আরও একবার- চতুর্থ পর্ব

by Tamali

“মানিনী”,নিজের নাম শুনে পিছন ঘুরে তাকায় মানি।”কত বড় হয়ে গেছিস তুই?ভাগ্গিস কাল তোর ফেসবুক প্রোফাইলটা দেখছিলাম,আর তোর হোয়াটস অ্যাপ এও কাল সন্ধের পর এই পোশাকের ছবি আপলোড করেছিস বলে সহজে চিনতে পারলাম”।
সামনের গোলগাল ফর্সা চশমা পরা ভদ্রলোকের সাথে দশ বছর আগের পিসির দেওয়রের খুব অল্পই মিল পায় মানিনী।
“দীপক কাকু।কত পাল্টে গেছো তুমি! শুধু তোমার সেই হাসিটা এক আছে”,পায়ে হাত ছোঁয়ায় মানিনী।
“আরে এসব বাড়ি গিয়ে হবে।আর তাছাড়া আজকাল হাত মেলানোর দিন,পায়ে কেউ হাত দেয় নাকি।চ চ,তোর কাকিমার আলুর পরোটা ঠান্ডা হয়ে যাবে নাহলে”,হাসতে হাসতে মানির ট্রলির দিকে হাত বাড়ায় দীপক।
“আরে ছাড়ো কাকু।আমি নিচ্ছি।তুমি বলো কেমন আছো তোমরা সবাই?” দীপক কাকুর সাথে কথা বলতে বলতে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আসে মানিনী।
দীপক গাড়িটা একটু দূরের পার্ক করেছে বলে মানিকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে গাড়িটা আনতে চলে যায়।
একা হতেই আবার ফিরে আসতে চাইলো মানিনীর বুকের শূন্যতা।কয়েক মুহূর্ত হয়তো অপেক্ষা,সেটাই মনে করাতে লাগলো কতশত অপেক্ষার মুহূর্ত।উৎসবের জন্যে কলেজ মাঠের অপেক্ষা,বা নন্দনে অপেক্ষা করতে করতে প্রিয় সিনেমার শুরুটা মিস করা।অথবা উৎসব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ওর বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে সেই অপেক্ষা!আর এই তো সেদিন ডায়মন্ড হারবার ঘুরতে যাবে বলে শেয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করতে করতে কয়েক ঘন্টা যে কাটিয়ে দিলো!!
নিজের অতীতে মশগুল মানিনী হঠাৎ দেখলো ওর থেকে কয়েক হাত দূর দিয়ে একটা প্রাইভেট গাড়ি যাওয়ার সময়,ওকে উদ্দেশ করে একটা প্রায় অপরিচিত হাত নড়তে নড়তে পেরিয়ে গেল। বাস্তবে ফিরে এসে মানি বুঝতে পারে হাতটা সেই বকবক করা ছেলেটার,হেসে ও হাতটা নাড়িয়ে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পড়লো একটুকরো কাগজটার কথা।দীপক কাকুকে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে কোথায় যেন রাখলো।হাত ব্যাগ হাতড়াতে যাবে তখনই কাকু গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়ালো।
মুখে হাসি টেনে,’পরে খুঁজে দেখবো কাগজটা’ ভাবতে ভাবতে গাড়িতে উঠে পড়লো মানিনী।
মেডিকেল টেস্ট দিয়ে বেরিয়ে একপ্রকার হাঁফ ছাড়ল মানিনী।বাপরে এটা টেস্ট?পরশু রাতে ট্রেনে পিরিয়ড হয়েছিল বলে মনে মনে হা পিত্যেস করছিল,আজ ভগবানকে ধন্যবাদ দিলো।ভাগ্গিস পিরিয়ড হয়েছে ওর,নাহলে যারা ঠিক ছিল তারা যেসব কথা বললো!! যাইহোক পরীক্ষা একটা মিটলো।এবার পরের কাজ।
এখানে আসার আগে ইনকাম ট্যাক্স অফিস থেকে একটা কাগজ লিখিয়ে আনতে হয়েছিল,আবার সব টেস্টের রিপোর্ট দেখে এখানকার হসপিটাল সুপার একটা ফাইনাল রিপোর্ট লিখে দিয়েছেন,সেটা ওই অফিসে জমা দিতে হবে।মানে এবার যেতে হবে দিল্লির আই.টি.ও (ITO) তে।
হসপিটালের গেট থেকেই একটা অটো নেয় মানি,মিনিট দশ লাগবে রাস্তা ফাঁকা থাকলে।সকালে কাকু গাড়ি করে অফিসে নিয়ে গিয়ে কাগজ সই করিয়ে হসপিটালে টেস্টের জন্যে ড্রপ করে দিয়ে গেছিল,অফিস যাওয়ার আগে।এখন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ই ভরসা।কাকু যদিও বলেছে ফেরার সময় ক্যাব নিয়ে নিতে,দিনের বেলা ক্যাবে ওর একা ভয় লাগবে না।কিন্তু মানিনীর ইচ্ছে আছে মেট্রো রেলে চড়ার।সেদিন অয়ন বলে ছেলেটা ওকে মেট্রো ম্যাপ খুলে রুট অনেকটা বুঝিয়ে দিয়েছে।যদিও দিল্লি মেট্রো রুট খুবই জটিল।কিন্তু অয়ন ওকে ম্যাপটা দেখিয়ে বুঝিয়েছিল বলে ও অনেকটা বুঝেছে,তাছাড়া ওর মাথা খুব একটা ভোঁতা না।
অয়ন বলছিল দিল্লিতে মেট্রো সবচেয়ে সেফ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, বিশেষ করে মেয়েদের জন্যে।
ইনকাম ট্যাক্স অফিসের কাজ মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে মানি বুঝতে পারে ছুঁচোয় পেটে ডন মারছে।একটু মাথা ঘুরিয়ে নজর আসে এক সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ।আরেকটু খুঁজলে অন্য নর্থ ইন্ডিয়ান বা চাইনিজ রেস্তোরাঁ হয়তো পেয়ে যেত ও,কিন্তু মনটা হঠাৎ দোসার জন্যেই কেমন করে ওঠে,পায়ে পায়ে রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢোকে ও।
একা একা রেস্তোরাঁয় বসে খেতে ওর বড্ড বোকা বোকা লাগে অন্যসময়,কিন্তু আজ বেশ একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে।হয়তো কয়েকমাস পরে এখানেই ওকে প্রায় আসতে হবে,কে জানে কি আছে ভাগ্যে!
খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে থাকার সময় আবার মন খারাপ ঘিরে ধরে ওকে।উৎসবের এই সব ইডলি,দোসা একদম পছন্দ না।ও খালি চাইনিজের ভক্ত,আর যেহেতু ওর পছন্দ তাই দুজনে একসাথে বেরোলে মানিনীকেও খালি চাইনিজ খেতে হয়।ও নিজেও চাইনিজ ভালোবাসে তবে মাঝে মাঝে স্বাদ বদল করতেও ইচ্ছা করে।
উৎসবের কথায় মনে পড়লো,ও সত্যি করে দুদিন ফোন করেনি মানিকে।মানিও এত দূর থেকে ঘাঁটায়নি ওকে,ফিরে মুখোমুখি যা বলার বলবে।
চিন্তার মধ্যে গরম গরম দোসার প্লেট এসে হাজির হয় ওর টেবিলে,এই সময়ে রেস্টুরেন্টে ভালোই ভিড়।চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে খাওয়ায় মনোনিবেশ করে ও।
অয়ন ছেলেটা বেশ ভালো ‘বন্ধু ম্যাটেরিয়াল’।সেদিন ওটুকু সময় বন্ধুর মতোই তো কত টুকটাক বিষয় বলে ওকে হেল্প করেছিল।
অয়ন বেশ কোন স্টেশনে যেন মেট্রো বদলাতে বললো?উমম…আচ্ছা খেয়ে ম্যাপটা দেখে নেবে গুগলে, ঠিক মনে পড়ে যাবে।
খাওয়া শেষে যখন রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে মেট্রোস্টেশনে যাচ্ছে,রাস্তাটা অনেকটা বুঝে গেছে ও।
আইটিও মেট্রো স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে গিয়ে মানি বলে,”ময়ূর ভিহার এক্সটেনশন”,দীপক কাকু ওখানেই ছোট একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে।
টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে ‘রাজা নাহার সিং’ মেট্রো স্টেশনের দিকে যাওয়ার মেট্রোর দিকের স্টেশনের এসক্লালেটরে পা রাখে ও।মনে পড়ে অয়নের কথা,”তুমি মাণ্ডি হাউস স্টেশনে নেমে নয়ডা সিটি সেন্টারের দিকের মেট্রো ধরবে,একদম ময়ূর ভিহার এক্সটেনশন স্টেশনে গিয়ে নামবে।এবার কি করবে তোমার কাকু জানেন ,মানে তোমার কাকুর বাড়ি ঠিক কোথায় তা তো জানিনা,তাই বললাম” সেই মিষ্টি হাসিটা হেসে বলেছিল ও।
এই দুদিনে,বিশেষ করে আজকের কর্মকান্ড সেই ভীতু মানিনী কে যেন একটু কনফিডেন্ট করে দিয়েছে।সেই আত্মবিশ্বাস চমকাচ্ছে ওর চোখে মুখে।উৎসবের ওই কথাগুলো বড্ড ধাক্কা দিয়েছিল ওকে।বাইরে হাসি থাকলেও মাত্র দুদিন আগে ও ভেঙে গেছিল ভেতর থেকে।আজকের দিনটা ওকে শুধু উঠে দাঁড় করায়নি ওকে যেন নতুন করে নিজেকে তৈরি করার উৎসাহ দিচ্ছে।
ওর আত্মবিশ্বাস ওকে সাহস দিচ্ছে উৎসবকে একবার বুঝিয়ে বলতে,একটা শেষ চেষ্টা করতে।
ওকে এই আত্মবিশ্বাসটা অয়নের স্টেশনের কথাগুলোই দিয়েছিল,পরে বারবার ওগুলো মনে পড়েছে আর নতুন করে উৎসাহ পেয়েছে ও।
অয়ন হারিয়ে গেছে,হারিয়ে গেছে ওই কাগজের টুকরোর সাথে,যেটা মানিনী আর খুঁজে পায়নি।কিন্তু ওর কথা গুলো রয়ে গেছে।
সেই কথাগুলো আজ ওকে সাহস জুগিয়েছে অচেনা শহরে একা মেট্রো ট্রাভেল করার।
আজকাল উৎসবের থেকেও বেশি অয়ন মনে আনাগোনা করে,কিন্তু ওই মন অবধি ওর গেটপাস,বাস্তবে এখনো উৎসবই আছে মানিনীর মন জুড়ে।তাই তো ওর বিশ্বাস ঠিক মানিয়ে নেবে ও ওর ‘রাম গরুরের ছানা’ কে।
মেট্রো স্টেশনে বসে নিজের মনে হাসে ও,আর ঠিক সেই মুহূর্তে দূরে দেখতে পায় ওর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মেট্রোটা আসছে।

ক্রমশ..

You may also like

1 comment

Anonymous July 9, 2024 - 5:36 PM

Daroon lagche

Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!