আরও একবার – ষোড়শ পর্ব

by Tamali

“ম্যাডাম আপ কে লিয়ে ভিজিটর হ্যায়”,পিয়ন শিবম এসে যখন মানিনীকে কথাটা বললো নিজের কাজে ডুবেছিল ও।এই একটা জায়গা যেখানে ও ভুলে যায় ওর সবটা,ওর অতীত ভবিষ্যৎ,ওর মানসিক উদ্বেগ সবকিছু।
ব্যস্ততার মধ্যেই মুখ তুলে একবার শিবমকে দেখে অন্যমনস্ক ভাবে বলে মানি,”কন হ্যা?নাম কেয়া বাতায়ে?” দীপককাকু কি? হতেও পারে।সপ্তাহ তিন যাওয়া হয়নি দেখা করতে।প্রথম দিকে প্রায় অফিস যাওয়ার পথে একবার চলে আসতো স্বচক্ষে ওকে দেখতে।
“ইয়ে লিজিয়ে”,একটা কাগজ এগিয়ে দেয় শিবম,ভিজিটর্স স্লিপ।
কাজে মন রেখেই হাত বাড়ায় মানিনী।ডেস্কটপ থেকে একবার নজর সরিয়ে কাগজে চোখ দিতেই চোখে পড়ে মুক্তাক্ষর,সেই অসাধারণ হাতের লেখায় ইংরাজি হরফে লেখা ‘অয়ন সেন’।
একটা বিদ্যুৎ যেন ছুঁয়ে যায় মানিনীর শরীরকে,নিজেই অবাক হয় কেন এমন হলো!অয়নের নামে ও অবাক হতে পারতো,বিরক্ত হতে পারতো,বড়জোর মুখে হাসি এনে স্বাভাবিক থাকতেও পারতো। হঠাৎ অন্য একটি অনুভূতি কেন হলো!! তাহলে কি অয়নের এই হঠাৎ না বলে ছুটে আসা ওকে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিলো? নাকি সায়নি ঠিক।
শুক্রবার রাতে অয়ন ফোন কাটার পর থেকে মানিনী অভিমানে আর ফোন ধরেনি ওর,কিন্তু অভিমানটা এত জোরালো কেন হলো সেটা ও নিজেও ভেবে পায়নি।অয়ন মেসেজ ও পাঠিয়েছে,কিন্তু মানি পড়েও দেখেনি।
আচ্ছা ও কি অবচেতনে কোথাও ভেবেছিল অয়নকে রিপ্লাই না করলে ও ওর পিজি বা অফিসে ছুটে আসবে? বিশেষকরে কাল রবিবার ছিল বলে আশাটা একটু হয়েছিল ঠিকই।তারপর নিজের মনকে বোঝানোর পর আজ সপ্তাহের প্রথম দিনে ওর ছুটে আসা…চিন্তাগুলো সরিয়ে ও শিবমকে বলে,”আপ এক গ্লাস পানি ডিজিয়ে উনকো, মে আ রাহি হুঁ”।
শিবম চলে যাওয়ার পর নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে যায় মানি।চুলটা ঠিকঠাক করে বেরিয়ে ওদের অফিসের রিসেপশনের দিকে এগোয়,অয়ন ওখানেই বসে আছে।
“বলো কী খাবে?” মানিনীর অফিসের কাছের সেই রেস্তোরাঁয় বসে প্রশ্ন করে অয়ন,চোখে মুখে ওর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।দিল্লির এই গরমে এতটা এসে স্বাভাবিক ভাবেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে,সাথে ছিল প্রায় দুদিনের উৎকণ্ঠা।শুক্রবার রাতে ফোন কাটার পর দুদিন মানিনী ওর ফোন ধরেনি।
“তার আগে তুমি বলো আজ তোমার অফিস নেই? এই সময়ে নিজের অফিসে না গিয়ে আমার অফিসে তোমার হঠাৎ আসার কী কারণ?” মানিনী যতটা সম্ভব মুখ নির্লিপ্ত রেখে প্রশ্ন করে।

অয়ন ওর স্বভাব অনুযায়ী কিছুক্ষন চুপ থেকে মানিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর দিকেই স্বপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চোখ নামিয়ে নেয় অয়ন।এতক্ষন পাগলের মত একটা কথাই ভেবেছে ওকে একবার দেখা করতেই হবে মানিনীর সাথে,কিন্তু দেখা হলে কী বলবে সেটা তখন ভাবেনি।
“তুমি ফোন ধরছিলে না কেন? আমি তোমার ফোন কেটেছিলাম কারণ সৌরভের সাথে কথা বলছিলাম,কিন্তু তারপর…”,অয়নকে থামিয়ে দেয় মানি।
“দুদিন আমি একটু ডিস্টার্বড ছিলাম।কারোর ফোন ধরিনি সেভাবে,কথা বলতেই ইচ্ছা করছিল না”,মানি নিজেও জানেনা কেন ফোন ধরেনি ও এই দুদিন।শুধু কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না এটা সত্যি।কিন্তু ওর মনে কোথায় অয়ন আর উৎসব এক হয়ে গিয়েছিল,তাই হয়তো সম্পর্কে থাকতে উৎসবের সাথে যা করতে পারেনি অয়নের সাথে তাই করে মনের শান্তি খুঁজেছে ও সেই পরশু রাত থেকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অয়ন,”তাহলে এই কেন কী এসব প্রশ্ন দুপক্ষেই বন্ধ থাক।আমি তোমায় ফোনে না পেয়ে ছুটে এসেছি,এই সত্যিটুকু জেনে রাখো।এরপর আর কোনো প্রশ্ন কোরোনা এই নিয়ে”।
“অয়ন তুমি কেন আমার জন্যে তোমার ইম্পরট্যান্ট সময় নষ্ট করো জানিনা।কিন্তু নিজের সিএল নষ্ট করে আজ এভাবে ছুটে আসার কোনো দরকার ছিল না”,মানি মরিয়া হয় কিছু জানতে।
“দরকার সবার ক্ষেত্রে এক হয়না।সেরকমই ইম্পট্যান্সও মানুষ ভেদে বদলায়।যেটা তোমার কাছে ইম্পরট্যান্ট না,আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট।তবে যদি তোমার সময় আমার জন্যে নষ্ট হয়,আই’ম এক্সট্রিমলি সরি”,অয়নের মনেও অভিমান যে একদম জমেনি সেটা প্রকাশ পায় ওর কথাতে।ও নিজেও জানেনা কোন অমোঘ টানে ও এভাবে মানির জন্যে নিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নষ্ট করে।
মানিনী জবাব না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায় অয়নের দিকে,যে দৃষ্টিতে মিশে থাকে বিরক্তি।
কথা না বাড়িয়ে অয়ন রেস্তোরাঁর ওয়েটারকে ডাকে খাবারের অর্ডার দিতে,সকালে শুধু চা খেয়ে বেরিয়ে এসেছিল,পেটে ছুঁচোয় নাচ শুরু করে দিয়েছে।
“তুমি এরপর কী করবে?” খেতে খেতে প্রশ্ন করে মানি।
“কী আর করবো তুমি অফিস ফিরে গেলে,আমি ফ্ল্যাটে চলে যাবো।এমনিও সৌরভ হয়তো আজই রেজিগনেশন জমা দিয়ে আসবে,এসে সারারাত বকবে,তাই ও ফেরার আগে ভালো করে ঘুমিয়ে নেব”,মন দিয়ে দোসা খেতে খেতে বলে অয়ন।
অবাক মানিনী খাওয়া বন্ধ করে শুধু তাকায় অয়নের দিকে,কী নির্বিকার ভাবে কথা গুলো বলছে দেখো!
“মানিনী তুমি সেদিন রাতে কী কারণে ডিস্টার্বড ছিলে যে একবার ফোনে আমায় না পেয়েই মাথা অত গরম হয়ে গিয়েছিল! তুমি তো এত সহজে মেজাজ হারাও না!” অয়নের এই দুদিনের সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসাটা ও করেই ফেলে।
মুখে খাবার তুলতে গিয়ে কিছুক্ষন থমকায় মানিনী,তারপর ধীরে সুস্থে খাবার চালান করে ভালো করে চিবিয়ে গিলে বলে,”আমার অতীত,সেটা বলতেই ফোন করেছিলাম তোমায়”।
এবার খাবার শুদ্ধু হাতটা মুখের সামনে আটকে যায় অয়নের।কী বলবে থমকে ভাবে,তারপর প্রত্যুত্তর করবে না ঠিক করে উদাস ভাবে খাবার মুখে ভরে।এখন ওর শোনার পালা,আর ও খুব ভালো শ্রোতা ও নিজেও ভালো করে তা জানে।তাই মনির বলার অপেক্ষা করে।
“ব্যস্ত মানুষ তুমি,সময় হবে আমার কথা শোনার?” প্লেটের দিকে মুখ রেখেই খেতে খেতে বলে মানিনী।
“হ্যাঁ এতই ব্যস্ত,অফিস বাদ দিয়ে তোমার খবর নিতে ছুটে এসেছি।এখানে না পেলে পিজি তে ছুটতাম।তুমি বলবে না আমি ব্যস্ত!” অয়নও একই সুরে জবাব দেয়।
মানি একটু অবাক হয়,আজ ওদের কথাবার্তা প্রথম থেকেই যেন অন্য সুরে হচ্ছে।এ সুর শুধু বন্ধুত্বের সুর না,আরো অন্য কিছু মিশে আছে এতে।যেন অনেকটা অধিকারবোধ থেকে ওরা একে অপরের সাথে কথা বলছে।শুধু অয়ন তো অফিস বাংক করেনি।ও নিজেও তো অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে নিলো শুধু ওর জন্যে।ভাবতে ভাবতেই শুনতে পায় অয়ন বলছে,”আমি কালকেই পিজি যেতাম।কিন্তু সৌরভ কাল খুব ডিপ্রেসড ছিল।ও বোকার মত চাকরি না পেয়েই এই চাকরিটা ছেড়ে দেবে বলছে।আমি অনেক বুঝিয়েও মনে হয় না আটকাতে পারবো।তাছাড়া ও জব ছাড়লে আর অন্য কোনো চাকরি না পেলে দুমাস পর আমাকেও রুম বদলাতে হবে…এইসব চিন্তায় কাল মাথা ব্লক ছিল তারওপর তোমার ফোন না ধরা…বুঝতে পারছো কী মানসিক চাপ গেছে আমার ওপর?”
“খেয়ে উঠে তোমার ফ্ল্যাটে যেতে পারি? এই গরমে নাহলে কোথায় ঘুরবো?অনেক কথা আছে”,মানিনী মুখ না তুলেই বলে।আগেরদিন অয়নের ফ্ল্যাটে যাওয়া হয়নি শেষ অবধি মানিনীর।প্লাম্বার সকালেই কাজ সেরে গিয়েছিল,আর তাকে সময় দিতে গিয়ে রান্নার জোগাড় হয়নি বলে ওরা মিট করেছিল বাইরে।
উফফ হার্টবিটের আওয়াজ বাইরে না শোনা যায়,এত জোরে দৌড়তে শুরু করলো কথাটা শুনেই।তাও নিজেকে বাইরে স্বাভাবিক রেখে অয়ন বলে,”যাহ আগে বলবে তো,তাহলে সেদিনের প্ল্যান মত আজ চিকেন কিনে নিয়ে যেতাম এই দোসা ইডলি না খেয়ে।”
“সে তো এখনও নিয়ে যাওয়া যায়।আমি জানিনা কেন তোমায় বলতে চাইছি,হয়তো এই মুহূর্তে তুমি আমার একমাত্র ভালো বন্ধু বলে।কিন্তু সত্যি নিজেকে হালকা করার খুব দরকার আমার।আর সেদিন এই কারণেই তোমার মুখটা সবার আগে মনে পড়েছিল।আর তুমি ফোনটা কেটে দিতে কেন কে জানে এমন রাগ হলো,আগে কখনো এমন হয়নি।সেই ছোটবেলায় মা’কে হারিয়ে অনেক কম বয়সেই নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা ভগবান তৈরি করে দিয়েছিল,কিন্তু আজকাল…”,থেমে যায় ও।সত্যি আজকাল বড্ড অধৈর্য্য হয়ে গেছে,কমে গেছে সহ্য ক্ষমতাও।
অয়ন মানির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করে,কিন্তু উত্তরটা ঠিক মত খুঁজে পায়না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও আস্তে করে,কে জানে আদৌ কোনদিনও উত্তরটা খুঁজে পাবে কী না?

ক্রমশ..

You may also like

Leave a Comment

error: Content is protected !!