-“তোমার বাবা মা কেউ নেই?”
-“না।”
-“তাহলে তুমি প্রতি রবিবার ছুটি নিয়ে কোথায় যাও?”
-“মানে? এটা কি একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার না?”
-“হতে পারে ব্যক্তিগত।কিন্তু তুমি শুধু আমার এখানে চাকরি করছো তাই নয়,তুমি এখানে থাকো।তাই এগুলো আমার জেনে রাখা দরকার। কখনো কোনো সমস্যা হলে তখন আমি ফেঁসে যাবো।”
-“কীসের সমস্যা? আর তুমি ফাঁসবে কেন?”
-“হয়তো কোন একদিন তুমি বের হলে আর ফিরলে না।কোথায় গেছ কিছুই জানবো না।”
-“না সেরকম কিছু হবে না।”
-“তুমি বলবে না কোথাও যাও?”
-“সৃজিত এটা একান্তই ব্যক্তিগত প্রশ্ন। আমরা বন্ধুর মত অনেক কিছু শেয়ার করি মানে এই না যে সমস্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিজের ইচ্ছে না থাকলেও বলবো। তোমায়ও তো আমি কখনো ব্যক্তিগত কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমি এখানে কাজ করি মানে কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা বিসর্জন দিইনি।”
এই অমৃতা কে সৃজিত সেভাবে চেনে না। হাসিখুশি বন্ধুবৎসল অমৃতা ওর কাছে পরিচিত। এই জেদি মেয়েটা হঠাৎ করে ওরও জেদ বাড়িয়ে দেয়।
“আমায় তাহলে বৌদির সাথে কথা বলতে হবে। এধরণের কাজে আগে কিছু ইনফরমেশন নিয়ে তবে কাজে রাখা হয়। যেখানে পুলিশ ভেরিফিকেশন, আই কার্ড,কন্ট্যাক্ট ডিটেইলস সব নেওয়া হয়,যদি পার্সোনালী কাউকে হায়ার করা হয়। কিন্তু শুধু বৌদির বোন বলে তোমার ক্ষেত্রে কিছুই করিনি আমি। কিন্তু তার মানে এই না তুমি তার ফায়দা তুলবে। তাতে যদি আমায় আমার নার্স বদলাতে হয় আমি তাতেও রাজি।”
সৃজিতের শেষ কথায় চমকে ওঠে অমৃতা। কিন্তু পার্থও তো এটাই চাইছে,কিন্তু এই মুহূর্তে এই চাকরি ছাড়া ওর পক্ষে সত্যি সম্ভব না। কাকিমার সাথে রীতিমত ঝগড়া করে ও কাকার বাড়ি ছেড়ে এসেছে। একটা ইয়ং ছেলের বাড়িতে থেকে তার শুশ্রূষা কাকিমা মানতে চায়নি। বিশেষ করে সেটা যখন বড়লোক মাসতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ি।
শেষে প্রায় সম্পর্ক কেটে বেরিয়ে এসেছিল অমৃতা। ও ভেবেছিল এখানে থাকতে থাকতে সরকারি চাকরির পরীক্ষা যদি ক্লিয়ার করতে পারে,তাহলে তো কোনো চিন্তা নেই।আর সেটা না হলে এই ক’মাসে থাকা খাওয়ার খরচ ওর লাগবে না। ন্যূনতম হাতখরচ করে যে টাকা ও জমাবে তাতে কিছুদিন পিজি তে থেকে একটা টেম্পোরারী চাকরি ও জোগাড় করে ফেলবে যতদিন না সরকারি চাকরির পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। তাই মাত্র দুমাস চাকরি করে এই মুহূর্তে এই কাজটা ছাড়া ওর পক্ষে সম্ভব না।
“আমি মাসির বাড়ি মানে তোমার বৌদির মায়ের কাছে যাই। কখনো নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথেও দেখা করি। আর কোথাও যাওয়ার জায়গা আমার নেই”,নিজের চাকরি বাঁচাতে ক্ষীণ স্বরে কথাগুলো বলে ও।
সৃজিত চুপ করে যায়। হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হতে থাকে ওর। মনেহয় অমৃতা ওকে ঠকিয়েছে। কিন্তু কিভাবে ঠকালো সেটা নিজেও বুঝতে পারেনা। বিছানায় একটা ঘুঁষি মেরে বলে,”তোমার কাকার বাড়ি যাও না কেন?”
চুপ করে থাকে অমৃতা। মুখ খোলে না। ও বুঝতে পারেনা সৃজিতের রেগে যাওয়ার কারণ। ও তো মিথ্যে কিছু বলেনি। দিদিভাই বলেছিল ও সপ্তাহে একদিন কয়েক ঘন্টা ছুটি নিতে পারে,ও তাই নেয়। কোথায় যায় সেটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখন ওর মনে হচ্ছে পার্থর কথা শুনে এই কাজটা ছেড়ে দিতে পারলেই ভালো হত। কিন্তু এত সুবিধে ও কোনো কাজেই পাবেনা। কাজ কোনো না কোনো জায়গায় পেয়ে যাবে,কিন্তু এই টাকা বা টাকা জমানোর সুযোগ বা সরকারি চাকরির পরীক্ষার পড়াশোনা কোনো সুবিধেই ও সে সব কাজে পাবেনা। এখানে সৃজিত পুরোপুরি সুস্থ হতে এখনো কয়েকমাস লাগবে,অপারেশন হলেও সেরে ওঠা পুরোটাই ভাগ্যের ব্যাপার। ও চায় সৃজিত সুস্থ হয়ে যাক,কিন্তু ও চাইলেও সেটা কয়েকমাসের আগে সম্ভব না।
“ঠিক আছে যাও এখন। আর তোমায় এসব জিজ্ঞেস করেছি,দাদাভাইকে কিছু বলোনা”,কথা শেষ করে মাথা এলিয়ে দেয় সৃজিত বালিশে।
অমৃতা পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে।
একটু আগে পার্থর ফোনকল,তারপর সৃজিতের এরকম জিজ্ঞাসাবাদ,বড্ড কান্না পায় ওর। বাবা মা কীরকম স্বার্থপরের মত চলে গেল। দোষটা তো আসলে ওরও কম ছিলোনা। নার্সিং হোমের চাকরিটা নাহয় মা বাবার মুখ চেয়েই ছেড়ে দিত, ওরা তো সেটাই চেয়েছিল। আর অমৃতা বেশি উদারতা দেখিয়ে,নিজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের জীবনের মূল্যবান সম্পদ দুটোই হারিয়ে ফেললো। ও চায়নি ওই সময় বাড়ি ফিরতে,বাবা এমন জোর করলো,আর নিজে তো সুস্থ অবস্থায় ফিরেছিল। কী করে জানবে মারণঘাতী রোগের জীবাণু আসলে লুকিয়ে আছে ওর শরীরে।
চোখের জলটা আজ কিছুতেই আটকাতে পারলো না ও। আজ বাবা বেঁচে থাকলে থোড়াই ও এই কাজের পরোয়া করতো? দিদির সাথেই ভালো সম্পর্ক নেই,তার আবার শ্বশুরবাড়ি। মনে মনে ভাবল সৃজিত এরকম ব্যবহার করলে ও শেষ অবধি কাজটা ছেড়েই দেবে।
রজত এবারে ফেরার সময় বুঝতে পারলো সুজুর মেজাজ আবার অস্বাভাবিক হয়ে আছে,আগের মত। শেষ দুমাসের সেই বদলে যাওয়া ভাইটা কে খুঁজে পেলোনা বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়। মনটা একটু খারাপ হলো। কিন্তু ও জানে এই মুড সুইং এটাই ওর ভাইয়ের বৈশিষ্ট্য। অনেকবার ভেবেছে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওদের দুভাইয়ের সম্পর্কে ওই জোরটারই অভাব।
ও ভাবে হসপিটালের ডক্টর এমনিও বলেছিল হঠাৎ করে শরীরের এরকম অবস্থা বেশিরভাগ রোগী মানতে পারেনা। মানসিক ট্রমায় চলে যায় অনেকে,ডিপ্রেশনের কারণে ছুটতে হয় সাইকোলজিস্ট দের কাছে। কিন্তু ওর ভাইয়ের মনের জোর সাংঘাতিক। তাছাড়া আগের বার গিয়েই ও লক্ষ করেছিল সুজু অমৃতাকে খুব ভালো ভাবে মেনে নিয়েছে। ওর ওপর নির্ভরশীলতা দেখে অবাক হয়েছিল রজত,ফিরে প্রিয়াকে বলেওছিলো। শুনে ও বলেছিল,”ভালো হলেই ভালো।তোমার ভাইয়ের ভালো করতে গেলেও টেনশন হয়”।
রজত এবারে জেনেছে অমৃতার একজন বয়ফ্রেন্ড আছে।ওর আন্দাজ সুজুও সেটা জেনেছে,আর সেটাও ওর মুড অফ হওয়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু কেন? নির্ভরশীলতা থেকে কি দুর্বলতার জন্ম হয়েছে? সেটা হলে একদিকে অবাক হওয়ার বিষয় হবে,অন্যদিকে চিন্তার।
সুজু ছোট থেকে বলতো ওর বউ খুব সুন্দরী হবে। সেক্ষেত্রে অমৃতা মোটেই সেরকম কিছু না। আর দ্বিতীয়ত যেহেতু ওরা এক ছাদের তলায় থাকে,আর কোনো অভিভাবক স্থানীয় কেউ নেই তাই বিষয়টা চিন্তার। কারণ রজত নিজে না দেখলেও প্রিয়া মারফত অনেক কিছু শুনছে সুজু সম্পর্কে। আর ওর যা জেদ, যেটা চাই সেটা আদায় করেই ছাড়ে।
চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে ও এবারে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা ভালোলাগা কাজ করছে। ওর আর প্রিয়ার বিয়েটাও তো বাড়ির একপ্রকার অমতেই হয়েছে। কিন্তু ও নিজে যথেষ্ট ভালো আছে। তাই মনে শান্তি কেই আশ্রয় দেয় ও,ওর ট্যাক্সি ঢুকে পড়ে এয়ারপোর্ট চত্বরে।
“আমায় ডাকছ?” সন্ধের পর নিজের ঘরে পড়াশোনা করছিল অমৃতা। হঠাৎ সৃজিতের বেলের আওয়াজ কানে যেতে উঠে এসেছে ও।
“হ্যাঁ বোস।কথা আছে”,গম্ভীর স্বরেই বলে ও।
অমৃতা চেয়ার টেনে বসে।
কিছুক্ষন চুপ থাকে সৃজিত,তারপর বলে,”এই বাড়িতে থাকতে গেলে তোমায় আমার একটা শর্ত মানতে হবে। নাহলে একটু অসুবিধা আছে”।
অবাক হয় অমৃতা। আবার কী নতুন পোকা নড়লো সৃজিতের মাথায়? আর ও শর্ত মানবেই বা কেন? ও টাকা নিচ্ছে বদলে সার্ভিস দিচ্ছে।
“আমার সাথে একটা কন্ট্রাক্ট করতে হবে তোমায়। কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ। রাতের দিকে একা থাকতে আমার আজকাল সমস্যা হয়,ঘুম আসেনা। কিন্তু আমার সাথে এক রুমে রাতের পর রাত থাকলে সেটা তোমার জন্যেই বদনাম তৈরি করবে।আর আমাকে নিয়েও লোকে নানা কথা বলবে।এর একটাই সমাধান ওই কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ।…”
অমৃতা কী উত্তর দেবে এই পাগলের প্রলাপে ও বুঝতে পারেনা। কেন করবে ও এধরণের কন্ট্রাক্ট? সিম্পলি ও কাজটা ছেড়ে দেবে। হ্যাঁ এই দুমাসের গ্যাপটা ওর কেরিয়ারে দাগ ফেলবে। তবে জব ও ঠিক পেয়ে যাবে। যে কোনো ছোট খাটো নার্সিং হোমে ও ঠিক কাজ খুঁজে নেবে। সৃজিতের শেষের কথা ওর কানে ঢোকেনা। ও তার বদলে বলে ওঠে,”সরি।সরি…সরি। আপনারা নতুন নার্স দেখুন,আমি ছেড়ে দিচ্ছি এই কাজটা”,ওর খেয়াল থাকেনা সৃজিত কে ও এখন বন্ধুর মত তুমি বলে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ও,সৃজিতের কথার মাঝেই। ঘর ছেড়ে বেরোতে উদ্যোগী হতেই সৃজিত বলে,”আমার কথা শেষ হয়নি,বোস”।
“কিন্তু এবিষয়ে আমার কোনো কথা নেই। আমি একজন নার্স। রোগীর দরকারে তার ঘরে রাত কাটাতেই পারি। তাতে কোনো বদনাম রটার প্রশ্ন আসেনা। আর তোমার নামে কেউ কিছু বললে তোমারই বা তাতে কী এলো গেল।তাই এসব ভিত্তিহীন কথার কোনো দরকার আমার কাছে নেই।আমি আসছি”, অমৃতা কতটা জেদী সেটা সৃজিতের জানা ছিলোনা,যেটা জানে শুধু প্রিয়া। সৃজিতের মুখের ওপর দিয়ে বেরিয়ে চলে যায় অমৃতা।কিন্তু বাস্তবটা ও নিজেও ভেবে দেখেনা। একটা হসপিটালে বা নার্সিং হোমে নাইট শিফট অথবা মুমূর্ষু বা বয়স্ক মানুষের ঘরে রাত জাগা আর দিদির দেওয়ের ঘরে দরকারেও রাতের পর রাত থাকা এক না। সৃজিত আর যাইহোক,ওর বাস্তব জ্ঞান বেশি ছিল বাইরের জগৎটা বেশি ঘুরতো বলে। অমৃতার বয়ফ্রেন্ড যে বেশিদিন এটা মানবে না সেটা আন্দাজ করেই অমৃতাকে ধরে রাখতে কিছুটা স্বার্থপর হয়েই এই অফার দিয়েছিল ও। ভাবেনি অমৃতা এক কথায় তা উড়িয়ে দিয়ে চাকরি ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে।অসহায়ের মত ও তাকিয়ে থাকলো অমৃতার চলে যাওয়ার দিকে।
ক্রমশ…