প্রথম পর্ব
“মা,ও মা হলো তোমার ? সাড়ে ৮টা যে বেজে গেল।আজ কলেজের প্রথম দিন,৯টার ট্রেনটা ধরতেই হবে…সবাই ওতে যাবে আজ,সাড়ে ৯টার মধ্যে না পৌঁছলে প্রথম ক্লাস মিস হয়ে যাবে যে।কোথায় কি রুম কিছুই তো জানিনা।” পর্ণার চিৎকারে পায়েল তাড়াতাড়ি মাছ ভাজা আর ডাল দিয়ে ভাত বেড়ে টেবিলে নিয়ে গেল,”এই তো,এই তো মা।কোনো দেরি হবেনা।বললাম প্রথম দিন আমি বা বাবা সাথে যাই।তা মেয়ে শুনলে তো।যতক্ষন না ফিরছিস চিন্তা হবে।””কাম অন মা,আমি কলেজ যাচ্ছি।স্কুলে না যে তোমরা কেউ পৌঁছে দিতে যাবে।আর আমার বেশির ভাগ বন্ধুই ওই কলেজেই ভর্তি হয়েছে,তার মধ্যে সুস্মিতা ছাড়াও আরো ৩জন একই বিষয় বাংলা অনার্স।সুতরাং প্লিজ এই রকম আতুপুতু করা এবার বন্ধ কর।অলরেডি বন্ধুরা আমায় নিয়ে হাসাহাসি করে।আমি বড় হয়েছি মা।” পর্ণার কথায় ওর মা বলে,”সেটাই তো চিন্তার।মেয়েরা বড় হলে মা বাবার চিন্তা বেড়ে যায়।নিজে কোনোদিন মেয়ের মা হলে বুঝবি।””উফ প্লিজ এবার খেতে দাও,আর এই তাড়াহুড়োর সময় মাছ দাও কেন?ডিম নেই বাড়িতে?মাছ বেছে খাওয়া যায়!”পর্ণা গজগজ করতে থাকে।”দেখো মেয়ের কথা।আজ শুভ দিনে কেউ ডিম খেয়ে যায়! আর দিয়েছি তো পেটির মাছ,ওতে কাঁটা আবার কি বাছবি?তুই আস্তে খা,ট্রেন এর দেরি আছে।আর তোর বাবাতো টিকেট কেটে এনে দিয়েছে ট্রেনের।খা খা,আস্তে আস্তে খা।”পায়েল যতই বলুক পর্ণা তাড়াতাড়ি যাহোক করে খেয়ে উঠেই হাত মুখ ধুয়ে ব্যাগ পিঠে চাপিয়ে সাইকেল নিয়ে ছুটলো।কলেজের প্রথম দিন বলে একটা ভালো সালোয়ার পড়েছে আর চোখে সামান্য কাজল।আর কোনো প্রসাধন সে ছুঁয়েও দেখেনা।সাজগোজে তার বড়োই এলার্জি। স্টেশনে এসে দেখে ট্রেন এখনো ১০মিনিট দেরি আছে,আসলে বাড়ি থেকে স্টেশন সাইকেলে ১০মিনিট ও লাগেনা।চারু,মিতা,সুতপা,সুস্মিতা,আরো আরো অনেকে ওরা একই কলেজে ভর্তি হয়েছে।আসলে ওদের কাছাকাছির মধ্যে ওটা সবচেয়ে ভালো কলেজ।ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে ১০মিনিট।আর তাছাড়া এই অঞ্চলের যথেষ্ট নামকরা কলেজ।কলকাতার কলেজে পড়তে গেলে যাতায়াতেই সব সময় এনার্জি শেষ হয়ে যায়,যারা ভর্তি হয়েছে তারা কলকাতাতেই মেস বা পিজি তে থাকছে।কিন্তু পর্ণা মা বাবার একমাত্র মেয়ে তাই তারা ওকে চোখের আড়াল করার কথা ভাবতেও পারেননা।পর্ণা খুব মেধাবী অথচ ফাঁকিবাজ।মাধ্যমিকে প্রায় ৯০% নম্বর পাওয়ায় স্কুল আর বাড়ির চাপে বাধ্য হয়েছিল সায়েন্স নিতে,কিন্তু ছোট থেকেই সাহিত্য প্রিয় মেয়েটা উচ্চমাধ্যমিকের পর কারোর কথা শোনেনি। ফিজিক্স বা অঙ্কে অনার্স পেলেও ওর প্রিয় বিষয় বাংলায় অনার্স নিয়েছে।ভাষার ওপর ওর অসম্ভব দখল,ওর বাংলা স্যারও ওকে তাই একটু বেশিই পছন্দ করতেন।আর পর্ণা তার মানও রেখেছিল।আজ ট্রেনে অসম্ভব ভিড়,বিশেষ করে মহিলা বগিতে।সবাই মিলে হইহই করতে উঠতে না উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো।বেশিরভাগ মেয়েরই অভিভাবকহীন প্রথম ট্রেনে চড়া।এ এক আলাদা অনুভূতি।প্রথম স্বাধীনতা পাওয়ার সুখ,হটাৎ যেন বড় হয়ে গেছি মনে হওয়া।জীবনের নতুন অধ্যায়ের নতুন সূচনা।
বাপরে কি ভিড়।নোটিশ বোর্ডের সামনে যাওয়াই দুস্কর।কিন্তু প্রথম পিরিয়ডে কোন ঘরে কি ক্লাস রুটিন না দেখলে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল এত বড় কলেজে। হটাৎ কয়েকজন ছেলে মেয়ের আলোচনা শুনে মনেহল এরা বাংলা অনার্স প্রথম বর্ষ,মানে ওর সহপাঠী।এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখল,যা ভেবেছে তাই।ওদেরও পাসের বিষয় ইতিহাস আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান।এখন ইতিহাসের ক্লাস আছে,ওদের নিজস্ব বিল্ডিংয়ে।সুস্মিতা আর পর্ণা ওদের সঙ্গ নিল। পাসের ক্লাস ভালোই কাটলো।আজ কেউ পড়াবেনা জানাই ছিল।আলাপ পরিচয় আর মানাতেই কদিন কাটবে।ওরা এবার এলো ওদের চির আকাঙ্খিত বাংলা বিভাগের ক্লাসে। প্রথম দুটো ক্লাসে স্যার এলেন…আলাপ করলেন…কোন বই ওরা অনুসরণ করলে ভালো বললেন….নিজেদের বিষয়ও বললেন ছাত্র ছাত্রীদের কাছে।অন্যরকম একটা অনুভূতি অনুভূত হলো মনে।কলেজ জীবন…কতটা আলাদা স্কুল থেকে।শুধু যে খুব ভালোলাগা তা নয়,নিজের প্রিয় স্কুল জীবনকে মিস করার একটা দুঃখবোধও মনে থাকে হয়তো।তৃতীয় পিরিয়ড শুরু হতে হইহই করে ঢুকে এলো দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের দাদা দিদিরা।ওরা নাকি মজার ছলে সবার ‘ইন্ট্রো’ নেবে।পর্ণা কিছুক্ষন ভাবলো,সেটা আবার কি জিনিস!ও হরি,ইন্ট্রোডাক্টসন।ওদের মধ্যে একজন দাদাকেই বেশি কথা বলতে দেখা গেল,যাকে দেখে অন্য অনেকের মতোই পর্ণারও বুকে যেন এক একটা বিট মিস হচ্ছিল।সম্ভবত তৃতীয় বর্ষ…উম্ উম্…সৌরভ, সৌরভ সরকার,সবাই ডাকছে এস.এস বলে।চোখ দুটো অসম্ভব আকর্ষণীয়,খুব লম্বা বা ফর্সা না।কিন্তু যেটা নজরে পড়বেই তা হলো ব্যাক্তিত্ব। আরে এরা তো রুমের দরজা বন্ধ করে ছোটখাটো রাগিং শুরু করে দিলো।কাউকে বলছে শুন্যে দাঁড়াও,উল্টো দিক দিয়ে নাক ধরো,প্রপোজ করো আরো কত কি।ক্লাসের সবার মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ে পর্ণাকে চিনতে ওদেরও অসুবিধা হলোনা।বলে কিনা আয়না হও, একটা ছেলের বিপরীতে।যে হারবে তাকে ওরা যা বলবে করতে হবে।ছেলেটা শেষে না পেরে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো,হার মেনে নিতে হলো পর্ণাকে।- “তোমার নাম বলো”।- “পর্ণা, পর্ণা পাল”।-“ওহ!তার মানে পি.পি”। ক্লাসে হাসির রোল উঠলো আর পর্ণার কান লাল হয়ে গেল।-“ওকে পি.পি তাহলে তুমি আমাদের এস.এস এর জন্যে একটা প্রেমের বাউল গান গাও।”-‘প্রেমের আবার বাউল গান!!!আমি তো বাথরুম সিঙ্গার।গানের ‘গ’ জানিনা।”-“অত কথা বলে লাভ নেই।গান তো তোমায় গাইতেই হবে,নাহলে শাস্তি বাড়বে।” একজন কেউ গম্ভীর গলায় বলল।-“আচ্ছা তাহলে শাস্তিই দেয়া হোক।কারণ আমি সত্যি গান জানিনা।আর বাউল তো শুনিওনা সেভাবে।”-“কেন বাউল কি গান না?”কোনো একজন সিনিয়র দিদি টিপ্পনি কাটলো।-“তাতো বলিনি।সবাই সব বোঝেনা,আমিও বাউল বুঝিনা।বাংলা গান শুনি,কিন্তু গাইতে একদমই পারিনা।জানি এখানে সিরিয়াসলি গাওয়ার কথা বলা হচ্ছেনা,কিন্তু সত্যি বলছি গান আমার একদম আসেনা।”-“তা কি আসে শুনি?” এতক্ষন পর এস.এস মুখ খুললো।-“কবিতা আসে।শোনাবো?”-“শুনি কেমন কবিতা আসে।”এস.এস এর কথা শুনে পর্ণা কিছু চুপ থেকে চিন্তা করে নিলো।তারপর উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতে লাগল,”আমার একটা ” তুই” চাই ….একটা সত্যি কারের ” তুই ” চাই।যে জানবে আমার পুরো ভেতরটা ….জানবে আমার লুকানো সব দোষ …আমার বদমাইশি , আমার নোংরামি …আমার কলঙ্ক …..যে নিজে থেকে আমার সব ভুল গুলোর অংশীদার হবে…..আমার পাপগুলো অর্ধেক করেলিখে নেবে নিজের খাতায়প্রথম পাতায় …..আমি এমন একটা ” তুই ” চাই ….যাকে আমি নির্দ্বিধায় উপহার দেবআমার সব অনিয়ম ……আমার অপারগতা … আমার বদভ্যাস ….আমার উশৃঙ্খলতা …..আমি পিঠ চাপড়ে তারকাঁধে তুলে দেব আমারনিঃসঙ্গতার কষ্ট , আমার দুশ্চিন্তা, আমার হতাশা …..সবগুলো ঝাড়ুদারের মতো কুড়িয়ে নিয়ে বাঁধবে মস্তবড় এক বস্তা……তারপর কুলির মতো মাথায়করে বয়ে নিয়ে যাবে সেইসব অভিশাপ….আর হাসতে হাসতে বলবে___” ভীষন ভারী রে”….. কি করে এতদিনবইলি এই বোঝা ???তারপর ……..ঠিকানা ছাড়া পথে হাঁটতে থাকবে…অসীম সমুদ্র পর্যন্ত….সাগরপাড়ে এসে প্রচন্ডশক্তিতে ছুঁড়ে ফেলে দেবে সেইবোঝা …..ঠিক সাগরেরমাঝখানে হারিয়ে যাবে আমার সবঅভিশাপের ঝুলি…..আমি ঠিক এইরকম একটা ” তুই ” চাই….যে কোনদিন ” তুমি’ বা আপনি” গুলোর মাঝে হারিয়ে যাবে না ……..”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই পর্ণার গলায় আবৃত্তি শুনছিলো।কি সুন্দর গলা।একজন দাদা টিপ্পনি কাটলো আবার,”স্বরচিত নাকি?”-“না,কবি শ্রীজাত এর লেখা পড়নি?এটা ওনার লেখা।কবিতার নামই ‘তুই’।-“খুব সুন্দর আবৃত্তি করো তুমি।’তুই’ আগেও শুনেছি,কিন্তু এভাবে অন্তর ছোঁয়নি।যাও গিয়ে জায়গায় বসো”। এস.এস এর কথায় আস্তে করে ধন্যবাদ দিয়ে পর্ণা নিজের জায়গায় ফিরে গেল।সৌরভের চোখের মুগ্ধতা ওর নজর এড়ালোনা।আর সিনিয়র দাদা দিদিরাও সৌরভের কথা বলার ধরণে হাসি ঠাট্টা শুরু করে দিলো। এরপর যতক্ষন ওরা থাকলো মাঝে মাঝে সৌরভ আর পর্ণার চোখ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলো। সবশেষে ওরা যাওয়ার সময় প্রত্যেকের হাতে একটা করে খাবারের বাক্স ধরিয়ে দিল।সেইসময় বাক্স দিতে গিয়ে সৌরভের আঙ্গুল পর্ণার আঙুলকে ছুঁয়ে দিলো।হয়তো অনিচ্ছাকৃতই কিন্তু পর্ণার মনে হলো এস.এস ইচ্ছা করে এটা করলো।পর্ণার সারা শরীরে যেন তরঙ্গ খেলে গেল।ওর মুখে চোখে তার প্রকাশও হয়তো সৌরভের চোখ এড়ালোনা। ছোট থেকে কল্পনাবিলাষী পর্ণা রোমান্টিক গল্পের পোকা সেই স্কুল জীবন থেকে।তাই কলেজে মানেই প্রেম যেন তার মনে গেঁথে গেছিল।কিন্তু প্রথমদিনেই কেউ মনে হিল্লোল তুলবে সে ভাবতে পারেনি।একটা ভালো লাগায় মন আবিষ্ট হয়ে থাকলো তার ফেরার রাস্তাটা।দুপুরের ফাঁকা ট্রেনে জানলার ধারে বসে কল্পনাবিলাসী মন রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে কখন ৪টে স্টেশন পার করে দিল বুঝতেই পারলোনা।পরের দিনের কলেজে যাওয়ার অপেক্ষায় সেই দিনের রাতও নিদ্রাহীন কেটে গেল।ভোরের মৃদু মন্দ হাওয়া পর্ণার দুচোখ কিছুক্ষনের জন্যে ভারী করে দিলো।ভোরের আলো চোখে মেখে সে হারিয়ে গেল তার স্বপ্ন রাজ্যে।
পরের দিন কলেজে গিয়ে থেকে পর্ণার চোখ দুটো একজন কেই খুঁজছিল।পাসের ক্লাস,অনার্সের একটা ক্লাস হয়ে গেল….পাশের ঘরেই তো ওদের ক্লাস….সবাই কে মোটামুটি দেখতে পাচ্ছে কাল যারা ছিল,ও কোথায়?…মনটা একটু ভার হয়ে গেল। এরপর যিনি অনার্সের ক্লাস নিতে আসবেন তিনি নাকি এই বাংলা বিভাগের সবচেয়ে পপুলার লেকচারার। বয়সে নবীন কিন্তু গাম্ভীর্য্যে প্রবীণ,এমনি সব বলছে।তিনি ক্লাসে অন্যমনস্ক দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বেড় করে দেন।তবে ওনার পড়ানো নাকি একঘর,আর প্রাইভেট পড়াননা।সত্যি বলতে কি সিনিয়ার দিদি কেকাদি বলছিল,”স্যারের ক্লাস মন দিয়ে করলে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া নাকি সকলের কাছেই সম্ভব।এই তরুণ বয়সে উনি সবার সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছেন। এমনকি বাংলা ভাষায় ওনার এতটাই দখল যে সেমিনারের ডাকে প্রায় বিদেশেও যেতে হয়।তবে ভীষণ কড়া, পড়া আর পড়ানোর বাইরে ওনার আর কোনো জগৎ নেই।” কেকাদির কথায় ওদের সবার হার্টবিট বেড়ে গেছে।তার ওপর আবার পর্ণার আজ উড়ু উড়ু মন।এস.এস,মানে ওই স্যার, শুভঙ্কর সেন নাকি প্রথম দিন সবার নাম জেনে নেন, আর তা বাকি ৩বছর ঠিক মনে রেখে দেন।ওনার কাছে সবাই সমান,তাই পড়াশোনায় গাফিলতি দেখলে ভালো স্টুডেন্ট কেও ক্লাসের মধ্যে কাঁদিয়ে ছেড়ে দেন।আবার দরকারে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীর প্রশংসা করতেও পিছপা হননা।সব মিলিয়ে রাশভারী হলেও উনি সবার প্রিয়। ওরে বাপরে বেল বেজে গেল।এই পিরিয়ডটা ওদের অফ ছিল,এবার বাঘের মুখে পরার পালা।৫মিনিটের মধ্যে এস.এস স্যার ক্লাসে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের চেয়ারে না বসে টেবিলে বসলেন।তারপর থেমে থেমে রোল কল করার সাথে সাথে মুখ তুলে দেখতে লাগলেন,অর্থাৎ নিজের মেমোরিতে মুখ আর নাম যেন লোড করতে লাগলেন।এমনিতেই এস.এস স্যার কে দেখে সবার কথা বন্ধ হয়ে গেছিল,মনে হচ্ছিল কোনো ‘ইয়াংরি ইয়ংমান’ ইংলিশ নভেলের পাতা থেকে উঠে এসেছেন,যেমন পেটানো চেহারা,তেমন গলার স্বর।টলিউড শুধু না বলিউড পেলেও লুফে নেবে।রিমলেস চশমায় ব্যাক্তিত্ব যেন আরো বেড়ে গেছে।এত হ্যান্ডসম বলেই হয়তো গাম্ভীর্য্যে মুখোশ পরে থাকেন। কিন্তু পর্ণা আজ বড়োই চঞ্চল।কালকের সেই স্পর্শটাই ওকে আবিষ্ট করে রেখেছে।তাই ওর কালকের এস.এস আজকের এই এস.এস এর উপস্থিতিকেও ম্লান করে দিচ্ছে।-“হেই!তুমি…শুনতে পাচ্ছো?কি যেন নাম দেখলাম।হেই হলুদ সালোয়ার?” শুভঙ্কর স্যার পুরো সিলাবাসের একটা ধারণা দিচ্ছিলেন ক্লাসে,হটাৎ পর্ণার দিকে চোখ যেতে মেজাজ খিঁচড়ে চেঁচিয়ে উঠলেন।পর্ণার পাশে সুস্মিতা ওকে ঠেলে দিতে ও ভয়ার্ত মুখে উঠে দাঁড়ালো।-“হ্যাঁ স্যার।আ..আমাকে বলছেন?”-“হ্যাঁ ইডিয়ট।প্রথম দিন থেকেই যদি জানলা দিয়ে আকাশ দেখবে তাহলে একটা সিট নষ্ট করে অন্য একজনকে বাংলা অনার্স নেয়া থেকে বঞ্চিত কেন করলে?” স্যারের সম্বোধনে আর কথায় পর্ণার গাল কান সব লাল হয়ে গেল।কোনো জবাবদিহি করার চেষ্টা না করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে শুধু আস্তে করে বললো,”সরি স্যার”।-“সরি বলে আমার ক্লাসে কোনো শব্দ হয়না,এটা জেনে রাখ।আজ প্রথম দিন বলে ছাড় পেলে।নেক্সট দিন তুমি শুধু না যে করবে দরজা তার জন্যে খোলা আছে।আর হ্যাঁ…”,সবার দিকে ফিরে বললেন,”…যাদের আমার ক্লাস মন দিয়ে করার ইচ্ছা হবেনা,অনায়াসে ঘরের বাইরে থাকতে পারে।বন্ধুকে দিয়ে বা বোর্ডে রোল লিখে রাখলে আমি আটেনডেন্স দিয়ে দেব,কোনো সমস্যা হবেনা।এমনকি পরে বন্ধুদের থেকে ক্লাসের নোটস ও নিয়ে নিতে পারো,আমি আপত্তি করবোনা।কিন্তু আমার ক্লাসে থাকলে শুধু আমার কথাই শুনতে হবে,আর আমার দিকেই পুরো মন দিতে হবে।নাহলে তাকে আমি নিজেই ঘরের বাইরে পৌঁছে দিয়ে আসব।”যেন এতক্ষন ধরে সবাই রুদ্ধশ্বাস কিছু শুনছিলো।এবার পর্ণাকে ইশারা করে বললো,”বসে পর।”বসার সময় পর্ণা বড় বড় চোখ দুটো তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকালো, জলে ভর্তি সেই নিষ্পাপ চোখগুলো দেখে কঠিন মনের এস.এস ও যেন কয়েক মুহূর্ত থমকে গেলেন।কি প্রচন্ড নিষ্পাপ সেই চাহনি,কিন্তু তার অভিজ্ঞ দৃষ্টি বুঝলো এই চাহনি ভোঁতা না,বুদ্ধির আলো ঝলমল করছে।আর তাই হয়তো তার নিজেরও একাগ্রতায় চির ধরলো।কাজল পড়া চোখ দুটো প্রথমদিনেই জলে ভিজে গিয়ে তাঁর কঠোর মনকে কেন জানেনা নাড়া দিলো।পর্ণাও বাকি সময়টা আর মুখ তুললোনা, তাই দেখাও হলোনা কান্না থেমেছে কি।বেল বাজার সাথে সব গুছিয়ে বেরোনোর সময়ও দেখলেন মুখ নিচু করেই মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে।কোনোদিন যা আজ অবধি হয়নি সেই খারাপ লাগা মন নিয়ে এস.এস ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস ছেড়ে থার্ড ইয়ারের ক্লাসে গিয়ে ঢুকলেন। শুভঙ্কর স্যারের ক্লাসের পর পর পর কটা পাসের ক্লাস ছিল।তারপর বিকেলের দিকে একটা শেষ অনার্স ক্লাস।ইচ্ছা করে এরকম রুটিন করা হয় যাতে ছেলে মেয়েরা পাশের ক্লাস গুলো করে।কিন্তু নিয়ম কে কলাগাছ দেখিয়ে বেশিরভাগ অনার্সের ছেলে মেয়েরা পাসের ক্লাস বাঙ্ক করে হয় ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দেয়,যারা পড়ুয়া লাইব্রেরি যায় আর বাকিদের কয়েকজনকে খুঁজে পাওয়া যায় ইউনিয়ন রুমে।এভাবেই চলে কলেজ জীবন।প্রথম বছর যাও বা কজন থাকে পাসের ক্লাসে।কয়েকমাস পর থেকে তা গুটিকয়েক এ এসে দাঁড়ায়। যাইহোক কলেজে দ্বিতীয় দিন বলে বাংলার সবাই গেছে পাসের ক্লাস করতে।পর পর দুটো ক্লাস করে তিন নম্বর ক্লাসের স্যার না আসায় সবাই ডিপার্টমেন্টে ফিরে আসে।পর্নাদের যেখানে ক্লাস হয়,সেখানে লাগোয়া একটা খোলা ছাদ আছে,অন্যমনস্ক পর্ণা সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।দূরে ট্রেন লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে।হটাৎ পিঠে একটা হাত এসে পড়ায় চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়।