মুখোশের আড়ালে – ষষ্ঠ পর্ব

by Tamali

ষষ্ঠ পর্ব:-


  চাঁদিপুরে সমুদ্র বেলাভূমি থেকে প্রায় ৫কিমি দূরে,একমাত্র জোয়ারের সময় বেলাভূমি ভাসিয়ে নিয়ে যায়।বালাসোর থেকে গাড়ি নিয়ে হোটেল পৌঁছতে দুপুর ১২টার বেশি হয়ে গেল।হোটেলটা নতুন হয়েছে।বেশ ছড়ানো হোটেল।একদিকে মেয়েদের ৪টে ঘর,এক একটা ঘরে ৬জন থাকার ব্যবস্থা।আর অন্যদিকে ছেলেদের ৩টে ঘর।ছেলেরা সংখ্যায় প্রায় জনা ত্রিশ।মেয়েদের দিকে আর একটা ঘরে ৪জন স্যার থাকবেন,আর শ্রীময়ী ম্যাম সেকেন্ড ইয়ারের দিদিদের সাথে থেকে যাবেন।পর্ণাদের ঘর ঠিক স্যারদের ঘরের উল্টোদিকে।     ট্রেনে এস.এস স্যার ওর সাথে কোনো কথাই প্রায় বলেননি, কিন্তু পর্ণা অনুভব করেছিল এক জোড়া চোখ সব সময় ওর ওপর নজর রাখছে।সৌরভও একবার যেচে কথা বলতে এসেছিল।পর্ণা  দায়সারা ভাবে কথা বলায় অল্পই কথা বলে সৌরভ চলে যায়।সুশীর অবজ্ঞায় বেচারার মুখ ছোট হয়ে গেছিল।     হোটেলে গিয়ে সবাই চান করে ডাইনিং রুমে যখন খেতে এলো তখন বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে।তবে বেশিক্ষন হবে বলে মনে হচ্ছিলনা।এখন সিজন পুরোপুরি শুরু হয়নি,তাই অপেক্ষকৃত ভিড় কম।এ হোটেলে ওরা ছাড়া বিশেষ কেউ নেই।আর চাঁদিপুর পুরী দিঘার মতো ওতো জনবহুলও না।বি.ডি স্যার সবাইকে একা বেরোতে বারণ করে দিলেন।এমনকি সন্ধ্যের পর ছেলে মেয়ে কাউকেই বাইরে বেরোনোর অনুমতি দিলেননা।মেয়েরা দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে চলে গেল বিশ্রাম নিতে,সবাই প্রায় রাত থাকতে উঠেছিল ভোরের ট্রেন ধরবে বলে। ছেলেরা কজন শুধু কাছাকাছি ঘোরার অনুমতি নিয়ে বেড়োলো। ঠিক হলো ৪টের পর বেলাভূমিতে যাওয়া হবে সবাই মিলে।   ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, নরম রোদ মাখা নীল আকাশ উঁকি দিয়েছে।ডিসেম্বরের শুরু,তার ওপর সমুদ্র তীর,দুপুরের হালকা ঠান্ডায় নরম রোদ গায়ে মাখতে ভালোই লাগছিলো শুভঙ্করের।বসে বসে ভাবছিলো সুস্মিতার কথা।….পুজোর ছুটির পর এক সপ্তাহ ক্লাস হয়ে যাওয়ার পর শুভঙ্কর লক্ষ্য করলো পর্ণার মধ্যে আগের চাঞ্চল্য নেই,যেন হটাৎ পরিণত হয়ে গেছে।কলেজে যতক্ষন থাকে ক্লাস না থাকলে লাইব্রেরীতে বসে থাকে,শুধু বসে থাকেনা রীতিমতো পড়াশোনা করে।এখানেও শুভঙ্কর নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় ওর মধ্যে।সৌরভের সাথে আগের মতো ঘুরে বেড়ানো তো দূর, কথা বলতেও দেখেনি এ’কদিন।খটকা লাগে।..এরকম তো হওয়ার কথা ছিলোনা।কোথাও যেন একটা সুর কেটে যাওয়ার আভাস! এর মধ্যে হটাৎ একদিন সুস্মিতাকে একা পেয়ে যায় লাইব্রেরীতে,বই নিচ্ছিল…কিন্তু আগের বই ফেরত আনতে ভুলে যাওয়ায় এখনকার বইটা ইস্যু হচ্ছিলনা। শুভঙ্কর নিজের নামে বইটা তুলে ওকে দেন।আপ্লুত হয়ে যায় সুশী। স্যারকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে আসতে গেলে শুনতে পায়,”সুস্মিতা কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।তোমার কি এখন ক্লাস আছে?” এস.এস স্যারের মুখে এই কথা শুনে সুশীর মুখ এমন হাঁ।…..স্যার বই আর পড়ানোর বাইরে কথা বলতে চান!!!….ও নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে বলে,”না না স্যার।আমি তো এখুনি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।আজ তেমন ক্লাস থাকেনা আমাদের,শুধু এই বইটার জন্যেই আসা।আর এমন ভুলো মন ফেরত দেয়ার বইটা আনতেই ভুলে গেছি”।সুশীর কথা শুনে শুভঙ্কর বলে,”তাহলে আমায় মিনিট কুড়ি সময় দিতে পারবে?কিছু জিনিস জানার ছিল।… কিন্তু কলেজে তো সম্ভব না।..উমমম….তুমি একা যদি স্টেশনের সামনে যে নতুন কফি শপটা হয়েছে ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারো আমি দশ মিনিটেই পৌঁছে যাব”। সুশীর নিজের কানকে অবিশ্বাস হয়।এস.এস তার সাথে কফি শপে দেখা করতে চাইছে।উফফ কাকে যে বলবে!..কিন্তু না,কাউকে বলা বা সাথে নেওয়া যাবেনা এটাই শর্ত স্যারের।    সুশী চালাক মেয়ে,ও বুঝতে পারে স্যার খুবই ব্যক্তিগত কোনো কথা বলতে চান।আর কি নিয়ে,সেটাও কিছুটা অনুমান করতে পারে।মেয়েদের সিক্সথ সেন্স একটু বেশিই প্রখর হয়।তাই স্যারের কলেজ খোলার পর অন্যমনস্কতা, বিশেষ একজনকে এড়িয়ে যাওয়া, তার সাথে খারাপ ব্যবহার কিছুই সুশীর চোখ এড়ায়নি।তবে এবিষয়ে সুশী এতদিন কৌতূহল চেপেই রেখেছে।কিন্তু তার সাথে স্যার কথা বলতে চাইবেন সেটা ও ভাবেনি।    সুশী ওই কফি শপে পৌঁছে অপেক্ষা করতে থাকে।দশ মিনিটের আগেই এস.এস পৌঁছে যান।দুটো কোল্ড কফির অর্ডার দিয়ে কোনো ভনিতা না করে সরাসরি প্রশ্ন করেন সুশীকে, “তোমার বন্ধুর কি ব্যাপার?এত চুপচাপ হয়ে গেছে কেন?” শুভঙ্কর জানতো পর্ণার বিষয়ে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় সে একমাত্র সুস্মিতা,কারণ মেয়েটা পর্ণার শুধু বেস্ট ফ্রেন্ড ই নয়,খুবই পরিণত মেয়ে।এস.এস এর অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও এখন মেয়ে চিনতে শিখিয়েছে। শুভঙ্কর স্যারের প্রশ্নে সুশী চমকায় না।ও জানে জহুরী আসল হিরে চেনে,তাই এস.এস মতো সোনার পাথরবাটির পর্ণার বিষয় আগ্রহ হওয়াই স্বাভাবিক।পর্ণা বোকা,তাই সৌরভের মতো একটা পিছনে এতদিন সময় নষ্ট করলো,যে পর্ণার নখেরও যোগ্য না।ও একটু সময় নিয়ে বলে,”আমি কি বলবো স্যার!একটা খারাপ ঘটনা ওকে একটু নাড়িয়ে দিয়েছে।কিন্তু ওটা একান্তই ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার।তাই আমার পক্ষে ও নিয়ে কথা বলা সম্ভব না।” এস.এস কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলেন,”দূর্ভাগ্য বশত ঘটনাটা আমি জানি।কিন্তু সেটা ওকে নাড়িয়ে দিয়েছে কেন এটাই আমার জিজ্ঞাস্য”। চমকে ওঠে এবার সুশী।স্যার জানেন মানে!?আবার শুভঙ্কর বলে,”আমি যে জানি এটা সম্ভবত তোমার বন্ধুও জানে।ওর ব্যবহারে আমি সেটা বুঝেছি।কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছিনা,ওই ঘটনাটা ওকে বদলে দিলো কেন?”সুশী চুপ করে থাকে,কি বলবে ভাবতে থাকে।পর্ণাকে না জানিয়ে ওর এতটা ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলা কি উচিত?যেখানে আমাদের সমাজ আজও এসব ক্ষেত্রে দোষ মেয়েদের দিয়ে থাকে।ওর  ভবিষ্যতে যদি এই সামান্য ঘটনাই সমস্যা তৈরি করে তখন সুশী নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।ওকে চুপ করে থাকতে দেখে স্যার আশ্বাস দেন,”তোমার বলা কথা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি কোনোদিন জানতে পারবেনা,এমনকি তুমি না চাইলে পর্ণাও না।কথাটা জানা আমার  খুব দরকার… তাই হয়তো জিজ্ঞেস করছি।তবে… তুমি যদি বিশ্বাস করতে না পার বলতে হবেনা।”এস.এস এর স্বরে কাকুতি ঝরে পড়ে, শেষের কথাটায় সুস্মিতা নড়েচড়ে বসে।অনেক ভেবে জানায় সৌরভের হটাৎ ঐরকম ব্যবহারে পর্ণার মানসিক অবস্থার কথা,আরো জানায় পর্ণার বাবা মার ওর পাশে থেকে ওকে মানসিক শক্তি দিয়েছেন প্রথম থেকে।সুশী বলতে থাকে,”পর্ণা খুবই সংবেদনশীল মনের,তাই ছোট ছোট অনুভূতি গুলো ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু যখন ও বোঝে সৌরভের এইসব অনুভূতি নেই,ও নিজের মোহ কাটিয়ে বেরিয়ে আসে।আর এব্যাপারে আনাড়ি হলেও একটা মেয়ে হিসেবে ও বুঝেছিল সৌরভ এসব ক্ষেত্রে ভালোই অভিজ্ঞ।….সম্পর্কের আসল ভীত শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস,এদুটোর কোনোটাই ও এই সম্পর্কে পায়নি।এখন হয়তো এটাও অনুভব করে ওটা একটা মোহ ছিল,নাহলে ওর পক্ষে এত সহজে বেরিয়ে আসা হয়তো সম্ভব হতোনা।….. এগুলো সবই আমার পর্ণার কাছে শোনা কথা,কোনোটাই নিজের উপলব্ধি নয়।”শুনতে শুনতে শুভঙ্কর মুগ্ধ হচ্ছিল,আজকের জেনেরশনের ছেলে মেয়ে সম্পর্কে ধারণাও পাল্টাচ্ছিলো।কি গভীর উপলব্ধি, কি স্বচ্চ অনুভূতি….শুধু চোখ না হয়তো এই মেয়েটার মন পড়া যার তার কাজ না।বাইরের চাঞ্চল্য আবরণ মাত্র,মনের গভীরতার তল পাওয়া মুশকিল।সুশীকে বললো,”তুমি আজ আমায় বিশ্বাস করে যা বললে,জানিনা অন্য কেউ হলে বলতো কিনা।তোমার মত বন্ধুরা আছে বলেই,বন্ধুত্ব কথাটা টিকে আছে।ভবিষ্যতে কখনো কোনো দরকার হলে স্যার না,এই শুভঙ্করদা কে নিশ্চই মনে করো।”স্যারের কথায় আপ্লুত হয়ে সুশী শুধু বললো,”নিশ্চই বলবো স্যার,কিন্তু এখন আমার একটাই চিন্তা ওই বখে যাওয়া ছেলেটা এত সহজে পর্ণাকে ছাড়বে কিনা?আপনিও একটু নজর রাখবেন।”    সুশীর কথার গুরুত্ব দিতেই তার কলেজ ট্যুরে আসা।কাল রাত অবধি দোটানায় ছিল আসবে কিনা,মার শরীরটা কদিন ভালো না।কিন্তু যেই খবর পেলো সৌরভ শেষ মুহূর্তে যাওয়ার ব্যাপারে গ্রীন সিগনাল দিয়েছে,এক মুহূর্ত আর ভাবেনি।মা’র কাছে শান্তা দিদিকে কদিনের জন্যে থাকার ব্যবস্থা করে চলে এসেছে। সত্যি বলতে কি সৌরভ বলে ছেলেটাকে ও নিজেও ঠিক বিশ্বাস করেনা।সৌরভ যে কেমন ছেলে ও নিজেও খুব ভালো করে জানে।সেইদিনটার কথা ওর আজীবন মনে থাকবে।সেদিন সৌরভ দের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় ক্লাস ছিল।অমনোযোগী সৌরভকে অন্য স্টুডেন্টদের মতোই শাসন করতে গিয়েছিল শুভঙ্কর।কিন্তু বেপরোয়া ছেলেটি আঙ্গুল তুলে এস.এসকে শাসায়।তার প্রত্যুত্তরে সবার সামনে ওকে বাইরে বের করে দেওয়ার প্রতিশোধও নিয়েছিল সে।প্রতিটা বখাটে ছেলের বড়লোক বাবার মতো ওর বাবাও পরেরদিন কলেজে ছুটে আসে।বি.ডি স্যারের ঘরে ডেকে অপমানও করে।পরে বিমল স্যার বলেছিলেন এসব ছেলেকে নিয়ে মাথা না ঘামাতে।এরা কলেজে ঘুরতে আসে।তবে ওই ঘটনার পর সৌরভ শুভঙ্করের বেশিরভাগ ক্লাসই করেনা।ওর কিছু তোষামোদকারি বন্ধু আর নকল করতে পারার মতো শিল্প কলার সাহায্যে পরীক্ষা গুলোয় যাহোক করে উৎরে যায়, কিন্তু বাংলা বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান প্রায় কিছুই নেই।তাই পর্ণার মতো মেয়েকে ওর সাথে দেখে শুভঙ্করের রাগই হয়ে গেছিল।আর পুজোর আগের ঘটনায় পর্ণাকেও দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ওকে কষ্ট দিতে থাকে,আর নিজে তার চেয়েও বহুগুণ বেশি কষ্ট পায়।সৌরভ এই ট্যুরে যাবেনা এটাই সবাই জানত,কিন্তু কাল রাতে যখন ফাইনাল লিস্ট চেক করার সময় জানতে পারে ওই ছেলেটা যাচ্ছে, শুভঙ্করের মুখটা তেতো হয়ে যায়।মনে ভেসে ওঠে ওই চোখটা। শ্রীময়ী কে এই কলেজে গেস্ট লেকচারার করে এনেছিল এস.এস।শ্রী ওর ছোটবেলার খুব ভালো বন্ধুদের একজন।কাল রাতে শ্রী কেও রাজি করায় ফোনে, বেড়াতে আসতে,তাহলে মেয়েদের সাথে কেউ একজন গার্ডিয়ানস থাকবে।ট্রেনে শ্রী কে অনুরোধও করে যাতে পর্ণাদের ঘরের দিকে নজর রাখে।যদিও শ্রী কে বলেনি পর্ণার প্রতি ওর ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা।যতটা বললে পর্ণার ব্যক্তিগত জীবনে কোন প্রভাব পড়বেনা,ততটাই বলেছে।      একটা সুবিধা আছে এখানে।মেয়েদের দুটো করে ঘর একে অপরের সাথে একটা মাঝের দরজা দিয়ে জোড়া।ওই দরজা দিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া যায়।পর্ণাদের ঘরে ও,সুশী আর ওদের ব্যাচের আরো ৪জন আছে,আর শ্রীময়ী আছে পাশের ঘরে অন্যদের সাথে।   দুপুর প্রায় শেষ হয়ে বিকেল নামছে।এখানে হোটেলে পিছন দিক দিয়ে একটা পায়ে চলা রাস্তা আছে বেলাভূমিতে যাওয়ার।রাস্তাটা এমনিতে ভালো না।কিন্তু এখন ওই রাস্তা দিয়েই যাওয়া হবে।বাইরে যেখানে শুভঙ্কর বসেছিল,আশেপাশে কিছু চেয়ার আরো পাতা ছিল।ভিতর থেকে ছেলে মেয়েরা এসে বসতে থাকে একে একে।শ্রীময়ীও বেরোবার সাজে তৈরি হয়ে এসে বসে শুভঙ্করের পাশে একটা চেয়ার টেনে।”কিরে ঘুমোচ্ছিলি নাকি?”শুভর প্রশ্নে শ্রী হেসে ফেলে,”আর ঘুম!শালিক পাখি গুলো সারা দুপুর কিচির মিচির করে জ্বালিয়ে মেরেছে,নিজেরা তো একটুও বালিশে মাথা ঠেকায়নি,আমাকেও দুচোখের পাতা এক করতে দেয়নি ৫মিনিট।”বলে দুজনেই হাসতে লাগলো।এস.এস হাসছেন!!!আসে পাশের সব কটা চোখ অবাক হয়ে তাকায় স্যারের দিকে।বিমল স্যার আর আরো দুজন তরুণ স্যার ও রমাকান্ত স্যারও যোগ দেন আড্ডায়।কিছুক্ষন পর বি.ডি স্যারের তাড়া লাগান দেরি হয়ে যাচ্ছে,বেরোতে হবে। সবাই জড়ো হয় বেড়াতে বেরোনোর জন্যে,স্যার সবাইকে বারবার সাবধান করলেন…কেউ যেন দলছুট না হয়।সমুদ্রের জলরাশি বেলাভূমি থেকে বেশ খানিকটা দূরে,তাই কেউ একা যেন এগিয়ে না যায়। শুভঙ্করের ফেরারী মন হলুদ সালোয়ারে উজ্জ্বল পর্ণাকে ছুঁয়ে দিয়ে যায় এত কথার মাঝেও।অনেক ছোট থেকে নিজের অনুভূতি আর আবেগ গুলো লুকোতে শিখেছে বলে কারোর শোনা হয়ে ওঠেনা এস.এস এর বুকের মধ্যে উত্তাল ঢেউয়ের আওয়াজ।শুধু সুশী জানে সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরের মানুষটা ধরা পড়েছে গভীর চোখের একটা মেয়ের কাছে।মেয়েটা নিজেও কতটা কি বোঝে সুশীর জানা নেই।চেষ্টা করেছিল,কিন্তু তল পায়নি।   কলেজের বেশির ভাগ মেয়ে মফস্বলের।অনেকের নিয়মিত বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেস থাকলেও বেশিরভাগ মেয়ে প্রথম সমুদ্র  দেখছে।বেলাভূমিতে লাল কাঁকড়া দেখে সবাই লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে,কেউ ফটো তুলছে,কেউ তাড়া করছে।পর্ণা ওদের খুব বোঝাচ্ছে যারা কাঁকড়া গুলোকে তাড়া করছে বা খোঁচাচ্ছে।…..ওরা এখানে এসে কিছুটা ছড়িয়ে গেলেও সুশী জানে শুভঙ্কর স্যার দূর থেকে হলেও ওদের নজরে রেখেছেন।গুটি কয়েক মেয়ে বি.ডি স্যারের সাথে এগিয়ে গেছে উদ্দাম উচ্ছল জলরাশির খোঁজে।দেখে মনে হচ্ছে ঐতো সমুদ্র,আসলে কিন্তু অনেকটাই দূরে।  হটাৎ সুশী আর পর্ণা একটু একা হয়ে পড়তেই সৌরভ কোথা থেকে উদয় হলো ওদের সামনে,সাথে আরো দুজন ওর ব্যাচমেট,এরা সবাই দুপুরে খাবার পরই বেরিয়ে এসেছিল হোটেল থেকে।সৌরভ পর্ণার সাথে আলাদা কথা বলতে চায়ছিল,কিন্তু পর্ণা রাজি হলোনা।সৌরভ যেন নাছোড়বান্দা।সুশী একটু ভয় পেল মনে মনে, কোনো ভাবেই ও সৌরভকে বিশ্বাস করেনা,তাই হটাৎ ওদের দেখে একটু ঘাবড়ে গেল।হটাৎ  আড়চোখে অনুভব করল এস.এস স্যার কাছাকাছিই আছেন,কিন্তু ও জানে খুব দরকার নাহলে উনি এখুনি আসবেন না,কিন্তু সবসময় সাথে আছেন।কিছুতেই পর্ণাকে রাজি করাতে না পেরে,সৌরভ যেন কিছুটা হতাশ হয়েই চলে গেল,আর পর্ণার মনে রেখে গেল বিভ্রান্তি ।পর্ণা নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকলো,’ও কি ঠিক করছে?’,’হয়তো সৌরভ বদলেছে।’কিন্তু পর্ণা যে আজ জানে প্রকৃত ভালোবাসা কি! অনুভব করে,সৌরভের প্রতি ভালো লাগাটা ভালোবাসায় পৌঁছতে পারেনি।পর্ণা জানে ভালোবাসা অত সহজলভ্য নয়।না বলা ভালোবাসাও সারাজীবন বুকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়,দূর থেকে একটু দেখেও আনন্দ পাওয়া যায়।তাকে অন্যের সাথে দেখলে মনে জ্বালা ধরলে সেটাও সবচেয়ে খাঁটি ভালোবাসা।তার চোখে অবজ্ঞা মনে কষ্ট দিলেও কারণ কল্পনা করেও সুখ পাওয়া যায়।সৌরভের মতো ভালোবাসা হাজার হাজার ছড়িয়ে আছে আসে পাশে,কিন্তু চোখ দিয়ে পড়ে আর মন দিয়ে অনুভব করে পাওয়া সেই বিশেষ জনের ভালোবাসা অমূল্য,যা কাউকে বলা যায়না।যা নিয়ে বন্ধুদের সাথে ঠাট্টা করা যায়না।যা একান্ত নিজের হয়ে থাকে।কখনো এরকম ভালোবাসা অব্যক্ত থেকে যায় সারাজীবন, পাওয়া হয়না দুর্লভ ‘মনের মানুষ’টাকে।কিন্তু একাকিত্বে,মনের দুঃখে,কোনো কারণে খুশির ছোঁয়ায় সারাজীবন ক্ষণে ক্ষনে মনে পড়ে তাঁকে।মন ভালো হয়ে যায়।

     সমুদ্রতট থেকে সবাই লোকাল বাজারে ঘুরে ৭টা নাগাদ হোটেলে ফিরে আসে।তারপর চা-কফির কাপ হাতে নিয়ে হোটেলের লনে বসে সান্ধ্যকালীন আসর।এখানে গল্প আড্ডার সাথে চলতে থাকে নিজেদের শখের চর্চাও।মানে কেউ গাইছে,কেউ নাচছে, সঙ্গে করে নিয়ে আসা গিটার, মাউথর্গানও মনোরঞ্জন করছে।বি.ডি স্যার গলা ছেড়ে গাইলেন,’আকাশ ভরা সূর্য তারা…’। শ্রীময়ী ম্যাম তরুণ স্যারের গানের তালে তালে পা মেলালেন।সৌরভ গিটার বাজিয়ে নিজের ব্যান্ডের গান করলো।এভাবে চলতে চলতে এস.এস স্যারের পালা এলো।কিছুক্ষন এড়িয়ে যাওয়ার পর সকলের অনুরোধে রাজি হলেন আবৃত্তি করতে…   “কবিতাটা কবি আরণ্যক বসুর,নাম ‘মনে থাকবে?’..” তারপর একটু থেমে শুরু করলেন আবৃত্তি,তাঁর ভরাট কণ্ঠস্বরে পুরো লন গমগম করে উঠলো…
“পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিকআমরা তখন প্রেমে পড়বোমনে থাকবে?
বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবেশীতলপাটি বিছিয়ে দেব;সন্ধে হলে বসবো দু’জন।একটা দুটো খসবে তারাহঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,কান্ত কবির গান গাইবেতখন আমি চুপটি ক’রে দুচোখ ভ’রে থাকবো চেয়ে…মনে থাকবে?
এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেবএই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেনএই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেনমনে থাকবে?
আমি হবো উড়নচন্ডিএবং খানিক উস্কোখুস্কোএই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেবতুমি কাঁদলে গভীর সুখেএক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেবমনে থাকবে?পরের জন্মে কবি হবোতোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো।তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়েনাকছাবি আর নূপুর নিয়েগান বানিয়ে__মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো…মনে থাকবে?
আর যা কিছু হই বা না হইপরের জন্মে তিতাস হবোদোল মঞ্চের আবীর হবোশিউলিতলার দুর্বো হবোশরৎকালের আকাশ দেখার__অনন্তনীল সকাল হবো;এসব কিছু হই বা না হইতোমার প্রথম পুরুষ হবোমনে থাকবে?
পরের জন্মে তুমিও হবেনীল পাহাড়ের পাগলা-ঝোরাগাঁয়ের পোষাক ছুড়ে ফেলেতৃপ্ত আমার অবগাহন।সারা শরীর ভ’রে তোমার হীরকচূর্ণ ভালোবাসা।তোমার জলধারা আমার অহংকারকে ছিনিয়ে নিল।আমার অনেক কথা ছিলএ জন্মে তা যায়না বলাবুকে অনেক শব্দ ছিল__সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিককাব্য করে বলা গেল না!এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতেপরের জন্মে মানুষ হবোতোমার ভালোবাসা পেলেমানুষ হবোই__ মিলিয়ে নিও!
পরের জন্মে তোমায় নিয়ে…বলতে ভীষণ লজ্জা করছেভীষণ ভীষণ লজ্জা করছেপরের জন্মে তোমায় নিয়ে…মনে থাকবে?”আবৃত্তি শেষ করে চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন তাকে,যাকে উদ্দেশ্য করে আবৃতিটা করা।সত্যি হয়তো ভালোবাসাটা পরের জন্মের জন্যে তুলে রাখতে হবে,হয়তো বলাই হয়ে উঠবেনা।হয়তো বয়সে নবীন কেউ এসে জয় করে নেবে তাকে,তবুও আজ অন্যের কবিতা দিয়ে নাহয় বলা হলো মনের কিছু কথা।ভয় হয়,ভালোবাসাটা হয়তো একতরফা হয়েই শেষ হয়ে যাবে।           সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো।কেউ ভাবেইনি ওই আপাত গম্ভীর মানুষটার মধ্যে এত প্রেম থাকতে পারে,কিন্তু যার উদ্দেশ্যে কবিতা আবৃত্তি করলেন সে কি বুঝলো,নাকি বিশ্বাস করলো যে তাকে ভেবে এস.এস কবিতা শোনাতে পারেন?শুধু বুঝলো স্যার হয়তো কাউকে ভালোবাসেন যে ভালোবাসা আশেপাশেই আছে।হয়তো মনে এলো শ্রীময়ী ম্যামের কথা।বুঝলো শুধু একজন,যে জানে শুভঙ্কর স্যার সবসময় ঘিরে আছেন তার বন্ধুকে,সুস্মিতা অনুভব করলো কবিতার মর্মার্থ।  এইভাবে গানের সুরে,গিটারের ছন্দে রাত বাড়তে লাগলো।তখন আর ২-৪জন বাকি,পালা এলো পর্ণার।পর্ণা এতদিন যে গুনটা লুকিয়ে রেখেছিল,যেটা জানত কলেজের মধ্যে শুধু সুশী,সেটাই সবাইকে জানাবে ঠিক করে রেখেছিল।পরিবেশ সঙ্গত করছিল পর্ণার সাথে তাই পর্ণা হটাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুরের মূর্ছনা তুললো।যেটা পর্ণার প্রানের প্রিয় সেই শাস্ত্রীয় সংগীতের মূর্ছনায় ভেসে গেল যেন গোটা চাঁদিপুর।চাঁদের আলোয় সেই মূর্ছনা যে না শুনবে তাকে বোঝানো যাবেনা তার মহিমা।যে বোঝেনা সেও ওই গলার জাদুতে আবিষ্ট হয়ে গেল।যখন পর্ণা থামল,চোখ খুলে দেখলো সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।সবার অবাক করা মুখ,আর তার স্বপ্নের মানুষটার চোখের প্রশ্ন তাকে লজ্জায় ফেলে দিলো।সে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে মৃদু হাসি মুখে নিয়ে বললো,”জানি অনেকে,বিশেষ করে আমার ক্লাসের বন্ধুরা হয়তো আমায় মিথ্যেবাদী ভাবছে,কারণ আগে কলেজের প্রথম দিন আমি নিজের মুখে বলেছিলাম আমি ‘বাথরুম সিঙ্গার’,ওই কথাটাও কিন্তু মিথ্যে ছিলোনা।কারণ যেরকম গান গাইতে বলা হয়েছিল আমি সে ব্যাপারে কিছুই জানিনা।কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীত আমার প্রাণের দোসর,যা ওই ধরণের জমায়েতে গাওয়া সম্ভব ছিলোনা।….তাই আমার দ্বিতীয় বন্ধু আবৃত্তিকেই সেদিন আশ্রয় করেছিলাম।আজ এমন সুন্দর পরিবেশে খুব ইচ্ছা করলো আমার গান গাইতে,তাই হয়তো গান এলো।৪বছর বয়স থেকে গান আমার সঙ্গী।”পর্ণার বলা শেষ হলে বি.ডি স্যার বলে উঠলেন,”অপূর্ব!অপূর্ব!এই জন্যেই আমি বাইরে বেড়াতে আসা এত পছন্দ করি।নাহলে জানাই হয়না কত সুপ্ত প্রতিভা আছে আমার ছেলে মেয়েদের মধ্যে।কোনো তুলনা হবেনা পর্ণা।সত্যি বলছি মাইন্ড ব্লোউইং।”প্রবীণ স্যার এগিয়ে এসে পর্ণার মাথায় হাত রাখেন।সবাই পর্ণার গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।শুধু সৌরভ কে আর দেখতে পাওয়া যায়না।আর পর্ণা যাঁকে সুরের অঞ্জলি দিতে গান গেয়েছিল,তিনি দূরেই দাঁড়িয়ে থাকেন।কেউ শুনতে পায়না মনে মনে করা তাঁর স্তুতি গুলো,মন পড়া বা দেখা গেলে বোঝা যেত পর্ণার অহংকারে কোনো অজানা কারণে তিনি অহংকারী হয়ে উঠেছেন।মনে মনে গর্ববোধ করলেন জীবনের প্রথম সবটুকু ভালোবাসা এমন একটা গুণী মেয়েকে দেওয়ার জন্যে,হোক না সে ভালোবাসা গোপন,হোক না সে ভালোবাসা শুধু তার একার,কিন্তু সেটা তো মিথ্যে নয়।সে ভালোবাসা তার অহংকার,সে ভালোবাসা তার বাঁচার অক্সিজেন।  দুজনেই দুজনের প্রতি ভালোবাসাকে গোপন করে মনে মনে একে অপরকে ভালোবাসা উৎসর্গ করলো।এস.এস এর টা তাও সুশী বুঝেছিল,কিন্তু নিজের প্রিয় বন্ধুর মনের হদিস সে পায়নি।শুভঙ্কর ভালোবেসেছিল হয়তো অনেক আগে,কিন্তু পর্ণার ভালোবাসা স্যারের প্রতি তার প্রেমের অর্ঘ্য,যাতে ছিল শ্রদ্ধার অনেকটা মিশেল।ছিল বিশ্বাস,ছিল সমর্পণ।হয়তো ওর প্রতি শুভঙ্কর স্যারের কোনো রকম দুর্বলতা অনুভব করেছিল,কিন্তু সেটা প্রেম না স্নেহ সেটা নির্ণয় করতে পারেনি।পর্ণা ভাবতেও পারেনি শুভঙ্কর স্যারের ভালোবাসাতেও ছিল শ্রদ্ধার ছোঁয়া।বিশ্বাস,শ্রদ্ধা,নির্ভরতা,প্রেম এবং সমর্পণ সবকিছু নিয়েই তো ভালোবাসা,যেখানে স্নেহরসও মিশে থাকে।একে অপরকে নিয়ে অহংকার করার মধ্যেই তো ভালোবাসা বহু বছর অবধি বেঁচে থাকে।সত্যিকারের ভালোবাসা বছরের সাথে সাথে আরো পরিণত হয়,প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠে।ভালোবাসা পরিপূর্ণ হয় সমর্পণে,অহংকারী হয় পরিণয়ে।কিন্তু শুভঙ্কর পর্ণার ভালোবাসার অদৃষ্টে কি আছে হয়তো শুধু ভগবানই জানতেন,তাই অনিশ্চয়তা নিয়ে দুজনের মনেই আলাদা করে বাড়তে লাগলো একে অপরের প্রতি ভালোবাসা।এত ভিড়ের মধ্যেও তাই দুটো চোখ একবার একে অপরের সাথে মিলল, পর্ণা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলেও শুভঙ্করের চোখ তাকিয়ে থাকলো পর্ণার দিকেই,খুঁজতে চাইলো আশ্রয়,বুঝতে চাইলো মনে ভাষা।

ক্রমশ…   

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!