আরও একবার – দশম পর্ব

by Tamali

প্রচন্ড অস্থির লাগে আজকাল উৎসবের।আরও প্রায় তিনমাস চলে গেল জীবন থেকে,মানিনীকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর,কিন্তু জীবন তো এগোলো না একটুও।অথচ কদিন আগে মানিনীর ফেসবুক প্রোফাইলে উঁকি মেরে দেখে এসেছে ওর জীবন এগিয়ে গেছে অনেকটাই।এখনো ফেসবুকে ওরা কানেক্টেড, তাই মানির সব কিছুই উৎসব চাইলে দেখতেই পারে।কিন্তু আনফ্রেন্ড না করলেও ওকে আনফলোও করে রেখেছে উৎসব।ও তো চেয়েছিল মানি বেরিয়ে যাক ওর জীবন থেকে।কিন্তু কদিন আগে যখন ওর প্রোফাইলে গিয়ে ওর হাসিমুখের সেলফি দেখলো…আচ্ছা মানিনী কে একটু অন্যরকম লাগছিলো কেন? ওর গায়ের রং তো অতটাও ফরসা না,আর চুলটাও কি একটু অন্য স্টাইলে কেটেছে? মুখটা বেশ মিষ্টি লাগছিলো।
আজকাল লেখার টেবিলে বসলে লেখা আর আসেনা।উল্টে মানিনী যেন ঘুরে বেড়ায় মন জুড়ে।যত পুরোনো কথা,পুরোনো স্মৃতি বারবার ফিরে ফিরে এসে উৎসব কে মনে করাতে থাকে ভুল করেছ তুমি,অন্যায় করেছ একটা মেয়ের সাথে।

“সবু খাবি আয় বাবা।রাত অনেক হলো”,নীচের তলা থেকে মায়ের ডাকে ঘোর কাটে উৎসবের।
এই এক মহিলা,সবে রাত ন’টা এখুনি খেতে ডাকছে।খিদে পেলো কী পেলো না উনি দায়িত্ব সেরে ফেলতে পারলেই হলো।কিছু বলতে গেলেই বলবে ,”বয়স হয়েছে আমার।আর পারিনা।এখন না খেলে নিজে বেড়ে খাবি।এত যখন ঝামেলা বিয়ে করে বউ আন,আমি বাঁচি”।
‘বউ আন’,যেন সহজ কাজ।সেই বউ আবার বাড়িতে থাকবে,সংসার করবে।কে করবে আমার মত বেকারকে বিয়ে? বাবার পেনশন দেখে কে আজকাল বিয়ে দেয়।আর আজকাল কি কেউ শুধু বাপ-মার জন্যে বিয়ে করে?নিজের মানসিকতার সাথে মিলতেও তো হবে।মানিনী তো ওর মানসিকতার ই ছিল,শুধুমাত্র মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি তে বিরক্ত হয়ে ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিলো উৎসব রাগের মাথায়।
“আমার এখন খিদে পায়নি।তুমি খেয়ে টেবিলে খাবার চাপা দিয়ে রেখে দাও।খিদে পেলে খেয়ে নেব”,চেঁচিয়ে উত্তর দেয় উৎসব।
“সে আবার কী কথা!এখনো ঠান্ডা যায়নি,খাবার ঢাকা দিয়ে রাখলে সে তো দশ মিনিটে ঠান্ডা হয়ে যাবে।তার চেয়ে তুই খেয়ে গিয়ে তোর কাজ কর না।আমিও খাবার পাট মিটিয়ে শুয়ে পড়ি।ঠান্ডাটা যাই যাই করেও যাচ্ছেনা,হাঁটুটাও ভোগাচ্ছে…খেয়ে যা না বাবা”,নিজের মনে বকবক করতে করতেই হাঁক পারে উৎসবের মা আবার।
উৎসবের গরম মাথা এই সব কথায় ঠান্ডা হওয়ার বদলে আরো গরম হয়ে যায়।নিজের ঘরের স্টাডি টেবিল ছেড়ে ছুটে যায় ও সিঁড়ির মুখে,”যাবো না আমি।খাবো না এখন।তুমি তোমার রান্না খাও,খেয়ে নাক ডাকাও গিয়ে।সারাদিন কি এমন রাজকাজ করো! শুধু তো ওই খুন্তি টুকু নাড়া কাজ।কী ভাবো, আমার কাজটা কোনো কাজ না।তোমার সময় মতো খাবো,শোবো।তারপর তোমার টাইম মত নিজের কাজ করবো?ফালতু কাজ করি তো আমি।কী ভাবো কী তুমি?” উৎসবের উত্তেজনা ওর কাণ্ডজ্ঞান লোভ পাইয়ে দেয়।
ওর মা থতমত খেয়ে চুপ করে যায় প্রথমে।তারপর প্রবল প্রতাপে গর্জন করে ওঠে,”কীই আমি শুধু খুন্তি নাড়ি! সংসারের বাকি কাজগুলো কে করে অ্যাঁ! আমার দশটা দাসী বাঁদী আছে তো? আছে শুধু একটা বাসন মাজার লোক।বাড়ি সংসারের জুতোসেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব করি।সকালে পাঁচ মিনিট এক্সট্রা শুতে গেলে দশ মিনিট ভাবতে হয়।গেলনের চিন্তা করতে হয়না তো,দুবেলা মুখের সামনে খাবার পাচ্ছ আর চিন্তা কী! বিয়ে করো তারপর বুঝবে।”
“বিয়ে করবো কী করে?তোমার মত মা থাকতে,যে এখন দিবাস্বপ্ন দেখে আমার বউ এসে রান্না করে তোমায় খাওয়াবে।আরে আমি ক্রিয়েটিভ মানুষ,স্ট্রাগল করছি।চাকরি করা মেয়ে ছাড়া আমার সংসার চলবে?কিন্তু তুমি…”,শেষ করতে পারেন উৎসব।
“ওরকম ক্রিয়াটিভিটির কাঁথায় আগুন।লজ্জা করেনা গলা বাজিয়ে বলতে যে বউয়ের পয়সায় খাবি।বাপের অন্ন ধ্বংস করে লজ্জা হচ্ছেনা,এবার উনি বউয়ের পয়সায় অন্ন ধ্বংস করবেন।আরে তোর লজ্জা না করুক,আমাদের করবে।একটা চাকরি জোগাড় করে তারপর শখ পালন করতে পারলি না? বসে বসে কী ছাই ভস্ম লিখিস ভগবান জানে,কোনোদিন কোথায় বেরোতে দেখলাম না।উনি শখের লেখক হবেন আর মা-বাপ সারাজীবন খেটে মরবে”,আর দাঁড়ায় না উৎসবের মা।ওর অন্তর জ্বালিয়ে দিয়ে নিজের একতলার ঘরে ঢুকে সপাটে দরজা বন্ধ করেন।
সংসারে চল্লিশ বছর হলো,আর পারে না এই একঘেয়ে জীবন বয়ে চলতে।ছেলেটাও আজকাল কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে।যা খুশি বলে।অন্যদিন চুপচাপ সরে যায় ছেলের কথা ভেবে…ছেলে বড় হচ্ছে,কেরিয়ার তৈরি করতে পারছে না বলে টেনশনে আছে,এই সব চিন্তা করে।কিন্তু আজ শরীরটা এমনিও ভালো ছিলোনা,তারওপর একটু আগে উৎসবের বাবার কাছে ছেলেকে নিয়ে কথা শুনেছেন,সব মিলিয়ে নিজেকে সামলাতে পারেনি।বলে দিয়েছে মুখে যা এসেছে।
উৎসব কখনো ওর লেখালিখি নিয়ে মা’কে এরকম কথা বলতে শোনেনি,বরং মা সবসময় ওকে উৎসাহ দিয়েই এসেছে ওর সাহিত্য চর্চা নিয়ে।আজ এতোটাও কড়া কথা মা বলবে ও ভাবেনি।ও নিজেও বড্ড খারাপ টোনে মায়ের সাথে কদিন কথা বলছে।তার অনেকটা কারণ মানিনী।ওকে বাদ দিয়ে মানি ভালো আছে,তাছাড়া সেই দিল্লির চাকরি জয়েন করেছে এটা ও কিছুতেই মানতে পারছে না।সেদিন উৎসবের এক বন্ধু বলছিল মানিনীর মাইনে নেহাত কম না।ওর বাবার দুমাসের পেনশনও অত না।এটা জানার পর থেকে ওই অস্থিরতা শুরু হয়েছে।
চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে লেখার টেবিলে চুপ করে বসে পড়ে ও।না,এভাবে উত্তেজিত হয়ে রাগারাগি করলে হবে না।

যেটা ও নিজে নষ্ট করেছে,সেটা ওকেই ঠিক করতে হবে।কি ভেবে ফোনটা হাতে নিয়ে মানিনীর নম্বরটা টিপেই দেয়।
‘যাহ ফোনটা অফ বলছে তো’।
নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে উৎসব,’এই ন’টায় ফোন বন্ধ মানে শুয়ে পড়েছে।মানে এখনো কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি তাহলে।নাহলে ফোন বিজি বলতো।ঠিক আছে কাল দিনের বেলায় চেষ্টা করবো।মানিনীর সাথে সম্পর্ক শেষ করাটাই বোকামি হয়েছিল,ওটা ঠিক হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।মানিনী আমার জন্যে লাকি।এখন তো আবার অন্য কারণেও মানিনী আমার ভাগ্য তৈরি করবে।ঠিক আছে,সব ঠিক করে নেব আমি।বোকা ছিলাম,কিন্তু আর না।আর বোকামি করবো না কিছুতেই।

নিজের চিন্তায় ব্যস্ত উৎসবের মনে হলোনা,হয়তো মানিনীও এতদিনে মানসিক স্বাবলম্বী হয়ে গেছে ওকে ছাড়া।হয়তো ও নিজেও এগিয়ে গেছে অনেক দূরে,হয়তো বদলে ফেলেছে ফোন নম্বরটা।সময় আসলে অনেক কিছু বদলে দেয়,হাতের বাইরে পাঠিয়ে দেয় অনেক কিছু,আর সেটাই মানতে পারেনা উৎসবের মত মানুষরা।আকাশ কুসুম কল্পনা সাজিয়ে ভাবে সময় বুঝি এক থাকে।দূর্বলতা কে হাতিয়ার করে বুঝি বারবার জিতে নেওয়া যায় মানিনীর মত মেয়েকে,যেমন খুশি খেলা করা যায় তাদের মন নিয়ে।নিজের সংকীর্ণ চিন্তাকে ফানুস বানিয়ে কল্পনার জাল ছড়াতে ছড়াতে আরো অনেক কিছু প্ল্যান ভাঁজতে লাগে উৎসব।

ক্রমশ..

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!