প্রথমপর্ব:-
“বড়বৌমা,অ বড় বৌমা…বলি বরণডালাটা আনবে তো নাকি!ছোটখোকা বউ নিয়ে কতক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে শুনি? তোমার কি আক্কেল হবেনা?কখন বলেছি বরণডালাটা গুছিয়ে রাখতে….কোনো কথাটা যদি একবারে বোঝে তো?!..”।
একবাড়ি ভর্তি আত্মীয় কুটুমের সামনে মুখুজ্জে গিন্নির চিৎকারটা বড়োই কানে লাগলো বড়ছেলে সুকোমলের।সে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে যেতেই ছোট ছেলে দীপক তার মাকে চাপা গলায় ঝেঁঝে উঠলো, “আঃ!মা।সবসময় বড়বৌদি কে ওভাবে কেন বলো সবার সামনে?… দাদার খারাপ লাগেনা?আর আমরা কতোক্ষণই বা এসে দাঁড়িয়েছি?” দীপকের কথা শেষ হতে না হতে বড় বউ মন্দিরা হন্তদন্ত হয়ে বরণডালা হাতে এগিয়ে আসে,”আসলে প্রদীপটা জ্বালাতে একটু দেরি হয়ে গেল মা।কিছু মনে করোনা ভাই দীপু।…এই নিন মা বরণডালা”,বলে বরণডালাটা নিজের শাশুড়িমা সরলাবালার দিকে এগিয়ে দেয়,আর তিনি মুখ বেঁকিয়ে ওটা হাতে নিয়ে বরণ করতে এগিয়ে যান।
সদ্য ছোট বউ হয়ে আসা প্রিয়া পুরো ঘটনাটা চুপ করে দেখছিল,আর তার বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিচ্ছিল সংসারে কার অবস্থান কোথায়।বাড়ির সবাইকেই আগে দেখলেও বড়জা মন্দিরাকে সে এই প্রথম দেখলো,যদিও দীপুর মুখে তার বড়বৌদি মন্দিরার গল্প অনেক শুনেছে।তাই শাশুড়ি মার কাছে বড় বউয়ের উঠতে বসতে কথা শোনার ব্যাপারটা তার অজানা নয়।যতক্ষন বরণ হলো সে মাঝে মাঝে মন্দিরার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা উজ্বল আভা পুরো মুখ জুড়ে,খুব খুশি হলে যেমন হয়।প্রিয়া অবাক হয়ে গেল,এত অপমান সয়েও কেউ কিকরে এত খুশি থাকতে পারে!বরণের পর প্রিয়ার হাত ধরে মন্দিরাই ওকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল। স্ত্রী আচার চলার সময় সরলাবালা সবার সামনে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,”আমার ছোটবৌ রূপে শুধু লক্ষ্মী নয়,গুনেও সরস্বতী হ্যাঁ।আমার দীপুর মতো ডাক্তারের উপযুক্ত দিদিমণি বউ।এম.এ,বি.এড…ইংরাজীর দিদিমণি।…ওই বড় বউয়ের মতো মুখ্যু নাকি?”শাশুড়ির কথায় সবাই মুখ চাওয়াচয়ি করছে দেখে মন্দিরা মাথা নিচু করে সরে গেল।প্রিয়া যত দেখছিল অবাক হচ্ছিল।ও বুঝতে পারলো ওর সুনাম করাটা উপলক্ষ মাত্র, বড় বউকে ঠোকার এমন সুযোগ শাশুরিমা ছাড়তে চাইছেন না।অথচ ওর এই শিক্ষিত হওয়া,চাকরি করা নিয়েই বেশি আপত্তি ছিল ওর শ্বশুর শাশুড়ির।বাড়ির বউ বাড়ির কাজ না করে বাইরে কাজ করতে যাবে মানতে পারছিলেন না দুজনের কেউই,বিশেষ করে যাহোক করে সই করতে পারা শাশুড়ি মা।সেই সময় মন্দিরা দায়িত্ব নিয়ে সুকোমলকে দিয়ে সব্বাইকে বোঝায়,সে সংসারের সব দায়িত্ব একাই সামলাতে পারবে একথা শোনার পর তবেই তাঁরা প্রিয়াকে এবাড়ির বউ করতে নিমরাজি হন।প্রিয়া সবটুকু জানে।এটাও সে বোঝে এবাড়িতে সে বউ হয়ে আসায় সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছে তার বড়জা, দীপুর মুখে শুনে শুনে কবেই যেন এবাড়ির ছোট বউয়ের স্থানটায় প্রিয়াকেই কল্পনা করে নিয়েছিল মন্দিরা।দীপুকে কোনোদিনও নিজের আত্মজ সুজাতর থেকে আলাদা করে দেখেনি সে। প্রিয়া দীপুর মুখে এতদিন যদি কারোর কথা সবচেয়ে বেশি শুনে থাকে সেটা মন্দিরা।ভোরের আলো ফোটার আগে থেকে মন্দিরার দৈনন্দিন রোজনামচা শুরু হয়,দুপুরে খানিক বিশ্রাম বাদ দিলে তা শেষ হয় রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর।কিন্তু মন্দিরার মুখ হাসি ছাড়া কেউ দেখেছে বলে মনে করতে পারেনা।বড়ছেলে সুকোমল ছোট দীপকের মতো অত মেধাবী ছিলোনা বলে কোনোদিনই বাড়িতে বড়ছেলের আদর,যত্ন ,সম্মান পায়নি।নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি স্কুলে ক্লার্কের চাকরি পাওয়ার পর সে বিয়ে করে স্কুলেরই আর এক ক্লার্ক অবনী বাবুর বাপ মা মরা ভাগ্নী মন্দিরাকে।বিয়ে করার পর থেকে শেষ ১০বছর সে আরো বাবা মার চক্ষুশূল।মন্দিরা এই সংসারে এসে থেকে কোনোদিনও কারোর অযত্ন করেনি,কিন্তু বদলে যত্ন ভালোবাসা দূরের কথা,সামান্য ভালো কথা কোনোদিন শুনতে পায়নি,এমনকি ছেলে হওয়ার সময় বা পরেও না।আজ পর্যন্ত কোনোদিনও শাশুড়ি মার থেকে ভালো কথা না শুনলেও মুখ তুলে প্রতিবাদ করতে কেউ শোনেনি।
বিয়ের সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন প্রিয়ার ছুটি হয়ে যায় টিফিনে।বাড়ি ফিরে এসে রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখে মন্দিরা তখনও খুটখাট করছে।”কি করছো দিদিভাই?এবার একটু বিশ্রাম নিতে যাও”।প্রিয়ার কথায় চমকে উঠে মন্দিরা বলে,”ছোট তুই?ছুটি হয়ে গেল তোর?ভালোই হয়েছে।সকালে দুমুঠো ভাত নাকে মুখে গুঁজে ছুটিস,চল চল খাবি চল আবার।”
“খিদে তো পেয়েছে,কিন্তু আমি তোমার ভাতটা খেয়ে নিলে তুমি খাবে কি, জলমুড়ি?”প্রিয়ার কথায় হেসে ফেলে মন্দিরা। “ছোটবাবুর এসব গল্পও হয়ে গেছে?”আদর করে দীপককে মাঝে মধ্যে সে ছোটবাবু বলে।প্রিয়াও হাসতে হাসতে বলে, “শুধু এইসব নয়,তোমার সব সব সব কথা আমি জানি”।দুজনেই হাসতে থাকে।এই দুপুর বেলাটা সবাই ভাত ঘুমে তলিয়ে থাকে তাই মন্দিরার একটু মুক্ত জীবন কাটে এইসময়।আগে দীপু যখন মেডিক্যাল কলেজে পড়তো,হোস্টেলে ভালো করে খাওয়া জুটতনা।বাড়ি ফিরলে প্রায় দিনই তার খালি খালি খিদে পেত।এরকম দুপুরের সময় প্রায়দিনই সদ্য মা হওয়া বড়বৌদি নিজের ভাগের ভাতটা আদরের দীপুকে খাইয়ে নিজে জলদিয়ে মুড়ি মেখে খেয়ে থাকতো।একদিন দীপু জানতে পেরে যায়।তার মায়ের সে আদরের ছোট ছেলে,কিন্তু কোনোদিনও মাকেও দেখেনি ওর জন্যে এভাবে মুখের ভাত ওকে দিয়ে দিতে।বড়বৌদিকে অভিমান ভরা গলায় শাসন করতে যায় ও।মন্দিরা বলে,”দূর পাগল আমার এরকম অভ্যেস আছে বিয়ের আগে থেকে।আর তাছাড়া তুই আর সুজাত আমার কাছে এক,সুজাতর খিদে পেলে কি আমি ওকে না দিয়ে নিজে খেতাম?আর তাছাড়া হোস্টেলে তোর খাওয়ার কত কষ্ট।যে কদিন বাড়ি আসিস ভালো করে একটু খাস।…যা তো তুই এসব নিয়ে কথা বাড়াস না।”
“আমি বাড়ি থাকি যে কদিন ভাতের চাল তো একটু বেশি নিতে পারো”,দেওরের কথায় মন্দিরার মুখ কালো হয়ে যায়।ও কিকরে বলবে যে হিসেবের বাইরে একমুঠো বেশি খরচ করার অধিকারও তার নেই।পর মুহূর্তে ও হেসে বলে,”তাই নেব ক্ষন।তুই এখন যা তো”।বড় বৌদির মুখ দেখে দীপু আন্দাজ করে নেয় কোনো অজানা সমস্যার কথা,আর কথা বাড়ায় না। আজ প্রিয়া কিছুতেই মন্দিরার ওই ফাঁদে পা দেয়না।শেষ অবধি এক থালায় ভাত বেড়ে মন্দিরা প্রিয়াকে খাইয়ে দিয়ে নিজে খায়।হঠাৎ প্রিয়ার চোখেও জল এসে যায়,মনে পড়ে যায় মেয়েবেলার কথা।নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”দিদিভাই পুঁইশাকটা জাস্ট ফাটাফাটি হয়েছে।আর তেঁতুল দিয়ে ইলিশ মাছের টকটা নিয়ে কোনো কথা হবেনা।তুমি পুরো আমার ঠাম্মির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো।” মন্দিরা প্রিয়ার কথায় হাসতে থাকে।এইভাবে খুনসুটি আড্ডায় গল্পে কেটে যায় দুপুরটা।এইটুকুই মন্দিরার জীবনে অক্সিজেন প্রিয়া তা বোঝে।প্রিয়া আসার পর ওর জীবনে অন্তত একটা সত্যিকারের বন্ধু,বোন জুটেছে,যদিও দীপু অনেকটাই সেই জায়গাটা পূরণ করে এসেছিল।দীপু ছাড়া কেউ কোনোদিন মন্দিরার হয়ে কিছু বলেনি,দীপুর সামনে অন্যায় হলেই ও প্রতিবাদ করেছে।আগে ছোট বলে কেউ ওর কথার গুরুত্ব দিতোনা, কিন্তু এখন এড়িয়ে যেতে পারেনা কেউ। স্বভাব শান্ত সুকোমল প্রথম থেকেই মুখচোরা।পড়াশোনায় খুব ভালো না হওয়ায় কোনোদিনও প্রাপ্য সম্মান পায়নি।মন্দিরার লাঞ্ছনার কথা তার অজানা নয়,সব দেখে সব শোনে,কিন্তু প্রতিবাদ করার কোনো ভাষা তার কোনোদিনও জানা নেই।এইভাবেই দিন কাটাতে থাকে।
মাস দুই বাদে প্রিয়া দুদিনের জন্যে বাপের বাড়ি যায়।বাপের বাড়ি ওর বেশি দূরে নয়,বাবার শরীরটা সামান্য খারাপ,মেয়ের সান্নিধ্য চাইছেন,তাই দীপুই জোর করে ঘুরে আসতে বলে। দুপুরে বাবাকে খাইয়ে ঘুমোতে বলে মা আর মেয়ে একসাথে খেতে বসে।প্রিয়ার মায়ের হাতের রান্না শুধু প্রিয়ার ‘হট ফেভারিট’ তা নয় উনি রান্নাও করেন অসাধারণ।মায়ের হাতের সব রান্নাই যেন প্রিয়ার অসামান্য লাগে।কিন্তু আজ খেতে বসে প্রিয়ার খালি মনে হতে থাকে রান্নায় কি যেন কম,কোনো রান্নাই আঙ্গুল চেটে খাওয়ার মতো মনে হয়না,বিশেষ করে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাকটা যেন কোনোভাবেই রসনাতৃপ্তি করতে পারেনা,বারবার মনে পড়তে থাকে ওর বড় জায়ের নিরামিষ পুঁইশাকের কথা।মা শুনলে কষ্ট পাবে ভেবে কিছু বলতেও পারেনা।এই রেসিপিটাই আগে যখন মা করতো পুরো ভাত ও এই একটা আইটেম দিয়েই খেয়ে ফেলতো।অন্যমনস্ক ভাবে খাওয়া শেষ করে উঠে ওর নিজের মেয়েবেলার ঘরে চলে যায় প্রিয়া,ওর ব্যবহারে একটু অবাকই হন ওর মা।ভেবেছিলেন সব মেয়ের পছন্দের রান্না,খুব খুশি হয়ে যাবে।শ্বশুরবাড়িতে এখনো নতুন বউ,এখনও কি আর অতটা স্বচ্ছন্দ হতে পেরেছে পছন্দের খাবার খাওয়ার ব্যাপারে?কিন্তু প্রিয়া যেন যাহোক করে পেট ভরিয়ে উঠে যায়,মুখ দেখে মনে হয়না মন ভরেছে। ঘরে গিয়ে প্রিয়া ভাবতে থাকে ব্যাপারটা কি হলো!একসময় তার উপলব্ধি করতে পারে কারণটা।মার শুনলে হয়তো খারাপ লাগবে কিন্তু এর থেকেও আরো মন ভরানো খাবার ও এখন রোজ খায়,তাই এগুলো তার পাশে অতটা মনে দাগ কাটতে পারলোনা।ও ভেবে অবাক হয়,রোজ খায় বলে বুঝতে পারেনি আসলে মন্দিরা অসামান্য ভালো রান্না করে।ও শুনেছে আগেকার দিনের মানুষেরা নাকি এরকম রান্না করতেন।মন্দিরা বিশেষ করে ট্রাডিশনাল রান্না অসাধারণ করে,যেগুলো বেশির ভাগ তার দিদিমার কাছে শেখা।মা বাপ মড়া মেয়েটা অনেক ছোট থেকেই মামারবাড়িতে মানুষ,দিদিমা মারা যান যখন মন্দিরা বারো ক্লাসের পরীক্ষা দিচ্ছে।তার আগে অবধি দিদিমাকে ঘিরেই তার দিন যাপন ছিল।এমনকি তখনকার দিনে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে রান্নায় ওর দিদিমা ছিলেন সবার সেরা।বিশেষ করে ওঁর হাতের নিরামিষ রান্না নাকি হাত চেটে খেতে হতো,আমিষও একবার খেলে লোকে সহজে স্বাদ ভুলত না।একদিন মন্দিরা প্রিয়াকে গল্প করছিল দিদিমা হাতে ধরে তাকে অনেক রান্না শিখিয়ে গেছেন।প্রিয়া অনুভব করে এক হারিয়ে যায় শিল্প রান্নার বাহক,ওস্তাদ রাঁধুনি আজ তার শ্বশুরবাড়ির অন্ধকার রান্নাঘরের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে।মনে মনে অস্থির হয়ে উঠে সে…কিছু করতে হবে,খুব তাড়াতাড়ি তাকেই কিছু করতে হবে।সবার আগে এই দুষ্প্রাপ্য রেসিপি গুলো সংরক্ষণ করতে হবে কোনোভাবে, তার মনে আসে প্রথমেই ইউ টিউবের মাধ্যমে ভিডিও আপলোডের কথা।কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভাবে কেন লোকে দিদিভাই এর চ্যানেল আর রেসিপিই দেখবে?!!একমাত্র তখনই দেখবে যদি তার আগে মন্দিরা মুখার্জী কে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিখ্যাত করা যায়,তার একটাই উপায় কোনো রিয়ালিটি শো, যা আজকাল খুব একটা অসম্ভব কিছু না।প্রিয়া মনেমনে ভেবে নেয়..আজকাল তো চ্যানেলে চ্যানেলে এধরণের রিয়ালিটি শো প্রায় সারাবছর ধরে হয়।এখন এই মুহূর্তে হয়তো হচ্ছেনা,কিন্তু যখন হবে সুযোগ নিতে হবে।আর এই অপেক্ষা করার মুহূর্তে তার নিজের হ্যান্ডিক্যামে শুট করবে দিদিভাই এর রান্না।গরমের ছুটি পরে গেছে,তাই দুপুরের নিস্তব্ধ সময়টার সুযোগ নেওয়া যাবে।খাবার বানানোর যা দরকারি জিনিস ও কিনে দেবে ঠিক করে।যেমন ভাবা সঙ্গে সঙ্গে দীপুকে ফোন করে বলে,”জরুরি দরকার,রাতে ফেরার সময় অবশ্যই এবাড়ি হয়ে যাবে,আর রাতের খাবারটাও খেয়েই যাবে।আমি দিদিভাইকে জানিয়ে দেব”।প্রিয়ার কথায় অবাক দীপু কিছু বলার সুযোগই পায়না।তার আগেই নিজের কথাটুকু বলে প্রিয়া ফোন কেটে দিয়েছে বুঝতে পারে।
প্রিয়া ইচ্ছা করে বাপের বাড়ি থেকে ফেরে দুপুর বেলা,যখন পুরো বাড়ি ঘুমের জগতে।রঘু কাকার দরজা খোলার অপেক্ষা যেটুকু,প্রিয়া সোজা ছোটে মন্দিরার কাছে।দুপুরে কোনোদিনও মন্দিরার সেভাবে ঘুম হয়না,সময় কাটাতে সে টুকটাক হাতের কাজ করে।তার হাতের তৈরি আসন সবার খুব প্রিয়,দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে প্রিয়া কে ঢুকতে দেখে চমকে যায়।”কিরে ছোট তুই কখন ফিরলি?” মন্দিরার কথা ঘরের বাতাসে হারিয়ে যায়।প্রিয়া মন্দিরার একটা গুণের সংরক্ষণের কথা বলতে এসে হারিয়ে যায় অন্য গুণের দর্শনে।হঠাৎ ঘোর কেটে বলে,”দিদিভাই আমার বিয়ের পরেরদিন শাশুরিমা আমায় বলেছিল গুনে সরস্বতী,তাহলে তুমি কি?চোখের সামনে এতদিন হিরে পড়ে থাকতেও কেউ লক্ষ্য করলো না?শুধু পুঁথিগত শিক্ষা যদি কাউকে সরস্বতী বানিয়ে দেয়,তাহলে সর্বগুনাসম্পন্না বউ কে কি বলবে?…” মন্দিরার অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়া বলতে থাকে,”১০বছর ধরে একটা খাঁটি হিরে অনাদরে অবহেলায় শুধু পরে নেই,পিষ্ট হচ্ছে অন্যদের মাঝে।বাইরের পৃথিবী হয়েতো তাকে পেলে লুফে নেবে,সেটা সে নিজেও জানেনা।হয়তো এভাবেই কত মন্দিরা রোজ রোজ হারিয়েও যাচ্ছে।”প্রিয়া থামলে মন্দিরা বলে,”কার কথা বলছিস তুই?আর এই ভরদুপুরে এলিই বা কেন?”প্রিয়া এসে বসে মন্দিরার খাটের এক কোনে।”তোমার সাথে দরকারি কথা আছে,তাই এই সময়টায় ফিরতে হলো”।’তার সাথে দরকারি কথা!’ মন্দিরার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়া তার গত দুদিনের উপলব্ধি বুঝিয়ে বলে।বোঝায় মন্দিরার হাতের জাদুর কথা।শুধু মাত্র দিদিমা মন্দিরাকে বলতেন মন্দিরার হাতে আছে তাঁর মতোই রান্নার জাদু,তারপর কোনোদিন কেউ খেয়ে নিন্দা না করলেও প্রশংসা সেভাবে শোনেনি।কিন্তু কি বলছে এই পাগলী মেয়েটা?যদিও মন্দিরাও চায় তার সাথে সাথে তার দিম্মার রান্নাও শেষ না হয়ে যাক,তাই খাতায় লিখে রেখেছে নিজের মতো করে,কিন্তু প্রিয়া যা বলছে তা কি আদৌ সম্ভব?দোনামনা করে শেষ অবধি রাজি হয়ে যায় মন্দিরা।সব ব্যবস্থা দীপু আর প্রিয়া করে ,দুপুরে সবার ভাত ঘুমকে কাজে লাগিয়ে প্রায়দিন চলতে থাকে হান্ডিক্যাম।শুরু হয় ‘মন্দিরার হারিয়ে যাওয়া রান্না’র ইউ টিউব চ্যানেল,যেখানে রেসিপি বিশ্লেষণ ছাড়াও প্রতিটা রান্নার পিছনে যে পুরাতনি গল্প আছে,মন্দিরার দিম্মার কাছে শোনা, সেগুলোও দর্শকের মধ্যে ছড়াতে থাকে ওরা।যদিও এখনো দর্শক খুবই অল্প।তবু প্রিয়া বুঝতে পারে তাদের পছন্দ হচ্ছে মন্দিরার চ্যানেল।স্বপ্ন দেখার শুরু হয়।
দ্বিতীয় পর্ব:-
মাস খানেক পর খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে প্রিয়ার নজরে আসে খবরটা…একটা জাতীয় টিভি চ্যানেল তাদের আঞ্চলিক ভাষা চ্যানেল গুলোর প্রতিটাতে কুকিং রিয়ালিটি শো’র আয়োজন করছে,নাম “কিং/কুইন ইন ট্রাডিশনাল কুকিং”।প্রতিটি আঞ্চলিক চ্যানেলের প্রথম ৩জন বিজয়ীকে নিয়ে মেইন চ্যানেলের জন্যে ওদের হেড অফিস মুম্বাইতে জাতীয় আর একটা শো ও করবে পরে।আঞ্চলিক ক্ষেত্রে অডিশন থেকে ফাইনাল পর্বের শুটিং পুরোটাই ওরা শেষ করবে ১মাসের মধ্যে।তারপর বিজয়ীদের নিয়ে মুম্বাইতে শুরু হবে পরবর্তী পর্বের শুটিংয়ের কাজ।খবরটা পরে যেটা সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে সেটা হলো ‘ট্রাডিশনাল কুকিং’ কথাটা।হারিয়ে যাওয়া সব প্রদেশের রান্নাকে আবার মানুষের মনে জায়গা করবার জন্য এই শো।প্রিয়ার মনেহল ভগবান যেন শুধুমাত্র মন্দিরার জন্যে এই শো টার আয়োজন করিয়েছে।জেতা হারা বড় ব্যাপার না,কিন্তু অনেক অনেক মানুষের মধ্যে নিজের রান্না পৌঁছে দেওয়ার এই সুযোগ ,বিশেষ করে মন্দিরার পছন্দের বিষয়,যে ধরণের রান্নায় ও বেশি পারদর্শী তার ওপর কম্পেটিশন।প্রিয়া ঠিক করে নেয় যত ঝড় ঝামেলা আসুক ভগবানের এনে দেওয়া সুযোগ কিছুতেই ও নষ্ট হতে দেবেনা।আপাতত দুদিন পরের অডিশনে নিয়ে যাওয়ার অজুহাত ভাবতে শুরু করে ওর মাথা।আর এক কাপ চায়ের জন্যে পায়ে পায়ে হেঁটে রান্নাঘরে যায়।দেখে মন্দিরা রোজকার মতো প্রাত্যহিক রান্নায় ব্যস্ত,সাথে শাশুড়িমাও টুকটাক সাহায্য করছেন।প্রিয়া এখনো রান্নাঘরে সেভাবে সাহায্য করে উঠতে পারেনা,সেই নিয়ে তেমন ভাবে কেউ কিছু বলেওনা।মন্দিরা একাই এতোদিনকার নিয়মে সব সামলে আসে,প্রিয়া গেলেও ওকে কুটোটা নাড়তে দেয়না।প্রিয়া বুঝলো,এখন কিছু বলা সম্ভব না।স্কুল থেকে ফিরেই যা করার করতে হবে।স্কুলে সারাদিন মাথায় একই চিন্তা ঘুরতে লাগলো।হটাৎ টিফিন টাইমে মাথায় এলো প্ল্যানটা।সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো মা কে।বুঝিয়ে বললো কি বলতে হবে।’উফ মাথা থেকে প্রথম বোঝাটা নামলো।আগে অডিশন তো উৎরোক,তারপর পরের চিন্তা পরে করা যাবে’,মনে মনে বললো নিজেকে।
বিকেলে বাড়ি ফিরতেই দেখলো শাশুরিমার মুখ গম্ভীর,বুঝে গেল মা কাজ করে দিয়েছে।ফ্রেশ হয়ে টিভি ঘরে আসতেই গম্ভীর গলা শুনতে পেল সরোলাবালার,”ছোট বৌমা তোমার মা ফোন করেছিলেন দুপুরবেলা।ওঁর নাকি শখ হয়েছে মেয়ে জামাইকে কাল যত্ন করে খাওয়াবেন।তা তোমরা যাবে যাও, আমার আপত্তি নেই,কিন্তু বড় বৌমাকে যেতে বলার কারণটা বুঝলামনা।তাও আবার ১০টার মধ্যে।ও না থাকলে কত অসুবিধা।..তোমার মা কে বুঝিয়ে বলো বড় বৌমার যাওয়া হবেনা।…”প্রিয়া ওঁর কথা শেষ করতে দেয়না,সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে,”কেন মা?দিদিভাই কি একটা দিনও ছুটি পেতে পারেনা?সব চাকরীতেই তো ছুটি আছে মা।দিদিভাই এর তো বাপের বাড়িও নেই,তাই আজ ১০বছর ধরে একই ভাবে একই কাজ করে যাচ্ছে।তার কি একদিনের ছুটি বড় বেশি চাওয়া?ইনফ্যাক্ট আমি তো ভাবছিলাম তুমি আর বাবা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওনি কোনোদিন,তাই তোমাদের জন্যে ‘চারধাম’ বেড়াবার ব্যবস্থা করবো”।সরলা বিরক্ত,সাথে সাথে অবাকও হয়।চারধাম বেড়ানোর শখ তার কতদিনের,কিন্তু বড় বৌমা না থাকলে রান্না ,খেতে দেয়া এগুলো তো অন্তত তাকে করতে হবে।কিন্তু আবার ছোট বৌমাকে রাগালে যদি বেড়াতে পাঠাবার ব্যাপারটা কোনোদিন না হয়!সরোলাবালা পড়লেন মহাবিপদে।প্রিয়া মনে মনে হাসতে লাগলো,তীর টা ঠিক জায়গায় লেগেছে বুঝে।কিন্তু সত্যি যদি দিদিভাই অডিশনে পাস করে যায় কোথাও তো এদের পাঠাতেই হবে কিছুদিনের জন্য।শেষ অবধি শাশুড়িমা নিমরাজি হয়ে যেতে দেন ওদেরকে।মন্দিরা কতদিন পর বাইরে বেরিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।তবে যতই চার দেয়ালে বন্দি থাকুক না কেন কলকাতায় ছোট থেকে আছে,তাই রাস্তাঘাট সবই চেনা।প্রিয়ার বাড়িকোনোদিন না গেলেও বুঝতে পারে তারা অন্য কোথাও যাচ্ছে।দীপুকে জিজ্ঞেস করতে প্রিয়া উত্তর দেয়,”আজ তোমায় আমরা পরীক্ষা দেওয়াতে নিয়ে যাচ্ছি।তুমি তাতে পাস করলে যাবো এক ট্রাভেল এজেন্সির কাছে”।মন্দিরার সাথে সাথে দীপুও চমকে উঠে বলে ,”মানে?প্রথমটা তো জানি কিন্তু পরেরটা কি ব্যাপার?!এটা আবার কবে ঠিক করলে?আর কেন,কার জন্য?”প্রিয়া এবার মন্দিরার দিকে ঘুরে বলে,”দিভাই আমরা তোমায় একটা চ্যানেলের কুকিং রিয়ালিটি শোর অডিশন দেওয়াতে নিয়ে যাচ্ছি,সবচেয়ে মজার কথা শো টার বিশেষত্ব হলো সাবেকি রান্না,মানে তোমার প্রিয় সব রান্না।আর ওতে পাস করলে শুটিং এর জন্যে তোমায় বেরোতেই হবে।মিনিমাম কদিন জানিনা,কিন্তু ভগবান চাইলে ম্যাক্সিমাম একমাস।আর আমি জানি ফেয়ার জাজমেন্ট হলে তোমায় কেউ হারাতে পারবেনা এই শহরে।আর তাই তখন বাবা মা কে দুদিনের মধ্যে বাইরে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে,এছাড়া আর কোনো উপায় নেই”।এতক্ষন বেড়াতে বেরোনোর আনন্দে মশগুল থাকা মন্দিরার এবার হাত পা ঘামতে থাকে।…
“ও ছোট,আমায় বাড়ি নিয়ে চল।এসব আমার দ্বারা হবেনা ভাই,বিশেষ করে বাড়িতে না বলে।আর তাছাড়া একদিন যাহোক করে সব সামলে যাবে,কিন্তু একমাস…ওরে বাবা!সংসার লন্ডভন্ড হয়ে যাবে রে।ওই তুই যেমন ভিডিও করছিস,ওই ঠিক আছে।আমি ভয়েতেই মরে যাবো।হবেনা,আমার দ্বারা এসব হবেনা রে”।রীতিমতো চিৎকার করতে থাকে বরাবরের শান্ত মন্দিরা।প্রিয়া মুখ টিপে হাসে,বুঝতে পারে মন্দিরা ভয় পেয়েছে।জলের বোতল এগিয়ে দেয়,”নাও জল খাও।আর তোমার দ্বারা কি হবে,তোমার থেকে বেশি আমি জানি।তুমি শুধু টেনশন কম কর,আর ওখানে রান্না করার সময় ভাববে বাড়ির রান্না ঘরে আছো।”জল খেয়েও মন্দিরা বিড়বিড় করতে থাকে ভয়েতে,কিন্তু ও এতদিনে বুঝে গেছে প্রিয়া একবার কিছু ভাবলে সেটার নড়চড় হবেনা। অডিশন এ পৌঁছে মন্দিরাকে জোর করে ভেতরে পাঠিয়ে ওরা বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে,এর মধ্যে দীপু চেনা ট্রাভেল এজেন্সিতে ফোন করতে গেলে প্রিয়াই বাধা দেয়।ভাবে কিছুই তো জানিনা,যতই নামকরা ন্যাশনাল চ্যানেল হোক,পলিটিক্স সর্বত্র।তাই আগে অডিশন শেষ হোক,তারপর এসব করা যাবে।প্রচন্ড টেনশন নিয়ে ভেতরে ঢোকে মন্দিরা,কিন্তু দেখে তার মতো হাজার হাজার মহিলা…পুরুষও আছে।আর হয়তো সাবেকি রান্না বলে প্রতিযোগীদের মধ্যে ঘরোয়া মানুষজন বেশি।সবার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হটাৎ শুনতে পায় অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে প্রতিযোগীদের উদ্দেশ্যে,এবার মনোযোগ ঘোরে প্রতিযোগিতার দিকে।সব মিলিয়ে ৩টে রাউন্ড হয়।প্রথমে মাল্টিপল চয়েসে প্রশ্নোত্তর…মসলাপাতি,সাবেকি রান্নার ইতিহাস,রান্নার উপকরণ সব মিলিয়ে সব প্রশ্নই প্রায় মন্দিরার জানা মনেহয়।খুব ভালো হয় ওই রাউন্ডটা। পরেরটা মৌখিক প্রশ্নোত্তর বিশেষজ্ঞদের সাথে…মুগ্ধ হন তাঁরা মন্দিরাতে।শেষ পর্বে প্রতিযোগীর সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৩০,তখন তাদের সমস্ত উপকরণ দিয়ে আর একঘন্টা সময় দিয়ে বানাতে বলা হয় বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় লুচি আর ছোলার ডাল।লুচির ময়দা নিজে মাখতে হলেও ডাল সেদ্ধই দেওয়া হয়।প্রথম থেকেই সব পর্বে এগিয়ে থাকা মন্দিরাকে ছোলার ডালের স্বাদে কেউ হারাতে পারার কথা ছিলোনা,আর কেউ পারেওনি। দিনের শেষে প্রায় ৩টের সময় যখন মন্দিরা বাইরে বের হয়,মুখে তার বিজয়ীর হাসি।যে ২০জন কে নিয়ে দুদিন পর থেকেই মসলাপাতির লড়াই শুরু হবে ক্যামেরার সামনে তাদের মধ্যে আপাতত সবার সেরা মন্দিরা মুখার্জি।প্রিয়া শ্বশুরবাড়ি ঢোকার দিন যে উজ্জ্বল আভা ছিল মন্দিরার মুখে,সেই আভা ভিড়ে আসে আজ প্রিয়ার মুখে,মনেহয় প্রিয়া জিতেছে,জিততে শুরু করেছে।
দিনের শেষে ওরা যখন বাড়ি ফেরে বুঝতে পারে সারা বাড়ি থমথম করছে।সকাল বেলা সব সামলানোর পর মুখুজ্জে গিন্নি আশা করেনি সন্ধ্যে গড়িয়ে সবাই ফিরবে।সুকোমল ও অনেকক্ষন ফিরে পড়েছে,সুজাত পড়তে বেরিয়ে গেছে।সন্ধ্যের চা নিয়ে গম্ভীর মুখ করে বসে কর্তা গিন্নি টিভি দেখছে।ট্রাভেল এজেন্সির অফিস ঘুরে কিছু খেয়ে ফিরতে ৭টা বাজবে এটাই স্বাভাবিক ছিল।ভীত মন্দিরা যতবার কিছু বলতে গেছে দীপু-প্রিয়ার ধমকে থামতেই হয়েছে। দীপুই প্রথম কথা শুরু করে,”মা যাও তোমার কাপড়, জিনিস পত্র,বাবার জামা, ওষুধ সব গুছিয়ে নাও ভালো করে,অন্তত কুড়িদিনের মতো সব নেবে।আর বাবার ওষুধ যা লাগবে বলো কাল আমি হসপিটাল থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসবো।”তারপর বাবা মা কে খুশি করার জন্যে ইচ্ছা করে বলে,”সবাই তো বোঝেনা,জামাই আদর খেতে গিয়ে আজকের চেম্বারটা মিস হলো।কি আর করবো?” দীপুর কথায় রাগটা বদলে যায় বিরক্তি আর বিস্ময়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়।সরলাবালা চরম বিরক্তি চেপে বলে,”কেন রাত টাও তো থেকে আসলে পারতিস।আর কিসব উল্টোপাল্টা বকছিস।হেঁয়ালি না করে সোজাসুজি বল।এবার কি বুড়ো বাপ মা কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবি নাকি,যাতে ফুর্তিতে অসুবিধা না হয়?!”দীপু বুঝতে পারে অবস্থা খুব চাপের।এবার প্রিয়া ঘরে ঢোকে,”তোমাদের টিকিট আর থাকা বেড়ানোর ব্যবস্থা করতে একটু দেরি হলো।মা,পরশু তোমাদের রাজধানীতে টিকেট..চারধাম নেক্সট বছর প্রমিস..এবার হরিদ্বার-ঋষিকেশ,এদিকে বেনারস ঘুরে এস।ভয় নেই বড় একটা দল যাবে,তাদের সাথে ব্যবস্থা হয়েছে।সব ঠিক করে গুছিয়ে নাও।” সরলাবালা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা।দীর্ঘ ৪০বছরের সংসার জীবন থেকে ২০দিনের ছুটি?!!সত্যি ছোট বৌমা কথা রেখেছে?আর কর্তা মশাই তো হাঁ করে শুনেই যাচ্ছেন।তাঁরও বোধ করি বিশ্বাস হচ্ছেনা।এবার গিন্নির মুখ হাসিতে ভরে যায়,”দেখেছো মুখুজ্জে মশাই,ছোট বউ তিনমাস এসে তার ভালোবাসাটা দেখেছো?এই জন্যেই বলে সংস্কার।আর একটা ধিঙ্গি বউ,তার সারাদিন বুড়ি শাশুড়ির চিন্তা আছে?…বেঁচে থাকো মা,সুখে শান্তিতে থাকো।বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ির জন্যে সত্যি আজকালকার দিনে কজন বউ ই আর ভাবে…আমি যাই আজ থেকে না গুছিয়ে নিলে সব শেষ হবেনা।”এবার উত্তেজনায় দীপুর দিকে ফিরে বলে,”উফফ অন্তত এক সপ্তাহ সময় নিবি তো।জাগগে, আমি ঠিক সামলে নেব।চলো চলো মুখুজ্জে মশাই আমায় একটু সাহায্য করে দাও কি কি নেব।”বলে নিজে ঘরের দিকে প্রায় দৌড়োয় বাচ্ছা মেয়েদের মতো।বিয়ের পর থেকে সংসারের জোয়াল টেনে ক্লান্ত হয়ে পরা সরোলাবালার বেড়াতে যাওয়ার সরল উচ্ছ্বাস দেখে দুই বৌমারই মন আর্দ্র হয়ে ওঠে, আর প্রিয়ার বুক থেকে চিন্তার বড় পাথর যেন নেমে যায়।
অন্তিম ভাগ :-
সুকোমল সেইসব মানুষদের দলে পরে যারা নিজেদের গন্ডির মধ্যে জীবনটা বাঁচে।ছোট থেকে সবার কাছে অবহেলা পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে বন্দি করে নেয় একটা খোলসে,অন্যের প্রতি আশা এরা করতে জানেনা।কিন্তু মন্দিরা এই মানুষটাকেই ভালোবাসে,সেই ভালোবাসায় মিশে থাকে শ্রদ্ধাও।মন্দিরার সাধারণ রোজকার জীবনের কোন কিছুই এতদিন স্বামীকে আলাদা করে বলার দরকার পড়েনি,শুধু প্রিয়ার ভিডিও করার কথাটা লজ্জায় বলতে পারেনি,কিন্তু অডিশনের দিন রাতে সে সুকোমলকে সব খুলে বলে।সব শুনে প্রথমে সুকোমল ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে মন্দিরার মুখের দিকে,তার মতো সাধারণ মানুষের সাধারণ কর্মঠ বউয়ের কোনো বিশেষ গুন থাকতে পারে হয়তো তার প্রথমে বিশ্বাস হয়না।তারপর যখন বুঝতে পারে মন্দিরার কথায় কোথাও বাড়িয়ে বলা কিছু নেই আনন্দে মন্দিরাকে জড়িয়ে ধরে।তার সাধারণ একঘেয়ে কেরানি জীবনে হঠাৎ যেন এক ঝলক ঠান্ডা বাতাসের উপস্থিতি টের পায়।সীমিত আবেগও বেরিয়ে আসে উচ্ছ্বাস হয়ে।”জানো মনি স্কুলে রেজাল্টের দিন নিজের থেকেও ভাইয়ের রেজাল্টের জন্যে উৎসাহ বেশি থাকতো।আমার তো সেই সাধারণ গড় রেজাল্ট,কোনো উত্তেজনা নেই তাতে।ভাইকে দূর থেকে রেজাল্ট হাতে আসতে দেখলে অদ্ভুত শিরসিরানী অনুভূতি হতো,ঠিক তেমন আজ হচ্ছে।আমি খুব খুব খুশি তোমার জন্যে”।আবেগ বাঁধ মানেনা অন্য দিনের মতো সুকোমলের,”বিয়ের পর থেকে কিছুই তো দিতে পারিনি তোমায়,আজ তোমার ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন তোমার ভাগের পুরো ভালোটা তোমায় সুদে আসলে দেন”।
মন্দিরা সুকোমলের কথায় মৃদু হেসে বলে,”বাপ মা মড়া অনাথ মেয়েটাকে ঠাকুর কম কি কিছু দিয়েছে?এমন ভোলানাথের মতো বর কজন মেয়ের ভাগ্যে জোটে।আর এখন তো প্রিয়া-দীপু যা করছে নিজের বোন বা ভাই থাকলেও হয়তো করতোনা”।সুকোমল মন্দিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”সবাই যদি তোমার মত ভাবতে পারতো মনি….”। দুদিন পর মুখুজ্জে কর্তা গিন্নী তীর্থ করতে চলে গেলেন।তাদের মুখের উজ্জ্বল খুশির আভা প্রিয়া মন্দিরাকে হয়তো সত্য গোপনের বিবেক দংশন কিছুটা কমাতে সাহায্য করলো।প্রিয়া মনে মনে বললো,’আমি জানি তোমরা যখন সব জানবে তখন রাগ না করে নিজেদের বড় বৌমার গর্বে গর্বিত হবে,আমাদের ক্ষমা করে দেবে’।আর মন্দিরা মনে মনে বললো,’যতই তুমি আমায় যা খুশি বলো মা,আমি তোমাকেই মা ভাবি।আজ অবধি কিছু লুকোইনি,মিথ্যে বলিনি।আজ সবটা বলতে পারলামনা অনেক কারণে।তাও তোমরা আমায় আশীর্বাদ করো,যেন সবার এত আশা রাখতে পারি’। পরেরদিন প্রিয়ার সাথে সুকোমল গেল মন্দিরাকে পৌঁছে দিতে।ওখান থেকে যে যার স্কুলে চলে যাবে।চ্যানেল আগেই জানিয়েছিল,প্রায় দিনই শুটিং শেষ হতে সন্ধ্যে হবে।তাই সুকোমল আবার স্কুল ফেরত আসবে ঠিক হয়েছে। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতায় টেনশন বেশি মিশে ছিল,কিন্তু রান্না শুরু করার পর সব টেনশন ভুলে গেল মন্দিরা।ডুবে গেল রান্নায়,যেমন বাড়িতে যায়।দিনের শেষে এপিসোড সেরা মন্দিরা হলেও বুঝতে পারলো সবাই খুব খুব ভালো রাঁধুনি,তাই যত দিন যাবে সব কিছু এত সহজ থাকবেনা। ২০টা দিন ঝড়ের মতো কেটে গেল।খুব যে মোলায়েম কাটলো তা নয়।টেনশনে কোনোদিন হাত পুড়লো,ইলিশ ভাপাতে নুনও কম হলো,মুগের ডাল সামান্য বেশি গলেও গেল,আবার বেশ কিছুদিন একসাথে লড়াই করতে করতে মনের কাছাকাছি এসে বন্ধু যে হয়েছিল কম্পেটিশন এর নিয়মে ছিটকে গেল কোনোদিন।তবে প্রশংসা আর প্রাপ্তিও অনেক জুটলো।এইভাবেই মন্দিরা সেমিফাইনালে পৌঁছল।সমস্যা হলো এরপর,যেদিন সেমিফাইনালের শুটিং, সেদিন দুপুরে ফেরার দিন সরলাবালাদের।সংসার অনভিজ্ঞ প্রিয়া একদিনে অনেকটাই সংসার সামলাতে শিখে গেছে।যদিও মন্দিরা সকালে উঠে সব রান্না করে গুছিয়ে যেত,কিন্তু প্রিয়াও নতুন বউয়ের গন্ধ ঝেড়ে ফেলে বাকি সব দিক সামলে দিত।একজন লোক ঠিক করা হয়েছিল রাতের রুটি তরকারির জন্যে,কিন্তু সবই হয়েছিল শ্বশুর শাশুড়ি বেড়াতে যাওয়ার পর। আগেরদিন ছিল রবিবার,প্রিয়া ছাড়াও সুকোমল দীপকও বাড়িতেই ছিল।আর মন্দিরারও শুটিং অফ ছিল।দুপুরে খাবার টেবিলে গুরুগম্ভীর আলোচনা ঘরের পরিবেশ থমথমে করে দেওয়ার পর মন্দিরা বললো,”আমি কাল কিছুতেই শুটিংয়ে যেতে পারবোনা।মা’রা ফিরে আমায় দেখতে না পেলে প্রচন্ড ভুল বুঝবেন।বাইরে জিততে গিয়ে শেষে আমার ঘর ভেঙে যাবে,এ আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবোনা।…”।প্রিয়া কথার মাঝেই বলে উঠলো,”ঠিক বলেছ,তোমায় আর যেতে হবেনা।সেটাই তো।আমার স্বপ্ন,দাভাই এর বিশ্বাস এগুলোর তোমার কাছে কি এমন মূল্য।করতে হবেনা তোমায় নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত।সারাজীবন ওই ভালো মানুষ হয়ে কাটিয়ে দাও,আর মনে মনে কষ্ট পাও।আর হ্যাঁ নীজে একা না,দাভাইকেও কষ্ট আর অমর্যাদার জীবনেই থাকতে দাও।আর সবাইকে খুশি করে যাও”।ঘরে সুজাত থাকলে সেও বুঝতো মায়ের কথায় কাকিমনি ক্ষেপে গেছে।এখন যদিও এটা স্বাভাবিক,মন্দিরাকে প্রিয়া নিজের দিদির মতোই যেমন ভালোবাসে তেমন শাসনও করে,সবাই এটা বুঝে গেছে।প্রিয়ার শাসনে মন্দিরা চুপ করে গেল,ও জানে কম্পেটিশনটা ওর থেকেও বেশি প্রিয়ার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।হয়তো সত্যি প্রিয়া আগের জন্মে ওর বোন ছিল,ও এবাড়িতে আসার পর থেকে এই ক’মাসে মন্দিরার জীবন কতটা বদলে দিয়েছে।
ওদের ডাইনিং স্পেসেই একটা ছোট টিভি আছে,খেতে খেতে সবাই মাঝে মধ্যে দেখে বলে।আজ থেকে ওই চ্যানেলে ‘কিং/কুইন ইন ট্রাডিশনাল কুকিং’ এর প্রমোশন শুরু হয়েছে,এরা পুরো শুটিং শেষ করে তবে সম্প্রচার শুরু করবে।আর ততো দিনে বিজয়ী ৩জন মুম্বাই পৌঁছে যাবে,তাই ভিতরের সিক্রেট খবর বাইরে সেভাবে ছড়াবে না। সব কল্পনা পরিকল্পনাকে মাথায় নিয়েই মন্দিরা পরেরদিন শুটিংয়ে গেল,আর প্রিয়া স্কুল ছুটি নিয়ে রয়ে গেল বাড়ির ঝড় সামলাতে,সাথে রইলো সুকোমল।দীপক মন্দিরাকে পৌঁছে দিয়ে হসপিটাল চলে যাবে সেটাই ঠিক ছিল আগে থেকে।সকাল ৮টা নাগাদ সুকোমল বাড়ির গাড়ি নিয়ে মা বাবাকে আনতে বেরিয়ে গেছিল।
সন্ধ্যে বেলা মন্দিরা একাই ফেরে আজকাল।বাড়িতে ঢোকার আগে ওর বুকে যেন কেউ হাতুড়ি পিটছিলো।সারাদিন মনের চাপ রান্নাতেও প্রভাব ফেলেছে।পোলাও বানাতে গিয়ে ভাত প্রায় গলিয়ে আর একটু হলে কম্পেটিশন থেকেই ছিটকে যাচ্ছিল।সাথে চিংড়ির মালাইকারীতে নারকেল দুধও পরিমান মতো না দেওয়ায় স্বাদ ওর করা চিংড়ির মালাইকারি মতো একদমই হয়নি।কিন্তু এতদিন ধরে সেরা রান্না করা শান্ত মেয়েটা আজ কোনোভাবে ডিসটার্বড আছে এটা জাজেরা বুঝেছিল।তাই স্পেশাল প্রতিযোগী হিসেবে ও ফাইনালে সুযোগ পেয়েছে।সব মিলিয়ে মন্দিরা বুঝতেই পারছিল দিনটা সারাদিন যেমন খারাপ কেটেছে শেষটা তার থেকেও বেশি খারাপ হবে হয়তো। মন্দিরা আস্তে আস্তে বসার ঘর পেরিয়ে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো।দেখলো ঘর অন্ধকার,কেউ নেই।ঘরে পড়ার শাড়ি নিয়ে চেঞ্জ করে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় দেখলো শ্বশুর শাশুড়ির ঘরে আলো জ্বলছে কিন্তু প্রিয়া বা সুকোমল ছাড়া ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস হলোনা।রান্নাঘরে প্রিয়া চা করছিল,মুখ দেখে মন্দিরা কিছুই বুঝতে পারলোনা।প্রিয়া বললো,”দিভাই তুমি বস,আমি মা বাবা আর দাভাইকে ডেকে আনি”।বলে মন্দিরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
“তারপর বড় বৌমা আজ কি রাঁধলে?”সবাই এসে চুপচাপ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চা খেতে শুরু করার পর এটাই মন্দিরার শ্বশুর মশাইয়ের প্রথম কথা।মন্দিরা কি বলবে ভাবার আগেই সরলাবালা বললো,”তুমি থামবে? কি হবে তোমার ওসব জেনে?তুমি কে হও ওর?কেউ না।আমরা কেউ না ওর।আমাদের কোনো অধিকার নেই এসব বড়সড় ব্যাপার জানার।আমরা মুখ্যু মানুষ,তাই বোকা বানানোও সহজ।আসলে আমারই ভুল,১০বছর খালি রাগটাই দেখিয়েছি,অন্যদের মতো ভালোবাসাটা তো দেখাতে পারিনি,তাই হয়তো কাছের জন হয়ে উঠতে পারলামনা”। মন্দিরা আর সহ্য করতে পারেনা,নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে শাশুরিমা কে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।এতদিনের না বলতে পারার কষ্ট,ভয়,নিজের জীবনে কিছু করতে পারার ভালোলাগা সব আবেগ গুলো একসাথে জল হয়ে বেরিয়ে আসে।সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে একসাথে।বৌমার সাথে শাশুড়িমার চোখও ভরে যায় অভিমানের কান্নায়।গলা বুজে আসে,”হয়তো আমি কটু কথা বলি।কারণ আমার আদরের বড় ছেলে যখন আমার মতের তোয়াক্কা না করে তোমায় বিয়ে করে, রাগ-অভিমানে মন ভরে গেছিল।কিন্তু ১০বছরে কি কখনো আমার ভালোবাসা বোঝোনি!?ভালো না বাসলে কি নির্ভর করা যায়?নিজের প্রিয় সংসারটা পুরোপুরি তুলে দেওয়া যায়?!নাকি বাড়ি ঢুকে দেখতে না পেলে ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতিতে মন ভরে ওঠে?!আমি হয়তো কোনোদিন যত্ন করিনি,ভাত বেড়ে খেতে দিইনি,জ্বর হলে আহাউহু ও করিনি।কিন্তু….কিন্তু বড় খোকাকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছি,খেতে বসার আগে দেখে নিয়েছি তোমার খাবার আছে কিনা?রান্নাঘরের ঢুকতে বারণ করেছি অসুস্থ শরীরে।”কিছুটা থেমে আবার বলে,”হ্যাঁ আমি প্রকাশ ঠিক করে করতে পারিনা ভালোবাসা,খাটতে পারিনা বলে তোমায় কোথাও যেতে দিইনা।কিন্তু এত বড় ঘটনা জানলে কি খুশি হতাম না?”এবার প্রিয়া মুখ খোলে,”বললাম তো মা ভুলটা আমার।প্লিজ আর রাগ করে থেকোনা।”
“মা রা কি আর রাগ করে থাকে মা।মা বাবারা সব সময় সন্তানের ভালো চায়।হ্যাঁ বড় বৌমার সাথে আমি অন্যায় করেছি,কিন্তু শত্রুতা নয়।”বলে সরলাবালা বড় বউ কে নিজের থেকে আলাদা করে বলেন,”ফাইনাল শুটিং কবে?বাড়ির লোক ঢুকতে দেবে?”মন্দিরা ধরা গলায় বলে,”পরশু।হ্যাঁ একজন কে ওরা নিয়ে যেতে বলেছে”।”দুজন হলে আমি যেতাম।কিন্তু ওই একজন অব্যশই ছোট বৌমা।ওই জায়গাটা আর কারোর হতে পারেনা।”শাশুড়িমায়ের কথায় দুই বৌমাই চোখ মোছে। তবে সবাইকে অবাক করে প্রিয়া বলে, “ওইদিন আমি না,দাভাই যাবে।আমি দিভাই কে হয়তো রাস্তা দেখিয়েছি, কিন্তু সেখানে হাঁটতে সাহায্য করেছে দাভাই।দাভাই দিভায়ের আসল শক্তি।তাই সাথে অনুপ্রেরণাই যাবে”।কেউ লক্ষ্য করেনি এত কিছুর মধ্যে কখন সুকোমল উঠে ঘরে চলে গেছে। ফাইনালের দিন এত মানুষের আশা যেন মন্দিরার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল।সকালে যখন সবার শুভকামনা আশীর্বাদ নিয়ে বেড়োলো তখন আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা।দিপু আর প্রিয়া ওদের পৌঁছে দিয়ে এলো।”একদম টেনশন করবেনা দিভাই।যা পাওয়ার সেটা তোমার অর্জন করা হয়ে গেছে।এবার যদি পাও সেটা তোমায় অনেকটা এগিয়ে দেবে।কিন্তু না পেলে হারাবেনা কিছুই।এটা সব সময় মনে রেখো”।প্রিয়ার বলা কথা গুলো সত্যি মন্দিরার মনোবল অনেকটা বাড়িয়ে দিল।ওরা দুজন একসাথে প্রবেশ করলো এতদিন ধরে বঞ্চিত হওয়া জীবনকে আরেকটু বেশি কিছু দিতে পারার ইচ্ছা নিয়ে।’বৃষ্টি শুভ’ এই বিশ্বাস নিয়ে, নিঃশ্বাসে বৃষ্টির অনুভূতি সাথে করে দিপু আর প্রিয়া বাড়ীর পথ ধরলো।রবিবার ,তারওপর মন্দিরা নেই..সব কাজ শেষ করে প্রিয়া যখন নিজের ঘরে এলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়।উত্তেজনায় শুতে পারলোনা,চুপ করে জানলার ধারে বসে অবিশ্রান্ত ঝরে যাওয়া বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইলো।ফোনটা এলো ৫টা নাগাদ,সুকোমলের ফোন থেকে।প্রিয়া লাফিয়ে উঠে ফোন ধরে শুনতে পেল সুকোমলের অন্য এক গলা,যেটার আশা প্রিয়া করেনি,”প্রিয়া তাড়াতাড়ি সিটি হসপিটালে এস।রেজাল্ট ঘোষণা শেষ হওয়ার পর মুহূর্তে সেটের একটা অংশ ভেঙে পড়ে।সবাই অল্প বিস্তর আহত।আমি ঠিক আছি, তোমার দিভায়ের চোট ভালোই”।
“কি বলছো কি?এখুনি আসছি আমরা”।ফোন রেখে মা বাবাকে শুধু ‘একটু বেরোচ্ছি’ বলে ওরা দুজন বেরিয়ে পড়ে। “আস্তে আস্তে দিভাই।পা’টায় চাপ দিওনা”।মন্দিরাকে ধরে প্রিয়া বসার ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সরলাবালা উত্তেজিত ভাবে ছুটে আসেন।প্রায় কান্নাকাটি শুরু করে দেন,প্রিয়া বা কেউ কথা বলার সুযোগ অবধি পায়না।সব কিছু শান্ত হলে প্রিয়া বলে,”আমরা এইসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে অনেক্ষন মাথা ঘামিয়েছি।এবার আসল কথায় এস সব্বাই।…দিভাই আজ এই শহরের সাবেকি রান্নার সেরা রাঁধুনি।আজ সব কটা রান্না ফাটিয়ে দিয়েছে।কেউ আশেপাশে আসতে পারেনি ওর।তোমরা কি জানো কেন এমন হলো,মানে এই দুর্ঘটনা?”প্রিয়ার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকায় সব্বাই।”আরে এত বড় ঘটনায় ভগবান উত্তেজনা প্রকাশ করে ফেলেছে।ফুল ফেলতে গিয়ে সেট ফেলে দিয়েছে।”সবাই ওর কথায় হাহা করে হেসে ওঠে।”যাইহোক আর ৫মিনিটের শুটিং বাকি আছে,সেটা ওরা পরে একদিন করে নেবে।…এখন আসল কথা হলো.. আমাদের দিভাইকে বেশ কিছুদিন ছেড়ে থাকতে হবে,আর সেই কারণে এখন থেকেই উনি কান্নাকাটি করছেন।সুজাত এর জন্যে বেশি করে।…”এবার প্রিয়ার কথা থামিয়ে মুখ খোলেন সরলাবালা।”দেখো মা,কিছু পেতে গেলে কিছু তো ছাড়তেই হয়।ওখানকার কম্পেটিশন এমনি অনেক শক্ত হবে।সব জায়গার রান্না তো আমরা জানিনা।তাই অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাও ঘুরে এস।সুজাত ভালোই থাকবে আমার কাছে।বরং বড় খোকা যদি সাথে যেতে পারে আমরা বুড়ো বুড়ি নিশ্চিন্ত হবো।কত কিছু শিখবে সেটা ভাব।আজকাল মেয়েদের এগিয়ে যেতে হবে।আর বাইরে বেরোলে মন যে কত ভালো থাকে আমি বুঝেছি।আর কোনো দ্বিধা রেখোনা।জেতার জন্যে না,শেখার জন্য তুমি যাও।তাছাড়া আমি তো আছি,সাথে ছোট বৌমা থাকলো।চিন্তা করনা”।
ভোর বেলার ফ্লাইটে যখন মন্দিরা আর সুকোমল আরো দুজন বাংলার বিজয়ীর সাথে আকাশ ছুঁয়ে মুম্বাই উড়ে গেল তখন পুব আকাশ ফর্সা হচ্ছে।শরতের আগমন জানান দিচ্ছে বাতাস।মা দুর্গার আগমন এবার দেরিতে।হয়তো মুখার্জী বাড়ির দুর্গা পুজো এবার অন্য রকম কাটবে।এখন… শুধু অপেক্ষা।অনেকটা আনন্দ,কিছুটা মন খারাপ,অনেকটা শূন্যতা আর সামান্য হলেও আশা নিয়ে অপেক্ষা।অপেক্ষা জেতার থেকেও হয়তো বেশি ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরার,একটা অন্য জীবন… সবাইকে নিয়ে শুরু করার।কিছুটা নতুন শেখার সাথে পুরনোকে মিলিয়ে অনেক কিছু সবার মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার।অপেক্ষা সেই মিষ্টি হাসির,কিন্তু অবসান অনেক না পাওয়ার।আজন্ম বঞ্চিত মেয়েটার বাইরের আকাশ ছোঁয়ার সঙ্গে সংসার আকাশ খুলে যাওয়াটাই বিশাল পাওনা।কখন কিভাবে সেই আকাশ গুলো ছোঁয়া যায় সত্যি হয়তো কেউ জানেনা।ভালোবাসার আকাশ,বিশ্বাস মিশে থাকে যাতে।হয়তো এভাবেই প্রিয়ারা এসে মন্দিরাদের আকাশটা উন্মুক্ত করে দেয়,ছুঁতে সাহায্য করে।সেই আশায় বাঁচুক পৃথিবী,বাঁচুক প্রজন্ম।
সমাপ্ত।
10 comments
Awesome tamali di tomar golpo gulo just eto pranobonto hoye othe tomar choyay sob
অনেক ভালোবাসা।
Darun laglo…khub khub sundor
অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভীষণ সুন্দর ইতিবাচক গল্প।সকল চরিত্রের মানসিক বিশ্লেষণ খুব ভালো লাগলো।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
Khub sundor hoechhe
অসংখ্য ধন্যবাদ।
Oshadharon…Tmi ato sundor lekho j mon stti i vore jay..Erm koto mondira hyto songsar er chape sesh hye jay…Vishon vbe mon chuyeche lekha ta…Osadharon,Onoboddo..❤️❤️
মন্দিরা দের আসলে প্রিয়ার উৎসাহের দরকার পরে, দরকার পরে অন্যের চোখ দিয়ে নিজেদের দেখার।😊