সাত পাকে বাঁধা – অষ্টম ভাগ

by Tamali


ত্রয়োদশ পর্ব:


 অধৈৰ্য্য হয়ে প্রজ্ঞা ফ্ল্যাটের বেল বাজাতে থাকে,বুঝতে পারে কেউ ছুটে এল দরজা খুলতে,আজ ছাই তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবিটাও আনতে ভুলে গেছে।সৌরভ সরকার দরজা খুলে কিছুটা বিরক্ত মুখে বললো,”কি হলো?অমন পাগলের মতো বেল দিচ্ছিস কেন?”পর্ণা ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকে এলো,”সেটা তো তুমি বলবে কি এমন হলো যে এত জরুরি তলব! তিনি আছেন নাকি ‘টাটা বাই বাই’ করে টেঁসে গেছেন”?বলে অসভ্যের মতো হাসতে লাগলো।সৌরভের বিরক্তি বেড়ে গেলো,কঠিন মুখ করে বললো,”পর্ণার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে সেটা ভেবেছিস?আর সত্যি ওর অবস্থা ভালো না।ওকে ইমিডিয়েট হসপিটালাইসড করতে হবে।আর কোনো অপশন নেই।” প্রজ্ঞা কিছুক্ষন সৌরভের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”তুমি পাগল হয়ে গেছ?!!!কোনো ভাবেই ওকে এই ফ্ল্যাটের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবেনা।তাতে যদি ওকে মরতে হয় মরবে।নাহলে ওকে বাঁচাতে গিয়ে আমাদের মরতে হবে।…দাঁড়াও আমার এক ডাক্তারি পড়া বন্ধু আছে তাকে ফোন করছি।”এই বলে প্রজ্ঞা মোবাইলে নম্বর খুঁজতে থাকে।সৌরভ আর ধৈর্য্য ধরতে পারেনা।প্রজ্ঞার ফোনটা কেড়ে নেয়।”আমি পাগল হইনি।প্রতিহিংসায় মনে হচ্ছে তুই পাগল হয়ে গেছিস।নাহলে নিজের ব্যাচ মেটকে এত অনায়াসে মৃত্যুর জন্য ছেড়ে দিচ্ছিস?একটা সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে চোখের সামনে শেষ হয়ে যাবে আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো?ওকে আমি আমার চেনা এক নার্সিং হোমে নিয়ে যাচ্ছি।ওটা আমার এক বন্ধুর বাবার।এখান থেকে আধ ঘন্টা।পর্ণার অলরেডি শ্বাস কষ্ট হচ্ছে,আর ফেলে রাখা যাবেনা।ও হয়তো খাবার নেয়নি ২৪ঘন্টার অনেক বেশি হবে,আর ঘুমিয়েই আছে তাই টানা ২৪ঘন্টার ওপর।আমি আর রত্না মিলে নিয়ে যাচ্ছি।তুই যাবি?”সৌরভের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রজ্ঞা চিৎকার করে ওঠে,”পাগলের প্রলাপ বন্ধ কর,আমি শুধু না তোমরাও কেউ যাচ্চনা।কারণ তোমাদের পাগলামী শুধু তোমাদের না আমাকেও ফাঁসাবে।আর আমার ফোন দাও,আর ভবিষ্যতে এরকম চিপ কাজকর্ম আমার সাথে করবেনা।আমি তোমার ওইসব মিডিল ক্লাস বান্ধবী নই।…পর্ণা মরে যাবে,হাইওয়ের ধারে কোথাও ফেলে আসবে।অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই।”প্রজ্ঞার অমানুষের মতো কথাটা সৌরভের কানে সুঁচ ফোটাল।ও কোনো কথা না বলে ভিতরের ঘরের দিকে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,”রত্না,পর্ণাকে একটু ঠিকঠাক করে রেডি করো।আমি ক্যাব ডাকছি।”প্রজ্ঞার মাথায় আগুন জ্বলে গেল,”আরে মাথামোটা সৌরভ সরকার কোনো সহজ কথা কি তোমার মাথায় ঢোকেনা?পর্ণার সাথে আমাদের দুজনের মান সম্মান বেঁচে থাকা জড়িয়ে গেছে।কোথাও যাবেনা ও”,চিল চিৎকার করে ওঠে।সৌরভ আর নিজেকে সামলাতে পারেনা।এমনি ওর মাথা গরম,রত্নার সামনে প্রজ্ঞার অপমানে ও রাগে অন্ধ হয়ে টেনে এক চড় মারে ওকে।

“এখন বুঝতে পারছি কি বিষাক্ত মানুষ তুই?সরি সরি,মানুষের রক্ত গায়ে থাকলে নিজের বয়সী একটা মেয়েকে যত যাই হোক মেরে ফেলতে পারতিস না।নিয়ে তো আমি যাবোই পর্ণাকে।এত বড় অন্যায় করলে সারা জীবন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবোনা,নিজের চোখে চোখ রাখতে পারবোনা আয়নায়।”সৌরভের কথার মাঝেই প্রজ্ঞা আবার চেঁচিয়ে ওঠে,”সে তুমি এমনিও দাঁড়াতে পারবেনা সৌরভ সরকার।পুলিশের লাঠির ঘায়ে হাত পা যখন ভাঙবে।আর বোকার হদ্দ ফাঁসবে শুধু তুমি,প্রজ্ঞা ব্যানার্জী কে কেউ ছুঁতেও পারবেনা।আমি সেই জায়গা রাখিওনি।এমনকি যে পর্ণার জন্যে করে মরবে,সেও পুরো জ্ঞান আসলে তোমার কথাই বলবে,জেনে রাখো।হাহাহাহা।মরার শখ হয়েছে যখন যাও গিয়ে মরো”।বলে সপাটে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যায়।ঠিক সেই মুহূর্তে রত্না ভেতর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে,” স্যার তাড়াতাড়ি”।সৌরভ প্রজ্ঞার কথা গুলো দুবার ভাবার সময়ও পায়না।তাড়াতাড়ি একটা ক্যাব আর একটা অ্যাম্বুলেন্স বুক করে।অ্যাম্বুলেন্স জরুরি ভিত্তিতে বুক করায় আগে আসে।রত্নাকে সব বুঝিয়ে রত্নার কে পর্ণার সাথে ওতে তুলে দেয়।আর নিজে ক্যাবে করে অ্যাম্বুলেন্সটাকে ফলোও করে।ওরা ঠিকই করেছিল আর ওরা নিজেদের গাড়ি করে এখানে আসবেনা।
“হ্যাঁ স্যার, পাখি যে বেরিয়ে গেল।”অভিক ফোনটা ধরার সাথে সাথেই অখিল,অভিকের দাদার দেওয়া লোক,বলে ওঠে।অখিল প্রজ্ঞাকে ফলো করে ফ্ল্যাটে পৌঁছে অভিকদের জন্য অপেক্ষা করছিল,ইতিমধ্যে প্রজ্ঞা বেরিয়ে এসে ক্যাবে উঠে বেরিয়ে যায়।অভিক ওর দাদাকে বলেছিল অল্প কয়েকজন বিশ্বস্ত লোক নিয়ে রেডি থাকতে।অখিলের গ্রীন সিগনাল পেলে ওরা বেরোবে।কিন্তু ওরা যখন মাঝরাস্তায় অখিল আবার ফোন করে এটা বলে।অভিক না ভেবেই বলে,”কোন ফ্ল্যাটে ঢুকেছিলো আপনি জানেন তো?তাহলে নিচেই অপেক্ষা করুন।”অখিলের কথার মাঝেই একটা অ্যাম্বুলেন্স আসে,একটা মেয়েকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে এসে গাড়িতে তোলে,সাথে অন্য একটা মেয়ে।অন্য কোনো ফ্ল্যাটের অসুস্থ কেউ বলে অখিল ফিরেও তাকায়না।তার পিছু পিছু একটা প্রাইভেট ক্যাব এসে দাঁড়ায়,সামান্য অন্ধকার থেকে একটা ২৪-২৫বছর বয়সী হ্যান্ডসম ছেলে বেরিয়ে এসে ক্যাবে ওঠে আর অ্যাম্বুলেন্স এর রাস্তায় ক্যাবটাও চলে যায়।কিছুক্ষন পর একটা টাটা সুমো এসে থামে,কলকাতা পুলিশ এর।তার থেকে নেমে আসে অভিক,ওর দাদা সুতনু আর সাদা পোশাকের পুলিশ।অখিল কে অনুসরণ করে ওরা পৌঁছে যায় সেই ফ্ল্যাটে যেখানে পর্ণাকে রাখা হয়েছিল।অভিক এগিয়ে গিয়ে বেল বাজায়।কিছুক্ষন অপেক্ষা করে কেউ দরজা না খোলায় বারবার বেল দিতে থাকে।কিন্তু ভেতরে কেউ আছে বলে মনে হয়না।”অখিল আপনি শিওর যে এই ফ্ল্যাট টাই?”অভিকের প্রশ্নে অখিল জোরের সাথে ঘাড় নেড়ে বলে,”আমি নিজে এসে দেখে গেছি”।এবার সুতনুর কি মনে হওয়ায় হঠাৎ প্রশ্ন করে,”আচ্ছা অখিল প্রজ্ঞা যাওয়ার পর আর কোনো গাড়ি গেছে কি?”

“কই, না..তো,সেরকম কিছু…ও হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার একটা অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল,একটা অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে…ও মাই গড…স্যার তার মানে…ছি ছি ছি,আমার মাথাতেই এলোনা।পিছনে একটা প্রাইভেট ক্যাব ও গেল।ইস ইস!!!”অখিলের আক্ষেপ অভিকের কান অবধি পৌছালো না,ও পাশের সিঁড়িতে হতাশ হয়ে বসে পড়ে নিজের চুল খামচে ধরলো।”একটুর জন্যে….একটুর জন্যে পর্ণাকে ফেরত পাওয়া হলো না।কিন্তু এই ফ্ল্যাট টার খোঁজ নিতেই হবে।…”সুতনুদা,এই ফ্ল্যাট এর মালিকের খোঁজ নাও।সেখান থেকে কিছু জানা যেতে পারে।আর হ্যাঁ এটা তো সোসাইটি ফ্ল্যাট না,সোসাইটি ফ্ল্যাটের অনেক সুবিধা, জানা যায় অনেক ডিটেলস।তাও খোঁজ নিয়ে দেখো যদি কিছু জানা যায়।”অভিকের কথা শেষ হতে অখিল বলে ,”স্যার দরজা ভেঙে দেখলে হয়না?”সুতনু ধমকে ওঠে,”একদম না।আমাদের কাছে কোনো সার্চ বা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নেই,তাই এরকম কাজ আইনবিরুদ্ধ।…নীচে একজন গার্ড আছে দেখেছি।ওর কাছে নিশ্চই কিছু খবর পাওয়া যাবে।আপনি দেখুন সেটাই।”সুতনুর কথা শেষ হতেই অখিল নিচে চলে গেল।এবার অভিকের দিকে তাকিয়ে সুতনু বললো,”কাম অন অভিক।ওরা বেশিদিন পালিয়ে বাঁচতে পারবেনা।কাছাকাছির মধ্যে যখন আছে ধরা ঠিক ও পড়বে।শুধু সময়ের অপেক্ষা”।এবার অভিক মুখ খোলে,”আচ্ছা সুতনুদা পর্ণা সত্যি অসুস্থ?তা যদি হয় তাহলে কাছাকাছি হসপিটাল বা নার্সিংহোমে যাওয়ার চান্স আছে।” এবার সুতনু বুঝতে পারে অভিকের ভেঙে পড়ার কারণ,”দেখ এটা পুরোনো ট্রিক, অজ্ঞান করে স্ট্রেচারে করে পুরোনো আড্ড্রেস থেকে সড়িয়ে দেওয়া,তার মনে এই নয় নে যে ভিক্টিম অসুস্থ।আগে খোঁজ নিয়ে দেখি এখানে।”অভিকের পিঠে চাপড় মেরে বলে,”চল নীচে চল।এখানে বসে কোনো লাভ নেই।”ঠিক সেই মুহূর্তে অভিকের ফোন বেজে ওঠে।স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে এস.এস স্যার।”হ্যাঁ স্যার বলুন।কোথায় ছিলেন ফোন করেছিলাম একটা দরকারে।”

“বিপদ কি আর একা আসে?সঙ্গে দোসর তো আনবেই।”শুভঙ্করের গলায় হতাশা ঝরে পড়ে। “কেন স্যার কি হলো আবার?”উদ্বিগ্ন স্বরে অভিক জিজ্ঞেস করে।”পর্ণার চিন্তায় চিন্তায় ওর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।প্রেসার ফল করে খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল।আসলে পর্ণা ও ওদের একমাত্র মেয়ে,আর ও ওর মায়ের খুবই ক্লোজ।মেয়ের চিন্তায় মাও একদিন পুরো কিছু প্রায় খাননি।তার ওপর দুশ্চিন্তা, কান্নাকাটি সব মিলিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।তুমি বল কেন ফোন করেছিলে?কোনো খবর পেলে?”অভিক কিছুক্ষন চুপ থেকে মুখ খুললো,”শুধু একটা কথাই হয়তো বলতে পারি স্যার,পর্ণা এখনো বেঁচে আছে।সুস্থ আছে কিনা জানিনা।”অভিককে থামিয়ে দেয় এস.এস,”তুমি সত্যি বলছো অভিক?কিকরে জানলে তুমি?”

“জেনেছি স্যার,সেটা এখন বলা যাবেনা।ভেবেছিলাম পর্ণাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে চমকে দেব,কিন্তু একটুর জন্যে ফসকে গেল।”অভিক সামান্য হেঁয়ালী করে,কিন্তু শুভঙ্করের অবুঝ মন তা শোনে না,”প্লিজ অভিক যা জেনেছো বলো আমায়।আমার না আছে কোনো চেনাশোনা,না আছে আত্মীয় স্বজন আর না এই মুহূর্তে মনের জোর।জানো অভিক যখন বিয়ে হয়নি কলেজ থেকে চাঁদিপুর বেড়াতে গিয়ে সৌরভ বলে ওই ছেলেটা পর্ণার সাথে মিসবিহেভ করার চেষ্টা করে।সেদিন মনে হয়েছিল ওকে খুন করে ফেলতে পারি।কিন্তু আজ স্বামী হয়ে দুর্বলতা যেন গ্রাস করছে প্রতি মুহূর্তে।হারিয়ে ফেলার ভয় গিলে খাচ্ছে।আসলে আমি তো আমার লক্ষ্মীর অবমাননা করেছি,তাই অপরাধ বোধে কুরে কুরে ভেতরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।কি করলে কোথায় গেলে শান্তি পাবো জানিনা।”একটানা কথা গুলো বলে শুভ হাঁফাতে থাকে।”স্যার এত ভাববেন না,একটু রেস্ট নিন।আমি কাল সকালে যাবো।তখন সব বলি?”শুভঙ্কর সাময়িক আবেগ প্রবন হয়ে পড়েছিল,কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে বলে,”হ্যাঁ ঠিক আছে।এখন রাখছি তাহলে।একটু বেরোব।কাছেই একটা নার্সিং হোমে পর্ণার মা কে ভর্তি করা হয়েছে।হয়তো রাতে ওখানেই থাকবো।পর্ণার অনুপস্থিতিতে ওর মা বাবা তো আমার পুরো দায়িত্ব।…ওকে অভিক কাল দেখা হচ্ছে।” এস.এস ফোন ছেড়ে দেন।কথা বলতে বলতে অভিক রা নিচে নেমে এসেছিল।এইসময় অখিলও ফিরে আসে।ও এসে যা বলে অভিকের মন একটু ভয় পেয়েই যায়।

চতুর্দশ পর্ব:-


“রুগী আপনার কে হন?”নার্সিং হোমের রিসেপশনে বসে থাকা মেয়েটির প্রশ্নের উত্তরে রত্না বলে,”বোন”।”উনি তো বিবাহিত মনে হচ্ছে।কি হয়েছে ওনার?”এবার সামান্য ঢোঁক গিলে রত্না বলে,” ডক্টর চ্যাটার্জি সব জানেন,কথা বলা আছে ওঁর সাথে।আমার দাদা কথা বলে নিয়েছেন,আমরা ওনার পরিচিত”। এবার মেয়েটি মুখ তুলে তাকায়।”ঠিক আছে এই ফর্মটা ফিল আপ করে দিন।আমি ডক্টর চ্যাটার্জিকে ফোন করছি।”বলে মেয়েটি ফোনের রিসিভার হাতে নেয়।কিন্তু রত্না এবার ভয় পায়,স্যার তো এ সম্পর্কে কিছু বলে দেয়নি।এদের কথা বার্তায় দুদিনে শুধু জেনেছে মেয়েটার নাম পর্ণা,কিন্তু আসল নাম তো লিখলে হবেনা।তাছাড়া ও বুঝেছে এটা অপহরণ কেস, এখানে ও যদি এই ধরণের ফর্ম ফিল আপ করে তাহলে ফেঁসে যেতে পারে।কিন্তু পর্ণা বলে মেয়েটারও অবস্থা ভালো নয়।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রত্নার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে,”ও দিদি আমি যে টিপসই ছাড়া কিছুই তেমন জানি না গো।আমার বোনের অবস্থা একদম ভালো না।আগে তুমি ডাক্তার বাবুকে ডাকো।”এবার মেয়েটা সন্দেহের চোখে রত্নাকে দেখে।”আমি ডাক্তার বাবুকে ফোন করেছি,কিন্তু এই ফর্মটা না ভরলে ভেতরে যেতে পারবেনা।সত্যি করে বল তো কেসটা কি?তোমায় দেখে কথা শুনে মোটেই অশিক্ষিত মনে হচ্ছেনা।” এতক্ষন সৌরভ দূর থেকে খেয়াল রাখছিল,এবার এগিয়ে আসে।শীত পড়তে শুরু করেছে, আর রাতের দিকে ঠান্ডা ভালোই থাকে এই অজুহাতে মাফলারে মুখ ঢেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে,”একি রত্না তুই এখানে দাঁড়িয়ে,যা যা, তোর বোনকে নিয়ে ভেতরে যা।আমি ডাক্তার বাবুকে বলে রেখেছি।”তারপর রিসেপশনিস্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে,”ছেড়ে দিন ওকে।ওর বোনের কিছু হলে আপনার চাকরি যেতে পারে।”মেয়েটি ভয়ে পায় এবার।একজন ওয়ার্ডবয় কে তাড়াতাড়ি হসপিটালের স্ট্রেচার আনতে বলে সৌরভ সরকারকে ফর্মটা ধরিয়ে বলে,”সময় মতো এটা ফিল আপ করে এখানে দিয়ে যাবেন।আপনার কথায় বিশ্বাস করে ছাড়ছি কিন্তু।এক্ষেত্রেও আমার চাকরি যেতে পারে।”সৌরভ কোনো উত্তর না দিয়ে হাত বাড়িয়ে ফর্ম টা নেয়।ক্যাবে ফিরতে ফিরতে প্রজ্ঞার মাথা আরো গরম হতে থাকে।ও মনে মনে সৌরভের কথা গুলো যত আলোচনা করতে থাকে তত ওর মাথা গরম হয়।সৌরভ সরকারের মতো ভোঁতা বুদ্ধির কাছে এর থেকে কিই বা বেশি আশা করা যায়?!জীবনে বন্ধুত্বটা তো করলো না,কিন্তু শত্রুতা করার ক্ষেত্রেও ডাহা ফেল।এবার যদি ডক্টর বুঝে যায় পর্ণা কে কিসের অসুধ খাওয়ানো হচ্ছিলো সেটাই একটু চাপ।ইস ৫দিন টানা খাওয়াতে হতো।মাত্র দুদিন হয়েছে।প্রজ্ঞা মনে মনে ভাবল যদি ধরা পড়ার চান্স আছে বোঝে ও নিজেই সৌরভ সরকারকে পুলিশের হাতে তুলে দেবে।হাহাহা বোকা সৌরভ সরকার জানেই না প্রজ্ঞা কবে থেকে সব প্ল্যান করছে।ফ্ল্যাট টা প্রজ্ঞার কোনো মাসি পিসির না,ওটা ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাট।তাও সৌরভের নামে।প্রজ্ঞা ব্যানার্জি কোনো কাঁচা কাজ করেনা।পর্ণার ও জ্ঞান ফিরলে প্রজ্ঞাকে বন্ধুই ভাববে।সেদিন বিশাল গল্প দিয়ে ওকে এই ফ্ল্যাটে আনে।পর্ণা জানে সৌরভ সরকারের কুকীর্তির একজন ভিক্টিম প্রজ্ঞা।ওকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিচ্ছে সৌরভ।সেদিনের সব কথা প্রজ্ঞার ভালো মনে আছে।”জানিস পর্ণা আমি খুব বিশ্রী ভাবে ফেঁসে গেছি, সৌরভ সরকার নামে একটা ছেলের খপ্পরে।”প্রজ্ঞার মুখে নামটা শুনেই পর্ণা কেঁপে ওঠে,প্রজ্ঞার মুখের দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকায়।প্রজ্ঞা আবার বলে,”প্রচন্ড ভালোবেসেছিলাম ওই বাস্টার্ড টাকে।কোনোদিনও কিছু তে বাধা দিইনি।নিজেকে উজাড় করে দিই ওর কাছে,আর ওই বদমাশ সৌরভ অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও তুলে এখন ব্ল্যাকমেইল করছে।ছেলেটার বাইরের রূপ দেখলে বুঝতেই পারবিনা ভিতরটা অতটা নোংরা।”প্রজ্ঞা থামলে পর্ণা জিজ্ঞেস করে ,”কিকরে আলাপ হলো তোর সাথে?”প্রজ্ঞা কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,”আমাদের গ্র্যাজুয়েশনের বছর আমার কলেজ ফেস্টে ও আসে।ও বাংলা নিয়ে পড়েছে একটা কোন কলেজে।ওখানেই প্রথম কমন ফ্রেন্ড মারফত আলাপ হয়।এখন ওই বন্ধুই বলছে সৌরভ ওরকম ই ছেলে।”আবার থেমে বলে,”আজ একটা ফ্ল্যাটে ডেকেছে সব প্রমাণ ফেরত দেবে,তার বদলে ওর মুখমাঙ্গি টাকা চাই।আমি তোকে স্টেশন ছেড়ে দিয়ে যাবো,কত টাকা চায় দেখি!” এবার পর্ণা মুখ খোলে,”তুই একা যাবি?আর ও যে সব ফেরত দেবে তার গ্যারান্টি কোথায়?” প্রজ্ঞা এবার গাড়িটা রাস্তার একদিকে দাঁড় করিয়ে নকল কান্নায় ভেঙে পড়ে।”আমি কিচ্ছু জানিনা।কিন্তু এভাবে তো বাঁচা যায়না, আজ তাই দেখা করবো।”প্রজ্ঞা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে।পর্ণা বিশ্বাস করে এই প্রজ্ঞাকে,যাকে হয়তো তার মাও বিশ্বাস করেনা।ও প্রজ্ঞার হাতে হাত রেখে বলে ,”রিলাক্স,আমি বুঝতে পারছি তোর অবস্থা।এস.এস না থাকলে আমারও হয়তো এই অবস্থা হতো,কারণ সৌরভ সরকার আমাদের কলেজেই পড়তো।আর আমাকেও টার্গেট বানানোর চেষ্টা করেছিল।”অবাক হওয়ার মুখ করে প্রজ্ঞা পর্ণার দিকে তাকায় আর ধীরে ধীরে নিজের বিষাক্ত গল্প দিয়ে ওকে বস করে নেয়।পর্ণা নিজে থেকে ওর সাথে সৌরভের ফ্ল্যাটে যেতে চায়।প্রজ্ঞার শয়তানি বুদ্ধির আর একটা উদাহরণ হলো ফ্ল্যাটে আগে থেকে একজন কে রেখে দেওয়া,প্রজ্ঞার বিশ্বস্ত একজনের কাছে চাবি থাকে ফ্ল্যাট মাঝে মাঝে ঝাড় পোঁছের জন্যে,তাকেই ফাঁক মতো কল করে আগেই ফ্ল্যাটে চলে যেতে বলে।খুব সহজেই ওই ছেলেটাকে সৌরভের পরিচারক দেখায়,ওকে দিয়ে চা করায়।তারপর সেই চায়ে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে পর্ণাকে ঘুম পাড়িয়ে ছেলেটাকে ভাগিয়ে সৌরভ কে ফোনে ডাকে।প্রজ্ঞার পুরো নাটকটা পর্ণা ভালোভাবে আকসেপ্ট করে,কোথাও ফাঁক রাখেনি যে প্রজ্ঞা।হঠাৎ ক্যাব ড্রাইভারের কথায় প্রজ্ঞা বাস্তবে ফেরে।বাড়ি এসে গেছে।নিজের মনেই অট্টহাসি হাসে,কোনো ফাঁক প্রমান কিছু ও রাখেনি।ওকে ধরা কারোর কম্ম না।ফাঁসবে,ফাঁসবে সৌরভ সরকার তুমি আষ্টেপৃষ্টে ফাঁসবে।মেরুদন্ডহীন প্রাণী একটা।ওটাই তোমার উপযুক্ত শাস্তি হবে।
পরেরদিন অনেক সকালে অভিক পৌঁছে যায় এস.এস এর বাড়ী।আগের দিনের অপেরাশনের সব ডিটেইলস বলে।শুধু প্রজ্ঞার ইনভলভমেন্ট বাদ দিয়ে,প্রমান ছাড়া এটা বললে কেউ বিশ্বাস করবেনা।অখিলের কাছে শোনা ফ্ল্যাটের বর্তমান ভাড়াটে সৌরভ সরকারের নামটাও এড়িয়েই যায়,অহেতুক টেনশন এড়াতে।অভিক আর এস.এস ঠিক করে আজ একবার লালবাজারে যাবে।তারপর ওই ফ্ল্যাটের আশেপাশে সব হসপিটাল নার্সিংহোমে।হঠাৎ শুভঙ্করের ফোনে ওর এক ডাক্তার বন্ধুর ফোন আসে।মনের ঝড় শুভকে এতটাই ভেঙে দিয়েছে যে কোনো বন্ধুর ফোন ও ধড়ছেনা।”স্যার ফোন টা?”অভিকের কোথায় এস.এস মুখের অভিব্যক্তিতে বুঝিয়ে দেয় ফোনে কথা বলার অনীহা।ফোনটা বেজে বেজে কেটে যায়।কিন্তু অদ্ভুত বন্ধু, আবার ফোন করে,এবার অনিচ্ছাকৃত ভাবে শুভ ফোন ধরে “হ্যালো” বলতে ওপাশের উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনতে পায়, “হ্যাঁ শুভ তোর ওয়াইফ কোথায় রে?”হঠাৎ এরকম প্রশ্নের জন্যে শুভঙ্কর রেডি ছিলোনা।শুধু বলে,”কেন বলতো?”

“আরে প্লিজ সত্যি বল,দরকার আছে।” ডাক্তার বন্ধুর সিরিয়াস গলা শুনে কি ভেবে শুভ সত্যিটা বলে দেয়।সব শুনে সে নিশ্চিন্ত হয়ে বলে,”আমার কথাটা মন দিয়ে শোন শুভ।আমি কলকাতায় একটা নার্সিং হোমের সাথে জড়িত।আজ সকালে ভিসিটে এসে দেখি নার্সিং হোমের মালিক আর তাঁর ছেলের মধ্যে বচসা হচ্ছে ওদের প্রাইভেট রুমে,যেখানে আমার যাওয়ার অধিকার আছে।ডক্টর চ্যাটার্জি আমায় একটু বিশেষ স্নেহ করেন।ওদের মধ্যে বচসার কারণ একটি পেশেন্ট।একটা অচৈতন্য অর্ধমৃত মেয়েকে ডক্টর চ্যাটার্জির ছেলের পরিচিত কেউ ভর্তি করে চলে গেছে ,সকাল থেকে ফোন তুলছেনা সে।আমি কৌতূহল বসত মেয়েটাকে দেখতে গিয়ে চমকে উঠি।রিসেপশনের রাতে একবার দেখলেও মুখটা দেখে তোর বউয়ের কথাই মনে আসে।তুই শিগগিরি একবার আয় ভাই।বৌদির অবস্থা খুব খারাপ।শুভ এই শুভ,শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা।শুভ…” ,শুভঙ্করের চোখ ছাপিয়ে জীবনে দ্বিতীয়বার জল নেমে আসে,ফাঁকা হয়ে যায় বুকটা।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলে,”পর্ণা কেমন আছে সত্যি বল।”এস.এস এর ব্যবহারে আর কথায় অভিক চমকে তাকায়।ওপাশ থেকে উত্তর আসে,”ভালো না রে।তুই তাড়াতাড়ি আয়।আমি তোকে আড্ড্রেসটা মেসেজ করে দিচ্ছি”।শুভর মুখ থেকে আপনা হতেই বের হয়,”আসছি।ততক্ষণ পর্ণাকে শুধু ধরে রাখিস।” ফোনটা রেখে অভিক কে শুধু বলে ,”অভিক মায়ের থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে গাড়িটা বের করবে প্লিজ,আমি জাস্ট ড্রেস পরে আসছি”,এস.এস কথা শেষ হওয়ার আগেই অভিক লাফ মেরে উঠেই চাবি আনতে ছোটে,এস.এস এর একদিকের কথা শুনেই যা বোঝার ও বুঝে গেছে,হাতে সময় কম।পৌঁছতে হবে,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে পর্ণার কাছে।

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!