সপ্তম পর্ব:-
“তুমি এই কথাটা বলার জন্য আমায় স্টাফরুম থেকে ডেকে আনলে?”প্রচন্ড বিরক্তির সাথে বলা শুভঙ্করের কথা গুলো শুনে পর্ণা হকচকিয়ে যায়।বোঝে সকালের এস.এস আর এখনকার এস.এস অনেকটাই ভিন্ন দুটো মানুষ।হটাৎ কি হলো পর্ণা বুঝতেও পারেনা।
“না মানে সুশী খুব জোর করছে যেতে,আমি অনেকবার বোঝালাম।কিন্তু…”পর্ণার কথা বাধা পায় এস.এস এর চাপা স্বরে,”পর্ণা এটা উনিভার্সিটি, তোমার বাড়ি না।আর আমি এখানে শুধু তোমার স্বামী নয়।তাই এভাবে পার্সোনাল কথা বলার আগে তোমার উচিত আমার ইমেজ সম্পর্কে চিন্তা করা।তুমি আজ আমার সাথে ফিরবে না সেটা বলার জন্য তুমি এই ফাঁকা রুমটায় আমায় ডেকে এনেছ?আর ইউ ক্রেজি?…হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলেই তো হতো”।…কিছুটা থেমে আবার বলে,”দুদিন পর প্রজ্ঞা সব জানাজানি করে দিলে তখন তো এমনি আমার লজ্জার শেষ থাকবেনা…”।
এস.এস এর অর্ধেক কথা পর্ণার কানে ঢোকে না।ও এস.এস এর বিয়ে করা স্ত্রী জানাজানি হলে লজ্জা হবে কেন? আর উনিভার্সিটি জয়েন করা তো শুভঙ্করের একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত,এমনকি গাড়ি করে নিয়ে আসারও…এটা তো স্বাভাবিক আজকের দিনে এত বড় ঘটনা দুবছর চেপে রাখা সম্ভব না।তাহলে এসব কি বলছে কি এস.এস!!পর্ণা মুখে কিছু বলতে পারেনা।শেষে শুভঙ্কর বলে,”তুমি ফিরবে কি ফিরবেনা,কখন ফিরবে,কার সাথে ঘুরবে,কোথায় যাবে…সব কিছু তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।আর হ্যাঁ কথায় কথায় আমাকে স্টাফরুম থেকে ডাকবেনা,আমার একটা সম্মান আছে।আর বাড়ি ঢুকতে দেরি হলে মা কে ফোন করে দিলেই হবে।”
পর্ণা হাঁ করে শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।চিনতে,বুঝতে অসুবিধা হয় ওর।তারপর এস.এস কথা শেষ করে স্টাফরুমের দিকে চলে গেলে পর্ণা ধীর পায়ে হেঁটে সুশীর কাছে যায়। “সুশী তুই যা প্লিজ,আমার হবেনা।শুভঙ্করের একটা জায়গায় যাওয়ার কথা আছে বাড়ি গিয়ে,এক বন্ধুর বাড়ি,আমি না গেলে খারাপ দেখাবে।আমি নেক্সট দিন যাবো।আজ তুই চলে যা,অভিকদা তোকে ঠিক স্টেশন অবধি পৌঁছে দেবে”,পর্ণার কথায় অসহায়তা ফুটে ওঠে,যা সুশীর নজর এড়ায়না।ও কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করে,”শুভদা রাগ করছে নাকি রে?আসলে ফিরতে যদি সন্ধ্যে হয়,আর মা ফোন করে…তুই সাথে আছিস জানলে কিছু বলবেনা।নাহলে…উররে বাবা!আজ বরং থাক,আজ দুজনেই ফিরে যাই।পরে একদিন দেখা যাবে”,সুশী পর্ণার কথায় নিজের যাওয়াও ক্যান্সেল করে দিতে যায়।পর্ণা বলে,”ওই তুই যা, নাহলে খারাপ দেখাবে।আর কাকিমা ফোন করলে বলে দিস আমি আছি।খুব একটা দেরি হবেনা,যে সময় ফিরি ওরকমই হবে।তবে অভিকদা কে বলিস তোকে স্টেশনে ছেড়ে দিতে।”পর্ণার কথায় সুশী তাও নিশ্চিন্ত হতে পারেনা,দোনামনা করতে থাকে।তারপর বলে,”অভিক কে কি বলবো তুই না যাওয়ার কথা?ওতো সত্যিটা জানেনা।তুই যাবিনা শুনলে যদি ও না যেতে চায়?”সুশীর কথায় পর্ণা বলে,”সত্যি আবার কি?অভিকদা তো জানে আমি বিবাহিত।বলবি ওর স্বামীর সাথে এক জায়গায় যাওয়ার ছিল,ওর মনে ছিলোনা।…দেখ এবার যাবি কি যাবিনা তোর সিদ্ধান্ত।যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে ঠিক কিছু না কিছু ভাবে ম্যানেজ করা যায়।”সুশীর যাওয়ার ইচ্ছা তো খুবই আছে,কিন্তু একা যেতে মন চাইছিলোনা,একটু ভয়ও পাচ্ছিল।ও একটা শেষ চেষ্টা করলো,”যদি অভিক আমায় কিডন্যাপ করে নেয়,একা পেয়ে।কত টুকু চিনি ওকে?”সুশীর কথায় পর্ণা কাঁদবেনা না হাসবে ভেবে পেলোনা।বিরক্ত হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”অভিকদা ফাইনাল ইয়ারের সবচেয়ে ভদ্র আর ভালো ছেলে।লাস্টবার একটুর জন্যে টপ করতে পারেনি,কিন্তু এবার টপ করার চান্স অনেক বেশি।আর তুই ৩মাসের বেশি ওকে দেখছিস,এরকম বোকা বোকা কথার কোনো মানে হয়না।ছেড়ে দে তোকে যেতে হবেনা।”সুশী বুঝতে পারে অভিকের ব্যাপারে পর্ণা খুব সেন্টিমেন্টাল,তাই আর কথা না বাড়িয়ে বলে,”তুই নিজেই অভিককে বলে আসবি চল,নিচেই দাঁড়িয়ে আছে”।
পর্ণা কিছু ভেবে বলে,”চ”।পর্ণাকে অকারণ উল্টো পাল্টা ওসব বলে এসে এস.এস ও স্থির ভাবে বসতে পারেনা।বিকেল হয়ে এসেছে,তাই স্টাফরুমও প্রায় ফাঁকা।শুভঙ্করের ৪টে থেকে ফাইনাল ইয়ারের একটা ক্লাস আছে।তাছাড়া পর্ণাদের নিয়ে যায় বলে প্রায়দিনই ওর যেতে দেরি হয়।পায়ে পায়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়।হঠাৎই নীচে তাকিয়ে দেখতে পায় অভিক দাঁড়িয়ে আছে।এই অভিক ছেলেটা শুধু স্টুডেন্ট হিসেবে না ছেলে হিসেবেও খুব ভদ্র আর নম্র।আর তাই হয়তো পর্ণাকে এর সাথে দেখে শুভঙ্কর ইনসিকিওর হয়ে গেছিল।তারপর দুদিন আগে পর্ণা শুভকে অভিকের ব্যাপারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেসও করছিল,যদিও পুরোটাই ওর মেধা আর স্বভাব নিয়ে,তখন এস.এস এরও কিছু মনে হয়নি।ও জানে পর্ণা কোনোদিনও ওকে ছাড়া কারোর দিকে চেয়েও দেখবেনা।তাও ওই বয়সের ফারাকটা মাঝে মাঝে ইন্সিকিউর করে দেয়।কেন যে সবসময় এরকম ভাবে!নিজের ওপর নিজেরই বিরক্তি বাড়ে।অভিকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার মাথা গরম হয়ে ওঠে,দেখতে পায় পর্ণা আর সুশীকে, অভিকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।ওদের মধ্যে কিসব কথা হয়,অভিককে দেখে মনেহয় ওদের কথা পছন্দ হচ্ছেনা।হঠাৎ করে পর্ণা অভিকের হাতটা ধরে কিছু বোঝাতে থাকে।আর দেখতে পারেনা এস.এস,রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে পুড়তে পুড়তে সরে আসে জানালা থেকে।একবারের জন্য অন্যভাবে বিষয়টা ভেবেও দেখেনা।স্বাভাবিক ভাবে ভাবলে হয়তো কোন খারাপ কিছু মনেই হতোনা।কিন্তু অতিরিক্ত অধিকারবোধ স্বাভাবিক চিন্তার পথ রুদ্ধ করে দেয়।ঠিক সেই সময় টেবিলে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করে আলো জ্বলে ওঠে,পর্ণার মেসেজ।..’আমি তোমার সাথেই ফিরবো’।শুধু একটা লাইন,যা আগুন কমানোর বদলে ঘৃতাহুতি দেয়।এস.এস সঙ্গে সঙ্গে নিজের শেষ ক্লাস ক্যান্সেল করে উনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যায় গাড়ি নিয়ে,পর্ণাকে ছাড়াই।ওদিকে পর্ণা জানে সপ্তাহের এই দিনটা শুক্রবার শুভঙ্করের ক্লাস শেষ হতে ৫টা বাজে।তাই সুশীরা বেরিয়ে যেতে ও মেয়েদের কমন রুমের দিকে হাঁটা লাগায়।ঘন্টাখানেক ওখানে বসে তারপর যেখান থেকে এস.এস ওদের গাড়িতে তোলে ওখানে গিয়ে দাঁড়াবে ভাবে।আজ অনেকদিন পর প্রজ্ঞা কলেজ এসেছে সেইসব ভাবতে ভাবতে কমনরুমে গিয়ে বসে।
গাড়ি নিয়ে এস.এস প্রথমে গঙ্গার ধারে চলে যায়।গঙ্গার ধারে একটা পার্ক মতো করা আছে,সেখানে গিয়ে বেঞ্চে বসে।গঙ্গার হাওয়ায় প্রায় আধা ঘন্টা বসার পর মাথাটা একটু ঠান্ডা হয়।শুভঙ্করের মাথা সাধারণত এখন আর গরম হয়না,আগে রেগে যেত কিন্তু রিলেশনে আসার পর থেকেই রাগটা অনেক কমে গেছিল।আর পর্ণার ওপর তো রাগ করার প্রশ্নই উঠতো না।লাস্ট একমাস কেন কে জানে বিরক্তি রাগ এগুলো বেড়ে গেছে,বিশেষ করে প্রজ্ঞার ঘটনাটার পর।মাঝে মাঝে মনে হয় সৌরভের ভয়টা অহেতুক,তাই ওই কারণে পর্ণাকে পাহারা দিতে উনিভার্সিটি জয়েন বোকার মতো হয়ে গেছে।আর তার থেকেও বোকামো হয়েছে ওর আর পর্ণার সম্পর্কটা প্রথম থেকে লুকিয়ে রাখা।ওটা না হলে আজকের এত জটিলতা কিছুই হতোনা।আজ জানাজানি হলে সেটা নিয়ে মজা হতে পারে,ইমেজ নষ্ট হতে পারে এসব নিয়ে ভাবতেও হতোনা।আর এসব নানারকম জটিলতার কারণে বিরক্তি বেড়ে গেছে,আর এখন যেহেতু সবচেয়ে কাছের মানুষ পর্ণা,তাই সব রাগ ওর ওপর গিয়ে পড়ে,ক্ষোভ বের হয় ওর ওপর।কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় ভালো করে ভাবলে শুভঙ্কর বুঝতে পারতো পর্ণার এখানে কোনো ভূমিকা নেই,বরং এখনো অবধি ভুল ঠিক যে সিদ্ধান্ত এস.এস নিয়েছে পর্ণা সব গুলো মেনে শুধু নেয়নি রীতিমতো অনুসরণ করছে।আজ অবধি শুভর কোনো কথার বিরুদ্ধাচারণ ও করেনি।এসব ভাবতে ভাবতে কখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে শুভঙ্কর খেয়ালও করেনি।একটা চাওয়ালা কে ডেকে চা খেয়ে যখন খেয়াল হয় না অনেক দেরি হয়ে গেছে,তখন ঘড়ির দিকে তাকায়।প্রায় ছটা বাজছে।কি খেয়াল হতে ফোনটা বের করে দেখে পর্ণার ১০টা মিশড কল ৫টা নাগাদ।সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে,কিন্তু মোবাইল সুইচ অফ বলে।এবার একটু হলেও টেনশন হয়,ওর ফোন তো কখনো অফ থাকেনা।বার দুয়েক চেষ্টা করে বোঝে,না নেটওয়ার্ক সমস্যা নয়,সত্যি অফ।তখন কি মনে হতে সুশীকে ফোন করে,কিন্তু সুশীর ফোনে রিং হয়ে গেলেও ও রিসিভ করেনা।বেঞ্চ ছেড়ে উঠে গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বাড়িতে মা কে ফোন করে।শুভ্রা অন্যদিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি ফোন ধরে।মার গলায় “হ্যালো” শুনেই উদ্বিগ্ন এস.এস পর্ণার খোঁজ করে ফেলে।”কি বলছিস খোকা,আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা।পর্ণা তো তোর সাথে ফেরে”।মায়ের প্রশ্নে কি উত্তর দেবে ভাবতে ভাবতে দেখে সুস্মিতা ফোন করছে।কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে শুভ বলে,”মা একটু পরে ফোন করছি,একটা দরকারি ফোন আসছে”,বলেই সুশীর ফোনটা ধরে নেয়।’হ্যালো’ বলার আগেই সুশী বলে ওঠে,”ওই তোর ফোন বন্ধ কেন রে?আমি এই বাড়ি ঢুকলাম।অনেক কথা আছে তোর সাথে।তোর ফোন অন করে ফোন কর।…আর হ্যাঁ,শুভদার রাগ পড়লো?”বলে ও হাসতে থাকে।এদিকে শুভঙ্করের পা কেঁপে যায়।শুধু বলে,”পর্ণা তোমার সাথে নেই সুশী?”সুশী অবাক হয়ে বলে,”কে শুভদা?আমি ভাবলাম পর্ণার ফোনে চার্জ নেই বলে অন্য সময় যেমন করে,তেমন এখন তোমার ফোন থেকে কল করেছে।…কিন্তু পর্ণা আমার সাথে থাকবে কিকরে?তোমার বন্ধুর বাড়ি তোমার সাথে যাবে বলে তো আমাদের সাথে গেলোনা।অভিক কত করে বললো,তাও কিছুতেই রাজি হলোনা”।
সুশীর কথা গুলো শুভর কানে ঢুকছিলোনা।রাগের মাথায় তখন খেয়াল অবধি করেনি পর্ণা মেসেজে ‘আমি’ লিখেছিল।শুভ নিজেই নিজেকে বললো,’আমি কি পাগল!নিজের স্ত্রী কে না নিয়ে রাগ দেখিয়ে চলে এলাম।কিন্তু পর্ণা এখন কোথায়?বাড়িও ফেরেনি।হঠাৎ সকালের একটা কথা মনে পড়ায় নিজের মনেই চেঁচিয়ে উঠলো,’ও মাই গড।আজ তো পর্ণা পার্স ফেলে এসেছে বাড়িতে।সকালেই বলেছিল।আর তাছাড়া গাড়ি করে যাতায়াতের জন্যে এখানকার রাস্তাঘাটও ঠিকঠাক জানেনা। ও পাশে সুশীর “হ্যালো,হ্যালো” শুনে সম্বিৎ ফেরে শুভঙ্করের।অনেক কষ্টে বলে,”তোমার সাথে কটায় পর্ণার শেষ দেখা হয়?”সুশী অনেক প্রশ্ন চেপে শুধু বলে,’পৌনে চারটার সময় আমি অভিকের সাথে কলেজ থেকে বেরোই।তবে পর্ণা ৫টা নাগাদ আমায় ফোন করেছিল,কিন্তু ফোন সাইলেন্ট থাকায় বুঝতে পারিনি।…কি ব্যাপার বলতো!পর্ণা কোথায় আর তুমি বা কোথায়,আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।”শুভর মনেহয় ওর পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছে,ও শুধু সুশীকে বলে,”আমি পরে সব বলবো এখন ফোন রাখছি।”বলেই ফোন ছেড়ে শুভঙ্কর গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা উনিভার্সিটির দিকে গাড়ি ছোটায়।হয়তো ওর পর্ণা কোথাও যেতে না পেরে ওখানেই অপেক্ষা করছে।
অষ্টম পর্ব:-
রাত ১১টা বাজে।লালবাজারে মিসিং স্কোয়াডে বসে আছে শুভঙ্কর,আর সাথে অভিক।উনিভার্সিটি এলাকায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও না পেয়ে হতাশ হয়ে এসে যখন গাড়িতে বসে পড়েছিল,একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে।আশা নিরাশায় দুলতে দুলতে ফোনটা ধরতেই শুনতে পায় অচেনা ছেলের গলা,”স্যার আমি অভিক।সুস্মিতার থেকে নম্বর পেয়েছি।কোথায় আপনি?”বিরক্তি ভরা গলায় এস.এস বলে,”আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি।পরে কথা বলবো।”বলে ফোন কাটতে যেতেই অভিক ব্যস্ত ভাবে বলে ওঠে,”পর্ণাকে পেলেন স্যার?সুশী খুব চিন্তা করছে,প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ফোন করলো।স্পষ্ট কিছু বলতে পারলোনা।প্লিজ স্যার পর্ণা কে পেলে একবার ফোনটা দিন।আমি পর্ণার নম্বর নিতেই ফোন করেছিলাম সুশীকে।”অভিকের কথায় শুভঙ্কর পাগল হয়ে গেল,একে পর্ণাকে খুঁজে না পাওয়ার দুশ্চিন্তা তার ওপর যত সমস্যার কারণ এই ছেলেটা।স্থান,কাল ভুলে চেঁচিয়ে উঠলো ফোনে,”কেন কি দরকার কি তোমার পর্ণাকে?জানোনা পর্ণা বিবাহিত?আমি ,আমি এস.এস পর্ণার হাজব্যান্ড।কি দরকার আমায় বল”।অভিকের কথা শুনতে শুনতে মনে হলো ওর নিজের বাঁচার কোনো অধিকার নেই।ওর মতো একটা অপদার্থ স্বামীর কোনো অধিকার নেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার।”পর্ণাকে থ্যাংক্স জানাতে ফোন নম্বর খুঁজছিলাম।আজ ও না থাকলে আমার প্রথম ভালোবাসা সুস্মিতাকে আমি পেতামনা।আমার মতো লাজুক ছেলের পক্ষে সুশীকে বলাই হতোনা ওকে কতটা ভালোবাসি আমি।আজ আমাদের প্রথম ডেটে ওই জন্যে পর্ণাও যাক আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম।কিন্তু ও গেলোনা।সুশী ওখানে অনেক করে বারণ করেছিল যাতে আমি কাউকে না বলি পর্ণা কার স্ত্রী,কিন্তু এখন নিজেই কাঁদতে কাঁদতে আপনার নাম্বার দিয়ে ফোন করতে বললো।কি হয়েছে স্যার?পর্ণা কোথায়?”এস.এস,শুভঙ্কর সেন,পৌরুষত্বের প্রতীক,যাকে আবেগী হতেই হাতে গোনা কজন দেখেছে,সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা।স্বল্প পরিচিত ছাত্রের কথায় ভেঙে পড়ল,”জানি না,আমি জানি না আমার পর্ণা কোথায়?কোথাও পাচ্ছিনা ওকে অভিক।ফোন বন্ধ,বাড়ি ফেরেনি।সুশী জানেনা।কোথায় খুঁজবো আমি।আমার মাথা কাজ করছেনা”।অভিক ফোনের ওপার থেকে বুঝতে পারে কতটা অসহায় নিজেকে অনুভব করছেন স্যার।নাহলে নিজের ছাত্রের কাছে কেউ এভাবে ভেঙে পড়েনা।তাও ও সম্ভাবনা মাথায় রেখে বলে,”ওর মায়ের কাছে যায়নি তো?”শুভর মনে মুহূর্তে আশার আলো জ্বলে উঠে নিভে যায়,”না তাহলে অন্তত আমার মা কে জানাতো।তাও আমি একবার ফোন করে দেখছি।”অভিক আবার বলে,”আপনি এই মুহূর্তে কোথায়?আমার বাড়ি উনিভার্সিটি থেকে ১৫মিনিট।আমি বেরোচ্ছি, আপনি কোথায় বলুন, মিট করে নেব”।অভিককে কোথায় আছে বলে ফোন কেটে পায়েলের নম্বরে ফোন করে শুভঙ্কর।ফোন ধরে উচ্ছ্বল গলায় পায়েল বলে,”নিজের নম্বর বন্ধ বলে শুভর ফোনটা হাত করেছিস?”আর পারেনা শুভ।ধরা গলায় বলে,”আমি শুভঙ্কর।পর্ণাকে খুঁজে পাচ্ছিনা মা”।শুভ বিয়ের পর এই প্রথম শাশুড়ি মা কে ‘মা’ বলে।এতদিনের সংকোচ এক ঝটকায় সরে যায়।পর্ণার মা’তে নিজের হতাশা,ভয়,অনিশ্চয়তার আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করে।পায়েল অবাক হয়ে বলে,”মানে??কি বলতে চাইছো শুভ?”একে একে বিকেল থেকে সব ঘটনা খুলে বলে পায়েল কে।মেয়েকে তেলোয় করে মানুষ করা মা শুধু কঠিন স্বরে বলে,”পর্ণার কিছু হবেনা,আমি জানি।ও ঠিক ফিরে আসবে”।
অভিকের এক দাদা লালবাজারে ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টে আছে।ওকে ফোন করতে ওই মিসিং স্কোয়াডে এসে ডাইরি করতে বলে।ও নিজেও তখন লালবাজারে উপস্থিত থাকায় সঙ্গে আসে।শুভঙ্করের চেহারা এই কয়েক ঘন্টায় ঝোড়ো কাক হয়ে গেছে।কাউকে সন্দেহ কিনা জিজ্ঞেস করায় কিছুক্ষন ভাবে কিছু বলবে কিনা।তারপর অসহায়ের মতো অতীতের ঘটনার রেফারেন্স টেনে এনে সৌরভের নাম বলেই দেয়,যদিও অফিসারকে বলে ওটা আনঅফিসিয়াল রাখতে।তারপর সবার জোরাজুরিতে নিজের বাড়ি ফিরতে রাজি হয়,যদিও নিজের বাড়িতে জানিয়ে অভিক সাথে যায়,কারণ গাড়ি ড্রাইভ করার মতো অবস্থা শুভঙ্করের ছিলোনা।মানসিক ভাবে বিপর্য্যস্ত শুভঙ্কর নিজের কর্মের জন্যে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে দুষতে থাকে।আর সারাজীবন ভগবান না মানা তরুণটি ভগবানকে সারা রাস্তা ডাকতে থাকে,যেন বাড়ি ফিরে দেখে ওর পর্ণা মাকে জড়িয়ে হাসছে।বাড়ি পৌঁছতে মাঝ রাত পেরিয়ে যায়।গাড়ি পার্ক করে দোতলায় উঠে বেল দেওয়ার সাথে সাথে শুভ্রা দেবী দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসেন।ছেলের সাথে আর একটা অচেনা ছেলেকে উপেক্ষা করে তার চোখ চেনা মুখটা খুঁজতে থাকে ছেলের পাশে।অসহায় বৃদ্ধা দরজার বাইরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।’ছেলের বউ’ থেকে কবে যে পর্ণা এত কাছের হয়ে উঠেছে আজকের ঘটনা না ঘটলে হয়তো শুভ্রা বুঝতেও পাড়তেননা।অল্প বয়সে মা বাবা আর যৌবনের মধ্যমে স্বামীকে হারিয়ে শক্ত মনের মানুষ হিসেবে পরিচয় ছিল তার পিরিচিত মহলে,কিন্তু বয়সজনিত কারণে মানসিক দুর্বলতা কবে গ্রাস করলো নিজেও বোঝেননি।ছোট নরম মনের মেয়েটা হয়তো দায়ী তার জন্যে।সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেননি শুধু তার কথা ভেবেই,যতবার চোখটা একটু বুঝেছেন ভেসে উঠে সেই নরম হাসির মেয়েটার চোখ।জানেননা ছেলেটা কিকরে সামলে আছে,তবে মা তো তাই এটা বোঝেন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ছেলেটাও তাঁর বাচঁবেনা।সোনার সংসার তার ভেসে যাবে।কার যে নজর লাগলো তার সাধের সাজানো সংসারে! সারারাত কারোরই ঘুম হয়নি।এমনকি শুভ্রার ঘরে একা শুতে যাওয়া অভিকও রাতভর দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।কদিনের আলাপ হওয়া মেয়েটাকে যে নিজের ছোট বোন বলেছিল সে…কোথায় গেলি পর্ণা?অভিমান নাকি কারোর কুট বুদ্ধি…কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছেনা।শুভঙ্কর স্যার তো কাল সারাটা সময় ৫-১০মিনিট অন্তর ওই বন্ধ নম্বরটায় ফোন করে গেছেন,যদি হঠাৎ রিং হয়?কাল সুশীর কাছে পর্ণার স্বামীর কথা শুনে মনে হয়েছিল এত বয়সের পার্থক্যে দাম্পত্য সম্ভব?কিন্তু আজ বোঝে এরকম ভালোবাসতে পারাটাও হয়তো সবার পক্ষে সম্ভব না।ভালোবাসা বেশি হলেই অভিমান,অধিকার বোধ গভীর হয়।কিন্তু সেই অধিকারবোধ ক্ষতিকারক তো হতে পারে যদি তা স্বাভাবিক চিন্তার পথ বন্ধ করে।”পর্ণা পর্ণা,ওদিকে খাদ।যেওনা লক্ষ্মীটি।পর্ণা,শুনতে পাচ্ছো?দাঁড়াও একা যাবেনা।দাঁড়াও বলছি।পর্ণা…..”,ভোর রাতের ঘোরে শুভর গোঙানির আওয়াজে শুভ্রার তন্দ্রা কেটে যায়।”বাবু,এই বাবু।কিরে ওই”,হাত দিয়ে ঠেলে দেন শুভকে।হঠাৎ বেলের আওয়াজে বুক ধড়াস করে ওঠে।ঘড়িতে ৭টা বাজে।এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দুরাশায় ভর করে শুভ্রা দেবী দরজা খুলতে ছোটেন,শুভও মাকে অনুসরণ করে।এত সকালে…নিশ্চই…নিশ্চই… পর্ণা ফিরে এসেছে।ডাইনিং স্পেসে অভিকও উঠে আসে,কিন্তু দরজা খুলে ৩জনেই অবাক হয়।সুশী যাদের সঙ্গে করে এনেছে তাদের এত সকালে কি প্রয়োজন শুভর বোধগম্য হয়না।হতাশা,বিরক্তি মিশিয়ে মুখটা তেতো হয়ে যায়।চলবে….