট্ট আলমারিটার দিকে এগিয়ে যায় পায়ে পায়ে। আলমারি খুলে তার ভেতর থেকে একটা প্যাকেট বের করে পর্ণার হাতে দেয়।”খুলে দেখো,পছন্দ হয় কিনা?”শুভর বলার আগেই পর্ণা প্যাকেট খুলতে শুরু করে দিয়েছিল অলরেডি।প্যাকেট খুলে হাঁ হয়ে যায়…একটা হলুদ রঙের সুন্দর লম্বা কুর্তি!।পর্ণা অবাক চোখে বলে,”তুমি কিনেছো?”ভ্রু তুলে শুভ উল্টে প্রশ্ন করে,”কেন বিশ্বাস হচ্ছেনা?””সত্যি হচ্ছেনা।সেই সারাক্ষন ভ্রু কুঁচকে থাকা,কোনোদিনও ভালো করে হাসতে না দেখা,স্টুডেন্টদের কাছে ভয়ঙ্কর এস.এস…. বউয়ের জন্যে এত সুন্দর একটা কুর্তি কিনে এনেছে?!!…এই বলোনা কে পছন্দ করে দিলো?”পর্ণার কথা গুলো বুঝিয়ে দেয় ও কতটা আনন্দ পেয়েছে।শুভঙ্কর পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার ছোট পরীটাকে হলুদে এত সুন্দর লাগে,তাই দোকানে গিয়ে এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল।কিনে ফেললাম”।তারপর ওকে আর একটু জড়িয়ে বললো,”যেভাবে কলেজ আসতে জিন্সের সাথে পরে,ওভাবেই কাল পরো।তোমায় অল্প সাজেই বেশি সুন্দর লাগে।সামান্য কাজল আর হালকা লিপস্টিক।একহাতে ঘড়ি আর ইচ্ছা হলে আর এক হাতে একটা চুরি।..পারফেক্ট।”শুভর হাত ছাড়িয়ে পর্ণা ওর দিকে চকিতে ঘুরে যায়,”মানে?বিয়ের ৩মাস হয়নি,আমি শাঁখা পলা খুলে ফেলবো?”তারপর থেমে বলে,”আমি তা পারবোনা।কিছুতেই না।”শুভ অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”জিন্সের সাথে শাঁখা পলা পরে তুমি ক্লাস করতে যাবে?!!তুমি কি পাগল হলে?”বলেই হাহা করে হাসতে থাকে।পর্ণা এবার কিছুটা রেগে যায়।বলে,”দরকারে শাড়ি পরে যাবো।কিন্তু এখনি এগুলো খুলতে পারবোনা।মা ,মামনি কি ভাববে!আর আমার মনও মানবেনা।পারবোনা আমি এগুলো খুলতে।”এস.এস এবার অবাক হয়,বিরক্ত হয়ে বলে,”কেন কি হবে ওগুলো খুললে?আমি কি বিয়ে করে চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি কোনো?তাহলে তুমি কেন তা করবে?ওগুলো না পড়লে কি হবে?তুমি তো জানো আমি ওসব মানিনা।সিঁদুর না পড়লেও আমার কিছু আসবে যাবেনা”।কেঁপে ওঠে পর্ণা শুভঙ্করের কথায়।ও এমনিতে কুসংস্কারি নয় কোনোদিন ই।কিন্তু শাঁখা পলা, বিশেষ করে সিঁদুরের সাথে ওর সেন্টিমেন্ট বেশি জড়িয়ে।কোনো কথা না বলে ও চুপ করে যায়।শুভ বুঝতে পারে একটু বেশি বলে ফেলেছে।এগিয়ে আসে পর্ণার কাছে,হাত দুটো ধরে বিছানায় বসায়।”দেখো পর্ণা এগুলো সংস্কার,সু কি কু সেই তর্কে যাচ্ছিনা।কিন্তু আজ বেশিরভাগ চাকুরীরতা, পড়াশোনা করা বিবাহিত মেয়েরা এগুলো নিয়মিত পড়তে পারেনা।তাই বলে কি তারা সংস্কার অগ্রাহ্য করে?না স্বামীকে ভালোবাসেনা?যেরকম পরিবেশে যেরকম পোশাকের সাথে যেটা মানায়।তুমি আজ এই ব্যালান্স টা করতে না পারলে,কোনোদিনও মনের বিরুদ্ধে যেতে পারবেনা।আমি তোমার ইচ্ছাকে সম্মান করেই বলছি তোমার যেটা মন চায় করো,আমি কোনো কিছুই কোনোদিন তোমার ওপর চাপিয়ে দেবনা।শুধু আমার কথাটা ভেবে দেখো।”এই বলে পর্ণার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে শুভঙ্কর ওখান থেকে সরে যায়।ও চায় ওর পর্ণা ভাবুক,ওর পর্ণা বাস্তববাদী হোক,ওর পর্ণা কুসংস্কারকে সরিয়ে রেখে সংস্কারকে সম্মান করুক।শুধু শাঁখা পলা বা সিঁদুর না,ভবিষ্যতে সব জিনিস বুদ্ধি আর চিন্তা দিয়ে ভেবে গ্রহণ করুক।শুধু ওর জন্যে না,নিজের জন্যেও নিজের ভালোবাসা পছন্দ গুলো চিনতে শিখুক।জীবনটাকে নির্দিষ্ট গন্ডিতে একবার বেঁধে ফেললে বেরোনো খুব কঠিন,তাই শুভঙ্কর ওকে শুধু একটু ঠেলে দিলো,কিন্তু বেরোবে কি বেরোবে না সেটা সম্পূর্ণ ওর ইচ্ছা।ও চায় পর্ণা খোলা পাখি হয়েই বাঁচুক ওর কাছে।ওর বিশ্বাস আছে পর্ণার ওপর,তার জন্যে ওকে বিবাহিত হওয়ার চিহ্ন বইতে হবেনা।তবে হ্যাঁ যদি ওর নিজের সেটাই পছন্দ হয় তাহলে শুভ কোনোদিনও কোনো জোর করবেনা।পর্ণাকে নিজের চিন্তার জগতে ঢুকিয়ে দিয়ে শুভ নিজের ছোট রুমটায় এসে বসে এই ফাঁকে নিজের দরকারি কাগজ গুছিয়ে নিতে।কাল ওর ও জয়েনিং ওই একই উনিভার্সিটি তে,কিন্তু পর্ণা কিচ্ছু জানেনা।মা কেও কিছু বলেনি।চাঁদিপুরের ওই ঘটনাটা পর্ণা ভুলে গেলেও শুভঙ্করকে আজও ভাবায়।তার ওপর শুভঙ্করকে সাজা ভুগতে না দিয়ে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা…সব মিলিয়ে সৌরভ এত সহজে সব ভুলে যাবে এটাই শুভঙ্কর এখনো বিশ্বাস করতে পারেনা, এই দুবছর পরেও না।ও উনিভার্সিটি তে পর্ণার স্বামী হিসেবে পরিচয় নিজেও দেবেনা,আর পরে পর্ণাকেও বারণ করে দেবে।শুধু এইচ.ও.ডি কে জানিয়ে রাখবে অফিসিয়াল কারণে,যাতে পরে কোনো সমস্যা নাহয়।ব্যস… শুধু দূর থেকে পর্ণার খেয়াল রাখবে,আর কিছু চায়না ও।এমনকি পর্ণার ব্যক্তি স্বাধীনতাতেও কোনো হস্তক্ষেপ করবেনা।কিন্তু নিজের প্রাণকে একা উনিভার্সিটিতে ছেড়ে ও কোনোভাবেই সুষ্ঠু ভাবে এখানে কলেজ করতে পারতোনা।পুরোনো আর নতুন স্মৃতির মাঝে নিজেকে হারাতে হারাতে কাগজ পত্র গুছিয়ে নিলো।কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।বাড়িতে জানে ও কলেজ ছুটি নিয়েছে পর্ণাকে প্রথমদিন উনিভার্সিটি পৌঁছে দেবে বলে।খাবার টেবিলে দেখে পর্ণার মুখ তখনও থমথমে।সারাক্ষন বকবক করা মেয়েটা যেন গভীর চিন্তা মগ্ন।শুভ ইচ্ছা করে মাকে বলে সবটা পর্ণার সামনে।পর্ণা নিচু হয়ে থাকা থুতনিতে হাতে করে তুলে উনি বলেন,”যেদিন আমার ছেলেকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনিস,সেদিন শাঁখা পলা পরতিস?না সেদিন ভালোবাসতিস না আমার ছেলেটা কে?বিয়ের আগে যখন দুবছর সম্পর্কে ছিলিস শুভর জন্যে ভালো চাওয়াটা কি আজকের ভালো চাওয়া থেকে কম ছিল?…দেখ পর্ণা সংস্কার ভালো,কিন্তু সেটা যেন কুসংস্কার হয়ে চেপে না বসে?আমি তো বিয়ের পর দিন থেকে ওর বাবার মৃত্যু দিন অবধি সব পড়েছি,কি হলো?এভাবে কিছু বেঁধে রাখা যায়না।তাই সব মনের ব্যাপার।মন যা চাইবে কর,কিন্তু এখনকার মেয়েদের ঘর-বার দুদিক সামলাতে হয়।তাই যা করবি ভেবে করিস।”পর্ণা মুখ তুলে মামনিকে দেখলো।কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারলোনা।শুভ ওর কাছে হয়তো সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।কিন্তু শুভ ওর চিন্তা দিয়ে ওকে আচ্ছন্ন করে দেয়।কতটা ভালোবেসে ও আগলে রাখে পর্ণা এই দুবছরে বুঝেছে।একেই শুভকে ছাড়া এবার একা পথ চলতে হবে ভেবে মন খারাপ,তার ওপর ওর দেয়া চিহ্ন…পর্ণার মনে চাপ লাগে।তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে ও।মামনিকে বলে নিজের ঘরে চলে যায়। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসে।পাশে শুয়ে থাকা শুভঙ্করের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে মুখ গুঁজে দেয়।শুভঙ্করের ছোট পরীটা ওকে আঁকড়ে ধরে।শুভরও ঘুম ভেঙে যায়,বুকের মধ্যে আগলে নেয় ওর জান টাকে।পরম শান্তিতে পরম নির্ভরতায় পর্ণা ঘুমিয়ে পড়ে।আর ওকে আগলে ঘুমিয়ে পড়ে শুভও।