নবম পর্ব:-
সারারাত মেয়ের ঘরেই কেটেছে পায়েলের।সুকান্তবাবু,পর্ণার বাবা,অনেক বুঝিয়েও কাল রাতে মুখে দানা অবধি কাটাতে পারেননি পায়েলের।সারারাত মেয়ের ঘরের বিছানায় বসে থেকেছে আর নিঃশব্দে গাল দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে।ভোর বেলা সুকান্তবাবু গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু ঘুম পাড়িয়েছেন।মা’রা তো কেঁদে হালকা হয়ে যায়,তাদের দুঃখ সবাই অনুভব করতে পারে,কিন্তু বাবাদের যে কতটা বুক ফাটে শুধু তারাই বোঝে।পায়েলকে রোজ একবার করে উনিভার্সিটি থেকে ফিরে মেয়ে ফোন করতো,সুকান্ত বাবু পাশে বসে বা শুয়ে একজনের কথা শুনে অন্য জনেরটা অনুমান করে নিতেন।২-৩দিন অন্তর বাবার খোঁজ পড়লে সামান্য কথা হতো মেয়ের সাথে।শুভঙ্কর আজ থেকে আড়াই বছর আগে যখন বিয়ের প্রস্তাব আনে তখনই বুকে একটা কষ্ট অনুভব হয়েছিল,’কেন এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল মেয়েটা!’ কিন্তু শুভঙ্কর ছেলেটাকে দুবছরে দেখে শুনে বিশ্বাস হয়েছিল যে মেয়েটাকে ভালোই রাখবে।আর পর্ণার শাশুড়িমায়ের মতো সরল সাদাসিধে মানুষ কমই আছে।সব মিলিয়ে মেয়ের জন্যে মন কেমন করা ছাড়া বিশেষ চিন্তা তেমন ছিলোনা।এমনকি শুভঙ্কর জামাই হিসেবেও তাঁদের খুব প্রিয় ছিল।তাই কাল পায়েল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাগের মাথায় যখন শুভঙ্কর কে দোষারোপ করছিল সুকান্তবাবু কিছু সাড়াশব্দ করেননি।কোন্ দম্পতির মধ্যে মান অভিমান হয়না!কিন্তু এটাও ঠিক তার বিচক্ষণ মেয়ে যতই অভিমানী হোক রাগ করে নিজে কোথাও যাবেনা।তাহলে কাল কি হলো?নাকি অন্য কিছু হলো মেয়েটার সাথে?আর ভাবতে পারেননা সুকান্ত।সারারাত বিছানায় পিঠ অবধি ঠেকাননি।বোন সরমা কাছেই থাকে,ওকে আসতে বলেছেন ফোন করে।পায়েলের যা অবস্থা একা রেখে যেতে সাহস হচ্ছেনা,কিন্তু একবার শুভঙ্করদের ওখানে যেতেই হবে,জানতেই হবে আসল ঘটনাটা।দরকারে শুভঙ্করের সাথে কোথাও যেতে হলে যাবেন।পর্ণাকে খুঁজে বের করবেন,তাঁর একমাত্র মেয়ে কোনোভাবেই হারিয়ে যেতে পারেনা।তাঁরা জ্ঞানত কোনো পাপ করেননি যে এরকম শাস্তি এই বয়সে এসে পাবেন।মনে মনে ভেবে পায়েল ঘুমোচ্ছে কিনা একবার উঁকি মেরে দেখে স্নান করতে ঢোকেন সুকান্ত, সারাদিনের জন্যে রেডি হয়ে বেরোবেন বলে।সুস্মিতার সাথে যাকে দেখে শুভঙ্করের মন বিরক্তিতে ভরে যায় সেই প্রজ্ঞাই সঙ্গে করে পর্ণার বন্ধ হয়ে যাওয়া ফোন এনেছে,আর ওর সঙ্গে ওর ছায়াসঙ্গী নিকিতাও এসেছে।অনেক রাতে সুশীর ফোনে প্রজ্ঞার ফোন আসে,প্রচন্ড অবাক হলেও যদি পর্ণার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে প্রজ্ঞা থাকে এই সন্দেহে ফোনটা ধরে।ফোন ধরে এক অদ্ভুত খবর শোনে সুশী।প্রজ্ঞা জানায় বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ উনিভার্সিটির সামনের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ফুটপাথের ওপর এই ফোনটা সে পায়।ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে যেরকম ব্যাটারি খুলে দুটো পার্ট আলাদা হয়ে পড়ে থাকে সেরকম পরে ছিল।ওই ফুটপাথটা একটু লোক চলাচল কম বলে হয়তো কেউ ওর আগে দেখতে পায়নি।তবে রাস্তায় পড়ে থাকলেও ফোনটা কোনো অজানা কারণে বসত প্রজ্ঞার খুব চেনা মনে হয়।সেই মুহূর্তে ভেবে সময় নষ্ট না করে ও ফোন টা ব্যাগে ভরে নেয়।রাতে শুয়ে হঠাৎ ফোন টার কথা মনে পড়ে ব্যাগ থেকে বের করে দেখতে থাকে।হঠাৎ ব্যাক ক্যামেরার ওপরের পাতলা কাঁচটা ভাঙা দেখে ও চিনতে পারে এই মডেলের এরকম ভাবে কাঁচ ভাঙা ফোন ও পর্ণার হাতে দেখেছে,কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও প্রজ্ঞা ফোনটা অন করতে পারেনি।এদিকে কনফার্ম হওয়ার জন্য কোনো অন্য উপায় না পেয়ে সুশীকে ফোন করে।কিন্তু সুশীর গলা শুনে ওর ভালো লাগেনা,একটু জোরাজুরি করতে সুশী ভেঙে পড়ে,আর ওর থেকেই প্রজ্ঞা পর্ণার খবর পায়।এবার প্রজ্ঞা এস.এস এর দিকে ফিরে বলে,”জানি স্যার আপনি,পর্ণা বা সুশী কেউ আমায় পছন্দ করেননা।কিন্তু তাও নিজের বন্ধুর বিপদের কথা শুনে বসে থাকতে পারলামনা।যদি ফোনটা কোনো কাজে লাগে তাই সকাল হতেই ছুটে এসেছি।এতটা দূর বলে বাড়িতে আপত্তি ছিল বলে নিকিতাকে সঙ্গে এনেছি”।আবার সামান্য থেমে বলে,”কাল আমি যখন ৪টে নাগাদ কমন রুমে গেছিলাম,দেখলাম পর্ণা ফোনে কিছু নিয়ে ব্যস্ত।আমায় দেখে একবার তাকিয়েছিল কিন্তু কোনো কথা হয়নি।তারপর আমি লাইব্রেরী চলে যাই।সেখান থেকে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে যাওয়ার সময় উনিভার্সিটি গেটের বাইরে ওই ফুটপাথে আমি ফোনটা পাই।কিন্তু সেই মুহূর্তে ওটা পর্ণার ফোন বলে আমি বুঝতে পারিনি”।এতটা বলে প্রজ্ঞা থামে।সেই সময় শুভর মা সবার জন্যে চা নিয়ে ঢোকেন।বাইরে থেকে যতটা শুনতে পেয়েছিলেন তাতে কোন অজানা কারণে মায়ের মন কেঁপে উঠেছিল, চোখের জল বাগ মানছিলোনা।এইসময় আবার বেল বেজে ওঠে।বেল বাজলেই সবার মন আশায় দুলে উঠছে।সুশী “আমি দেখছি” বলে তাড়াতাড়ি করে উঠে যায়।ফিরে আসে পর্ণার বাবাকে নিয়ে,শুভ সুকান্তবাবুকে দেখেই বুঝতে পারেন সারারাত ঘুমোননি ভদ্রলোক।একরাতে বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে।শুভ্রা দেবী ব্যস্ত হয়ে বলেন,”বসুন বেয়াই মশাই”,বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠেন।সুকান্তবাবু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলেন,”ব্যস্ত হবেন না বেয়ান”,বলেই টেবিলে চোখ পড়ে উল্টো করে রাখা ফোন টার ওপর।”এটা তো পর্ণার ফোন।ও তাহলে ফিরে এসেছে?”বলেই বুঝতে পারেন দুরাশা,নাহলে পর্ণা ফিরলে এতক্ষনে ওনাকে জানানো তো হতই, আর বেয়ানও ওভাবে ফুঁপিয়ে উঠতেন না ওকে দেখে।তাঁর কথায় সবার মুখ ,বিশেষ করে শুভঙ্করের মুখ করুন হয়ে গেছে দেখে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সোফার এক প্রান্তে বসে বলেন,”ফোনটা কি করে পেলে শুভঙ্কর?”এবার অনেক্ষন পর শুভ মুখ খোলে,”আপনি শিওর বাবা,ওটা পর্ণারই ফোন?”ওর এরকম প্রশ্নে সুকান্তবাবু আর শুভ্রা দেবী বাদে সবাই অবাক হয়ে তাকায়, এস.এস তাহলে এতক্ষন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না নাকি?!সুকান্তবাবু শুভর কথার উত্তর বলে,”হ্যাঁ, ওর ব্যাক ক্যামেরার ওপরের কাঁচটা আমার দোষেই ভেঙেছিল।আমার ধাক্কায় ওর হাত থেকে ফোনটা এমন ভাবে পরে যে ফোনের চার্জর এর মুখটার ওপর ওই কাঁচটা পরে,আর ক্র্যাক হয়ে যায়।পরে অনেকবার বলেছি সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে যেতে কিন্তু ফোন ছেড়ে থাকতে পারবেনা বলে নিয়ে যায়নি।”সুকান্ত বাবুর কথা শেষ হতে শুভ আনমনে বলে,”হ্যাঁ আমায় বলেছিল আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবেনা,তাই জমা দেবেনা।সারাক্ষন হোয়াটসঅ্যাপ করতো তখন।বলেছিল বিয়ের পর নিয়ে যাবে সার্ভিস সেন্টারে।…কে জানে আর নিয়ে যেতে হবে কিনা?”বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।শুভর কথায় সবাই আঁতকে ওঠে।সুকান্ত বাবু আর সামলাতে পারেন না নিজেকে,”এরকম বলোনা শুভঙ্কর।আমার মা এর কিছু হয়নি”।কিছু না বলে শুভ উঠে চলে যায় নিজের ঘরে মাথা নিচু করে।এই সময় অভিক খেয়াল করে পর্ণাকে নিয়ে এস.এস এর কথার সময় প্রজ্ঞার চোখ হঠাৎ একবার জ্বলে উঠেছিল।অভিক কাউকে কিছু না বলে নিজের মনে চিন্তায় ডুবে যায়।হঠাৎ প্রজ্ঞা বলে,”আর একটা যে কারণে আমি আরো এসেছি,কথাটা ফোনে বলার থেকেও সামনাসামনি বললে হয়তো সবার বিশ্বাস হবে।…কেউ কি জানো আমার বাবা ডি.এস.পি আর এখন লালবাজারে আছে।আই থিংক হি ক্যান হেল্প আস।হয়তো সরাসরি কেসে ইনভলভ হতে পারবেনা,কিন্তু রেপুটেশনটা কাজে আসবে।আর শুনতে বোকা বোকা লাগলেও হি ইস ফেমাস ফর হিস অনেস্টি।তাই আমাকে পছন্দ না হলেও বাবাকে তোমাদের ভরসার মানুষ বলেই মনে হবে।যদি সম্ভব হয় এখনই চলো,আমিও যাবো।আমার সাথে গাড়ি আছে,সবার জায়গা হয়ে যাবে।চলো বাবার কাছে যাই,দেখি উনি কি সাজেস্ট করেন।” প্রজ্ঞা বেশ জোরে কথা গুলো বলছিল তাই ওর কথার মাঝে এস.এস বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।প্রজ্ঞাকে কিছু না বলে সুশীর দিকে তাকিয়ে বলে ,”সুশী তুমি মার কাছে থাকতে পারবে?একা রেখে যেতে সাহস হচ্ছেনা।…শান্তিদিদি আসলে ওকে থাকতে বলে তুমি বাড়ি চলে যেও।তবে যদি তোমার কোনো অসুবিধা না থাকে।”শুভঙ্করের কথা শেষ হওয়ার আগে সুশী বলে, “ফোনটা কি পুলিশকে দেখাবে?নাহলে আমি একটু রাখতে চাই,এবাড়িতে যতক্ষন থাকবো।”শুভঙ্কর কিছু বলার আগেই প্রজ্ঞা বলে ওঠে,”তুই কি করবি বন্ধ ফোন নিয়ে?আর পুলিশে আপাতত জমা না দেওয়াই ভালো, পর্ণার কত কি পার্সোনাল জিনিস থাকতে পারে।”প্রজ্ঞার কথায় আবার খটকা লাগে অভিকের।শুভঙ্কর প্রজ্ঞার কথা জবাব না দিয়েই সুশীকে বলে,”ঠিক আছে রাখো।”ডি.এস.পি প্রদ্যুৎ ব্যানার্জি যথেষ্ট মাই ডিয়ার লোক।যদিও ঘটনার গুরুত্ব তাকেও চুপ করিয়ে দিয়েছে।ওরা সবাই লালবাজারে ওনার অফিস রুমেই এসেছে দেখা করতে।সব শুনে উনি সবাইকেই টুকটাক প্রশ্ন করে সব জেনে নেন।তারপর শুভঙ্করের কাছে ডাইরির ডিটেলস নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে ফোন করেন তদন্তের আপডেটস নিতে।ডি.এস.পি ব্যানার্জি কে সত্যি সবাই সমীহ করে চলে,তাই কোনো তদন্ত শুরু না হওয়া কেসের সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু হয়ে যায়।কলেজে,পর্ণার বাড়ি,উনিভার্সিটি সর্বত্র সঙ্গে সঙ্গে লোক চলে যায় ইনফরমেশন জোগাড় করতে।অফিসার ব্যানার্জী আশ্বাস দেন সব রকম সাহায্যের।শুভঙ্কর আর পর্ণার বাবার দিকে তাকিয়ে বলেন,”আমিও মেয়ের বাবা।তাই আপনাদের ওপর কি যাচ্ছে বুঝতেই পারছি।কিন্তু আমায় প্লিজ অন্তত আজকের দিনটা সময় দিন।”শুভঙ্করের সত্যি ওনাকে ভালো লাগে।কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও কোনো আশার আলো সে দেখতে পায়না,বিশেষ করে ফোনটা ঐভাবে পেয়ে।কিন্তু কেন জানেনা ওর একটা অদৃশ্য বন্ধন ছিল পর্ণার সাথে,সেটা অনুভব করতে পারে এই মুহূর্তেও,মন বলে পর্ণা আছে,কিন্তু ভালো নেই।নিজের ওপর হতাশা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে, আর ‘সত্যি’ কঠিন হলে নিজের অপরাধের কি শাস্তি নিজেকে দেবে সেটাও ভাবতে থাকে।ফেরার সময় একটু আড়াল দেখে অভিক বলে,”স্যার একটা কথা,আমায় আজ দিনটা সময় দিন।আর প্লিজ আমাকে না বলে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেননা।প্লিজ।একটু ভরসা রাখুন।কটা খটকা স্যার সেগুলো উত্তর না পাওয়া অবধি প্লিজ একটু ধৈর্য্য রাখুন,শুধু আজ দিনটা”।অভিকের কথায় অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালেও কোথাও যেন একটা বিশ্বাস খুঁজে পায় শুভঙ্কর,শুধু ঘাড় নেড়ে বলে ‘ঠিক আছে’।
দশম পর্ব:-
(পর্ণা নিখোঁজ হওয়ার দিন সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ একটা সোসাইটি ফ্ল্যাট বাড়িতে)”তুই আমার পাতানো বোন কে বলবে?প্রতিটা কাজে এস.এস এর ছায়া,যেন মায়ের পেটের বোন।কিকরে এত স্মুথ কাজটা করলি বলতো?তাও এত তাড়াতাড়ি।আমি তো ভাবতেই পারছিনা ওই সাংঘাতিক মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে তোর মাসির ফ্ল্যাটের বিছানায়।তাও এত শান্তিতে,চুপচাপ।”,হ্যাঁ এস.এস,সৌরভ সরকার কথাগুলো বলে।উত্তরে মেয়েটা মৃদু হেসে বলে,”তা তুমি কি আজ রাতে থাকবে নাকি ওই মেয়েটার দেখাশোনার জন্যে”।বলেই বাঁ চোখ টিপে অন্য ইঙ্গিত করে।কিন্তু সৌরভ সরকার চিৎকার করে ওঠে,”নাহ!সৌরভ সরকার টাটকা ফুলের গন্ধ নেয়।বিয়ে হয়ে যাওয়া সেকেন্ড হ্যান্ড মালে তার কোনো উৎসাহ নেই”।তারপর থেমে বলে,”ওই শুভঙ্কর সেন আমায় মেরে কালসিটে ফেলে দিয়েছিল,ওকে তরপাতে দেখলেই আমার শান্তি।…এই পর্ণা শালী নিজের মেহবুব কে একরাতও জেলের খাবার খেতে দেয়নি,আর কোনোদিন তার মুখ দেখতে না পেয়ে যখন কেঁদে কেঁদে চোখের কোলে কালি ফেলে দেবে সেটা দেখার পর ওকে দুবাই পাঠিয়ে দিতে পারলে যে সুখ হবে,তা সম্ভোগের থেকেও বেশি।…বিশ্বাস কর আমি প্রতিহিংসাটা জাস্ট গিলে নিয়েছিলাম।আর না নিলেই বা কি করতাম,বাবা আল্টিমেটাম দিয়েছিল আর এসবে না জড়াতে।যখন ওই মিত্রাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলাম,বাবা জানতে পেরে শাসিয়েছিলো ওসব ছেলেমানুষি ঝেড়ে ফেলার জন্যে,কারণ ওদের হাতে আমার ওই ফোনটা প্রমান হিসেবে ছিল,আর মিত্রার ক্ষতি হলে সবটুকু সন্দেহ আমার ওপর পড়বে বলে ওকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।তারপর বাবা সব ভোলাবার জন্যে ব্যবসায় জড়িয়ে দেয়।…যেদিন খবর পেয়েছিলাম শুভঙ্কর মালটা পর্ণা কে বিয়ে করছে মন করেছিল শালীকে তুলে আনি।কিন্তু বাবার ভয়েতে পারিনি।আর শুভঙ্কর সেনও তো প্রেয়সীকে একা ছাড়তোনা কোথাও।…নিজেকে ভুলিয়ে রাখতাম সব।তারপর তুই যেদিন নিজে যেচে এলি,নিজের জ্বালা জুড়োতে আমার সাহায্য চাইলি আমার ভেতরের প্রতিশোধস্পৃহা টা মাথা চাড়া দিলো।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কিকরে এত বড় কাজটা করলি প্রজ্ঞা?”…প্রজ্ঞা,প্রজ্ঞা ব্যানার্জি,পর্ণার সহপাঠী, এস.এস এর প্রেমে পাগল, একমাস ধরে ধীরে ধীরে ঘুঁটি সাজিয়েছে আর অপেক্ষা করেছে সুযোগের।ভাবেনি এত তাড়াতাড়ি তা এসে যাবে।তবে সুযোগ আসতেই কাজে লাগিয়েছে।সৌরভের প্রশ্নের উত্তরে ক্রুর হাসি হাসে।”জানো সৌরভদা ভগবানও ওদের এক দেখতে চাইছিল না।নাহলে দুম করে শুভঙ্কর সেন তার প্রানের প্রিয় বউকে রেখেই বা কেন বেরিয়ে যাবে?আর পর্ণা সুন্দরী বা কেন ওইদিন পার্স আনতে ভুলে যাবে?!”…ভগবান ই আমায় সুযোগ করে দেয়।”…”৪টে নাগাদ বেরিয়ে যেতে গিয়া খেয়াল করি নোটস এর খাতাটা ওপরে নিজেদের রুমে ফেলে এসেছি।ফোনে চোখ রেখে ওঠার সময় ওপর থেকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নেমে আসা এস.এস এর সাথে প্রায় ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে যাই।ওনার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি প্রথম সন্দেহ তৈরি করে,তারপর দেখি এস.এস গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস ক্যান্সেল করে।এরপর কমন রুমে মুখ শুকনো করে বসে থাকা পর্ণাকে দেখে দুয়ে দুয়ে চার করে নিই।…সৌরভ দা বিয়ার খাবে?”গলা শুকিয়ে যাওয়ায় প্রজ্ঞা সৌরভকে প্রশ্ন করে।”ঠান্ডা পড়ছে কিন্তু,সাবধান এই ওয়েদারটা।তবে একটা বিয়ার চলতে পারে”।বলে সৌরভ খ্যাকখ্যাক করে হেসে নেয় একটু।দুটো বিয়ারের ক্যান হাতে ফিরে এসে একটা ক্যান সৌরভের হাতে দিয়ে আবার শুরু করে,”হ্যাঁ যা বলছিলাম।অষ্টমীর দিনের ঘটনা যতই মনে আগুন জ্বালাক পর্ণাকে দেখে নিজে এগিয়ে যাই,স্বাভাবিক কথা বলার মাঝে ওর আর এস এস এর জুড়ির খুব প্রশংসা করি।তারপর পর্ণা ৫টা নাগাদ শুভঙ্করকে ফোন করে, কিন্তু শুভঙ্কর ফোন ধরেনা।দু তিনবার চেষ্টা করার পর পর্ণার মুখে দুশ্চিন্তা ফুটে ওঠে।ফাঁকা কমন রুমে বসে ও বলে ও আজ পার্স আনতে ভুলে গেছে,আর সুশিও আজ নেই।”ওর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান খেলে যায়।ওকে লিফ্ট অফার করি স্টেশন অবধি আর কিছু টাকাও ধার নিতে বলি।…ও এতো বোকা আমার মনে হয়নি ,কিন্তু রাজি হয়ে যায়।তারপর তো বাকিটা ইজি।ওকে কথার ফাঁদে ‘দরকার’ বলে এক সেকেন্ড এর জন্যে এই ফ্ল্যাটে আনি, চা অফার করি,আর তারপর তো তুমি দেখতেই পাচ্ছো।”সৌরভ ক্ল্যাপ দিয়ে ওঠে,কিন্তু উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কোনো উইটনেস নেই তো গাড়িতে তোলার?”প্রজ্ঞা হেসে বলে,”পাগল পেয়েছ?খুব সাবধানে সব করেছি,এমনকি রাস্তার সিসিটিভি ক্যামেরাও বাঁচিয়ে।কিন্তু দাদা রাতে ওকে দেখার আর সময় মতো ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করার একজন তো লাগবে,মেয়ে হলে বেটার হয়।””আগে বলবি তো!”বলেই সৌরভ মেয়ে জোগাড় করে ফেলে আধ ঘন্টায়।মেয়েটাকে সব বুঝিয়ে বাইরে থেকে লক করে বেরোনোর সময় প্রজ্ঞার হাতে পর্ণার মোবাইল দেখে সৌরভ অবাক হয়।প্রজ্ঞা সৌরভের দৃষ্টি অনুসরণ করে ব্যাপারটা বুঝে সৌরভ কে বলে,”এটা এস.এস এর কাছে গিয়ে ভালো হওয়ার কাঠি।ওই প্ল্যানটা ফুলপ্রুফ হলে পরে বলবো।”বলে একপেশে হাসি হেসে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।সৌরভ মাথা নেড়ে প্রশয়ের হাসি হেসে বলে,”তোর বুদ্ধির ওপর পুরো ভরসা আছে আমার।যাইহোক কাল আসবি তো?আমিও আসবো”।”হুম আসবো, তবে রাতের দিকে।মায়ের এই বন্ধুর ফ্ল্যাটের কথা ড্যাড ও জানেনা।ভাগ্গিস এটার চাবি মা আমায় দিয়ে রেখেছিল উনিভার্সিটির কাছে বলে।”তারপর দুজনে পরের দিনের প্ল্যান করতে করতে গাড়িতে গিয়ে ওঠে নিঃশব্দে,চারিদিক ভালো করে দেখে।সৌরভ কে স্টেশনে নামিয়ে প্রজ্ঞা বাড়ি ফেরার রাস্তায় ফোনের গল্পটা ফেঁদে নেয়।নিজের বুদ্ধিতে নিজেরই গর্ব হয়।সৎ বাবাকে ওদের প্ল্যান জানতে ব্যবহার করা আর ধীরে ধীরে এস.এস কাছে যাওয়া…প্রজ্ঞার প্রধান দুটো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হয়ে ওঠে।অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রজ্ঞা গুনগুন করে ওঠে,”অ্যাম দ্য বেস্ট,অ্যাম দ্য বেস্ট,অ্যাম দ্য বেস্ট”…ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে।